ইমন কল্যাণ

ওয়াহিদার হোসেন
উপন্যাস
Bengali
ইমন কল্যাণ

 

পরিচ্ছেদ ৩

শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই। আজ রবিবার।তাই আজকে তেমন তাড়া ছিলনা মোনালিসার।কাওসার এসেই গাড়ি ঘ্যাঁ করে ব্রেক কষলো।একহাতে হেলমেট নিয়ে ঢুকতে গিয়ে টেবিলের ওপর কাগজটাতে চোখ পড়লো।পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন মেম্বার মোনালিসার দলবদল।সিপিএম থেকে তৃণমুলে দলবদলের খবর।মুখটা ঝুলে গেল কাওসারের।এরা খবর পায় কি করে?
মোনালিসা কাপড় গোছগাছ করছিল।সে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,তোমার ভাইয়ের কীর্তি।আরো খবর দাও।এখনতো তোমার সাধ পূর্ণ হলো।বারবার বলছিলাম বাড়িতে রাজনীতির ব্যাপার আলোচনা না করাই ভালো। শুনলেনা।দ্যাখো তোমার আদর্শবাদী ভাই।আমার দল পরিবর্তনের খবরে কতটা উল্লসিত।ভাগ্যিস তোমার জমি জায়গা নেই।নাহলে এতদিনে তোমাকে জেলে ঢোকাতো।
ভাইয়ের কথাটায় কাওসারের সেন্টিমেন্টে লেগে গেল।সে ঝাঁঝিয়ে উঠলো।
তোমারও ভাবা উচিত মোনা, ওকে তুমিই তৈরি করেছ।এক সময় আদর্শের কথা তুমিও বলতে।আর ইলেকশন এলেই আদিবাসীদের দলে দলে ঘরবন্দী করে মাল খাইয়ে ঠকিয়ে ভোট দিতে নিয়ে যেতে।এই পচন আজকের?আমার ভাইতো তবু ক্ষমতার লালসায় দল বদল করেনি।
আর সাংবাদিক ডেকে যে এসব খবর দিল?
তুমি কনফার্ম?কাওসার বলে।
আর কে বলবে?আমি ওকে বেশকিছুদিন ধরে বলছি জেলা সভাপতির হাত ধরে ঢুকতে ওর আপত্তি কোথায়?জেলা লেবেলে পদ পাবে।সমস্ত রকম কন্ট্রাক্ট। আমাকে আগামীতে সমিতিতে দেবেই বলেছে সুনীল বসাকদা।এরপর আর কথা হয়না কাওসার?
সোজাসুজি জবাব দেয় মোনালিসা।
তোমার অভ্যাস গেলনা।আবারও কাওসার!কলেজবেলায় তুমি নেই যে আমার নাম ধরে ডাকবে।কথাগুলো বলে কাওসার হেসে ওঠে।
কাতল মাছটা ধুয়ে দাও।সপিরন আসেনি নাকি?
ওর মেয়ের সমস্যা নাকি।
কি সমস্যা হলো?
মেয়েটার আর বাচ্চা হচ্ছেনা।
দুটো বাচ্চা আছে না?
আছে।এখন ছেলেটা বলেছে আরও বিয়ে করবে।ভাবছি পুলিশ দিয়ে তুলে দিই।
মোনালিসার চোখে তীব্র প্রতিহিংসার আগুন আবারও ফিরে আসে।কাওসার ভয় পায়।মেন যে কথাটা সে এতক্ষণ ধরে বউকে বলতে চেয়েছিল সেটা আর বলে উঠতে পারেনি।বউয়ের মুড ঠান্ডা না হলে আর বলতেও পারছিলনা।অন্যদিকে কথা ঘোরাতে সে বললো একশো আশি টাকা হয়ে গেল কাতলের দাম,ভাবো!
কথা ঘোরাচ্ছো?মোনালিসা উত্তরের অপেক্ষায় সোজাসুজি তাকায় কাওসারের চোখে।
কাওসার সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়।লুঙ্গির কোনটা মুখে আটকে বলে তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো।
কি কথা?
ভাষা দিবসের প্রোগ্রামে প্রীতিকে আনতে চাচ্ছি।
কোন প্রীতি?
আরে প্রীতি বানু।আমাদের হসপিটালের স্টাফ।খুব ভালো ভাওয়াইয়া গায়।বেতার শিল্পী। আসাম বাংলা বিখ্যাত।
ও আচ্ছা। যে মেয়েটার কিছুদিন আগে একটা ভিডিও ক্যাসেট বেরোল?
আরে হ্যাঁ।
ঠিক আছে।আনো।তোমার ব্যাপার।আমি কি বলব?

মাছ ধুতে রান্নাঘরে চলে যায় মোনালিসা।আজকে সপিরন আসেনি।এত সমস্যা।অন্য কাজের লোক দেখতে হবে মনে হচ্ছে।এত ঝামেলা নেওয়া যায়না।মাছ ধুতে গিয়েই মোনালিসার মনে পড়ে ফেসবুকে ছবি দেখেছে প্রীতির।সে ভালো করেই চেনে মেয়েটাকে।কুড়ি বাইশ বছর বয়স হবে।মাঝেমধ্যেই মেয়েটার পোস্টে কাওসারকে কমেন্ট করতে দেখেছে।খুব দাদা দাদা করে আর লাভ ইমোজি দেয় কমেন্টে।সে কি বোঝেনা কিছু?পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই স্বামীর মনের গতিক সে কি ধরতে পারছেনা?কি করে করুক।
এদিকে কাওসারের উসখুস লাগছিল।কথাটা বলে কি ভুল করলো?প্রীতিকে আনাটা কি ঠিক হবে?রাহুল কি বলে?রাহুল সন্দেহ করবে নাতো?আচ্ছা সে যে পিকনিকে গেছিল প্রীতিদের সঙ্গে হসপিটালের স্টাফেরা মিলে সেটা কি কানেক্ট করতে পেরেছে মোনালিসা?
সব ভজোকটো হয়ে যায়।আর এই বালের সাংবাদিক, কোথায় কি খবর পায়!ব্যাপারটা ঠিক হলোনা।সে সব কিছু গুটিয়ে নিচ্ছিল।আর হবেনা ঠিকঠাক।সুনীল বসাকের নাদুস চেহারাটা মনে পড়তেই সে হেসে ওঠে।
কি ভেবে এত হাসছো?মোনালিসা কখন ঘরে এসেছে কাওসার লক্ষ্যা করেনি।আরে তোমাদের এই সুনীল বসাক লোকটা ব্যাঙের মতো।
দেখো তোমার চেহারাও তো জলহস্তীর মতো। তারপরও তো ছুঁক ছুঁক করার অভ্যাস যায়নি।সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে রাতের বেলায় মেসেঞ্জারে এত কথা বলো লজ্জা করেনা?মোনালিসা রুষ্ট হয়ে উত্তর দেয়।
আর এ কথাটা জিগ্যেস করেও সে আর কিছুই এক্স প্লেনেশন চায়না।চুলটা বেঁধে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে।
কাওসার খবরের কাগজে চোখ বোলায়।দেখে বিভিন্ন রকমের খবর।পরকীয়া করতে গিয়ে স্টাফের হাতে ধরা পড়লেন ডাক্তার।ফের চিতাবাঘের হানায় মৃত্যু ডুয়ার্সের এক সন্ন্যাসীনির।কাঠ পাচার করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ দুই।পাতা ওল্টালে দেখতে পায় ভারতের নতুন কোচ হচ্ছেন রবি শাস্ত্রী।এইসব খবরগুলো ছেয়ে আছে।আরেকটা খবরে চোখ আটকে যায় তুষারপাত রিশপে।

ফোন বেজে ওঠে কাওসারের।
হ্যাঁ বল।
মইদুলের ফোন।এ আবার কি বলে কে জানে।
দুলাই আমি।
হ্যাঁ বলনা।কাওসারের গলায় বিরক্তি ঝরে পড়ে।
দুলাই বুবু বাড়িতে আছে?
হ্যাঁ।কেন?দেবো ফোনটা।
আরে নাহ।
কি দরকার বল।
আরে আমার কিছু টাকা লাগবে।
কত টাকা?সেটা না বললে দিই কি করে?
দাও হাজার দশেক।ট্রিটমেন্ট এর জন্য।
কিসের ট্রিটমেন্ট?তোর আবার কি হল?
আরে দুলাভাই সেদিন হঠাৎ করে একটা বাইক এক্সিডেন্ট হয়েছে আমার মাথায় আর পায়ে চোট লেগেছে।এক্সরে করাতে হবে।সিটি স্ক্যান আছে।আর আমি এ মাসের বাড়ি ভাড়ার টাকাও দিতে পারিনি।
এত টাকা তোর বুবুকে না বলে দিতে পারবোনা।
কি হল কে ফোন করেছে?মোনালিসা কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কাওসার খেয়াল করেনি।সে বলে তোমার ভাই। নাও কথা বলো।ফোনটা মোনালিসার হাতে দেয়।

হ্যাঁ মইদুল বল।
বুবু আমার টাকা লাগবে।
কত?
দশ হাজার।
কেন?কি হইছে?
আরে একটা ছোট এক্সিডেন্ট।টাকা পাঠায় দে আমার একাউন্টে।
মোনালিসা ফোন রেখে কাঁদতে শুরু করে দেয়।কাওসার কাছে এসে মাথায় হাত রাখে।আরে ছোট এক্সিডেন্ট।
মোনালিসা বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকে।ছোটবেলা থেকেই ভাইটা তার ন্যাওটা যতই সে সৎভাই হোক।তবু।
মইদুলের জন্য বুকের ভেতরটা তার মোচড় দিয়ে ওঠে।
ক্লান্ত বিধ্বস্ত মাথাটাকে সে সোফায় বসা কাওসারের কোলে রাখে।
আরে সব ঠিক হয়ে যাবে।আগামীকালই ব্যাবস্থা করে তোমাকে শিলিগুড়ি পাঠিয়ে দেব।দরকার হলে রাহুল যাবে তোমার সঙ্গে।
ঠিক তো?
একদম ঠিক।কাওসার চোখের জল মুছে দেয় মোনালিসার।মোনালিসাকে অনেকদিন পরে এত নিষ্পাপ এত সুন্দর এত মাসুম দেখাচ্ছে।

 

গাড়ি নিয়ে ফিরতে কখনো রাত হয়ে যায়।কখনো বাইরে খেতে হয়।এসব একদমই পছন্দ করেনা শহীদুল।ওর মায়ের রান্নাই ভালো লাগে।বোন কখনো রান্না করেনা।বাবা নিজের মতো করে ক্ষেতে চলে যায়।কখনো ব্যাবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকে।শুয়ে শুয়ে ভালো লাগছিল।আজ কেউ ফোন করেনি।রাতে ভাড়া মেরে এসে ঘুমিয়েছিল
একটার দিকে।বাইরের দরজা খোলাই ছিলো। নিজের ঘরে এসে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়েছিল।খাবার টেবিলে রাখা ছিলো। মা সারাদিন কাজ করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায়।এখন জানালা খুলে দিলে আলো আসে।শহীদুলের ঘরটা পূর্ব দিকে ফলে জানালা খুললেই সূর্যের আলো সরাসরি এসে চোখে পড়ে।অবিন্যস্ত জামাকাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ঘরের মেঝেটা মাটিরই।কাগজের টুকরো পরে আছে।রাতে আসার সময় চিকেন কষা এনেছিলো।কাগজের কাভারটা বাইরে ফেলা হয়নি।দেখে বিরক্ত লাগছিল নিজের প্রতি। জানালা দিয়ে ফেলে দিলেই হতো।মশারী টাঙাতেও বিরক্তি এসে যায় মাঝেমধ্যে। কখনো সারারাত ধরে মশা কামড়ায়।ফুলে যায়।অল আউটের তেল আনতে হবে।মর্টিনের কয়েল জ্বালিয়ে রাত্রে শুয়েছিল।তারপরও মশা এন্তার কামড়ে গেছে।হাতের জায়গায় জায়গায় ফুলে গেছে।বিছানা থেকে নেমে জানালা খুলে দেয় শহীদুল।বাইরে থেকে পাখিদের আওয়াজ আসছে।হাজার রকমের পাখি।ভোর হলেই শুরু করে দেয়।বাতাবাড়ি ফরেস্টের কাছে।কখনো ধানখেতে ময়ূর চলে আসে।পাইথন ধরা পড়ে।আবার হাতির উৎপাত লেগেই আছে।দেয়ালের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে সাড়ে সাতটা।আর্লি রাইজার শহীদুলের আজকে দেরি হয়ে গেল।

চা খেয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে কোথাও।বাড়িতে বসে বেশিক্ষণ ভালো লাগেনা।
চপ খাবি?
এত সকালে কেউ চপ খায়।
ব্রেড চপ।শিরিন বলে।
এত সকালে মা ভাজছে?
আরে আব্বা আনছে বাজার থেকে। সকালে যে বাজারে গেল খাসির গোস্ত আনতে।শিরিন উত্তর দেয়।
এত সকালে?পেট খারাপের বুদ্ধি।তা গোস্ত কি দুপুরেই রান্না হবে?শহীদুল জিজ্ঞেস করে তার একমাত্র আদরের বোনটিকে।এবারে মাধ্যমিক দেবে শিরিন।শিরিনের যাবতীয় পড়াশোনার খরচ শহীদুলই দেয়।
হ্যাঁ দাঁড়া।নিয়ে আসি।বলে শিরিন ঘর থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরে ঢোকে।পুই শাঁক বাছছিল রোকেয়া।
ধরি যা।আর কল্যাণক ক ওক দেখা করির কইছে সুভাষ দা।
আচ্ছা।
ব্রেড চপগুলো দিতে দিতে শহীদুলকে বলে সুভাষ কাকু তোকে দেখা করতে বলছে।ঠিক আছে।
আব্বাকে হয়তো বলেছে?
না বাড়ি আসছে কালকে বিকেলে।
আচ্ছা।যাচ্ছি একটু পরে।

ক্ষেতের মধ্যে থাকলে মাটির গন্ধ পাওয়া যায়।কোদাল দিয়ে আগাছাগুলো সরিয়ে দিতে হয়।অনেক দিন আগে মামাবাড়িতে থাকতে মইনুদ্দিন তিস্তার গন্ধ পেত।সাঁতার কাটতে কাটতে বুঝতে পারতো তিস্তা তাকে গ্রাস করছে। তারপর বাবা দিল রোকেয়ার সঙ্গে বিয়ে।এই সেদিনের কথা। কল্যাণ বড় হয়ে গেছে।বিয়ের বয়স হয়ে গেছে।ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে রোকেয়া।লুঙ্গিটা উরু থেকে নিচে নামিয়ে দিয়ে কোদাল নিয়ে বাড়ির দিকে হাটতে থাকে মইনুদ্দিন।আর কয়দিন পরেই ফাতেহা দোয়াজদহম। প্রিয় নবীর জন্মদিন। ভোরে ফজরের নামাজ পড়েই দহলাবাড়ি চলে গেছে মইনুদ্দিন।আজকে খাসির গোস্ত খেতে ভালোই লাগবে।রবিবার।কল্যাণও বাড়িতেই।মইনুদ্দিন কোদালটা উঠানে রাখতে গিয়ে দেখতে পায় কল্যাণ বিছানায় বসে ব্রেড চপ চা খাচ্ছে।মাংস কাটতে শুরু করেছে রোকেয়া।মাঝেমধ্যে নফসকেও খোরাখ দেওয়া দরকার।

ওয়াহিদার হোসেন। কবি। জন্ম ১৯৮৬, ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের আলিপুরদুয়ার জেলার দক্ষিণ খয়েরবাড়ি রাঙ্গালিবাজনায়। লেখাপড়া করেছেন ইংরেজি সাহিত্যে। পেশাগত জীবনে তিনি একজন শিক্ষক। চাকরি করছেন ডুয়ার্সের এক প্রত্যন্ত চা বাগানের প্রাথমিক স্কুলে। প্রকাশিত বই: 'মধ্যরাতের দোজখ যাপন' (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৩) এবং 'পরিন্দা' (কাব্যগ্রন্থ,...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ