ইমন কল্যাণ

ওয়াহিদার হোসেন
উপন্যাস, ধারাবাহিক
ইমন কল্যাণ

পরিচ্ছেদ ৫

আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে গিয়ে বহুত ঝামেলা হয়ে গেছে।মইদুল ফিরছিল ডিউটি থেকে রাত আটটার দিকে তখুনি ঘটনাটা ঘটে।সেদিন ঝোঁকের মাথায় একটু খেয়ে ফেলেছিলো। রাস্তা পার হতে গিয়ে একটা টোটো পায়ে মেরে দেয়।সচকিত হয়ে সে যখন তাকায় ততক্ষণে টোটো পায়ের ওপর এসে মেরে দিয়েছে।ব্লিডিং হচ্ছিল।পুলিশ দৌড়ে আসে।চার পাঁচজন লোকাল ছেলে হাকিমপাড়া রোড থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়।ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেয় পায়ে।রক্ত পড়া আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।পায়ে ব্যাথা নিয়ে পরেরদিন সকালে সে ঘরে ফেরে টোটো নিয়ে।সেও দেড় মাস হয়ে গেল।তারপর আবার সুস্থ হলে হাসপাতালে ডিউটিতে ফিরতে হয়।ওই টাইমটা খুব খারাপ যায়নি।ভালো ছিলো।সুসময় যাকে বলে।মোবাইলে অ্যাপ ডাউনলোড করে হুমায়ুন আহমেদের হিমু সিরিজ পড়েছে।মিশির আলি পড়েছে।হেলাল হাফিজ মহাদেব সাহা পড়েছে।জয় গোস্বামী পূর্ণেন্দু পত্রী পড়েছে।খুব মজা ছিলো।বাড়িঅলা মাঝেমধ্যেই ওকে ডেকে নিয়ে বসে পড়তো টেবিলে।এটা ওটা জিগ্যেস করতো।ফল টলও কিছুদিন নিয়ে এসেছে।

আজ শরীরটা ভালো লাগছে।প্রায় পনেরদিন পরে আজই ছুটি নিয়েছে।চারটা বাজতেই প্রিয়াঙ্কার উপদ্রব শুরু হবে।আজকে প্রিয়াঙ্কাকে সে একটা কবিতা মেল করেছে।

কবিতাটা হেলাল হাফিজের। দেখি প্রিয়াঙ্কা কেমন পাঠ করে।বাথরুমে গিয়ে ফিরে এসে সে আধশোয়া হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।হেডফোন অন করে।

নমস্কার।আমি আর যে প্রিয়াঙ্কা।ওয়েলকাম টু আওয়ার মিউজিক প্রোগ্রাম রং সং বং সং। এফ মির্চি রেডিও থেকে সরাসরি।আপনাদের প্রিয় সব গান আর গল্প নিয়ে হাজির।আজকে আমি আমার বন্ধুদের মেল আর প্রচুর রিলিজড সং নিয়ে এসে গেছি।আজকে মেল পাঠিয়েছেন তৃষ্ণা।হাই প্রিয়াঙ্কা,ইট ইজ ফর মাই জান সঞ্জয়।এডভান্স হ্যাপি বার্থডে টু ইউ মাই লাভ।এবার কিন্তু অন্যরকম একটা ট্রিট চাই।আর তোমার জন্য থাকলো অনেক অনেক ভালোবাসা টেক কেয়ার।প্লিজ প্রিয়াঙ্কা একটা লাভ সং প্লে করো ইট উইল ডেডিকেট টু মাই লাভ সঞ্জয়।খুব ইন্টারেস্টিং এই মেইলটি পড়ার পরে একটা হয়।তারপর ব্রেক হয়।মইদুল আরেকটা সিগারেট ধরায়।ততক্ষণে ফিরে ব্রেক থেকে ফিরে এসেছে প্রিয়াঙ্কা।
এবার একটা কবিতা।এটা আজকের মেল।সকালে।কে পাঠিয়েছে? জানেন?আমাদের রকিং বয় ম্যাডি।মইদুল।কবিতাটা পড়ি তাহলে….

প্রস্থান
হেলাল হাফিজ

এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিও

 

এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালীর তাল পাখাটা
খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিও।
ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত
ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিও।
কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে
কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে
পত্র দিও, পত্র দিও।

 

আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেও, আপত্তি নেই।
গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কী তাতে?
আমি না হয় ভালবাসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরে নির্জনতা খুন করেছি, কি আসে যায়?
এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,
এক মানবী কতোটা বা কষ্ট দেবে!

একসময় যন্ত্রচালিতের মতো পা দুটো অবসন্ন হয়ে আসে।নতুন করে কিছুই ভাবা যায়না।ভাব ভাবনা আসেনা।অনেক রাত এমন গেছে সে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। নতুন করে এসব মনে করারও কারণ নেই। যদি ও পারে আমি পারিনা?নতুন করে সবকিছু ভাবতে হবে।নতুন স্টার্ট চাই। কিন্তু শিলিগুড়ি থেকে আর বেরোতে ইচ্ছে করেনা।হঠাৎ মনে হয় সিনেমা হলের ভেতর একা মুভি দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে সে বসে আছে।বাড়ি থেকেও কেউ আর তেমন ফোন টোন করেনা।মাঝেমাঝে রাঙ্গালিবাজনা থেকে মোনালিসা দিদি ফোন করে। আর দুলাভাই হঠাৎ দু তিন মাসে একবার।একদিন ওরা এসে হাজির হয়।আবার ওইদিনই চলে যায় দুজনে।এই একলা অবসন্ন বিষাদগ্রস্ত জীবনের শেষ কোথায়?পা দুটো নামিয়ে আনে শুয়ে পড়ে মইদুল। ফোন বেজে ওঠে। পরিচিত নাম্বার।সে ফোনটা কেটে। আরেকটা সিগারেট বের করে। আজতো কোথাও যাওয়ার নাই।কিচ্ছু করার নেই। হায় সুমন।

 

হঠাৎই আকাশ কালো হয়ে উঠলো।শোভার জন্য চিন্তাই হচ্ছিল।মাছব সব্জি আনতে আজকে শোভা নিজেই গেছিল।প্রায় চল্লিশ মিনিট হলো।এদিকে জোর হাওয়া দিচ্ছি।কয়েকদিন আগে দুটো বই এসেছে ক্যুরিয়ারে কলকাতা থেকে। মাঝেমধ্যেই বই আনিয়ে নেয় দেবোত্তম বইদুটো পড়ার টেবিলে রেখে এসে ব্যালকনিতে দাঁড়ায়।তারপর সিড়ি বেয়ে নিচে নামে।ওপর তলাটা ওদের নিজের।নিচেরটা ভাড়া নিয়েছে মহিলা কলেজে পড়ান একজন মহিলা প্রফেসর। মোবাইল নিয়ে ঘাঁটতে শুরু করে দেবোত্তম।এমন সময় শোভা এসে ঢুকে পড়ে ঘরে।
আর বোলোনা যা আকাশ।শরীরটা ভিজে গেল।
খুব ভিজেছে কি?
না অতটাও নয়।শোভা উত্তর দেয়।
দাঁড়াও তোয়ালে এনে দিই।মুছে দিই।নাহলে আবার ঠান্ডা লেগে এলার্জি শুরু হবে।দেবোত্তম বলে।
পাশের রুমে গিয়ে কাপড় ছেড়ে নাইটি পরে নেয় শোভা।বাড়িতে বেশিরভাগ সময় নাইটিই পরে।
তোমার জন্য চা করব?
হ্যাঁ। করো।ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয় দেবোত্তম।
তোমার বন্ধু সুবীরেশের খবর কি?
জানিনা।এখান থেকে যাওয়ার পরে তার সঙ্গে সেরকম কথা হয়নি।ও হ্যাঁ ভাবছি গরমে বেড়াতে যাই কোথাও।
আমি যেতে পারবোনা।দিদির ছেলের এনগেজমেন্ট তুমি হয়তো ভুলে গেছো।
ও তাইতো।কিন্তু সেতো এক দুই দিনের ব্যাপার।শিলিগুড়ি গেলে ওদিকে বেড়িয়ে যাওয়াতে খুব অসুবিধা হওয়ার নয়।
টাকার কথা ভেবেছ?
রাহুলও বলছে আসবে।ওকে নিয়ে গেলে বেড়াবো কি করে?
তাইতো।ছেলেটার কথা ভুলে গেছি।
আমিতো ভুলতে পারিনা। দেবু।ওকে আমি পেটে ধরেছি।
তুমি হয়তো ভেবেছ সে শুধু তোমারই ছেলে?
জন্ম দিলে হয়না পিতা।শোভা হেসে ফেলে কথা ক’টা বলে।

 

ল্যাপটপের স্ক্রিনে একটা একটা করে কবিতা আপ্লোড হতে থাকে।ড্রয়ার থেকে পাণ্ডুলিপিটা বের করে দেবোত্তম। স্বপ্নের প্রজেক্ট। কতদিন ধরে লেখা। আরও কিছুদিন থাকুক।ছেলেটা পড়ুক।ওর মতামত দরকার।
ইঞ্জিনিয়ার হলেও ছেলেটা সাহিত্য ভালোবাসে।ব্যাঙ্গালোরে থাকাকালীন সে নিজে একটা ওয়েব্জিন করবে বলে ভাবছে।দেখা যাক কি করে। ইঞ্জিনিয়ার হয়েও তো অনেকে মেইনস্ট্রিমে এসেছে।চুটিয়ে লিখেছে।
রাহুল আর এই পাণ্ডুলিপি দুটোই যেন ওর সন্তান।চশমটা খুলে রেখে দেবোত্তম ব্যালকনিতে আসে।চায়ে মুখ দিয়ে দেখে আজকে কেমন যেন বিস্বাদ লাগছে চা টা।বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে।

ওয়াহিদার হোসেন। কবি। জন্ম ১৯৮৬, ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের আলিপুরদুয়ার জেলার দক্ষিণ খয়েরবাড়ি রাঙ্গালিবাজনায়। লেখাপড়া করেছেন ইংরেজি সাহিত্যে। পেশাগত জীবনে তিনি একজন শিক্ষক। চাকরি করছেন ডুয়ার্সের এক প্রত্যন্ত চা বাগানের প্রাথমিক স্কুলে। প্রকাশিত বই: 'মধ্যরাতের দোজখ যাপন' (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৩) এবং 'পরিন্দা' (কাব্যগ্রন্থ,...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ