ইমন কল্যাণ

ওয়াহিদার হোসেন
উপন্যাস
Bengali
ইমন কল্যাণ

দ্বিতীয় পর্ব

মইদুল সারারাত এপাশ ওপাশ করেছে।রাতে মনে হয়েছিল প্রেসার বেড়েছে। হাইপ্রেসার আছে ওর বাবারও।বাড়ি থেকে দূরে আছে বলে মাঝেমধ্যে প্রেসার চেকও করে। কিছুদিন আগে ডাক্তার দেখানোও হয়েছে।এখন হঠাৎ প্রেসার বাড়ছে।আবার হয়তো ওষুধ চালু করতে হবে।এক বোতল জল রাখা থাকে বিছানার পাশে।সে জল খায়।জলের বোতল রাখে।লাইট জ্বালায়।চপ্পল পরে বাথরুমে ঢোকে।পায়খানা চাপ দিচ্ছে।আবার বেরিয়ে এসে সিগারেট লাইটার নেয়।সিগারেট ধরিয়ে বাথরুমে ঢুকে বসে পড়ে।সিগারেটের ধোঁয়া গুলো এলোমেলো মেঘের মতো বাথরুমে ছড়িয়ে পড়ে। মনে হয় বাথরুমের ছাদে মেঘের মতো ছড়িয়ে পড়ছে।আশঙ্কার মেঘ জমছে।সঙ্গে উদ্বেগও তখুনি মনে পড়ে ওরা মিলিত হয়েছিল।ব্যাথা পায় পেটে। আরও ক’টা টান দেয়।ফ্ল্যাশ অন করে।পায়ে জল দেয়।থুতু ফেলে আবার ফ্ল্যাশ অন করে। ঢাকা দেয় টয়লেটে। বেরিয়ে এসে দেখে তখন প্রায় সাড়ে চারটা। পুরো বিছানাটা এলোমেলো হয়ে আছে।একটা গ্যাসের ট্যাবলেট নেয়।এসিলকের পাতাটা ছুড়ে দেয় টেবিলের ওপর।তখনও অল আউট জ্বলছে। স্যুইচ অফ করে। লাইট জ্বলতে থাকে।সে হাফপ্যান্টটা পরেই জানালা খোলে।শিলিগুড়ি এখনো অনুজ্বল।তবে রাত শেষ হয়ে আসছে।দূরে ঝংকার মোড়ের মসজিদের আওয়াজ কানে আসে।আবার সে বাথরুমে ঢুকে পড়ে। ব্রাশ করে। তারপর কিচেনে গিয়ে একটা কলা বের করে। গতকাল নার্সিংহোম থেকে ফেরার পথে কলা আর ক’টা পেয়ারা নিয়েছিল।পেয়ারা খেতে মইদুলের ভালো লাগে।মইদুল একটা কলা খায়।ডাস্টবিনে কলার খোসা রাখে।সাফাইওলা এলে ডাস্টবিনের নোংরাগুলো দিতে হবে।ডাস্টবিনটা প্রায় ভর্তি হয়ে এসেছে।বাড়িওয়ালা হরেন ঘোষের সঙ্গে সন্ধ্যায় দেখা হয়েছিল।ভদ্রলোক ব্যাঙ্কে চাকরি করেন।হরেন ঘোষ মাঝেমধ্যে তাকে চা খেতে ডাকে।অনেক ব্রডমাইন্ডেড লোক।শিলিগুড়ির বেশিরভাগ মানুষই এরকম।ভাড়াটিয়াদের জাতধর্ম তারা দেখেননা।ভাড়া টাইমে পেয়ে গেলেই হলো।ভদ্রলোকের একমাত্র ছেলে মুম্বাইতে ফ্যাশন ডিজাইনিং এর কাজ করে। বাড়ি প্রায় আসেইনা বলা চলে। মইদুল তার তিনবছরের কর্মজীবনে দু’বার বাড়ি পাল্টেছে।আগে সে আশ্রম পাড়ায় থাকতো।এখানে যতদিন থেকে আছে ভদ্রলোকের ছেলেকে একবার মাত্র দেখেছে।কথা হয়নি যদিও।

মইদুল আরেকটা সিগারেট ধরায় স্পেশালের প্যাকেটে আর মাত্র দুটো সিগারেটই আছে।ডিউটি শুরু হবে আট’টায়।এদিকে আধ ঘন্টা হলেও অন্ধকার কাটেনা।আকাশ কালো হয়ে আসছে একটু উজ্জ্বল হওয়ার পরেই।ঠান্ডা হাওয়া আসে।মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে।ভাবতে ভাবতেই দু তিন ফোটা করে পড়তে শুরু করে। ঠান্ডা হাওয়া ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে ঘরে। জানালার পাল্লা পুরোটা খুলে দেয় মইদুল।সে খালি গায়ে শুয়েছিল।সারারাত ফ্যান চলেছে।এখন মনে হচ্ছে ফ্যানটা বন্ধ করা দরকার,
সে করেনা।ঠান্ডা ফিল নিতে চায়।দুটো হাত জানালার বাইরে করে দেয়।ভেতরে নিয়ে এসে বৃষ্টি চেটে দেখে।অদ্ভুত স্বাদ।আরও অনেক কিছু মনে পড়ে। সে নিজের মাথা চেপে মেঝেতে বসে পড়ে। বাবলির ফোন এসেছিল।রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে ইমনের।ইমন যেদিন বাড়ি ফিরেছিল তারপর সে টানা ট্রাই করে গেছিল।একবারও পায়নি।বাধ্য হয়ে বাবলিকে কল করে। খবর নেব বলেও বাবলি খবর দেয়নি।দুদিন পরে রাতে খবরটা দেয় বাবলি।
হ্যাঁ বল।
আরে শোননা।
বলছি তো শোনা যাচ্ছে।কি বলবি বল।
কোনো খবর আছে ইমনের?মইদুল জিজ্ঞেস করে।
হ্যাঁ ওর রেজেস্ট্রি হয়ে গেছে। বাবলি উত্তর দেয়।
মইদুলের হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছিল।আবার সে জিজ্ঞেস করে।
কি বললি?
বাবলি উত্তর দেয়। আরে ওর বিয়ে হয়ে গেছে।
আরও অনেককিছুই বলছিল বাবলি।মইদুল সেগুলো শুনতেই পায়নি।তখন প্রায় রাত দশটা।খাওয়া দাওয়া করে হোটেল থেকে এসে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমনিতে সে ডিউটি থেকে ফিরে মোবাইল চালায়। ইউটিউবে মুভি দেখে।ফেসবুকের ভিডিও দেখে।আজকে ভাবছিলো ঘুমোবে।শরীরটাকেও রেস্ট দেওয়া দরকার। কিন্তু।

আরেকটা সিগারেট ধরায় মইদুল।আরেকবার টয়লেটে যায়।জল খায়।বিছানায় ছটফট করে। কিন্তু সে মরে গেলেও কারো যায় আসেনা।কাউকেই সে ফোন করেনা।কেউ তাকে ফোন করেও খবরটা দেয়না।অন্তত ফেসবুক টা চেক করা দরকার ছিলো। কিন্তু সে দুদিন ধরে ফেসবুকেও তেমন পোস্ট দেখেনি।ইমন ব্লক করে দিয়েছে।মইদুল ধোঁয়া ছাড়ে।তার মনে পড়ে সে একবার শান্তিনিকেতন গিয়েছিল।ওখানে সে ইমনের সঙ্গে নিভৃতে সময় কাটিয়েছে।জয়ন্তীর পাহাড়ে।জঙ্গলে।ইমনের গায়ের গন্ধ। মনে পড়ে। ওর স্কুলের পাটভাঙা শাড়ির গন্ধ মনে পড়ে। প্রথমবার যখন ইমন স্কুলের বাইরে এসেছিল একলা দেখা করার জন্য।ক্যাডবেরির চকলেটটা নেওয়ার জন্য।

আহা।মইদুল কি করে ভুলে যাবে এইসব।শেষবার ইমনের নগ্ন শরীরটা মনে পড়ে।দামাল হাতির মতো জঙ্গল তছনছ করার কথা গুলো মনে পড়ে মইদুলের।তার চোখগুলো লাল হয়ে ওঠে।বিজাতীয় ঘৃণায় মুখটা বেঁকে যায় মইদুলের। বাবলিকে সে ছাড়বেনা।আবার সে মাতাল হাতির মতো জঙ্গল তছনছ করবে।

 

গাড়িতে বসে বসে বিরক্ত হওয়ার মতো কিছু ছিলনা।সমস্যা একটাই পাছা ব্যাথা করছে।মাথা ঘুরছে। টার্নিং নিতে নিতে অসহ্য লাগছে।কিন্তু কিছু করার নেই।প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করার পরে অবশ্য এক ধাক্কায় মন ভালো হয়ে যায়।বিন্দু ঝালং দেখা হয়ে গেলে শহীদুল,দেবোত্তম আর সুবীরেশ সেনকে নিয়ে পাহাড়ের দিকে এগোতে থাকে।টার্নিং গুলো অসহ্য লাগছে সুবীরেশের।সন্ধ্যা হয়ে আসছে।পাপরখেতি পার করে এসে ভালো লাগছে। রাতে বেশি চলাচল না করাই ভালো।যদিও আজকে হয়তো লাভা ঘোরা হবেনা।সোজা রিশপ চলে যেতে হবে।ভিজিবিলিটি কমছেই।খুব সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছে শহীদুল।
দাদা,আর আধ ঘন্টা।
দ্যাখো।
এই স্পীডে আধ ঘন্টার আগে সম্ভব নয়।যদিও এখনো আলো আছে।
দ্যাখ বাবা যেভাবে পারিস।এবার তো প্রথম নয়।দেবোত্তম বলে।
শহীদুল উত্তর দেয়। হ্যাঁ।
দাদা আপনি তো কিছুই বলছেন না?
কি বলব রে ভাই। যা অবস্থা। বমি বমি লাগছে।সুবীরেশ উত্তর দেয়।
দেখুন,উত্তরে টার্নিং থাকবেই।অন্তত এদিকে।দার্জিলিংয়ে এত টার্নিং নেই।
ভাই ছোটবেলায় দার্জিলিং ঘুরেছি।বাবার সঙ্গে। সুবীরেশ উত্তর দেয় শহীদুলকে

সন্ধ্যা ছটায় গাড়ি পৌঁছল রিশপে।ততক্ষণে রান্না বান্না হয়ে গেছে। আগেই শহীদুল ফোন করে লজ মালিক গৌতম লামাকে বলে রেখেছিল।ডিম,চিকেন রাইস হবে সঙ্গে পাপড়,চাটনি আর সন্দেশ।দেবোত্তম জলপাইগুড়ি থেকে এনেছে।বিন্দুতে দুপুরের লাঞ্চ বউ তৈরী করে দিয়েছিল।ফ্রায়েড রাইস চিকেন।শহীদুল খায়নি।সে রুটি আর তড়কা নিয়ে নিয়েছে চালসার এক ধাবা থেকে। দেবোত্তম জিগ্যেস করে হালাল জন্য খাচ্ছিস না নাকি?
দাদা আপনারা দুজনে খান। অসুবিধা নেই।আমি খাই অবশ্য।
তাহলে অসুবিধা কোথায়?
আপনারা খান।শহীদুল বেশি কথা বলেনি।ততক্ষণে মদের নেশা চড়ে গেছে দেবোত্তমের মাথায়। মাল খেলেই দেবোত্তমের হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা।সেটা শহীদুল জানে।দার্জিলিংয়ে একবার ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে ঝামেলা করেছিল দেবোত্তম।সেবার পুলিশের হাতে পায়ে ধরে সে আটকায়।
কোনো অসুবিধা হয়নি দুজনকে নিয়ে।মদ খাওয়ার পর দুজনেই বেশি বেশি কথা বলছিল।এখন রিশপে এসে তারা ধাতস্থ হচ্ছে।গৌতমদাকে শহীদুল বলে রেখেছে ওর জন্য খাবার ব্যাবস্থা রাখবে।সকালেই সে বের হয়ে যাবে।বাতাবাড়ি এখান থেকে বেশ দূরে।যদিও দেবোত্তম লাটাগুড়ির কথাও বলছিল কিন্তু সময় হবেনা।অন্য গাড়ি বুক করে ওরা দুজনে যেন চলে আসে।মেদো মাতালদের নিয়ে খুব ঝামেলা হয়।যদিও দার্জিলিঙয়ের তুলনায় এদিকে ঝামেলা কম।কিন্তু একজন মানুষ কি করে দুজন মাতালকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে বেড়াবে?

রাতের খাবার পরে সুবীরেশের একটু খারাপ লাগছিল।সিগারেট খেতে খেতে সে দেবোত্তমের টাক মাথার দিকে তাকাচ্ছিল।দেবোত্তম প্রায় বাহান্ন হয়ে গেছে। সুবীরেশ তরুণ।সুবীরেশ কম বয়সেই বেশ নাম করে নিয়েছে।তুলনামূলক ভাবে দেবোত্তম বড় ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান মিডিয়ার বাইরের লোক।লিটল ম্যাগাজিন করে যাচ্ছেন প্রায় কুড়ি বাইশ বছর। সুবীরেশের উঠে আসার পিছনে লিটল ম্যাগাজিনই।অথচ সুবীরেশ এখন লিটল ম্যাগাজিনে লেখেনা।তারপরও দুজনের মধ্যে পুরোনো সম্পর্কে চিড় ধরেনি।দেবোত্তম স্নেহ করে সুবীরেশকে।সুবীরেশ প্রতিষ্টিত হোক দেবোত্তম মনে মনে চায় কিন্তু তবু দেবোত্তমের অবদান বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হবেনা।সে মরে গেলেই সব শেষ। এতদিন ধরে সে যে কাগজ করে যাচ্ছে তাতে কি লাভ?বউ মাঝেমধ্যে জিগ্যেস করে বসে।সে উত্তর দিতে পারেনা।এতদিন লিটল ম্যাগাজিন করে কি পেলে?শোভার প্রশ্নের উত্তর দেবোত্তম দিতে পারেনি।যাচ্ছো যাও।কিন্তু তুমি নিজেও জানো সুবীরেশ ছেলেটি পাক্কা ধান্দাবাজ।কলকাতার লোকেরা এরকমই।

জানালাটা বন্ধ করে দেয় দেবোত্তম।তার নতুন বইয়ের পাণ্ডুলিপি বের করে ব্যাগের ভেতর থেকে। হাত বোলায়।চশমার ফাঁক দিয়ে পাণ্ডুলিপিটা দেখতে পায় সুবীরেশ।ওটা কি?
এটা একটা থ্রিলার।আমি নিজেই লিখেছি।তার পাণ্ডুলিপি।
তাই?দেখি।
পাণ্ডুলিপি ঝকঝকে স্পষ্ট হাতে লেখা। অন্তত আড়াইশো পৃষ্ঠা হবে।সুবীরেশের চোখে আগুন জ্বলে ওঠে।সে যা খুঁজছে তাই এখানে তৈরি হয়ে আছে।

টেবিলে দুটো গ্লাস দিয়ে যায় গৌতম।হুইস্কির বোতলটার ছিপি খুলে ফেলে দেবোত্তম।
কেমন বুঝছো?
দারুণ।
হ্যাঁ। আমার সারাজীবনের পরিশ্রম।
দেখি।আমিও লিখতে পারি কিনা।
তারপর অর্ধেক রাত পর্যন্ত ঠুংঠুং আওয়াজ আসতে থাকে গ্লাসের।জানালার বাইরে যেন মেঘ এসে দাঁড়িয়ে আছে।গৌতম চলে যাওয়ার আগে জানিয়েছে আগামীকাল ভোরে তুষারপাত হতে পারে।হলে সে দরজায় নক করে জাগিয়ে দেবে।

ওয়াহিদার হোসেন। কবি। জন্ম ১৯৮৬, ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের আলিপুরদুয়ার জেলার দক্ষিণ খয়েরবাড়ি রাঙ্গালিবাজনায়। লেখাপড়া করেছেন ইংরেজি সাহিত্যে। পেশাগত জীবনে তিনি একজন শিক্ষক। চাকরি করছেন ডুয়ার্সের এক প্রত্যন্ত চা বাগানের প্রাথমিক স্কুলে। প্রকাশিত বই: 'মধ্যরাতের দোজখ যাপন' (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৩) এবং 'পরিন্দা' (কাব্যগ্রন্থ,...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ