প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
এক মাঝবয়সী মহিলা বসে আছে গঙ্গার পাড়ে।
খুব জল নদীতে।
জল আরও বাড়ছে। ঘাটে ছলাৎ ছল ঘাই মারছে জল। উঠে আসতে চাইছে যেন একদম উপরের ধাপে।
সে তাকিয়ে দেখে, আর দুটি ধাপ বাকি। তারপরই জল ডুবিয়ে দেবে ঘাট।
তার খুব ইচ্ছে চান করবে। একটু পুণ্য সঞ্চয় হোক। সবই ত চলে যাচ্ছে খরচের খাতায়।
কিন্তু নামবে কোথায়? এ ঘাটের কিছুই সে চেনে না।
সে চুপ করে ঘাটের মাথার সিমেন্টের বেঞ্চে বসে থাকে।
কেউ কেউ আসছে, জল তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
কেউ ওই জলেই ঝাঁপ মারছে। সাঁতার দিচ্ছে। স্নান সেরে ফিরে যাচ্ছে। একজন পাড়ের কাছে নৌকা রেখে নদীতে ছিপ ফেলছে।
মাঝবয়সী মহিলা কীকরে? সে নৌকা দেখে। এই জলেও তাদের মাছ ধরায় কামাই নেই।
[ এই গল্পের অডিও শুনুন এখানে ]
ইলিশ আর এই বর্ষায় খাওয়া হল না।
এবার পাতে পড়ল না একটুকরো মাছও।
চারশ’র নিচে কেজি নেই। চারশো’র নিচে ওজন নেই।
বাজারে খোকা ইলিশ নেই। ধরা নাকি বারণ।
বড়রা ধরা পড়ে আর খোকারা মহানন্দে গঙ্গার জলে খেলে বেড়ায়।
গালে হাত দিয়ে বসে আছে মাঝবয়সী মহিলা — ।
শিল্পী: রিয়া দাস
ওদিকের সিমেন্টের বেঞ্চিতে সাত আট জন ছোঁড়া বসে আছে। তারা নিজেদের মধ্যে প্রচুর খিস্তি খেউড় করছে। কে কত মদ খেতে পারে তাই নিয়ে হুল্লোড় করছে। ওদের সবার গলায় গামছা। ওরাও হাসপাতালে এসেছে। এখন এখানে এসে বসে আছে। বুড়িটা ওদের দেখে প্রথমে ভেবেছিল, ওরাও বুঝি চান করবে। সেক্ষেত্রে ওদের দলে ভিড়ে পড়লে এই গভীর জলেও স্নানটা হয়ে যেত। কিন্তু ওরা নামছে না। ওরা অপেক্ষা করছে। হয়ত আরও ছেলে আসবে ওদের।
মাঝবয়সী মহিলার কোলের উপর একটি পাকা বটফল পড়ল।
তখন পাশে একটা বুড়ি এসে বসল। তার গালে পান। সে চেহেরায় সরু। মাথায় ঘোমটা। কিন্তু তার মাথায়ও সিঁদুর নেই।
এসে ধপাস করে তার পাশে বসে পড়ল। মুখ তুলে বলল, কে গা তুমি? ঠায় দেখছি বসে রইছ?
তার মুখ থেকে ভকভক করে পানের গন্ধ আসছে। জর্দার সুবাস। সে পান খায় বটে তবে নেশা নেই। হলে ভাল, না হলেও অসুবিধে নেই।
মাঝবয়সী মহিলা বললে, হাসপাতালে এসেছিলুম। ডাক্তার দেখান হল; এবার ভাবি একটু গঙ্গায় ডুব দিই। কিন্তু এ যে গলাকাটা জল! ভয়ে নামতে পর্যন্ত পাচ্ছি নে!
তা বটে। এমনি জল দেখলে বুক শুকিয়ে যায় বটে। আর জলে নোংরাখানা দেখলে?
তা আছে। তুমি কী করবে গঙ্গায়?
জল নেব। আমি বাপু নলের জলে পুজো করিনে। আমার বাড়ি এই এইধারে, বটতলায়। চান করিনে বটে কিন্তু জল ফুরুলেই জলটি নিয়ে যাই।
হুম! তা চান করো নে কেন?
বললুম যে, গা চুলকায়।
হ্যাঁ। যে যা পারছে ফেলে দিয়ে যাচ্ছে।
মড়া ভেসে যায়, মড়া!
বল কী!
সে আর কী বলব বল—। খুন হুয়া কত লাশ ভেসে যায় গঙ্গায়। আরও কত কী! তুমি এই ঘাটে নতুন—তোমারে শোনাই। এই থেকেই তো ডেঙ্গুর মশা হয়।
ও বাবা! গেল বার আমাদের পাড়ার তিনজন মারা গেল। এই হাসপাতালেই ভর্তি ছিল। মরতে বলল ডেঙ্গু নয়, ডেঙ্গুর মত হয়ে মারা গেছে।
ও হল ছোট মাছ চাপা দেবার জন্য বড় মাছ উপরে রাখা। এই তো পুরসভা থেকে বাড়িতে বাড়িতে লোক ঘুরছে। সেদিন আমাদের পারায় এক হ্যায় লোকের ঘরে ঢুকেছিল। বিরাট দোতলা বাড়ি সামনে বাগান। লোকটার ছেলেরা থাকে আমেরিকায়। বউ মরে গেছে। ওই বড় বাড়িতে কাজের মেয়েটার সাথে বুড়োটা থাকে। পুরসভার লোককে ঢুকতে দেবে না, কুকুর লেলিয়ে দেবে। পুরসভার লোক বলে, আমাকে ঢুকতে না দিলে থানায় খবর দেব। তোমার বাড়িতে অনেক টব, তাতে জল জমে আছে—ওতে ডেঙ্গুর মশা হয়। অনেক ময়লা আছে জমে ওতে মশারা ডিম পাড়ে। গেট খোল।
তারপর?
খুলল। কেন খুলবেনে? সরকারি লোককে কাজে বাধা দিলে পুলিশ চলে আসবেনে?
হুম।
এইবারে ডেঙ্গুর উৎপাত তবে কম। গতবার তো প্রতি পাড়ায় গড়ে পাঁচজন করে ডেঙ্গুতে ভুগেছে। যারা মরে গেছে, হাসপাতাল থেকে বলেছে ওই—ডেঙ্গু নয়, ডেঙ্গুর মত।
সেটা আবার কী রোগ?
সে আমিও জানি নে।
সে পা তুলে বসে। দুলে দুলে পান চিবায়। বলে, বটবৃক্ষের ছায়া আর নদীর বাতাস। আহা! পরান ঠান্ডা হয়।
তা জল নিয়ে তুমি ফিরবে কখন?
সে এখন দেরি আছে।
এসেছ তো অনেকক্ষণ।
তা বটে। তবে কি এলে আমি গঙ্গা মাকে দু’ চোখ ভরে দেখি। মন শান্ত হলে তবে যাই।
বুঝেছি, এইভাবে তুমিই পুণ্য নাও। নদীর মাছ কেন না?
দূর! ঐ মিনসে জেলেরা কখন যে ঘুম থেকে উঠে জাল টানবে তারজন্য বসে থাকব নাকি? মাছ কিনি বাজার থেকে।
ইলিশ খাও না নদীর? জ্যান্ত ইলিশ?
না না। সব বরফ মারা মাল। শুনি তো সব ইলিশ কোলাঘাটের। চারশোর নিচে নাই। আর বাংলাদেশের ইলিশে তো হাত দেওয়া যায় না।
কত যাচ্ছে দর?
বারোশো থেকে আঠারোশো।
ও বাব্বা। এত দাম!
দাম কেবল দেখলে হবে? তার সাইজ দেখবেনে? দেড় কেজি দুই কেজি ওজনের মাছ—। এই চওড়া পেটি। পেটিকেই দু’ ভাগ করতে হয়। তাও দেখি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইলিশ আর এ জেবনে খাওয়া হল নে। ওদের দেশে খোকা ইলিশ হয় না, জান?
মানে?
ওদের দেশে ছোট ইলিশ ধরলেই জেল।
ও বাবা!
আমাদের এখেনে নিয়ম হল এই তো সিদিন। আগের জেলেরা মানতুনি, এখনকার জেলেরা শুনি মানছে। সরকারি কড়া নিয়ম। তাই বড় ইলিশ ধরতে হবে। খোকা ইলিশ বাদ। তাইতে আমাদের পেটে আর ইলিশ ঢুকল নে।
আগে খোকা ইলিশ কিনিছি কুড়ি টাকার পিস।
তব্বে।
আর এখন ইলিশ খেতে গেলে কমসে কম দু’শ টাকা।
লোকের হাতে কত পয়সা, আঁ?
বাংলাদেশের ইলিশের সোয়াদ নাকি খুব সুন্দর।
শুনিছি।
একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ।
পয়সা থাকলে কত কী করা যায়!
যাদের আছে তাদের আছে। আমরা কি হ্যায় লোক?
গঙ্গার ইলিশ তবে গেল কোথায়?
দূষণে সব মাছ মারা যাচ্ছে; জন্মাবে কোত্থেকে?
তা যা বলেছ।
এখানের জালে ছোট মাছ পড়ে নে? এখানে ত আর কেউ দেখতে যাচ্ছে নে।
কই!
আর জল তুলবে কেমনে?
সে হয়ে যাবে।
ওদের বললে তুলে দেবে না?
দেবে? ওরা? বলে পানবুড়ি ওদের উপর চোখ বোলালে। বললে, ওরা চান করবে না গো। আর ওদের জলও চলবেনে।
কেন?
ওরা আসলে এসেছে মড়া পোড়াতে। কথাবার্তা শুনে বুঝছুনি?
হুম! আমি ভাবলুম কেউ স্নান করবে আর তাকে ধরে স্নান করে নেব।
তুমি বুঝি বেশি জলে ভয় পাও?
তা পাই। তবে কি না আমার ব্যামো আছে। বসলে আর উঠতে পারি নে, আবার উঠলে বসতে পারি না। সে অনেকক্ষণ ধরে, সময় নিয়ে ওঠবোস করতে হয়। এতজলে যদি একবার পা পিছলে যাই, চোরা টানে ভেসে যাব।
ঠিক কথা এখন জোয়ার এসেছে। জোয়ার এলে বাঁদিকের জল ডানদিকে বয়। আর কচুরিপানারা জলের মাঝে স্থির থাকে। তারা কোথাও যায় না।
ওঃ, খালি জল,আর জল! একবার ভেসে গেলে আর কেউ খুঁজে পাবেনি।
তাহলে স্নানের কী হবে তোমার?
সেটাই বুঝছি নে।
ডাক্তার কী বললে?
অনেক পরীক্ষা টরিক্ষা করতে হবে। সব হাসপাতালে হয় নে। বাইরে থেকে করতে হবে। অত পয়সা নেই। লোকের বাড়ি কাজ করে খাই। পয়সা কোথা পাব যে দেখাব? ফিরিতে যে হবে তাই চলবে। এমনি করে যদ্দিন চলবে-।
ওঠবোসের ডাক্তার?
হুম।
ঘর কোথা তোমার?
প্রভাস কলোনী।
খুব বেশি দূর তো নয়।
তবু দূর। পেরায় একবছর পর তো ইদিকে এলুম।
কিন্তু স্নান করবে কি করে?
তাই ভাবি।
রোগা চেহেরার সেই বুড়ি জল নিয়ে চলে যায় হেলেদুলে।
বিঘৎখানেক দেহ নিয়ে তেমনই করে থেবড়ে বসে থাকে সে।
ছেলেগুলোদের কাগজের কাজ মিটে গেছে।
এবার তারা বডি আনতে চলল।
একজন বালতি করে জল তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। ঘাটের মাথায় একটা টোটো দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ধোবে। তার থেকে এক আঁচলা জল চেয়ে নিয়ে মাথায় দিলে মাঝবয়সী মহিলা।
তারপর বসেই রইল।
দূরে জাল পেতে জেলেরা নৌকায় ঘুমায়।
বেলা হতে থাকে।
হোক—
ইলিশ ধরা দেখা তো দোষের কিছু নয়।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..