ইসতানবুল নট কনস্তানতিনোপল

যোষিতা
ধারাবাহিক, পডকাস্ট, ভ্রমণ
Bengali
ইসতানবুল নট কনস্তানতিনোপল

ভ্রমণকাহিনি লেখা আদৌ উচিত হচ্ছে কিনা সে নিয়ে ধাঁধায় পড়ে গেছি। এমনিতে কোথাও বেড়াতে গেলে পর্যটক হিসেবে সঙ্গে একটা ক্যামেরা থাকা জরুরি, ক্যামেরা আমার নেই, সেটা না থাকলেও স্মার্টফোনে ঘনঘন ফোটো তুলতে হয়। মুশকিল হচ্ছে যে, আমি বেড়াতে গেলে ফোটো তুলতে ভুলে যাই সুন্দর সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর, কিংবা মানুষের বানানো ঐতিহাসিক কি সমকালীন স্থাপত্য স্মৃতিসৌধ ইত্যাদির। একেবারেই ভুলে যাই বললে ভুল হবে, ইচ্ছে করেই সেসবের ছবি তুলি না এই যুক্তিতে, যে ওসবের ছবি তো বইয়ের পাতায় কি ইন্টারনেটে খুঁজলেই পাওয়া যায়। পুরোটা হয়ত আমার তোলা ফোটোটির মত হুবহু এক হবে না, তবে কাছাকাছি কিছু তো একটা হবে।

আরও কিছু অদ্ভূত সমস্যা আমার আছে। দুনিয়ার দারুণ দারুণ সব জায়গায় বেড়াতে গিয়ে যেসব অবশ্য দ্রষ্টব্যের তালিকা টুরিস্ট গাইডে পাওয়া যায়, সেগুলো যথাসম্ভব এড়িয়ে গিয়েছি। না, না, ভিড় টিড়ের দোহাই দিয়ে, কি পর্যটকদের ফোটো তোলার হিড়িক দেখে নয় কিন্তু – ওগুলো কাছ থেকে দেখে তেমন কোনও বিশেষ রোমাঞ্চ অনুভব করি না। ফের মনে হয় বইয়ের পাতা উল্টে ছবি দেখে নিলেই হবে। তবে কী দেখার জন্য বেড়াতে যাওয়া আমার?

কেন বেড়াতে যাওয়া? কেন খরচাপাতি করে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ানো? সত্যিই হয়ত এর কোনও মানে নেই। আসলে তো অনবরত বেড়িয়েই চলেছি। গোটা জীবনটাই তো কত কিছু দেখা, কত মানুষ চেনা, অভিজ্ঞতার তীব্রতায় নাস্তানাবুদ একটা মস্ত বড়ো ভ্রমণকাহিনি। সেই বেড়িয়ে চলার পথে আমি পথিক, যে সব কিছু দেখতে দেখতে কোথাও কোথাও থামে, জড়িয়ে পড়ে নানান ঘটনার সঙ্গে। সেই ভ্রমণের কোনওখানে আবেগ অনুভূতির সংযোগ বেশি, কখনও আবার গাছাড়া ভাব। এই মস্ত গোটা ভ্রমণটার মধ্যেই রয়েছে টুকরো টুকরো ভ্রমণ, যেখানে টুক করে কয়েক দিন বা সপ্তাহ কি মাসব্যাপী ঘুরে আসা যায়। ইসতানবুল তেমনই এক ভ্রমণ আমার।

এই লেখাটির অডিও শুনুন এখানে:

আমার বাস সুইটজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে। এই দেশে হরদম পর্যটকের আনাগোনা। ছোট্ট এই দেশ পাহাড় নদী জলপ্রপাত হ্রদ গিরিখাতে ভরা, এখানে গাছপালা সবুজ থাকে গ্রীষ্মে বসন্তে, নানা রঙের ফুল ফোটে, শরতে রকমারি রং ধরে গাছের পাতায়, আবার শীতের সময় বরফও আছে, মেঘ খুব কাছ দিয়ে ঘোরাফেরা করে। তেমনি আছে স্থাপত্য গীর্জা এই সমস্ত দেখার জিনিস। বেশির ভাগ পর্যটকেরা এসব দেখতে আসে। তারা বলে এ দেশ একেবারে ছবির মতো। এই স্থির ছবি থেকে বেরিয়ে আমরা উড়ে গেলাম ইসতানবুলে। আমি এবং আমার বন্ধু। দেখতে গেলাম জ্যান্ত একটা জায়গা, মানুষের গল্প শুনবার লোভে লোভে।

ঠকিনি। প্রকাণ্ড এয়ারপোর্টে নামবার পর থেকেই চারপাশে অসংখ্য মানুষ। ইমিগ্রেশনের লাইন পেরিয়ে বেরিয়ে আসতে অনেকটা সময় লেগেছে, সন্ধে পেরিয়ে রাত্রি হয়েছে, কিন্তু হোটেলে কেমন করে পৌঁছব সেটা বুঝতে পারছি না। ট্যাক্সি নেওয়া যায়, কিন্তু বড্ড দাম চাইছে। আমি খুঁজছি পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। ট্যাক্সির বিলাসিতায় আমার আপত্তি। আমাদের দুজনের মধ্যে কথাকাটাকাটি বাড়তে বাড়তে ঝগড়ার আকার নিল। আশেপাশের লোকজন ততটা খেয়াল না করলেও একজনের চোখ তা এড়ায় নি। সেই লোকটি আমাদের কাছেই একটা চেয়ারে বসে ছিল। সে নিজেই এগিয়ে এসে আমার বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করল। তার অবস্থাও আমাদের মত, তারও ঝগড়া হয়ে গেছে নিজের বৌয়ের সঙ্গে। এরা ফ্লাইট মিস করেছে। বৌটি পাশেই বসে আছে, দুচোখের জল অনবরত মুছে চলেছে ন্যাপকিনে। এরা ইসতানবুলেরই লোক, তবে থাকে পশ্চিম আফ্রিকার বুরকিনা ফাসোর রাজধানী উয়াগাদুগুতে। লোকটি উয়াগাদুগুতে টার্কিশ দূতাবাসে কনসাল। ঝগড়ার প্রাথমিক দমক  কেটে যাবার পরে বৌ তার সঙ্গে কথাই বলছে না। লোকটির হাতে এক পাঁইট হুইস্কির চ্যাপ্টা বোতল। বোতলের এক তৃতীয়াংশ সে খরচ করে ফেলেছে, আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বোতল আরও একটু খালি করে ফেলল। আমরা আলোচনা করে ঠিক করলাম এয়ারপোর্ট থেকে মেট্রো নিয়ে শহরের ভেতরে যাব। গন্তব্য আমাদের ভিন্ন হলেও কিছুটা পথ একসঙ্গে যাওয়া যাবে। আমাদের হোটেল ইসতানবুলের সুলতান-আহমেত এলাকায়। প্রথমে মেট্রো, পরে ট্রাম, এই করে করে অনেক পথ আমরা এক সঙ্গে গিয়েছি। শেষের দিকে তার বোতলে হুইস্কি তলানিতে এসে ঠেকল। সে ইংরিজি প্রায় না জানলেও ফরাসীর সঙ্গে ইংরিজি মিশিয়ে এত উৎসাহে পুরোটা পথ কথা বলে গেছল যে কিছুই বুঝতে অসুবিধে হয় নি। আসলে ভাষায় কিছু আটকায় না, মানুষ যখন খোলা মনে নিজের গরজে সম্পূর্ণ অপরিচিতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, সাহায্যের হাত বাড়ায়। সে আমাদেরকে তার নাম ঠিকানা টেলিফোন নম্বর দিয়ে দিল নিজের গরজে, কোনও প্রয়োজনে যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না ভুলি বার বার বলেছিল এবং আমরা ট্রাম থেকে নেমে যাবার পরেও সে ক্রমাগত হাত নেড়ে গেল। নাঃ সবটা হুইস্কির নেশায় নয়, মন বলে একটা বস্তুও যে আছে এটাই তার অকাট্য প্রমাণ।

রাত দশটায় সুলতান-আহমেত এলাকা গমগম করছে। শুধু গ্রীষ্ম বলে নয়, হরেক রকমের মানুষ, দেশি-বিদেশি মিলিয়ে সবাই সেই বিখ্যাত ব্লু মস্ক, অর্থাৎ সুলতান আহমেত কামিই-র সামনের প্রকাণ্ড বাগানে ইতিউতি বসে আছে বা ঘুরে বেড়াচ্ছে। একে ওকে তাকে জিজ্ঞেস করতে করতে মিনিট দশেক হেঁটেই আমাদের নড়বড়ে হোটেলটায় পৌঁছে গেছি। সমুদ্রের ধারে হলেও ইসতানবুল সমতল নয়, সমুদ্রের দিকটা উৎরাইতো বটেই, শহরটা কিছু অংশে ঢালু, কিছুটা সমতল। হোটেল ছোট্ট হলেও রিসেপশনের কর্মচারীটির ব্যবহার অমায়িক এবং আন্তরিক। সে প্রথমেই বলে দেয়, এত রাতে এসেছেন, রাতের খাওয়া হয় নি নিশ্চয়? আশেপাশের রেস্টুরেন্টগুলোয় যাবেন না, ঠকিয়ে নেবে কিন্তু! গড়গড় করে সে বলে দেয় দু তিনটে রেস্টুরেন্টের নাম, একটু হাঁটতে হবে চড়াই বরাবর তাও বলে।

কিন্তু আমরা বড্ড ক্লান্ত তাই তার কথা না শুনে কাছের রেস্টুরেন্টে যাই, সেখানে আমাদের অবধারিতভাবে ঠকায়, এবং আমি মনে মনে ভজহরি মান্নাকে শাপশাপান্ত করি।

 

দুই.

আমরা থাকব মোটে দশটা দিন। এই দশটা দিন শুধু ইসতানবুলেই থাকব। আশে পাশে অনেক জায়গাতেই যাওয়া যায় দশদিনব্যাপী ছুটি থাকলে, চাইলে আন্তালিয়া কি উত্তর-সাইপ্রাসের নিকোসিয়া ও ঘুরে আসা যায়। কিন্তু আমাদের তেমন কোনও ইচ্ছে নেই। এই পুরোটা সময় আমরা এই শহরেই থাকব, ঘুরতে ইচ্ছে হলে ঘুরব। ইচ্ছে হলে পার্কের বেঞ্চিতে বসে থাকব যতক্ষণ খুশি। একই জায়গায় বারবারও যেতে পারি কিংবা হোটেলের ঘরে টানা ঘুমিয়েও কাটিয়ে দিতে পারি যদি ইচ্ছে না করে কোনওদিন বাইরে বের হতে। মোটকথা ইসতানবুলের রাস্তা ধরে হাঁটা, নিজের খুশি মত অলিগলি ঘোরা, এর মাধ্যমেই শহরটার গন্ধ রং শব্দ এগুলোকে ছুঁতে পারার একটা খেলা থাকে। দশদিনে কিছুই প্রায় হবে না জানি। দশদিন বড্ড কম সময়।

হোটেলের কাছেই গুচ্ছের রেস্টুরেন্ট, ডাকাডাকি করছে ব্রেকফাস্টের জন্য। টার্কিশ ব্রেকফাস্ট বলে যে জিনিসটা খেলাম পরের দিন সেটা তেমন সুবিধের ঠেকল না। ছোট ছোট চিনেমাটির খুরিতে তিন চার রকমের মধু এবং জেলি, নরম পাতলা চিজ, রুটি মাখন, এবং ডিম সেদ্দ। তুলনায় কফি উপভোগ্য। সম্ভবত এইসব খাবার ভজহরিবাবুর রান্নার সিলেবাসে ছিল না।

ব্রেকফাস্ট খেয়ে চড়াই ধরে পৌঁছেছি আরাস্তা বাজার নামক একটা অতি প্রাচীন বাজারে। তুরস্কে যখন ইসলাম ধর্ম আসে নি, তারও আগে এই বাজার তৈরি হয়েছে এবং এখনও সে বাজার সম্পূর্ণ জ্যান্ত, রমরমিয়ে বিক্রিবাট্টা চলছে। এখানে ফিক্সড প্রাইসের ব্যাপার নেই, দরদাম করতে হয়, বার্গেইন করাটাই একটা শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তবে আমাদের কেনাকাটির কোনও তাগিদ নেই তখন, আমরা হাঁটছি। মার্মারা ইউনিভার্সিটিকে পেছনে ফেলে তারপর সেই ব্লু মস্ক, সেখানে টুরিস্টের ভিড়, মেয়েরাও এই মসজিদে ঢুকতে পারে দেখলাম।

এর পাশ দিয়ে হেঁটে পৌঁছেছি সুলতান আহমেত স্কোয়ারে। এই তল্লাটে দোতলা বাস বোঝাই হচ্ছে সাইট সীইং এর জন্য। আর রয়েছে বসফোরাস ট্যুরের জন্য এজেন্টদের হাঁকাহাঁকি। গাছতলায় বসে এসব দেখছি। পোড়ানো ভুট্টা খেতে খেতে ভাবছি, উঁহু কোনও এজেন্টই আমাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে বসফোরাস ট্যুরে নিয়ে যেতে পারবে না। যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধে কোথায়, রাত ঘনিয়ে আসার জোগাড়। সঙ্গে সঙ্গে এক রোগা লিকপিকে এজেন্ট এসে উপস্থিত। সে জানালো, যে বসফোরাস প্রণালীর রাউন্ড ট্রিপের জন্য মার্মারা সমুদ্রের বন্দরে স্টিমার-বোট দাঁড়িয়ে রয়েছে, বিশ মিনিটের মধ্যেই ছেড়ে দেবে। এখান থেকে হেঁটে যেতেও লাগবে মিনিট সাতেক। যত তাকে বলি যাব না আজ, অন্যদিন যাব, ছাড়েই না। সে পাকা লোক, বলে, কিনুন কিনুন টিকিট কিনুন, এ সুযোগ হেলায় হারাবেন না, ইত্যাদি প্রভৃতি। আমরা দাম জিজ্ঞেস করি টিকিটের। সে দাম বলে। আমরা বলি না না, অত দাম দিয়ে কে যাবে, সঙ্গে অত লিরা নিয়ে বের ই হই নি! সে বলে, কোনও সমস্যা নেই, লিরা কেন, ইউরো থাকলে ইউরো দিন। ইউরোয় কত পড়বে? সে দাম বলে। আমরা ভাবি একটু বার্গেইন করলে কেমন হয়? বার্গেইন করলে সে নিশ্চয় আর জ্বালাবে না আমাদের। সে আমাদের বলা দাম মেনে নিল এক বাক্যে। অর্ধেক দামে দুটো টিকিট বেচে দিল লোকটা! অর্থাৎ পর্যটকদের মতো আমাদের যেতে হবে বসফোরাস প্রণালীতে, একপাশে থাকবে ইয়োরোপ, অন্যপাশে এশিয়া মহাদেশ। একুল ওকুল দুকুল জুড়েই একটা শহর ইসতানবুল।

টিকিট বিক্রি হয়ে যাওয়া মাত্রই এজেন্ট কিন্তু চলে যায় না। সে আমাদের সঙ্গে গল্পস্বল্প করে। নিজের পরিচয় দেয়, তার নাম ইয়াশের আরাফাৎ। নাম শুনেই চমকে গিয়েছি আমরা। আরিব্বাস! ইয়াসের আরাফাৎ? হুবহু প্যালেস্তাইনের সেই বিখ্যাত লিডারের নামে নাম!

সে আমাদের শুধরে দেয় –  উঁহু ইয়াসের নয়, ইয়াসের নয়, ইয়াশের। আমার নাম ইয়াশের আরাফাৎ। যদিও দুজনের নামেরই উৎস অভিন্ন। আরাফাৎ পর্বতের নাম থেকে আমার নামকরণ করেছিলেন আমার বাবা, তিনি ঐ পর্বতকে ভালোবাসতেন, আমি ওঁর প্রথম সন্তান।

এবার সে অনেক কথা বলতে শুরু করে তার নিজের সম্বন্ধে। তার শৈশব, বড়ো হয়ে ওঠা, কর্মজীবন। হয়ত সম্পূর্ণ অচেনা মানুষকেই অনেক কথা বলে ফেলা যায়। ইয়াশের পকেট থেকে তার ভিজিটিং কার্ড বের করে আমাদের হাতে দেয়। যে কোম্পানীর হয়ে সে টিকিট বেচে, সেই কোম্পানীর কার্ড। তাতে অজস্র ভুলে ভরা ইংরিজিতে তাদের পরিষেবার বর্ণনা রয়েছে। আর সময় নেই হাতে, যেতে হবে স্টিমার ধরতে। আমরা হাসিমুখে পরষ্পরকে বিদায় জানাই, সযত্নে রেখে দিই তার ভিজিটিং কার্ড ভবিষ্যতে আর কখনও প্রয়োজন হবে না জেনেও।

প্রায় তিনঘন্টাব্যাপী বসফোরাস ট্রিপে নানান দেশের মানুষ রয়েছে স্টিমারে। মাইক্রোফোনে সহজ ইংরিজিতে গাইড শুনিয়ে দিচ্ছে উপকুলের জায়গাগুলোর ইতিহাস ও বর্তমান। পর্যটকেরা ঘুরছে ফিরছে বসছে ফোটো তুলছে, বিক্রি হচ্ছে কাটা তরমুজ, টাটকা অরেঞ্জ জুস। আমাদের পেছনের সারিতে বসে আছে এক তুর্কী পরিবার, বাবা মা দুটি শিশু, শিশুরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে জার্মান ভাষায়। বুঝলাম এরা জার্মানিতে থাকে, সেখানেই জন্মেছে বড়ো হয়েছে, গরমের ছুটিতে দেখতে এসেছে পূর্বজদের দেশ। স্টিমারের নাবিকের কেবিনের কাছে একটা জটলা, খিলখিল হাসি। সেখানে তিন আরব তরুণী রঙ্গ মশকরা করছে দুই তুর্কী যুবকের সঙ্গে। তাদের মাথায় রুমাল ছাড়া আর কোনও পর্দার চিহ্ন নেই পোশাকে। তিনজনেই পরেছে ফ্যাশনদুরস্ত জিন্স ও টিশার্ট। দুতরফেই ভাষার আদান প্রদানের জন্য একমাত্র সম্বল ভাঙা ভাঙা ইংরিজি – লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা!

দুজন কিশোরীও আছে সেই জটলায়, তবে তারা বড়োদের হাসি তামাশায় নিতান্তই দর্শকের ভূমিকায়। খুব একচোট তর্ক চলছে সেখানে, তবে গুরু গম্ভীর কোনও বিষয় নয়। অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে তুর্কী তরুণ হাত টাত নেড়ে জোর গলায় জানিয়ে দিল তার বক্তব্য – আই লাইক শী!

যার দিকে আঙুল তুলে কথাটা বলল, সেই তরুণী কৌতুকের দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে যুবকের দিকে। বাকি সকলের কথা থেমে গেছে নিমেষে। যুবক আরেকটু দম নিয়ে ঘোষণা করে দিল – শী লাইক আই!

এটুকু বলতেই খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ে তিন তরুণী। কিশোরী দুজনও যোগ দেয় তাতে। কেবিনের ভেতর থেকে ডাক পড়ে, যুবকদ্বয় সেখানে ঢুকে যায়, এরা নাবিকের সহকারী। একটু পরে সেই যুবকদ্বয় ডেকে নেয় মেয়েদের কেবিনের একেবারে সামনে থেকে ফোটো তোলাবে বলে। ঐখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ।

 

তিন.

বসফোরাস প্রণালী জুড়ে রেখেছে মার্মারা সমুদ্রকে কৃষ্ণসাগরের সঙ্গে। কিন্তু ঐ অত উত্তরে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত এই স্টিমার যাবে না। একটু পরে স্টিমার উল্টোমুখো ঘুরে গিয়ে অন্য পারের কাছ ঘেঁষে চলতে থাকে, এদিকটা এশিয়া মহাদেশ, এদিকের বাড়িগুলোর জৌলুস কম, গগনচুম্বী অট্টালিকাও চোখে পড়ে না। ঠিক করে নিই, একদিন আসতে হবে এদিকে। এই স্টিমার তো এ পারে নোঙর করবে না, অন্য কোনও রাস্তা বা ব্যবস্থা আছে নিশ্চয়। রাউন্ড ট্রিপের শেষে ডাঙায় নামতেই দেখি বিক্রি হচ্ছে আগুনে সেঁকা মাছ। এক বিঘত প্রমাণ সেঁকা মাছ পুরু পাঁউরুটির মধ্যে পুরে পেঁয়াজ টেয়াজ দিয়ে স্যান্ডুইচ বানিয়ে দিচ্ছে, দাম মাত্র বিশ লিরা। ব্রেকফাস্টের তুলনায় এ অমৃত। আবার চড়াই ধরে হোটেলে ফেরা। মার্মারা সমুদ্রের এ দিকটায় কোনও স্নানের বীচ চোখে পড়ছে না, ইতিউতি শুধু বন্দর।

পরের দিন করেছি কি, ম্যাপ ট্যাপ দেখে একবার ট্রাম বদলে একে ওকে তাকে জিগ্যেস করে পৌঁছে গেছি তাকসিম স্কোয়ারে। আগের বাক্যটা দেখে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, ঠিক ততটা সহজ ছিল না ওখানে পৌঁছনো। ম্যাপ দেখে মনে হলো সোজা পথ, শর্টকাট করতে হলে ট্রাম থেকে নেমে অলিগলি দিয়ে হয়ত এক দেড় কিলোমিটার হাঁটলেই হবে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। কতকটা হেঁটে দেখি রাস্তা চলেছে সোজা চড়াই বরাবর, এ ছাড়া আর কোনও রাস্তাই নেই। অতয়েব চড়াই বরাবর চলতে চলতে বসফোরাসের জলীয় বাষ্প এবং প্রচন্ড রোদের প্রকোপে আমরা ঘেমে হাঁফিয়ে একাক্কার কান্ড। চড়াইয়ের অর্ধেকও পৌঁছই নি, জায়গাটা পার্ক, রীতিমতো খাড়া পাহাড়ের গায়ে একটা মস্ত পার্ক ঘাস টাশ দিয়ে যত্নে মোড়া, প্রচুর গাছও রয়েছে। কিছুটা চড়বার পরে বেঞ্চি দেখতে পেয়ে একটু জিরিয়ে নিলাম। দূরে দেখা যাচ্ছে বিস্তৃত ইসতানবুল শহর এবং মার্মারা সমুদ্র। আচ্ছা, মার্মারা শুনলে কেমন মর্মর শব্দটা মনে পড়ে না? আবার ওঠো। পার্কটুকু শেষ হবার পরেও রাস্তা চড়াই বরাবর চলেছে। ম্যাপ বলছে প্রায় পৌঁছে গিয়েছি। অবশেষে একটা সমতল অঞ্চলে পৌঁছনর পরে বুঝলাম ঐটাই তাকসিম স্কোয়ার। মেট্রো করে এদিকে এলে এই চড়াইয়ের তীব্রতা অজানা থেকে যেত। তবে ফেরা পথে মেট্রোই নেব। এক দিনে এত বেশি হাঁটা পোশাচ্ছে না। খুব বেশিদিন হয়নি, এখানেই একটা সামরিক অভ্যুত্থান গোছের কিছু হয়েছিল, খবরের হেডলাইনে বারবার এসেছে, সেই কারণেই নামটা বারবার মনে পড়েছে। ওখানে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে ইতিউতি ঘোরাঘুরি করে ফেরার পথে একটা ছোট্ট ব্যাপার অনেকদিন মনে থেকে যাবে। বিস্কুট এবং জুস কিনব বলে একটা মনিহারি দোকানে ঢুকেছি, দেখি ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে শুরু হয়েছে ভাষার সমস্যা। দুজন আরবি মহিলা কিছুতেই তাদের ইংরিজি দিয়ে দোকানদারকে বুঝিয়ে উঠতে পারছে না তারা কী কিনতে চায়। দেখি এক মহিলার হাতে মোবাইল ফোন, সে প্রাণপনে বোঝাচ্ছে যে সৌদিতে ফোন করার জন্য যে কার্ড সে কিনেছিল তাতে ব্যালেন্স ফুরিয়েছে, আরও লিরা ভরতে হবে। অন্যদিকে দোকানি ইংরিজি খুব অল্প বোঝে, আরবি ভাষা একেবারেই বোঝে না এবং দুইপক্ষের শব্দভাণ্ডারে কমন ইংরিজি শব্দ খুবই কম। দোকানি বুঝতেই পারে নি এরা কী চায়। আমি হাতটাত নেড়ে দোভাষীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলাম। ভাঙা ভাঙা উজবেক ভাষা দিয়ে বোঝালাম, এদের কাছে ফোন আছে, সিমকার্ড আছে, কিন্তু তাতে লিরা নেই (হাত ঘুরোলে নাড়ু দেব ভঙ্গিমায়)। ব্যস, বাকিটা দোকানী বুঝে ফেলেছে।

ইসতানবুলে এক বিশাল সংখ্যক পর্যটক আসে জিনিসপত্র কেনাকাটি করতে। সারা শহর জুড়েই অসংখ্য বাজার, সেখানে বিক্রি হয় না এমন কোনও জিনিস নেই। কিন্তু দেখবার মতো বাজার হচ্ছে মাহমুৎ পাশার দোকানগুলো এবং গ্র্যান্ড বাজার। শুধু দেখবার জন্যই ঐ বাজারে আমরা দিনের পর দিন গেছি। বেশ কয়েকবার হারিয়েও গেছলাম। একদিন তো বাজারের ভেতরে কয়েকবার পথ হারিয়ে অনেক কষ্টে সৃষ্টে বের হয়ে দেখি রাস্তাঘাট কিছুই চিনতে পারছি না। যেদিক দিয়ে ঢুকেছিলাম সেখানে ছিল ঘিঞ্জি ট্রামরাস্তা, আর এদিকে ট্রাম লাইন থাকলেও একটা ব্রীজ রয়েছে, ব্রীজের নীচে মার্মারা সমুদ্র। ম্যাপ খুলে দেখবার মত ধৈর্য তখন কই? পাশেই বেশ কয়েকটা সাদা গাড়ি দাঁড়িয়ে, তাতে নীল দিয়ে লেখা zabita, দেখে পুলিশ পুলিশ লাগছে। তাদেরই শরণাপন্ন হলাম। উঃ কী ভালো সবিতা, থুড়ি zabita! খুব মিষ্টি করে কথা বলল, রাস্তা দেখিয়ে দিল তো বটেই আবার বিনামূল্যে মস্ত একটা ম্যাপ ধরিয়ে দিল হাতে।

বাজার এলাকায় যাওয়াটা নেশার মত হয়ে যাচ্ছিল। সেইসঙ্গে ঐ অঞ্চলের খাবার। ভজহরিবাবু নির্ঘাৎ গ্র্যান্ডবাজার তল্লাটেই রান্নার ট্রেনিং নিয়েছিলেন। এমনিতে রাস্তার লেখা, সাইনবোর্ড পড়তে অসুবিধে হয় নি, সবই টার্কিশ ভাষায় লেখা হলেও রোম্যান হরফ। আমি উজবেক ভাষা অল্প বুঝি, এবং সে ভাষার সঙ্গে টার্কিশ ভাষার কিছু মিল আছে। এছাড়া এদের ভাষার সঙ্গে জুড়ে গেছে বেশ কিছু ইয়োরোপীয় ভাষায় শব্দও, সবমিলিয়ে সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। আরব দেশ থেকে প্রচুর ক্রেতা আসে এই গ্র্যান্ড বাজারে। বিশাল বিশাল সুটকেস ভর্তি করে করে জিনিস কিনে চলেছে, কাপড় জামা জুতো খেলনা বাসন থেকে শুরু করে কী নয়! আর দেখলাম একটা বইয়ের বাজারও আছে। খুব বেশি বড় নয়, তবে আছে। গ্র্যান্ড বাজারের একটা প্রান্তে ইসতানবুল ইউনিভার্সিটি, ছাত্রছাত্রীরা বইয়ের বাজারে বই কিনছে। পাঠ্যপুস্তক, কম্পিউটারের বই, ইংরিজি শিখবার বইয়ের স্তুপের পাশে গল্পের বইও রয়েছে বিস্তর।

উঃ যা গরম ইসতানবুলে, রোদের আঁচে শরীর যেন পুড়ে যায়, তবু তারই মধ্যে যে যার গন্তব্যে হেঁটে চলেছে। গরমে আমার দম বেরিয়ে যায়, পথের ধারে মসজিদ পড়লে তার সঙ্গে জলের কল থাকবেই। মাঝে মধ্যেই কল খুলে হাত মুখ মাথা ধুয়ে নিই। আবার মিনিট দশেক পরে যেই কে সেই গরম। ভাবলাম মাথার চুল আরও ছোট করে ছেঁটে ফেলা যাক। সামনেই একটা চুল কাটার সালোন। ধপাধপ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গিয়েছি। কাস্টমার বিশেষ কেউ নেই। আবার শুরু হল ভাষার সমস্যা, যে মেয়েটি চুল কাটবে সে ইংরিজি খুবই কম বোঝে। দোকানের মালিককে বোঝালাম, সে বুঝে নিয়ে মেয়েটিকে বলে দিল। চুল কাটতে বসে মেয়েটিকে হাত টাত নেড়ে যত বোঝাই যে যত পারো চুল কেটে দাও, নেড়া করে দিলেও ক্ষতি নেই, সে ততই বিভ্রান্ত হয়ে যায়। কোন ভাষা বোঝো তুমি, ইংলিশ? সে অল্প অল্প মাথা নাড়ে। টার্কিশ? এবার বেশি বেশি মাথা নাড়ে। তাকে দেখে তো তুর্কী বলে মনে হয় না, খানিকটা চিনে চিনে লাগে। তুমি কি চাইনিজ? সে নেতিবাচক মাথা নেড়ে বলে, না, আমি কিরঘিজ।

বাহ, এতো মেঘ না চাইতেই জল। কিরঘিজস্তানের মেয়ে রাশিয়ান তো জানবেই। এরপর আমরা গড়গড়িয়ে রাশিয়ানে গল্প করে চলি, সে খুব উৎসাহ নিয়ে বলে চলে তার চুল কাটার অভিজ্ঞতা। খুব যত্ন করে কেটে দেয় আমার চুল। বলে পরেরবার এলে অনেক সস্তায় চুল কেটে দেবে। ওর বোনও এই একই সালোনে কাজ করছে। দুবছর হল এসে রয়েছে ইসতানবুলে, তবে শুধু এই সালোনের কাজে যথেষ্ট উপার্জন হচ্ছে না, দেশে টাকা পাঠাতে হয়, মাঝে মধ্যে অন্য রাস্তাও দেখতে হয় টাকা রোজগারের জন্য।

বেরিয়ে আসার সময় সামান্য একটু টিপস পেয়েই সে কৃতজ্ঞতায় প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। অন্য সব সহকর্মী বন্ধুদের ডেকে এনে আমাদের সঙ্গে আলাপ করাচ্ছিল। ঐ সালোনের নীচের ফুটপাথ দিয়ে প্রায়ই আসা যাওয়া করতাম আমরা। কয়েকবার দেখেছি সে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ঐ অত ভিড়ের মধ্যেও আমায় চিনতে পেরে হেসে হাত নেড়েছে। ও আমার নাম জানে না, আমিও ওর নাম জানি না।

 

চার.

বাজারে বাজারে ঘুরে টুকটাক কিছু কেনাকাটা হয়ে থাকে। মোজাইকের জিনিস বড্ড ভারি হয়, কিন্তু দেখতে এত সুন্দর যে না কিনে পারা যায় না। আমরা প্রায় খালি হাতেই এসেছিলাম ন্যুনতম দরকারি জিনিস সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু শপিং যা হয়েছে, তা পিঠে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া কষ্টের। ফলত একটা ছোট সুটকেস কেনা দরকার। যে তল্লাটে সুটকেসের দোকান সেখানে সার দিয়ে হরেকরকমের সুটকেস রয়েছে। এক সদ্য কিশোর নিপাট ভালোমানুষের মত মুখ করে ঝাড়ন দিয়ে ধুলো সাফ করছিল দোকানের সামনে রাখা সুটকেসগুলোর। তাকে একটা সুটকেসের দাম জিগ্যেস করতেই সে আমাদের দোকানের ভেতরে ডেকে নিল। ভেতরে বেশ অনেকটা ফাঁকা জায়গা। আমরা যেটার দাম জিগ্যেস করেছিলাম সেরকম একটা এনে দেখাল, দামও বলল, কিন্তু হাবে ভাবে বুঝিয়ে দিল জিনিসটা ভালো নয়। আমরা দোকান থেকে বেরিয়ে আসব ভাবছি, সে অন্য একটা সুটকেস পেড়ে ফেলল তাক থেকে। বলল, এটা ভাল, এটার দাম বেশি, কিন্তু এটাই ভাল। এখন সে প্রমাণ করে দেখাবে। জিনিসটা মেঝেয় ফেলে দিয়ে তার ওপরে ধাঁইধাঁই করে লাফিয়েই চলেছে। তাকে নিরস্ত করে কার সাধ্য! আরও অনেক কারসাজি জানে সে। আমরা আগে যেটা পছন্দ করেছিলাম, সেরকম একটা এনে দেখাল, ওপরটা ফেটে গেছে। এভাবে বেশিদিন লাফালে ফেটে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই ছেলে জিনিস বেচতে জানে বটে। ঠিক কিনিয়ে ছাড়ল।

মার্মারা সমুদ্রের তলা দিয়ে এরা বানিয়েছে মেট্রো। ইসতানবুল শহরের এশিয়া মহাদেশের দিকটায় যেতে হলে ঐ মেট্রোই সহজতম উপায়। সিরকেজি থেকে উসকুদার, একটা স্টেশন। স্টেশন থেকে বের হলেই দেখা যায় ওপারে ইয়োরোপ। এই অভিজ্ঞতাটুকু করবার ছিল। এপারে পর্যটক বিশেষ কেউ নেই, অধিকাংশই স্থানীয় মানুষ। আমরা জল এবং খাবার নিয়ে গাছের তলায় বেঞ্চিতে বসে জিরোচ্ছি, একটু তফাতে মুখোমুখি বেঞ্চিতে এক ক্লান্ত ঠাকুমা জিরিয়ে নিচ্ছে কিশোরী নাতনির পাশে। ঠাকুমা একটু পরে তার থলে থেকে খাবার বের করে নাতনিকে দিল। নাতনি একটু খাবার পরে ঠাকুমাকে বলছে, তুমিও খাও। আমরা বিপরীতে বসে সব দেখছি বুঝছি, এই দৃশ্য চিরন্তন, এর জন্য আলাদা করে কোনও ভাষা শিখতে হয় না।

সন্ধের দিকে মোটামুটি ঘুরিয়েফিরিয়ে তিনটে রেস্টুরেন্টে গিয়েছি আমরা। একটা সুলতান-আহমেতের বড় রাস্তার ওপরে, সেখানে হরেক কিসিমের খাবার, ভিড়ও বেশি, দেরি করে পৌঁছলে অনেক আইটেমই ফুরিয়ে যায়, যেমন দোলমা। একবারই পেয়েছিলাম দোলমা সেখানে, সুস্বাদু। অন্যান্য দিন সন্ধের খাবার খেতাম আমাদের হোটেলের রিসেপশনিস্ট বর্ণিত একটা চারতলা রেস্টুরেন্টে। চারতলা হলে কী হবে, কেবল একতলা আর চারতলায় সবাই খেতে বসে, বাকি দুটো তলা খালিই পড়ে থাকে। চারতলাটা আসলে ছাদ। আমাদের পরিবেশন করে যে ছেলেটি তার বয়স বড়জোর ষোলো। দেখে মনে হয় বিদেশি, খানিকটা ইংরিজি জানে। বলছিল ও এসেছে আফগানিস্তান থেকে, দু বছর হয়ে গেছে, পরিবারের সকলে এখনও এসে পৌঁছতে পারে নি। ওর কাছে কোনও কাগজ নেই। কাগজ বলতে নিজস্ব নথিপত্র। ফলে আপাতত ও একজন আনডকুমেন্টেড মাইগ্রেন্ট, এমনকি রিফিউজিও না। এখন এখানে কাজ করছে, করতে হচ্ছে, নইলে যাবেটা কোথায়? তবে কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় হবে।

ফিরবার আগের দিন আমরা বেরিয়েছিলাম আগোছালো ইসতানবুল দেখতে। মেট্রো আর ট্রামলাইনের দুধার ঘেঁষে যে ইসতানবুল, তা বিস্তীর্ণ হলেও মোটামুটি প্রাসাদ স্মৃতিসৌধ ইউনিভার্সিটি মসজিদ বাজার দোকানে ভরা। এই জায়গাগুলোয় পর্যটকদের আকর্ষণ বেশি। আমরা ম্যাপ খুলে বের করলাম অন্য পথ, সেই প্রথম যে বন্দর থেকে স্টিমার ছেড়েছিল, তার খুব কাছ দিয়ে দিয়ে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে হেঁটে যাব ইয়েনিকাপি রেলস্টেশন অবধি। তারপর ভেতরে ভেতরে অলি গলি দিয়ে ঘুরে বেড়াব। এই আমাদের প্ল্যান।

…আগামী সংখ্যায় সমাপ্য।

যোষিতা। লেখক ও কম্পিউটার প্রকৌশলী। জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতায়। ১৯৮৫ সালে উচ্চশিক্ষার্থে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে যাত্রা। প্রাক-পেরেস্ত্রৈকা ও তৎপরবর্তীকাল, সবমিলিয়ে দশ বছর কাটিয়েছেন মধ্যএশিয়ার উজবেকিস্তানে। তিনি সামাজিক প্রথাবহির্ভূত জীবনের পাশবইয়ে জমার অঙ্ক ভরে তুলেছেন বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞান। ১৯৯৫ সালের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ