ইয়াং লিয়ান এর কবিতা

বল্লরী সেন
অনুবাদ, কবিতা
Bengali
ইয়াং লিয়ান এর কবিতা

ইয়াং লিয়ান সম্পর্কে দু‘একটি কথা

জন্ম সুইটজারল্যাণ্ডে, কিন্তু বড় হলেন বেইজিং শহরে। লেখালিখির সূচনা সত্তরের দশকে,যার প্রভাবে তৈরি হল এক শক্তিশালী সাহিত্যপত্রিকা যার একজন হোতা তিনি নিজে। পত্রিকার নাম “জিনচিয়ান”,  যার মানে হল ইদানিন্তন বা হাল আমল। বর্তমানে তা কবির নির্বাসনজনিত কারণে স্ক্যানডিনাভিয়া থেকে প্রকাশিত। ১৯৮৩ থেকে তাঁর কাব্যের তীব্র সমালোচনার জেরে ১৯৮৯ এ তাঁর রচনাসংগ্রহ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, কারণ তিনি তিয়ানানমেনের ছাত্র হত্যার স্মরণে সভা ডেকেছিলেন। ‘বৃত্তীয় ভার্গব’ বা Concentric Circles কবিতাবই থেকে কয়েকটি কবিতার অনুবাদ দেওয়া হল। ইংরেজি অনুবাদ করেছেন Brian Holton এবং Agnes Hung- Chong Chan, ২০০৫ এ প্রকাশিত। এই বইটি তাঁর বহিষ্কৃত জীবনের জিভে ধরে রাখা এক বিন্দু পরমান্ন, যার স্বাদে রক্তের টাকরা লেগে আছে। লিয়ান নিজে বলেছেন,

”Concentric Circles is the most important piece since I came out of China.”

চিনা সংস্কৃতির ইতিহাসের সঙ্গে পশ্চিমের মর্ডার্নিটির একটা বিরুদ্ধমুখ কবিতার চিত্রকল্প, স্বর, ছত্রবিন্যাস,যতিচিহ্নের মধ্যে থেকে উঠে আসে ।কবিতার লাইনের প্রাকরণিক সজ্জা কিম্ভূতকিমাকার। ভাঙা লাইনের দুরভিসন্ধি খুব স্পষ্ট কথকের মধ্যে আরো কাউকে চেতিয়ে দিচ্ছে এরকম একটা বিশ্বাস হয়। ছত্রবিন্যাসের পরম্পরাকে খণ্ড করে কথক স্পেস এর এমন একটা নতুন রীতি নির্মাণ করছেন;
যা একটানা নয়। যেমন-

you I sound of rain October droops between the legs ocean
turn a page morning unwilling to wake squeezed every year
endure a little heat grows bit by bit once imagined missing another
bus window tongue erects the world’s obstacles
I bright definition morning’s most unthinking part

experiencing a cellular reality a reality unwilling to wake up at morning tell or
can’t tell or impossible to tell when you can’t not tell experience you’re not blank
you make your own blankness dazzlingly threatening a blood-red eyeball glares
at lifelong illogical scenery
live no word

(Concentric Circles, pg37, Bloodaxe Books)

পূর্ণছেদহীন গদ্যে ভাঙা স্তবক, বেভ্ভুল পরিকাঠামোচ্যুত এক দেশরিক্ত মানুষের ইতিকথা ধরা দিল। প্রতিটা প্রযুক্ত শব্দ কবির আভিপ্রায়িক নন্ ল্যাঙ্গুয়েজের নির্মিতি। তাই বৃত্ত আসলে পরিবর্তমান বিন্দুর পুনর্বাসনের আর্তি,ছিটকে যাওয়া ফুলকিদের সমাপতিত করার একটা স্পর্ধা। তাই যার দেশদ্রোহ আসলে স্বজাতীয়ের সংগ্রামের স্বীকৃতি, তার রাষ্ট্রকে সম্ভাষণের ভাষা তো পৃথক হবেই। মানসিক অভিজ্ঞতার আবর্তনকে বোঝাতে কবি ইচ্ছে করে খাপছাড়া ভাবে কথাসূত্রের ধ্রুবক হিসেবে নানা শব্দ পুনরাবৃত্তি করেছেন। তবে কবিতার পদান্তিক মিল নেই, তেমনি কখনো চলমান ছবি যেন আধখানা করে দেখানো। তীব্র হতাশা বা ব্যর্থতার কোনো টানাপোড়েন নেই। কিছুটা বহির্জগতের থেকে বিযুক্ত হয়ে কবি দৈনন্দিন চর্চাকে অন্য এক বহুস্তরীয় পিরামিডাল প্লটে কাহিনি বুনেছেন। তাই টানা গদ্যের অর্থ বা ভাবের নির্দিষ্ট নিষ্পত্তি হয় না। স্কিৎজোফ্রেনিক উন্মাদ যেন যা মনে আসছে লিখে রাখছে। বোঝানোর দায় নেই।  কয়েকটি কবিতার ভাষান্তরের চেষ্টা করেছি, এসঙ্গে দেওয়া হল ।

 

এক

শৈত্যের ভয় যা পিছে ফেলে যায় শীত
ধূসর পাথর সারি,ফেলে যাওয়া অন্ধ পাথরের
কান ঝাঁঝানো হেমন্তকাল প্রত্যঙ্গ জর্জর গাছ
বাকল বিচ্ছিন্ন, মূল শাখা থেকে

পরে বায়ু শুকনো ডালপালায় নয়, মানুষের অস্থি কেবলি
ফলের খোলস না,কেবলি শটিত শ্রবণরেখা
ডানার ঝাপট না, অনেক যুগের বাসি ধাতুর বাসন ঘষে চলা

সেই মৃত আগুন যেভাবে কুয়াশায় , ফেলে আসে মৃত্যুদের আরও
শূন্য ক্ষেত কালো দৃষ্টির সামনে পাতালগর্তে রান্নার গন্ধ ওড়ে
তুষার লাগা আখরোট জমাট থেকে ছিঁড়ে একটার পর একটা
সুরার গেলাস যাকে ডেকেছিল একটা সমুদ্র রঙিন ও শয়তান
প্রতি মিনিট খরচা করে ভয় জমিয়ে রাখে প্রার্থনা প্রাসাদ

বর্জন শেষ অব্দি তার সবটুকু ধ্বংস মিলে গেলে

 

দুই

বিষাদ করিডোরে চিরকাল থেকে যাবে ছায়ার শ্রবণ
কর্ণকুহরে থেকে কেউ কেউ সরে যায় অন্য কোনো দূরে

সমুদ্রস্তরের পাথরে
পাখিদের হাড় করতালি শব্দে চৌচির
তাড়া করে কোনো এক দেহ সংবেদী
আর এক জোড়া গোলাপি ফুসফুসে
আমাদের দেহ ফের জন্মায় আর জন্মায়

বাস্তবের ক্রমবিস্তারে বাতাসের টানেলের থেকে
হাজার কাঁটাগাছ জুড়ে বসে সুরেলা রাত্রি
ছাগলের ফাঁকা আয়ুবৃত্ত ভেদ করে

মূর্ছনা সরে যায় শ্রবণেরা ফেটে চুরমার

তিন.

অটাম্ ঘুরছে এখানে ছিটিয়াল সুরের তন্ত্রীর মতো
হেমবর্ণ প্রার্থনাস্মৃতি কুঁকড়ে যায়
শবের মাঝামাঝি যখন এক বাতি তরঙ্গে আরো শব
আমরা পিচ্ছিল কাদায় লাল হল্কা শ্বাস তুলছি
কেবল যখন মুখাবয়ব হল নিয়তি হল আছে সেই এখন

ফুসফুস হদ্দ এক কালো তুলে আনে সর্বাধিক গভীরে আমাদের
পাষণ্ড সতর্কতায় ঢেকে দিচ্ছে হাড়ের ক্যালসিয়াম
সংক্রমণ দূরত্ব
তার অসুখের ঢেকুরে বোঝা যায় কতখানি ব্যবধানে থাকা
নীরন্ধ্র সমুদ্র ভারী হয়ে আছে তার পেপারওয়েট, যা কিছু লিখিত

কর্কশ হাউণ্ডের চিৎকার এগিয়ে দিচ্ছে এখন কে গতিমান শব্দে
শব্দহীন শুধু অতএব সে এখন পড়ে থাকলো

এক পাহাড় সন্চয় সুরের ওজন তুলে সারা জীবনের
পাইপ অর্গান পরিয়ে দেয় নকল দাঁত
যার মিথ্যে রক্তমাংসের সত্য ঠাণ্ডা সফেদ অহোরাত্র সরগমের সুর ভেসে যায়
রবহীন মরা পোকাদের চিকচিকে গম পুঁতে দেয়

বিয়োগফল যে ব্যাকরণ একা সৈন্য নিয়োগ করেছে
আমাদের চোখ ব্যবহার করে সূর্যের ক্ষয়িষ্ণু যন্ত্রণা বিনিয়োগ
বুনোফল পিটিয়ে পিটিয়ে তার পুঁজ নীরবে বেগনি হয়ে যায়
যৌনকোষ ঝুলে থাকে একা মুহূর্তকে সম্পূর্ণ মুছে দেবার পর

মধ্যরাতের চিরকুট

আমার মাঝরাত্রিগুলো সমস্ত ব্যবহৃত
যা যা অন্ধকার তালাবন্ধ পড়ে আছে লম্ফটাতে
লিখে যাওয়া পূর্ণসূর্যগ্রহণ কন্যা চলেছে তার চামড়ায় ধবল

হিরণ্যবরণ আলোকবিন্দু এইমাত্র মগজে বিয়োলো

ঘড়ি বন্ধ চিরকুট রক্ত প্রবাহ হীন
অতীতকে পাঁচ আঙুলে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে
মেঘপুন্জ নিঃসঙ্গ পুঁটলি যেন জমাট বাঁধছে কন্ক্রিটের
আকাশ সে কন্যা পরস্পরের শব্দশরিক ক্রমশ খুঁড়ে আনে
মানুষের হাড়ের ফসফরাস রাত্রির ক্ষত দিয়ে আক্রান্ত হয়
বীর্য ফুঁড়ে শূন্য আর শূন্য

কেবল মাংসের মতো ,যার কোনো মালিকানা নেই
ক্ষয় হওয়া , অথচ প্রজনন বৈরী কেবল শরীর

প্রেমহীন ভালবাসা অনিদ্রাপ্রধান চোখ ধ্বংস হতে বাকি
এত তার উজ্জ্বলতা মেয়েটির মধ্যরাতের বিষাদ
অজর অক্ষয় আমার না গুলো নিয়ে ভূতের মতো খেয়ে ফেলে

 

জীবন এই শব্দটুকু

এটা বেঁচে থাকার উপায়মাত্র মুখবিবরে চেবানো নাদ
মৃত্যু ও তো একটা উপায় আওয়াজ চিবোয় সেই
একই আওয়াজ উঠছে দু দুটো হারাকিরি মাছের জঠর কেউ চেবানোর

যে চল্লিশ বছরের পোষাকটা বরখাস্ত করেছো আর আমি তাকে চড়িয়ে নিয়েছি

শব্দশ্রুতি দীর্ঘ সময়ের বীর্য উপচানোর দাগ
কেলাসিত এই চামড়ায় কত কঠিন কর্কশ
স্নায়ু রক্ত স্বপ্ন হাড়ের ওপরে সেঁটে
অক্ষরের চার পায়ে
জ্বরের বালিশে আছে বাঁধা
সেই তুমি,এ হেন চল্লিশের মুখাবয়বকে যদিও ফেলে দাও
চল্লিশটা বছর ধরে সে আমারই একটা ফুটন্ত তাওয়ায় পাগলের অট্টহাসি
কথা বলা কথা লেখা লেখা যা আগুনে ফুটে ফুটে

 

আর সে-ই তো বাঁচা

মীনকথকতা
পেট কাটা শরীরের এক টুকরো নোংরামির মাংসের ছাঁট মাত্র
তুমি যাকে সফেদ নুনের ঢাকনায় চেঁছে ফ্যালো আসমুদ্র সমাপ্তপ্রায়
এই রক্তনালী শুনতে পায় ক’বার পচতে পচতে
শয্যার শিরদাঁড়া কামড়ে ধরে সবটা শরীর,অন্তত একবার
কাঁচের বয়ামে রাখা অন্ত্র ধুইয়ে রক্তঝাল প্রস্রবণ গড়িয়ে নামছে বসন্ত
মিথ্যে চর্বণ
নকল দাঁতের ধার দেওয়া কত কত জলজ্যান্ত আনুপুঙ্খিকতা

বল্লরী সেন। গবেষক, কবি। প্রকাশিত বই বাংলায় ৫ টি ইংরেজি ২ টি। 'বিহান রাতের বন্দিশ' কাব্যগ্রন্থের জন্য ২০১০ এ কৃত্তিবাস পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১২ থেকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলা ভাষার নানা গবেষণায় যুক্ত। 'নারী বীক্ষায় পুরুষের কবিতা' তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণা গ্রন্থ।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..

ফ্রেম

ফ্রেম

দেবী না পরিণীতা রাতটা একা থাকে এবং নিঃসঙ্গ অন্ধকার মানে রাত; তাহলে অন্ধকার নিজেও একা…..