ঈদ

রুদ্র অয়ন
ছোটগল্প
Bengali
ঈদ

আবুল করিম একজন দরিদ্র কৃষক। নিজের তেমন কোনো জমি-জমা নেই। অন্যের কিছু জমিতে চাষ করে জীবন যাপন করে। সামনে ঈদ। ছেলে মেয়ে নতুন জামার আবদার করছে।
ছোট মেয়ে বলে, ‘বাবা, বাবা নতুন জামা দিবেনা?’

আবুল করিম কি বলবে ঠিক বুঝে ওঠতে পারছেনা। ছোট্ট মেয়েটাকে কোলে নিয়ে একটা চুমু দিয়ে বলে, ‘মা মন খারাপ করোনা মা, অবশ্যই ঈদে জামা কিনে দিবো।’

পেছন থেকে ছেলেটা বলে ওঠে, ‘বাবা আমার জন্যে জামা নিয়া আসবা না?’
‘হুম! বাবা তোমার জন্যেও নিয়ে আসবো।’

কি মজা কি মজা, বাবা নতুন জামা নিয়ে আসবে… বলে দু’টো ছেলে মেয়ে খুশিতে লাফাতে শুরু করে।

আবুল করিমের কাছে এখন যেনো একটাই স্বপ্ন, ছেলে মেয়ের নতুন জামা। কিন্তু কারো কাছে চাইতে তার লজ্জা লাগে।বিক্রি করার মতোও কিছু নেই, যা বিক্রি করে জামা কিনে নিয়ে আসবে। চোখে মুখে অন্ধকার নেমে আসে তার।

মাথাটা নিচু করে বউ’র সামনে বলে, ‘কি যে করি এখন? জিনিস পত্রেরও এখন যে দাম, পেট চালানোটাই দায় হয়ে ওঠছে। এই দেশে রমজান মাস এলেই এক শ্রেণীর লোকেরা ধান্দাবাজির ব্যবসা খুলে অসহায় মানুষের রক্ত চুষে খায়! দেড়শো টাকার মুরগী হয়ে যায় তিনশো টাকা! বিশ টাকার বেগুন আশি টাকা, বিশ টাকার শশা আশি টাকা! এই দুর্মূল্যের বাজারে ইফতারিতেও তো মুড়ি ছাড়া আর কিছুর ব্যবস্থা করতে পারিনা!’

আবুল করিমের স্ত্রী রোকেয়ার কিছু বলার নেই। কোনো বুদ্ধিও দিতে পারেনা। ছেলে মেয়েদের জামা কেনার কথা তার কাছে তেমন প্রয়োজনীয় মনে হয়নি। তাই কিছু না বলেই ঘরে থেকে বের হয়ে চলে গেলো।
উঠোনে বসে বাচ্চা দু’টো। ঈদে নতুন জামা নিয়ে আসবে বাবা, ঈদের দিন সকালে গায়ে দিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াবে। কতো কথা বলছে দু’ভাই বোনে।
রোকেয়া আবার স্বামীর কাছে আসে। খেয়াল করে আবুল করিমের চোখে জল ছলছল করছে।
রোকেয়া হাতে বিছানাটা গুছিয়ে নিতে নিতে বললেো, ‘বেলা পড়েছে, নতুন জামার কথা বাদ দেন। আমি বাচ্চা দু’টোকে ঠিক বুঝিয়ে দিবো। আপনি কাজে বের হোন। জামা কাপড়ে নিয়ে কোনো চিন্তা করা লাগবে না।’

আবুল করিমের নির্ভার জবাব, ‘দেখো বউ, ছেলে মেয়ে দু’টো ছোট মানুষ। এই বয়সে ঈদের দিনে তো নতুন জামা কাপড় পড়তে চাইবেই। আর আমি কি হতভাগ্য বাবা ছেলে মেয়ের চাহিদা পুরণ করতে পারিনা। আজ ভাগ্য কোথায়?’ বলতে বলতে তার চোখে জল আসে। আর কিছু বলতে পারেনা, কাজে বের হয়ে যান।

আগামীকাল ঈদ। বাচ্চা দু’টো মাকে বলে, ‘মা বাবা কি নতুন জামা নিয়ে আসবে?’
রাত হয়েগেছে অনেক। এতোক্ষণে তো এসে পড়ার কথা। এতো দেরি তো কোনোদিন করেনি! রোকেয়ার মনে হালকা চিন্তা ঢুকে গেলো! ছেলে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘মা, বাবা কি নতুন জামা নিয়ে আসবে?’
মা জানে নতুন জামা নিয়ে আসার মতো কোনো অবস্থা নেই। তবুও স্বান্তনা দেয়, ‘হ্যাঁ, আনবে তো।’
মেয়েটা মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মা আমার নতুন জামার রঙ কি হবে?’

ছেলেটা বোনকে বলে তোর জামার থেকে, আমার জামা ভালো হবে। মেয়েটা বলে, ‘না না আমারটা ভালো হবে।’
মা হঠাৎ হুংকার দিয়ে বলে, ‘তোরা কি থামবি! নতুন জামা আনলে দুইজনেরটাই ভালো হবে। এখন ঘুমিয়ে পড় তোরা। না হলে নতুন জামা হবে না!’
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ভাই বলে, ‘মা বলছে ঘুমিয়ে পড়তে, না ঘুমালে নতুন জামা হবেনা, চল বোন ঘুমাই।’
ঠিক ওরা ভাই বোন ঘুমিয়ে যায়।

রাত বাড়তে থাকে। রাত পেরিয়ে এক সময় সকাল হয়। সহসা আবুল করিমের ফেরার শব্দে ঘর খুলে বেড়িয়ে আসে তার স্ত্রী রোকেয়া। স্বামীর হাতে নতুন শাড়ি, ছেলে মেয়েদের নতুন জামা আর ব্যাগে কিছু বাজার দেখে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বলে ‘কোথা থেকে আনলে এসব?’
আবুল করিম বলে, ‘অনেক ঘুরাঘুরি করে কোনও টাকা পয়সা জোগাড় করতে পারছিলাম না, মহাজনের কাছে ধার চেয়েও একটা কানাকড়িও না পেয়ে হতাশ হয়ে কি করবো কোথায় যাবো বুঝে ওঠতে পারছিলাম না। দ্বিকবিদিক হাটছিলাম। শেষ রাতে ফজরের আজান শুনে মসজিদে নামাজ আদায় করে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করছিলাম। মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় হঠাৎ পেছন থেকে এক ভদ্রলোক ডাক দেন। এক রকম জোর করেই আমাকে অনেকগুলো টাকা ধরিয়ে দিয়ে বউ বাচ্চাদের নতুন কাপড় কিনে দিয়ে ঈদ উদযাপনের অনুরোধ করেন। আমি প্রথমে নিতে চাইনি। পরে উনি জোর করে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য আমি আল্লাহর এক বান্দা হয়ে আরেক বান্দার জন্যে এইটুকু সাহায্য করছি অনুগ্রহ করে ফিরিয়ে দিবেন না। আর আমি যা কিছু দান করি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে, কোনও এ্যাডভ্যাটাইজের উদ্দেশ্যে নয়। ডান হাতে দান করলে বাম হাতও যেনো না জানতে পারে এমন দানই আমি সমর্থন করি। এ্যাডভ্যাটাইজ বা প্রচার করা দানকে অন্তর থেকে ধিক্কার জানাই। আমি আল্লাহর এক বান্দা হয়ে আরেক বান্দার সামান্য দুঃখ লাঘবের উদ্দেশ্যে একটুখানি সহযোগিতা করছি, অনুগ্রহ করে গ্রহণ করুন।’
একটুক্ষণ পরে সে আবার বলে, ‘উনার দেয়া টাকা থেকেই বাচ্চাদের জামা, তোমার শাড়ি আর কিছু বাজার করে এনেছি।’
আবুল করিমের চোখ ততক্ষণে জলে টলমল করছে। এই অশ্রু দানশীল লোকটির প্রতি দোয়ার অশ্রু, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার অশ্রু।
রোকেয়া বলে, ‘দুনিয়ায় ভালো মানুষ এখনও আছে বলে দুনিয়াটা টিকে আছে, আল্লাহ উনাদের ভালো রাখুন।’

আবুল করিমের মতো মানুষ আমাদের চারপাশে বসবাস করে। যারা হয়তো কারও কাছে চাইতেও পারেনা কিন্তু অর্থ কড়ির চরম অভাবে ভুগতে থাকে। আসুন, ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই৷ আনন্দ ভাগাভাগি করে নিই ওদের সঙ্গে৷ সামর্থ অনুযায়ী হাসি ফোঁটাই ওদের দুঃখ, বিধ্বস্থ মুখে৷ প্রকৃত সুখ তো ভোগে নয়, ত্যাগে৷ ইসলামতো নিজ স্বার্থে মত্ত বা ভোগ বিলাসিতা, রঙ তামাশার ধর্ম নয়, ত্যাগের ধর্ম। শান্তির ধর্ম। ত্যাগের মহিমায় আলোকোজ্জ্বল হয়ে জেগে ওঠুক আমাদের ঘুমন্ত অন্ধকার সমাজ।

রুদ্র অয়ন। কবি।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ