ঈর্ষা

অনুরাধা পল
গল্প
ঈর্ষা

বিদিশার আঙ্গুলে কাঁটাগুলো ফুটছিল। কিন্তু সেটা নিয়ে ভাবার সময় তার হল না। সে তাড়াতাড়ি মাথাটা একবার ওপর নিচে করে লাজে রাঙা মুখখানা নামিয়ে নিল। গোলাপটা তো ভারি সুন্দর।

অনেক দিনের স্বপ্ন আজ তার পূরণ হল। সে মন প্রাণ দিয়ে যাকে চায় – শহরের নামকরা আর্টিস্ট – তাকে প্রপোজ করেছে। বিয়ের জন্যে। লম্বা, ছিপছিপে চেহারার অর্জুন সেনের পেছনে মহিলারা ছিনে জোঁকের মত পড়ে থাকে। তার ওপর আবার তার সেই ঢুলু ঢুলু চোখে তাকানো আর ঠোঁটের কোণে বুক ধড়ফড়ানি হাসি। মেয়েদেরই বা পাগল না হয়ে দোষ কী ! কিন্তু বিদিশাকে যেটা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল সেটা হচ্ছে তার লম্বা সরু নিখুঁত আঙ্গুলগুলো, যার ডগায় পরিপাটি করে সাজানো এক ফালি চাঁদের মত নখগুলো দেখলে বিদিশার মনে পড়ে যেত প্রজাপতিদের ফিনফিনে পাতলা ও স্বচ্ছ ডানার কথা। ওই আঙ্গুলগুলোই তো অর্জুনের জাদুর ছড়ি। একবার ছেনি হাতুড়ি পেলে মনে হত যেন আস্ত একটা ম্যাজিক শো দেখছে বিদিশা- যেন কোন মন্ত্রবলে অর্জুন গড়ে তুলছে মাটির অবয়ব, পাথর চিরে বেরিয়ে আসছে মানুষ ও প্রকৃতি, তুলির টানে তারা পাচ্ছে নতুন প্রাণ। যেমন সে প্রাণ পায়ে- তার আলতো হাতের ছোঁয়ায়।

তার ছেলেবেলার মনের ভিতর লুকোনো রূপকথাগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে অর্জুনের মায়ার বশে। কিন্তু যেভাবে সব রাজকন্যারা এক দিন সংসারী হয়ে পড়ে , বিদিশাও কালক্রমে সেই সংসারের জাঁতাকলে হারিয়ে গেল- তার সেই রূপকথাও হারিয়ে গেল স্মৃতির অন্ধকুপে- এবং সময়ের অবিশ্রান্ত পরিহাস জন্ম দিল এক নতুন বিদিশার- নিষ্ঠুর ও ঈর্ষান্বিত এক স্ত্রীর। যৌবনের ভাললাগার বদলে দেখা দিতে লাগলো চাহিদার তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা। নাম আর যশ বেশিদিন থাকেনা- তাই অর্জুনও মিলিয়ে যেতে লাগল লোকচক্ষু থেকে- তার মনকাড়া কাজগুলো বড়ই একঘেয়ে হয়ে উঠল প্রশংসকদের। যে শিল্পকে ভালবেসে বিদিশা স্বপ্নের মহল বানিয়েছিল- সেটাই হয়ে উঠল তার চক্ষুশূল।

রাত দিন অর্জুন অভিশাপ এর প্রধান কারিগর হয়ে উঠল। অবস্থার অবনতির সাথে সাথে পয়সার অভাব কুরে কুরে খায় বিদিশাকে। বাড়ির সমস্ত কাজই তাকে করতে হয়। উনি আবার তার আর্টিস্টের হাতে রান্না করতে বা বাসন ধুতে পারেন না। যত দিন যায় অর্জুনকে দেখলে গা জ্বলতে থাকে বিদিশার। “অকম্মার ঢেঁকি- শিল্প মাড়িয়ে দুখানা পাঁঠার মাংস এনে দেখাও তো! আমার ইচ্ছার কোন দাম নেই তাই না? ডাল আর শাকভাজা খেয়ে খেয়ে মুখে চড়া পড়ে গেল। আর পারিনা বাপু তোমার সংসারের শিল্প টানতে। ভেবেছিলাম কিছু না হোক বছরে একবার একটু কোথাও ঘুরতে যাব- তা আর কপালে জুটল কই? গরুর মত খাটো আর ডাল ভাত আলুভাতে গেলো!“

বিদিশারও বা দোষ কোথায়ে? পাড়াপড়শির হাসাহাসি আর দয়াদাক্ষিণ্যের কথা শুনতে শুনতে আর ভাল লাগে না। ওই তো রিতা সেদিন কতই না হেসে হেসে দুটো ইলিশ মাছভাজা দিয়ে গেল আর তার পরের দিনই দত্ত বৌদি বলে গেল যে রিতা নাকি কি ছিছি না করছিল বিদিশার ঘরদোরের- “বাবা ভাগ্যিস অর্জুনকে বিয়ে করিনি- কী অবস্থাটাই না হত আমার দিদি! ওরকম পাগল বেকার স্বামী নিয়ে আমি বাবা ঘর করতে পারতাম না। অথচ বিদিশার বিয়ের দিন আমি কী কান্নাটাই না কেঁদেছিলাম-হে হে।“

ঘটনাটা ঘটল এক শ্রাবণের রাতে। অনেকদিন ধরেই বিদিশার মনে কালবৈশাখীর খেলা চলছিল। মাঝে মাঝেই সেটা আছড়ে পড়ছিল অর্জুনের শান্ত মরমে-মরে থাকা মনে। মুখ বুজে সব সহ্য করেও সে বিদিশার আহত দগ্ধ অভিমানের ধকল কমাতে পারে নি। কিন্তু চণ্ডাল রাগে যখন বিদিশা তার সৃষ্ট কাজগুলো কে আগুন ধরিয়ে দিল তখন আর সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না। বিদিশা তখন নিষ্ঠুর আনন্দে উন্মাদিনীর মত হাসছে। সম্বিৎ ফিরল যখন সে স্টুডিওর দরজার দিকে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। কী একটা বিপুল শক্তিতে আর্টিস্ট অর্জুন সেন তার পথ আটকে দাঁড়িয়েছে। তার সেই ঢুলু ঢুলু চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকম শান্ত। কিছু বোঝবার আগেই বিদিশা অনুভব করল কী একটা যেন মজবুত আঁকশির মত তার গলায় চেপে বসেছে- হাত দিতে মনে হল কটা প্রজাপতির ডানার মত পাতলা ফিনফিনে সূক্ষ্ম আঙ্গুল। সূক্ষ্ম কিন্তু দৃঢ়- প্রজাপতির ডানাগুলো যেন কেমন মন্ত্রবলে ধীরে ধীরে অক্টোপাসের শুঁড়ের মত তার গলা জড়িয়ে ধরছে- সে আর নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, চোখটাও ঝাপসা হয়ে আসছে। এটাই- এটাই তো সে চেয়েছিল- পুরনো অর্জুন সেনের সেই জাদু দেখতে- যে মায়ার বশে এসে সে স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল- আজ আবার একবার সেই ম্যাজিক দেখার সুযোগ সে পেয়েছে- শুধু এবার প্রাণের বদলে সে দেখছে মৃত্যুর খেলা। কার একটা বাড়ির দেয়ালঘড়িতে ঢং করে একটা বাজলো- বিদিশার মুখে আর কোন রাগ, ঘৃণা নেই – সে হাসছে। অর্জুনের যখন মতি ফিরল, তখন তার হাতখানা কাঁপছে থর থর করে- সে আর পারল না-এক ঝটকায়ে হাতটা সরিয়ে নিতেই , বিদিশার স্পন্দনহীন শরীরখানা জড়িয়ে ধরল তাকে।

অনুরাধা পল। জন্ম: ১৮ই মার্চ ১৯৯৩, কলকাতা, ভারত। শিক্ষা: বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৬ সালে ইংরাজি সাহিত্যে এম এ (গোল্ডমেডালিস্ট), ২০১৪ সালে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ারস কলেজ থেকে ইংরিজিতে অনার্স। চাইনিজ ( ম্যান্ডারিন) ও ডয়েচ (জার্মান) ভাষায় উচ্চতর শিক্ষা। ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরির কাজে সার্টিফিকেট এবং...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..