যে পথে যেতে হবে
স্কোয়াড সাবধান। এক। বায়ে মুড়। এক। স্কোয়াড আগে বাড়ে গা আগে বাড়। এক দো এক।…..
ঈশানী নদীর পাড়ে জনপতি গ্রাম।হারুদাদু বলেন,এই গ্রামে পাঁচশো বছর আগে এক রাজা এসে বড় অট্টালিকা করেছিলেন এক সুন্দরীকে ভালোবেসে।সেইসব আর নাই।কালের প্রবাহে ভেসে গেছে।গ্রামে দুইশত পরিবারের বাস।বেশিরভাগই মাটির বাড়ি।সন্তুদেরও মাটির বাড়ি।
সন্তু ছোটো থেকেই মায়ের নেওটা। মা ছাড়া সে কিছু বোঝে না,চেনে না। ফলে মায়ের স্নেহছায়া একটু বেশি পেতো সে। মা জানতেন এই ছেলে আমার অবর্তমানে অন্য ছেলেমেয়েদের দেখবে। সন্তুর বাবা ছিলেন সরকারী কর্মচারী। তিন ছেলে আর দুই মেয়েকে পড়াশোনা শেখাতে সমস্ত ব্যবস্থা করেচেন। খাওয়া পরার কোনো অসুবিধা নেই। বেশ চলছিলো বটগাছের ছায়ায় সাতটি জীবন। কিন্তু মহাকালের বিচার মানতেই হবে। হঠাৎ মারা গেলেন সন্তুর বাবা।
তখন সন্তুর বয়স একুশ। মেট্রিক পাশ করে আই,টি,আই এ ভর্তি হয়েছিলো। কিন্তু অর্ধপথে পড়া থেমে গেলো। সংসারের সমস্ত দায়ীত্ব কাঁধে তুলে নিলো সন্তু। বাবার চাকরীটা সরকার বাহাদুর দিলেন সন্তুকে। এবার ভাই, বোনদের পড়াশোনা, মাকে যত্ন করা সব অই সন্তুর সামান্য মাইনের টাকায়। নতুন চাকরী তাই মাইনে কম। ট্রান্সফারেবল্ জব। আজ হাওড়া তো কাল শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি থাকাকালীন ছুটির দিনে ঘুরতো সন্তু একা। একবার দার্জিলিং গিয়েছিলো। পাহাড় তাকে ডাকতো। ভালোবাসা
ধরে রাখতো সবুজ প্রকৃতি। সে সমতলের ছেলে। আর পাহাড়ি ছবি তার মনে শান্তি আনতো। মন খারাপ হলেই পাহাড়ের ডাকে বেরিয়ে পরতো বারে বারে।
একরাতে বাসা বাড়িতে খাবার নেই। মাইনের টাকা গ্রামে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সামান্য কটা টাকা আছে। সন্তু জানে মাস চালাতে হবে। রাত বেশি হওয়ায় দোকানগুলো বন্ধ। একগ্লাস জল ঢকঢক করে পান করলো। অমৃতের স্বাদ। কিন্তু পোড়া পেট মানে না বারণ। চুঁই চুঁই করছে। তবু লেপ মুরি দিয়ে শুয়ে পরলো। গুরুর জপ শেষ করে ঘুমোয় সন্তু। জপ করার সময় শুনতে পেলো ঠক ঠক আওয়াজ। তাড়াতাড়ি জপ শেষ করে বললো,কে?
-আমি, দরজাটা খুলুন।
-জগতে সবাই তো আমি। নাম বলুন।
-আমি পাপিয়া,
-এত রাতে
-আরে খুলুন না ছাই।
দরজা খুলে দেখলো বাড়িওয়ালার সুন্দরী অষ্টাদশী মেয়েটা। হাতে একটা থালা। বললো,আজকে আমাদের সত্যনারায়ণ পুজো ছিলো মা তাই প্রসাদ পাঠালেন। খেয়ে জল খাবেন। প্রসাদ খেয়ে জল খেতে হয়।
সেই প্রসাদ খেয়ে সন্তু ঘুমিয়েছিলো।
বাড়িওয়ালার মেয়ে পাপিয়া দেখতো, সন্তু সকালে বেরিয়ে যায় আর রাতে ঢোকে। তার মানে হোটেলে খায়। কোনোদিন বেশি কথা বলে না। শুধু বলে,ভালো আছেন। আর ভাড়া দিতে এলে বলে,বাবা আছে। পাপিয়া মা আর বাবাকে বললো,আমি সন্তুদার কাছে ইংরাজীটা দেখিয়ে নেবো। বাবা খুব কিপটে। বিনা পয়সায় পড়ানোতে আপত্তি নেই। মা বললেন,ছেলেটা ভালো।যাবি প্রয়োজন হলে।
রাতে সন্তু এলে পাপিয়া বই নিয়ে ওর ঘরে গেলো। লুঙ্গি পরে তক্তায় সন্তু বসেছিলো। সন্তু বললো,কিছু বলবে।
-হূঁ,একটু ইংরাজীটা দেখিয়ে দেবেন?
-কই দেখি, আমি পড়তে ভালোবাসি।
-আর পড়াতে
-দুজনে আলোচনা করবো। ইংলিশ আ মার বেস্ট সাবজেক্ট ছিলো।
-তাই,তাহলে ভালোই হলো।
সন্তু দেখছে পাপিয়ার পড়াশোনায় মন নাই। শুধু কথা বলছে। বলছে,আপনি এত অগোছালো কেন?
তারপর সন্তু দেখলো পাপিয়া সব কিছু গোছাতে শুরু করেছে।
সন্তু বললো,তুমি বড়লোকের একমাত্র কন্যা
আমার কাজ করবে কেন?
-আমি এসব দেখতে পারি না। আপনি চুপ করে বসুন। আর আমি একবার করে আপনার কাছে গল্প করতে আসবো। তাড়িয়ে দেবেন না তো?
-না,না আমিও তো একাই থাকি। কথা বলার সঙ্গি পাবো।
-বাবাকে বলবেন,আমি খুব পড়ি।
-মিথ্যা বলতে নেই। যা বলার তুমি বলবে। আমি কিছু বলবো না।
-ঠিক আছে, আপনি ক্যাবলার মতো এসব বলবেন না।
-আমি এসব ভালোবাসি না।
সন্তু ভাবে মেয়েটা কি চায়? আমার মাথার ওপর বড়ো সংসারের দায়ীত্ব। আমাকে সাবধানে চলতে হবে।
পুজোর ছুটিতে সন্তু বাড়ি এসেছে। মায়ের জন্য সাদা তাঁতের শাড়ি। দুই ভায়ের জন্য জামা,প্যান্ট একই কালারের। বোনেদের চুড়িদার এনেছে। বাড়িতে দুর্গাপুজোর পালা। আগের দিন রাত থেকে সব্জি বনানো,কুটনো কাটা শুরু হলো। অনেক লোকজন বাড়িতে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা। বড়ো বড়ো গামলায় রেখে সব্জি সব উঠোনে নামানো হলো। কাল সকালবেলা রান্না হবে। সন্তু কে ওর মা বলে,এবার বিয়ে করে নিবি। আমি দোনাগ্রামে মেয়ে দেখে রেখেছি। কথাও বলেছি। মায়ের কথা ফেলতে পারে না সন্তু। সে সম্মতি দিলো। তা না হলে মা দুঃখ পাবেন।
পুজোর ছুটি ফুরিয়ে গেলে সন্তু ফিরে এলো শিলিগুড়ি। এসেই দেখলো,পাপিয়া হাতে একটা চিঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সন্তু বললো,কি এটা।
-পুজোতে তোমার জন্য লিখেছি।
-থাক,তোমার কাছে থাক। আমার আবার ট্রান্সফারের অর্ডার এসেছে। কাল মোবাইলে মেসেজ পেয়েছি। আজকে নোটিশ পাবো অফিসে।
-কিন্তু আমি যে অনেক কিছু দিয়েছি তোমাকে। আমার মন,প্রাণ সবকিছু।
সন্তু দরজা খোলামাত্র পাপিয়া জড়িয়ে ধরলো তাকে। চোখের জলে তার জামা ভিজিয়ে দিলো। আর সন্তু তো কাঁদতে পারছে না। পাপিয়ার জন্য তার মন পাপিয়া কতবার যে ডাক দিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নাই। সন্তুর বাসা বাড়ির টালির চাল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো, চাঁদ আজ ঢেকে গেছে অন্ধকারে।
( দুই)
সংসারে কর্তব্য করে যায় এক জাতীয় মানুষ। তারা নিজের আবেগ,ভালোবাসা বিসর্জন দেয় সকলের জন্য। আর এক জাতীয় মানুষ তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার ক’রে দূরে ছুঁড়ে ফেলে। সন্তু এবার বাড়ির কাছে চলে এলো। খেয়ে বাড়ি থেকে বেরোয় সকাল দশটায়।
মা খুব খুশি সন্তুর। বিয়েতে ভালো পাওনা। চাকরী পাওয়া ছেলে। কুড়ি ভরি সোনা।
সন্তুর বিয়েতে কলিগরা সবাই এসেছে। মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ফোনে পাপিয়ার গলা। বলছে,বজ আমার বিয়ে সন্তুদা। তুমি ভালো থেকো। সন্তু ফোনটা কেটে দিলো। কেউ শুনতে পেলে অসুবিধা হবে। মনকে শক্ত বেড়ি পরিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসলো। বিয়ে হয়ে গেলো। শেষ রাতে অর্ধেক চাঁদের আলোয় সন্তু পাপিয়াকে দেখলো বাগানের মধ্যে। স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেলো। আজ বিয়ের পরদিন। কালরাত্রি। বৌয়ের মুখ দেখতে নেই।
ফুলের শয্যায় কাঁটা। বৌ জয়ার শরীর খারাপ। সন্তুর বন্ধুরা পরের দিন বললো,নতুন অভিজ্ঞতা কেমন হলো? সন্তু বললো,ভাগ্য প্রসন্ন নয়। অপেক্ষায় আছি। বন্ধুরা হতাশ।
তারপর খাড়া বড়ি থোর,থোর বড়ি খাড়া। মামূলী জীবন। চাকরী। দিন কাবার। রাত। ভোর।রান্না।চান।জপ।খাওয়া।সাইকেল। অফিস।
মা বললেন,বোনেদের বিয়ের ব্যবস্থা করেছি
দুই বোনের একই দিনে বিয়ের ঠিক করেছি। তুমি লোন নাও।বৌমার গহনাগুলো দাও।মায়ের কথা অনুযায়ী সব কিছি হলো। জয়া সব সোনা দিয়ে দিলো। দুটো ননদের বিয়ে হলো।
বড় ভাই লন্ডন চলে গেলো সবাইকে ফেলে। ভালো চাকরী পেয়েছে। ছোটোভাই গ্রামেই একটি মেয়েকে প্রেম করে বিয়ে করলো। ভালো চাকরী পেয়ে কলকাতায় চলে গেলো। সন্তু খুশি। মাও খুশি। মা বললেন,সবাই ভালো থাকলেই ভালো। মা কিন্তু সন্তুর কাছেই থাকলেন। স্বামীর ভিটে তার কাছে স্ব র্গ। আর কোথাও তার ভালো লাগে না।
সন্তুর এখন এক ছেলে ও দুই মেয়ে। মাকে সঙ্গে নিয়ে বেশ সুখেই আছে। কিন্তু সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। রুমকি ও ঝুমকি দুই মেয়ে। রুমকি এখন ক্লাস টেনে পড়ে আর ঝুমকি সেভেনে। দুজনেই এক গৃহশিক্ষ কের কাছে পড়তো। রুমকি সেন্ট আপ হলো। কিন্তু ঝুমকি আ্যনুয়াল পরীক্ষায় ফেল করলো। সন্তু আর জয়া খুব বকাবকি করলো। বললো,সারা বছর পড়বি না, তাহলে ফেল করবি না তো কি? গৃহশিক্ষক বললো,যা, গলায় দড়ি দেগা। ফেল করে বসে আছে। ঝুমকির মন খুব খারাপ হয়ে গেলো। সে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকলো। বাড়ির সবাই জানে কিন্তু কেউ একবারও তাকে ডাকলো না। ঝুমকি ভাবলো,কেউ আমাকে চায় না। ভালোবাসে না। সে শুনতে পেলো কে যেনো বলছে গলায় দড়ি দিয়ে মর। সব ঠিক হয়ে যাবে। কে বলছে? সে ভাবলো ঠিকই বলেছে। আমি খারাপ মেয়ে। গৃহশিক্ষক অজয় আমার যৌনাঙ্গে আঙুল দিয়ে রক্তাক্ত করে বলেছিলো। পড়াশোনা তোর হবে না। এইসবই হবে। গলায় দড়ি দেগা। অজয়ের মুখ থেকে মদের গন্ধ পেয়েছিলো। কাউকে বললে, প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছিলো। সেদিন তার দিদি ছিলো না। দিদিকেও হয়তো ভয় দেখিয়েছে।আবার ভাবছে, আমি মরে গেলে ওই মাতালটা আরও অনেক মেয়েকে মারবে। কিন্তু ওর বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই। বাবা, মা পর্যন্ত আমাকে ডাকলো না। আমার খিদে পেয়েছে। একবারও ডাকলো না। ভাবতে ভাবতে তার ওড়নাটা গলায় গিঁট দিলো। খুব লাগছে। তারপর মাটির ঘরের কড়িকাঠে, ওড়নাটা, পেঁচিয়ে নিলো চেয়ারের ওপর উঠে।তারপর চেয়ারটা লাথি দিয়ে সরিয়ে ঝুলে পরলো। তারপর ভাবছে। কেন করলো এই কাজ। খুব ভুল করলো। মা বাবার মুখ মনে পরলো তার।
সন্ধেবেলায় সন্তু এসে জয়াকে বললো,মেয়েটা খেয়েছে?ঘর খুলেছে?
জয়া বললো,জানিনা, যাও তুমি দেখো।
ঘরের ফাঁক দিয়ে দেখলো মেয়েটা ঝুলছে। সন্তু ভাবে, এই সময় মা থাকলে ভালো হতো। মা ছোটো ভাইয়ের বাড়ি কেন গেলো?
সন্তুর শরীর কাঁপছে থর থর করে। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না।
জয়া দেখতে এলো স্বামীকে, ধপ করে একটা আওয়াজ শুনে। এসে দেখলো,সন্তু অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। জয়া দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলো মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে, ঝুলছে। বাড়ির আশেপাশে যারা ছিলো তাদের চিৎকার করে ডাকলো জয়া। লোকজন এলো।দরজা ভাঙলো। মৃতদেহ নিয়ে চলে গেলো দাহকাজে।
সন্তু আর জয়া দুবছর রাতে ঘুমোতে পারে নি। একটা অপরাধবোধ তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো। হয়তো তাদের ভুলে মেয়েটা অভিমানে চলে গেলো অকালে। বড়ো মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলো সন্তু।
জয়া ভাবে তার জন্মকালের কথা। মায়ের মুখে শুনেছে,জন্মমাত্রই তাকে মৃত মনে করে বাড়ির লোকজন ফেলে দিয়েছিলো বাঁশতলায়। আঁতুড় ফেলার জায়গায়। বাগ্দীবুড়ি দেখতে পেয়েছিলো জ্যান্ত মেয়েটাকে।হাত, পা নড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিলো কোলে। খবর ছড়িয়ে পরলো গ্রামে। তখন বাড়ির লোক এসে নিয়ে যায় মেয়ে। বাগ্দীবুড়ি নাম রেখেছিলো জয়া। ও তাদের বাড়ি এসে বলেছিলো,ও জীবন জয় করেছে। তাই ওর নাম জয়া। তারপর জয়া বড়ো হলো। কালো মেয়ে আলো রূপ নিয়ে ভরতি হলো স্কুলে। পড়াশোনায় খুব ভালো। অন্যদের থেকে আলাদা। নীরব শিল্পীর মতো তার স্বভাব। সবাই ভালো বলতো তাকে। তারপর কলেজে ভরতি হলো। কিন্তু কলেজে পড়তে পড়তেই তার বিয়ে হলো। তিন সন্তানের জননী হলো। কাজ হলো হাঁড়ি ঠেলা। আত্মীয়স্বজনের কাছে ভালো হবার ব্যর্থ চেষ্টা। কম বয়সে শিখলো অনেক। শক্তি জাগ্রত হলো শরীরে,মনে। সহজ পথে চলা শুরু হলো। তেল মাখানো কথাও বন্ধ হলো। শত্রু বাড়লো। তবু সে বললো,কুছ পরোয়া নেহি।
একটা মেয়ে ইচ্ছে করলে পৃথিবীর সব কঠিন কাজ হাসিমুখে করতে পারে। দশভূজা দুর্গা। স্বামীর অফিসের রান্না,ছেলে মেয়েদের স্কুল পাঠানোর পরে বাসনমাজা,কাপড়কাচা ও আরও কত কি? দুপুরবেলা বই নিয়ে বসে ঘুমে ঢুলে পরতো জয়া। আবার কোনো কোনো দিন ভাবনার সাগরে ডুব দিতো অনায়াসে। মনে পরতো কিশোরীবেলার স্কুলের পথে আলপথের ধারে ক্যানেলের জলে রং বেরংয়ের মাছের কথা। গামছা দিয়ে ছেঁকে তুলতো বায়েনবুড়ো কত মাছ। বায়েন বুড়োর কাছে চেয়ে একটা বোতলে ভরে রাখতো জল। আর তাতে সাঁতার কাটতো ছোটো ছোটো তেচোখা মাছ। পুকুরের ধারে বসতো বুড়ি গিন্নির ছাই দিয়ে বাসন মাজা দেখতে। কি ভালো যে লাগতো। মনে হতো দিই বুড়ির বাসন মেজে। কিন্তু সাহস করে বলতে পারে নি কোনোদিন। সন্ধেবেলা সিধুকাকা পড়াতে আসতো। আমরা মেয়েরা সুর করে পড়তাম একসাথে। তারপর খাওয়ার পরে শোওয়ার পালা। ঠাকুমার পাশে শুয়ে শুনতাম পুরোনো দিনের কত গল্প। গল্প শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পরতাম ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে। জয়া এইসব ভাবতো আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামতো ঘাটে। স্বামী,ছেলে,মেয়েরা চলে আসতো জয়ার স্বপ্ন নীড়ে। আবার শুরু হতো সংসারের ঘানিটানা কলুর বলদের মতো। দুঃখ,সুখের অপূর্ব মিশ্রণে বয়স কাঁটা এগিয়ে চলে টিক টিক শব্দে।
সন্তু মেয়ের বিয়ে দিলো। তারপর গ্রাম ছেড়ে চলে এলো কোয়ার্টারে। গ্রামের বাড়িতে সবখানে ভেসে উঠতো মৃত মেয়ের মুখ। তাই এই সিদ্ধান্ত। কোয়ার্টারে সন্তুর মন হাঁপিয়ে উঠতো। অফিসে ছুটি পেলেই চলে যেতো মেয়ের শ্বশুর বাড়ি। সেখানে বড়ো মেয়ের মুখ দেখে ভুলে যেতো মৃত মেয়ের মুখ। আর দুই মেয়ের মুখের আদলে দুবছর পরে ঘর আলো করে এলো নাতি। মেয়ের পুত্রসন্তানের মুখ দেখে সন্তু ও জয়া ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে লাগলো।
নাতি ও মেয়ে এসে দুমাস, তিনমাস করে থাকতো কোয়ার্টারে। এবার মন শক্ত করে সন্তু ফিরে এলো গ্রামের বাড়িতে। কোয়ার্টারে তার মন ভারী হয়ে যেতো। নিজেকে হারিয়ে ফেলতো বারে বারে। এবার গ্রামে এসে পুরোনো বন্ধুদের মাঝে সন্তু জীবন খুঁজে পেলো। সব কিছু স্বাভাবিক হলো।
(তিন)
সন্তু কাজ করতো বি,ডি,ও অফিসে। এই অফিস থেকেই গ্রামের গরীব মানুষরা সরকারী সাহায্য পেয়ে থাকে। তার প্রধান দায়ীত্বে ছিলো সন্তু। গ্রামে গ্রামে গিয়ে লিষ্ট করতো সে। গ্রামের লোকেরা খুব ভালোবাসতো সন্তুকে। কোনোদিন অন্যায়ভাবে কারও কাছে টাকা পয়সা ঘুষ নিতো না সন্তু। একবার রঘু ডাকাত বললো,আমার বাড়ি মিষ্টি, জল খান কেনে। আমি খুশি হবো। সন্তু বললো,আমাকে এক গ্লাস জল দাও। আর কিছু খাবো না। আমি এখন সরকারী কাজ করছি। এর জন্য আমি মাইনে পাই। জামাইমারি গ্রামে একবার সন্তু কাজে গেছিলো। ফিরতে রাত হয়ল গেলো। রাস্তায় দেখলো,অন্ধকারে ঝিনুকঘাটা পুলের তলায় একদল সশস্ত্র লোক। ওরা ডাকাত। কারও হাতে খাঁড়া,কারও হাতে বল্লম, কারও হাতে তীরধনুক। একজন এসে বললো,আংটি কই? সোনার চেনটাও দে। সন্তু বললো,দি,এই নাও। ওদের মাঝে রঘু ছিলো খাঁড়া হাতে। ও এগিয়ে এসে বললো,আরে ঠাকুর মশাই। আপনি। যান, যান কোনো ভয় নাই। দলের লোকদের উদ্দেশ্য করে বললো,তোরা লোক চিনিস না। আমাদের ব্লকের বড়বাবু।
সবাই জোড় হাত করে বললো,মাপ করবেন,আমরা বুজতে পারি লাই গো ঠাকুর মশাই। মদ খেয়ে আচি তো। যান, যান। কুনু ডর লাই। মজা করে হাঁটেন। কুথাও দাড়াবেন নি।
সন্তুর ধড়ে প্রাণ এলো। ঝিনুক ঘাটা পার হয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এলো। বাড়িতে এসে জল খেয়ে বাঁচলো।
সন্তু মায়ের কাছে শিক্ষা পেয়েছে সততার। তার জন্য আজ সে বেঁচে গেলো। মনে পরছে সন্তুর মায়ের কথা। সে আপন মনেই বলে চলেছে তার মায়ের কথা। মা রক্ষাকালীর পুজো দিতে দিতে গেয়ে উঠতেন ভক্তিগীত। নিরামিষ মা কালীর আশীর্বাদ মাথায় রেখে ছেলেদের নিয়ে সংসার চালাতেন ছন্দে। অভাব থাকলেও কোনোদিন তার ছাপ পরেনি মায়ের চোখেমুখে। আসল মূল্যবান রত্নের সন্ধান তিনি পেয়ে গেছিলেন পুজোর আসনে বসে। কোনোদিন তার কথায় প্রকাশ পেতো না সেসব কথা। তার চলনে, বলনে ফুটে উঠতো মাতৃরূপের জলছবি। মাকে দেখেই মাথা নত হয়ে যেতো সকলের। দাদু মাকে, মা বলেই ডাকতেন। তিনি সময়ে অসময়ে মাকে রামপ্রসাদী শোনাতে বলতেন। মায়ের গান শুনতে শুনতে একদিন চলে গেলেন পরপারে তৃপ্ত মুখে। একবার বৈশাখি ঝড়ে আম গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়লো। মা বললেন,তোদের দাদুর আত্মা মুক্তি পেলো। অই ডালে বাঁধা ছিলো দাদুর মুক্ত হবার লাল চেলি। অবশ্য এটা ছিলো এক সাধুবাবার তুকতাক। বুড়ি ঠাকুমা সেদিন কেঁদে উঠেছিলো জোরে। ঠাকুমা বলে উঠলেন,চলে গেলো,ও চলে গেলো। কোনো কিছুই আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। তবু কিছু ঘটনা বার বার তার অস্ত্বিত্বের কথা স্বীকার করে নেয়। একটা দেশি কুকুর আমাদের বাড়িতে থাকতো ছোটে থেকে। তোমরা বিশ্বাস করবে কি না জানি না? সে অমাবস্যা,পূর্ণিমায় কিছু খেতো না। রক্ষাকালী পুজোয় উপবাস করতো। তার সামনে খাবার দিয়ে দেখা গেছে সে খাবারের ধারের কাছে যেতো না। শুধু কথা বলতে পারতো না। কিন্তু ভাবে, ভঙ্গিমায় সব বেঝাতে পারতো মানুষের মতো। মা বলতেন,পূর্বজন্মে তোর সঙ্গে কোনো আত্মীয়তা নিশ্চয় ছিলো। তাই তোর আমাদের বাড়িতে আগমণ। যেদিন জিম দেহ রেখেছিলো সেদিন ওকে মাটি চাপা দিয়ে ধূপ আর ফুলে শেষ বিদায় জানিয়েছিলো সারা পাড়ার বাসীন্দা। তাহলে কি বলবে তুমি এই ঘটনাকে। কোন যুক্তিতে অস্বীকার করবে তার সারা জীবন ধরে পালন করা ব্রত,উপবাস। বলবে,কাকতালীয়। সেসব তো এক আধবার হয়। সারাজীবন ধরে নিয়মিত হয় না।
বিজয়ার সময় আমার মা জিমকে প্রথম মিষ্টিমুখ করাতেন। ধান রাখার গোলার তলায় একবার গোখরো সাপ দেখে, ঘেউ ঘেউ শব্দ করে জিম আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিলো সাপটা। তারপর সাপুড়ে ডেকে সাপটি বনে ছেড়ে দেওয়া হয়। বড়দার বিছানার মাথার কাছে সে শুয়ে থাকতো। কোনো বিপদ বুঝলে ঝাঁপিয়ে পরতো নিঃস্বার্থ ভাবে। প্রত্যেক প্রাণীর কাছে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু।
সন্তু ভাবে,মা ছোটো ভাইয়ের কাছে ভালো থাকতো। ভাইরা সবাই ভালো। শুধু আমি হয়তো খারাপ। তাই মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। আর তার দেখা পাবো না। কোন যাদুগর ভ্যানিশ করে কোটি কোটি জীবকে তার আয়ু শেষে। এখন সন্তু চাকরী জীবন থেকে অবসর নিয়েছে। নাতি বড়ো হয়েছে। ছেলের বিয়ে দিয়েছে। নাতনি ঘুরে বেড়ায় বারান্দা জুড়ে। অবসর জীবনে সারা জীবনের ভাবনা এসে জুড়ে যায় হৃদয়ে। তার মনে পরছে বাল্য জীবনের স্মৃতি।
তেঁতুলতলার মাঠে এসে ঢিল মেরে পেরে নিতাম কাঁচা তেঁতুল।
আর হনুমান লাফিয়ে শেষে জলে ঝাঁপ দিলো।
চারদিকে প্রচুর লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। তারা মজা দেখছে আর হাততালি দিচ্ছে।তাল গাছের কামান হতো হেঁসো দিয়ে। মাথার মেথি বার করে কাঠি পুঁতে দিতো তাড়ি ব্যাবসায়ী। আমাদের ভয় দেখাতো, ধুতরা ফুলের বীজ দিয়ে রাকবো। সকালের তালের রস খেলেই মরবে সে। চুরি করা কাকে বলে জানতাম না। একরাতে বাহাদুর বিশুর পাল্লায় পরে রাতেসকালের তালের রস খেতে গেছিলাম। কারণ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তালের রস তাড়িতে পরিণত হয়। মদের মতো নেশা হয়। বিশু বললো, তোরা বসে থাক। কেউএলে বলবি। আমি গাছে উঠে রস পেরে আনি। তারপর গাছে উঠে হাত ডুবিয়ে ধুতরো ফুলের বীজ আছে কিনা দেখতো। পেরে আনতো নিচে। তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে নিতাম আমাদের ঘটিতে। গাছেউঠে আবার হাঁড়ি টাঙিয়ে দিয়ে আসতো বিশু। সন্ধেবেলায় হাড়ি রসে ভরে যেতো। ব্যাবসায়ির কাছে গিয়ে বলতাম, রস দাও। বুক ঢিপঢিপ চাঁদের গর্ত। অবশেষে প্রাপ্তিযোগ। যেদিন রস পেতাম না তখন মাথায় কুবুদ্ধির পোকা নড়তো। তাতে ক্ষতি কারো হতো না। কোনো পাকামি ছিলো না।সহজ সরল হাওয়া ছিলো। ভালোবাসা ছিলো। আনন্দ ছিলো জীবনে। শয়তানের বাপ পর্যন্ত আমাদের সমীহ করে চলতো। কোনোদিন বাল্যকালে আত্মহত্যার খবর শুনিনি। সময় কোথায় তখন ছেলেপিলের। যম পর্যন্ত চিন্তায় পরে যেতো বালকদের আচরণে, কর্ম দক্ষতায়। হাসি,খুশি সহজ সরল জীবন।
ছোটোবেলার কার্তিক পুজো,গণেশ পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো । পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পী কে ।তারপর প্যান্ডেলের জোগাড় । বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল । তার একপাশে বানানো হত আমাদের বসার ঘর । সেই ঘরে থেকেই আমরা ভয় দেখাতাম সুদখোর মহাজনকে।সুদখোর ভূতের ভয়ে চাঁদা দিতো বেশি করে। বলতো, তোরা পাহারা দিবি। তাহলে চাঁদা বেশি দেবো।
আমরা পড়তে যেতাম রেল লাইনের ওপাড়ে।
একদিন স্যার পড়াতে পড়াতে অনেক রাত হয়ে গেছে । প্রায় দশটা । বাড়ি ফিরতে হতো লাইনের পাশ দিয়ে ।
চারজনে ভয়ে ভয়ে লাইনের পাশ দিয়ে হাঁটছি । একটা ট্রেন চলে গেলো বুক কাঁপিয়ে ।
অমাবস্যা র রাতে অন্ধকার হয় শুনেছি । কিন্তু তার থেকেও ঘন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি চারজন ।
হঠাৎ সামনে দেখি গলা থেকে মাথা পর্যন্ত কাটা একটা স্কন্ধ কাটা ভূত ।আমার আর অনুপের হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে ।
ছোটো থেকেই বিশুর সাহস বেশী । আমরা ভয়ে বু বু করছি । এমন সময় দেখলাম অনুপকে কে যেনো ছুঁড়ে পাশের হাই ড্রেনে ফেলে দিলো ।
বিশু দা হাঁক দিয়ে বললেন, কে রে ভয় দেখাচ্ছিস । কিন্তু ভূত কোনো সাড়া না দিয়ে থপাস করে বসে পড়লো ।
রতন দা বললেন, কে তুমি, বসে পড়লে কেনো ?
তারপর লাইনের পাথর কুড়িয়ে যেই না মারতে যাবেন তখন ভূতটা কথা বললো ।
বললো, আমি ভূত নই । আমি মানুষ ।
তারপর আমরা দেখলাম তার আপাদ মস্তক কালো জামা ও প্যান্ট দিয়ে ঢাকা ।
কালো জামার মাঝে সাদা গোল গোল ছাপ । ফলে অন্ধকারে আমরা সাদা ছাপ দেখতে পাচ্ছি কিন্তু আর কিছু দেখা যাচ্ছে না । শুধু দেহ টা ভেসে যাচ্ছে ।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে অনুপকে ছুঁড়ে ফেললো কে ?
জয়া বললো, ভয় পেলে মানুষের আপৎকালীন হরমোন বের হয় । ফলে মানুষ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য লাফিয়ে পড়ে । জয়া পাশের গ্রামের মেয়ে। তাকে আমরা এগিয়ে দিয়ে আসতাম তাদের গ্রামে।
রতনদা বললেন, আর বসে পড়ে লোক টা পেচ্ছাপ করছিলো ।আর আমরা মনে করেছি ভূত বসে পড়েছে ।
অনুপ ততক্ষণে ড্রেনের কাদা মেখে উঠে আসছে ভূত হয়ে ।
বাড়িতে গিয়ে বলার পরে সবাই হেসে ফেলেছেন ।
তারপর ভালো মন্দে কেটে যায় সময়।
অপরের ভালো কাজে বাধা দিয়ে একদল বাঁদরের দল মজা পায়। ভালো কাজ দেখলেই তাদের মাথাব্যথা। তারা সমাজের ভালো দেখতে চায় না। কারণ তাহলে তাদের অসুবিধা। গোলেমালে তাদের অনেক কাজ সহজে হয়। গোলমাল পাকাতেই তাদের পাকামি প্রকট করে আনন্দ পায়। পৃথিবীর পাকে তাদের পাকামি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ভালো কাজ কিন্তু চিরদিন অমরত্ব পেয়ে যায় মানুষের হৃদয়ে।সন্তুর ভাবনার পাশে বসে আছে চিরনবীনের দল।
জয়া দেখে নাতনিকে। আর ভাবে তার ছোটোবেলা ফিরে এসেছে নাতনির রূপ ধরে। এই ভাবেই চিরকাল প্রবাহ চলে জীবনের। সমুদ্রের ঢেউ এর মতো তালে তালে।
(চার)
সন্তু ঈশানী নদীর তীরে পূর্বে জনপতি বলে এক গ্রামের কথা বুড়ো হারুদাদুর কাছে শুনেছে।এক রাজার প্রেম কাহিনী।প্রায় পাঁচ শো বছর আগের কথা।অনেকে বলে আজব কাহিনী।কিন্তু সন্তু জানে ইতিহাস মিথ্যা বলে না।সবাই বসে আছে।দাদু বলে চলেছেন,
জনপতি গ্রামে রাজা এসেছেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কোনো এক দেশের রাজাকে দেখতে আশেপাশের গ্রামের লোক জড়ো হয়েছে। রাজা খুব খুশি। চারিদিকে রাজার জয়ধ্বনি দিচ্ছে সবাই। রাজা অভিবাদন গ্রহণ করছেন হাসিমুখে। অনেকে মাল্যদান করছে। হঠাৎ তার নজর গেলো এক স্বল্পবাস পরিহিতা
নারীর প্রতি। রাজা দেখলেন তার পরনে পোশাক প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ গায়ে দামী স্বর্ণঅলঙ্কার।প্রথমে রাজার ক্রোধ হলো। তারপর এক সেনা কে নির্দেশ দিলেন অই নারীকে সবার আড়ালে আনার জন্য। রাজার আদেশ পালিত হলো। রাজা আড়ালে ডাকলেন রমণীকে,নির্জনে।কারণ লোকলজ্জা বলে একটা কথা আছে। আড়ালে জিজ্ঞাসা করলেন,এই বেশে তুমি রাজাকে দেখতে এসেছো এত লোকের সামনে। তোমার সাহস তো কম নয়। রাজা দেখলেন,রমণী সুন্দরী। স্তনযুগল যেনো আহ্বান করছে তাকে,যৌনক্রিড়ায়। রমণী বললেন,আমার কাছে আজ পর্যন্ত নারী, পুরুষের ভেদ চোখে পরে নাই। তাই নারীর কাছে আর এক নারীর লজ্জা কিসের?আমি যতজন পুরুষের সান্নিধ্যে এসেছি তারা সকলেই নপুংসক সমান।নিতান্তই কাপুরুষ।রাজা বললেন,তুমি নারী হয়ে এত নির্লজ্জ কেন? রাজা বললেন,তোমার নাম? নারী বললো,রতিপ্রিয়া। সে আবার বললো, আপনার স্ত্রীসংখ্যা কতজন রাজন ? রাজা বললেন,চারজন।কেন? রমণী বললেন,আপনি অভয় দিলে, বলি একটা কথা। রাজা বললেন,ভয় নেই। তোমার সাহস দেখে আমি খুশি। তোমার রূপেও আমি মুগ্ধ। চলো জঙ্গলে যাই।সেখানেই কথা বলা যাবে। রাজা প্রহরীদের সংবাদ প্রেরণ করে রতিকে নিয়ে আড়ালে এলেন। জঙ্গলে গিয়ে রমণী বললেন, আপনি আপনার রাণীদের যৌন আনন্দ দিয়ে তৃপ্ত করতে পেরেছেন কি?রাজা বললেন,তোমার ভয় না হলে, পরীক্ষা করে দেখতে পারো সুন্দরী,তবে আমার মনে হয় আমি পুরোপুরি সফল নই। । আমি নিজেকে তোমার নিকট সমর্পণ করছি। তুমি এই যৌনশাস্ত্র পড়েছো, অনুভব করেছো।তাই অন্য রমণীর থেকে তোমার ককাছে প্রত্যাশা আমার ববেশি। তোমার সব দায়ীত্ব আজ থেকে আমার হলো।তোমার সকল আশা পূরণ করবো আমি। রতি বললেন,আমি বহুবল্লভা। শুনুন রাজন আমার প্রেমিক উমাপদর কথা।
উমাপদ একবার আমার প্রেমে পরলেন। এতদিন গীতা,মহাভারত ঘাঁটাঘাঁটি করে ছাপান্ন বছর বয়সে নতুন করে এক সুন্দরী নারীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন উমাপদ। তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে বর্তমান। আবার জাঁহাবাজ স্ত্রীকে থোরাই তোয়াক্কা না করে কোন সাহসে তিনি এ কাজ করলেন।
গল্পটা মনে করুন তার মুখেই শুনছেন রাজন। আমি তার মতোই বর্ণনা করি আপনার সকাশে। আমি উমাপদ পাল। রাজার অন্যতম সেনাপতি। মাইনে নেহাৎ কম নয়। প্রায় ষাট হাজার মুদ্রার কাছাকাছি। তাছাড়া উপরি পাওনা বিশ হাজার মুদ্রার কাছাকাছি।
স্ত্রী বিষ খেয়েছেন। তাকে নিয়ে ছোটাছুটি করলো আত্মীয়স্বজন,পাড়ার লোকজন।প্রায় এক লাখ মুদ্রা খরচ করে তাকে বাঁচিয়ে আনা হলো। তা না হলে কারাগার বাস হত অবধারিত। পাড়ার লোক গালাগালি করলো। আমি সোজা সাপটা ছেলে মেয়েদের এক জায়গায় করে স্ত্রীকে বললাম,তোমার মরার প্রয়োজন নেই। আমার মাইনে ষাট হাজার মুদ্রা প্রতি মাসে। সংসার খরচ বাবদ চল্লিশ আর জমানো বাবদ কুড়ি। মোট ষাট হাজার প্রতি মাসে তুলে দেবো তোমার হাতে। আর বেশি বিরক্ত করলে আমি এ বাড়িতে থাকবো না। আসবো না। আমার থাকার জায়গা আছে। গিন্নি তবু তেড়েমেরে বললো,তুমি সব ভুলে গেলে। অর্থই সব হলো। আমাদের ভালোবাসার কোনো দাম নেই। আমি কি করে বোঝাই, তোমাদের ভালোবাসা নিজেদের স্বার্থের জন্য।
আর আমার ভালোবাসার জন আমাকে ভালোবাসে স্বার্থহীনভাবে। আমার প্রতিটি অনুভবের কথা সে বোঝে। আমার আত্মার উত্তরণ ঘটিয়ে আমাকে উন্নত করে। সমাজের উচিত আমাদের প্রেমকে কুর্নিশ করা। তোমার মগজে এসব কথা ঢুকবে না। তোমরা পৃথিবীতে এসেছো খেতে,শুতে আর হাগতে। তারপর চলে যাবে ভিখারির মত খালি আত্মায়। আর আমরা প্রেমিক যারা তারা মরবো আত্মার পূর্ণ দর্শনে। সেদিন থেকে গিন্নি চুপ করেই আছে। সে বলে,থাক তবু তো কাছে আছে। যা করছে করুক গো। মরুক গো। আবার পরক্ষণেই বলে,হাগো তোমার মনে এই ছিলো। এতদিনের সংসার, আর আমাদের ভুলে গেলে। আমি কি করে বোঝাই,আমি তোমাদের ভুলি নাই। আমি শুধু একটু নিজের আত্মার উন্নয়ন ঘটাতে চাইছি। একটু শরীরের আনাচে কানাচে অতৃপ্ত আশা গুলোকে সাজাতে চাইছি। আমাকে একটু ভাসতে দাও, “আমাকে আমার মত থাকতে দাও”…
আর অন্য কিছু নয়। কদিনের অতিথি আমরা এই পৃথিবীতে। কেউ থাকবো না। তবু যতদিন আছি একটু আনন্দে থাকি। তুমি তোমার আনন্দ খুঁজে নাও,আমি আমার মত থাকি। এইটুকু ত্যাগস্বীকার করো। তুমি,আমি,ছেলে,মেয়ে কেউ কারো নই। বেঁচে থাকা অবস্থায় এটুকু বুঝতে দাও। মরে যাওয়ার পরে সমাজের লোক সবাই বলে,কেউ কারো নয় গো। তবে বেঁচে থাকতে কেনো নয়। এই সত্য কথাটা কেন তুমি অস্বীকার করছো। কাউকে পর ভেবো না। আপনজনও কেউ নয়। শুধু দেওয়া নেওয়ার খেলা থেকে আমাকে দুদন্ড শান্তি দাও। রতি আমার জীবনে যে আনন্দ,রস,জ্ঞান এনেছেন তোমার ক্ষমতা নেই সেই স্তরে ওঠার। আমি দিবা,নিশি রতির প্রেমে আবিষ্ট।
তাহলে রাজন, বলুন কোন আনন্দ পেলে মানুষ বয়স মানে না। আত্মীয়স্বজন মানে না। বেরিয়ে আসে সংসারের শৃঙ্খল থেকে। রাজা বললেন,আমি সব শুনলাম। তুমি আজ থেকে শুধু আমার। আমাকে তোমার উপযুক্ত করে গড়ে তোলো। আমি আবার নতুন করে বাঁচতে চাই আনন্দে। শুধু আনন্দ। আর কিছু নয়।
কিশোরী বয়স থেকেই নরনারীর যৌন বিষয়ে আমি আগ্রহী। আমি কাম বিষয়ে গ্রন্থ লিখবো। আমার দীর্ঘ দিনের আশা। সহজ,সরল করে,সাধারণ লোকের বোঝার মত করে । বাৎসায়নের কামশাস্ত্র, বা আরও প্রাচীন অনেক কামশাস্ত্র থেকে নির্যাসটুকু নিয়ে সহজ সরল ভাষায় নতুন করে লিপিবদ্ধ করবো। আরও অনেক নতুন তথ্য যোগ করবো যাতে সকলে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। আর সেই কাম শাস্ত্রের নাম রাখবো,শরীর এক বাঁশী। এর জন্য আপনার সাহায্য প্রার্থনা করি। অর্থবল,মনোবল সকল কিছুই আপনার কাছে আশা করি পাবো। রাজা বললেন,নিশ্চয় পাবে রতি। রতি বললেন, আচ্ছা আপনি বলুন, আপনি একটিমাত্র স্ত্রীকেও যৌনতৃপ্তি দিতে পেরেছেন কি?রাজা ভাবলেন,এই নারী বিদূষিও বটে। শুধুমাত্র সাধারণ যৌনবিলাসি নয়। তারপর রাজা বললেন,সেভাবে ভাবিনি কোনোদিন।তবে তোমার চিন্তনে,মননে আমি আনন্দিত এবং
আমি সহমত। আমি তেমাকে অবশ্যই সাহায্য করবো। রমণী রতিপ্রিয়া বললেন,আমি জানি চারটি স্ত্রীকে যৌনতৃপ্ত করা, এক ব্যস্ত রাজার পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের একসাথে নিয়ে কোনোদিন ভ্রমণ করেছেন কোনোদিন। অন্দরমহলে বন্দি থাকতে থাকতে তাদের মন প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। তখন তাদের যৌনক্রিয়া এক যান্ত্রিক পদ্ধতি হয়ে ওঠে। আমার প্রাণও এক জায়গায় থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে। ভ্রমণ সফল কামের জন্য একান্ত প্রয়োজন। আমাকে কামতৃপ্ত করতে পারেনি কোনো পুরুষ আজ পর্যন্ত। তাই আমি স্বল্পবাসে থাকি। কাউকে যথার্থ পুরুষ বলে মনে করি না। তাই আমার ভয় নাই। এই দেখুন আমার স্তনযুগল। আপনাকে মিলনের আহ্বান জানায়।প্রাচীন যুগে স্তন অন্য দেহের মতো উন্মুক্ত থাকতো। তখন কোনো আপত্তি ছিলো না সমাজের।তাহলে আজ কেন? রাজা কামে আসক্ত হয়ে পরলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলেন।মনে মনে ভাবলেন,আমি রাজা। সহজে ধরা দিলে হবে না। তাই তো আমি রাজা। রমণী বললেন, আপনি প্রথম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এই স্তনযুগল দেখেই অনেকের রেতঃপাত হয়ে যায়। কাপুরুষের মতো জড়িয়ে ধরে অনেকে। কিন্তু পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারে না। ধর্ষকে ধর্ষণ করে নিজের অভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য।পশুবৎ আচরণ তাদের। শতধিক তাদের। কিন্তু যে স্বামী, স্ত্রীকে অগ্নি স্বাক্ষী রেখে সকল সুখ দেবার পণ করে। সে যদি বাড়িতে এসে ফুলের বিছানায় রতিসুখ না দিতে পারে তবে সে তো ধর্ষেণরই নামান্তর। তাই কোনো পুরুষকে আমি পুরুষ বলি না। রাজা খুব চিন্তিত হলেন। তিনি এ বিষয়ে কথা বলার আগে কয়েকদিন সময় চাইলেন। রতিপ্রিয়া বললেন,আপনি তো চলে যাবেন। রাজা আশ্বাস দিলেন,তোমাকে রতিতৃপ্ত করার আগে,তোমার সমস্ত ইচ্ছা আমি পূরণ করবো। প্রথম দর্শনেই আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। তাই তোমার গ্রন্থ প্রকাশের আগে আমি এ গ্রাম ছাড়বো না। তুমি লেখো নবীন কামশাস্ত্র চিরনবীনের জন্য। তারা যেনো তাদের ক্ষণিকের যৌবনের স্বাদ পায়। মামূলি গন্ডি ছাড়িয়ে যৌনমিলন সফল হোক নারী পুরুষের। আমি তোমার কাছে বন্দি হয়ে থাকতে চাই প্রিয়া। রতি বললেন,তাহলে আপনার রাজপাট কিভাবে চলবে। রাজা বললেন,চলবে, আমি এখান থেকেই সমস্ত দেশ পরিচালনা করবো।আমার লোকবল আছে। সভায় অনেক রত্ন আছে। আমি তোমাকে আমার কাছে রাখতে চাই।তুমি কি রাজী?রতি বললেন, অবশ্যই রাজী। তবে কয়েকদিন সময় আমাকে দিন। রাজা বললেন,তাই হবে। তারপর দুজনেই স্বস্থানে গমণ করলেন। রাজা সেনাপতিকে নির্দেশ দিলেন,এখানে রাজপ্রাসাদ গড়ে তোলো। সমস্ত ব্যবস্থা এই গ্রামে করো। এটি আমার দ্বিতীয় রাজধানী হোক। রাজার নির্দেশে সেখানে গড়ে উঠলো বাজার,হাট,সড়ক,ব্রীজ সবকিছু। কেউ জানলো না, এক রমণীর রমনীয় আকর্ষণে রাজা বাঁধা পরেছেন। সেই রমণীর জন্য এই গ্রাম রাজার দ্বিতীয় রাজধানী হলো। কয়েক দিন পরে রাজা রতিপ্রিয়াকে প্রাসাদে আসতে বললেন।
রতিপ্রিয়া বললেন,আমার গ্রামের সকলে সুখে থাকলে আমি সুখি হবো এবং অপরকে সুখী করতে পারবো। রাজা আশ্বর্য হলেন। যে নারী পরের সুখে সুখী সে গ্রামের দেবীস্বরূপা। তাকে শত চুম্বনে সিক্ত করি। রাজা ভাবেন আর তার প্রধান পরামর্শদাতা ও সর্বশাস্ত্রে পারদর্শী অমিয়ভূষণের পরামর্শ মতো কাজ করেন। অমিয় বলেন,এ রমণীকুলের শ্রেষ্ঠা রমণী। এনাকে সাবধানে বুঝতে হবে। খোলা তলোয়ার আনাড়ির হাতে গেলে কেটে,ছরে গিয়ে রক্তাক্ত হবার ভয় থাকে। তাই হে রাজন সাবধান।
রাজা অই গ্রামের সকলের জন্য সুখ,সুবিধার ব্যবস্থা করলেন। সকলের পাকা বাড়ি হলো। প্রত্যেক পরিবার পিছু দুজনে কাজ পেলো। গ্রামের সমস্ত পুকুরে মাছ চাষ হলো। কৃষিকাজ শুরু হলো আশেপাশের সমস্ত গ্রামে তোড়জোর করে। সকলকে রাজার ভান্ডার থেকে অর্থ সাহায্য করা হলো। কিছুদিনের মধ্যেই এলাকার উন্নয়ন বাড়তে লাগলো।
রতিপ্রিয়া বুঝতে পারলো না কি করে সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেলো। গ্রামের আশেপাশে কোনো অভাবের ছাপ নেই। আজ তার মনের গোপন আশা পূরণ হয়েছে। সে একা তার আপনজনদের অভাব দূর করতে পারতো না। রাজা তার মনোবাসনা পূর্ণ করেছেন। রাজার কাছে সে কৃতজ্ঞ। এবার রাজাকে পরিতৃপ্ত করা তার কাজ। তার আত্মার উন্নয়ন ঘটানোও তার প্রধান কাজ। এ কাজ তাকে করতেই হবে।
সে ছোটো থেকেই পড়াশোনায় আগ্রহী। কিন্তু সমাজ বাধা হয়ে দাঁড়ায়েছিলো। তাই সে লুকিয়ে সব কাজ করতো।বারো বছর বয়সে তার প্রথম গুরুর কাছে শিখতো বিভিন্ন শাস্ত্রের কথা। পড়ানোর সময় তার সদ্য জাগ্রত কুঁড়ি সদৃশ বুকে হাত রাখেন গুরু। তারপর বনের নিভৃতে কচি বয়সে তার উপর বলাৎকার হলো। লৌহশলাকা সম লিঙ্গদন্ডের প্রবেশে ছিন্ন যোনী রক্তাক্ত। তবু এ ঘটনা কাউকে বলেনি, রতি। কারণ তাহলে তার শিক্ষা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। গুরুর কাছে দিনের পর দিন ধর্ষিত তার দেহ,মন। একদিন বিরক্ত হয়ে সে অন্য গুরুর কাছে গেলো। তখন তার বয়স পনেরো বছর। বাড়িতে বাবা নেই। মারা গেছেন।মা বিবাহ দিতে চাইলেন। রতি মাকে বললেন,বিবাহের জন্য জন্ম আমার নয়। আমি পড়বো। মা জানতেন তার অন্তরের সব কথা। কিন্তু সেই মা কে হাসুখালির ডাকাতরা একদিন ধরে নিয়ে গেলো কোথায়,কেউ জানে না। রতিও জানে না। তবু সে ভেঙ্গে পরে নি। মাত্র পনেরো বছর বয়সে রতি অনাথ হলো। কয়েক মাস পরে সে অন্য গুরুর কাছে থাকতো।আশ্রমের কাজ করে দিতো। আর তার বদলে গুরুদেব তাকে খেতে দিতো ও শিক্ষাদান করতো।
সে নতুন গুরুর কাছে গেলো ইচ্ছে করে। পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলো গুরুর কাছে। আরও জানতে হবে তাকে সব গুপ্ত বিষয়ে। এবার রতি গুরুদেবকে সরাসরি বললেন,আমি গুপ্তশাস্ত্র সম্বন্ধে জানতে চাই। আমাকে শিক্ষাদান করুন দয়া করে। বশীকরণ,সম্মোহন,তৃপ্তকাম সমস্ত বিষয় আমাকে শেখান। গুরু বললেন,এই প্রথম আমি কোনো যুবতীর কাছে সোজাসাপটা কথা শুনলাম। এখন তোমার বয়স কুড়ি বছর। গুপ্তবিদ্যা তোমাকে শেখানো যেতে পারে।গুরু মহাখুশি হয়ে তাকে শিক্ষাদানে রাজী হলেন। তখন রতি সুন্দরী। যৌন নির্যাতন বিষয়ে বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা তার আছে। কিন্তু ভালোলাগার সন্ধান এবার পেলো। এবার সে আরও ভালো শিক্ষা পেলো। গুরু যখন বলেন কামশাস্ত্রের কথা তখন তার যোনীদেশ সিক্ত হয়ে ওঠে। রতি চায় গুরু যদি তার যোনীদেশ চোষণ করে তো ভালো হয়। কিন্তু বলে কি করে। যতই হোক গুরু। তখন সে গুরুকে আকর্ষিত করার জন্য গুরুর কাছে শেখা ষোলোকলা অস্ত্রের সাহায্য নিলো। এযে গুরুমারা বিদ্যা। গুরুর একজন বাইশ বছরের পুরুষ ছাত্র আছে। কিন্তু সে তো আনাড়ি,অমনোযোগী। তাকে দিয়ে কাজ হবে না। গুরুর বয়স তিরিশ কি বত্রিশ বছর হবে। তারপর তিনি সুনুরি, অভিজ্ঞ পুরুষ। তাকেই প্রেমের শেকল পরাতে হবে। যথারীতি গুরুর শেখানো বিদ্যায় গুরু শেকল পরলেন।তার প্রেমে বাঁধা পরলেন। একরাতে রতি গুরুর ঘরে ঢুকে তার লিঙ্গ মুখে নিয়ে চুষে উত্থিত করলো।কিছুক্ষণ পরেই গুরু রতির মুখ থেকে লিঙ্গ টেনে বার করে রতির সিক্ত যোনীতে আমূল প্রবিষ্ট করলেন। রতি ভাবলেন,এবার পুরুষ পেয়েছি। শীৎকার ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। গুরু অই অবস্থায় রতির কানের লতি কামড়ে ধরলেন। বুকের কালো বোঁটা কামড়ে আবার ছেড়ে দিলেন। রতি ভাবছে,বড্ড বেশি উত্তজিত হয়ে পরেছেন গুরু। আর কিছুক্ষণ পরেই স্বর্গের আনন্দ পাবো। কিন্তু ভুল ভেঙ্গে গেলো। গুরু বীর্যস্খলন করে বললেন,আমি ব্যর্থ হলাম। পারলাম না। আরও ধৈর্য্যের প্রয়োজন। বাড়াতে হবে ধারণশক্তি। রতি বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন,আপনার শিক্ষা কি তাহলে ব্যর্থ। গুরু বললেন,শিক্ষা ব্যর্থ নয়। আচরণ করা কঠিন। তারপর তোমার মতো সুন্দরী। তোমার মতো নারীর সমকক্ষ পাল্লাদার পুরুষ পাওয়া সহজ নয়। গুরুর কথা আজও সত্য। রতি স্বীকার করে, সে আজও মনের মত বির্যবান পুরুষের সন্ধান পায় নি। ধারণশক্তিধর পুরুষের সংখ্যা নিতান্তই লঘু। নিশ্চয় একদিন তার সন্ধান পাবো।
জনপতি গ্রামের ভোল পাল্টে গেলো এক নারীর আশীর্বাদে। রাজা মনে মনে ভাবছেন,এই নারীরত্নকে তিনি মনের মণিকোঠায় সাজিয়ে গুছিয়ে রাখবেন। চার চারটি নারী সম্ভোগেও তার দেহ,আত্মা তৃপ্ত হয় নি। রাণীরা মধ্যপথে রাস্তা গুলিয়ে ফেলে।সঠিক শিক্ষার অভাব আর কি।রাজা মনে মনে ভাবছেন এইসব কথা। একটা রাতও রাজার ভালোভাবে পার হয় নি। যৌন ইন্দ্রিয়সুখ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। তিনি বিড় বিড় করছেন নিজের মনে মনে,প্রথম রাণীকে বললে চোষণ,মর্দন, লেহনে রাজী হয় না। শরীরের যে একটা ভাষা আছে তা পড়তে জানে না। নিজেও সক্রিয় হয় না আবার হতেও দেয় না। দ্বিতীয়জন দুর্মুখ। তৃতীয়জন গল্প শোনায় বেশি, কাজের থেকে। আর চতুর্থজন ঘুম কাতুরে। তাকে মৃতদেহের মতো বোধ হয়। ঠান্ডা,বরফ,শীতল উলঙ্গ দেহ। পাশে থাকলেও স্পর্শে মন যায় না। রাজা ভাবে,এখানেই বাকী জীবনটা কাটানো যাবে। মনের মতো নারী পেয়েছি। স্বর্গ আর দূরে নেই মনে হচ্ছে।
এদিকে প্রধান পরামর্শদাতা ও পন্ডিত রাজাকে পরামর্শ দিলেন,বেশি ছটপট করবেন না। আমি একবার অই নারীকে দেখতে চাই। তার সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চাই। আপনি রাজী তো? রাজা বলেন,রাজী। কিন্তু তার দেহআমি কাউকে স্পর্শ করতে দেবো না। যদি জানতে পারি,তার গর্দান যাবে। পন্ডিত রাজী হলেন। কিন্তু মনে তার অন্য ভাবনা।
এক গভীর চাঁদনী নিশিথে অমিয়ভূষণ ও রতিপ্রিয়া, হাসিমুখ অরণ্যে,উপস্থিত হলো। সেই অরণ্যে আর কেউ নেই। অমিয়ভূষণ শরীরচর্চা করেন। তার আজানুলম্বিত বাহু।দীর্ঘ আকারে,মনোমুগ্ধকর সম্ভাষণে রতিপ্রিয়া খুশি হলো।রতিপ্রিয়া বললো,আমি আপনাকে চিনেছি। আপনি আমার সেই আকাঙ্খিত পুরুষ। আসুন মিলিত হই। অমিয়ভূষণ বললেন,চারদিকে রাজার চর ঘোরঘুরি করছে। গর্দান যাবে আমার। রতিপ্রিয়া বললেন,আমি এই জঙ্গলের সব চিনি। এমন গভীর অরণ্যে আমরা ফুলশয্যা সাজাবো কেউ দেখতে পাবে না। অমিয়ভূষণ বললেন,এটাই শেষ ফুলশয্যা হবে না তো? রতিপ্রিয়া বললেন,আপনি কি ভীত? তাহলে সম্পূর্ণ যৌন সফলতা পাওয়া অসম্ভব। যৌনতার অর্থ শুধু দেহ নয়। চোখের চাহনি,গ্রীবা ভঙ্গিমা,পরস্পরের যৌন প্রলাপ, পোশাক,মন,প্রতীক্ষা,পরিণতি সবকিছুর উপর নির্ভর করে কাম সফলতা। অমিয় বললেন,আমি ভীত নই। তবে কথার খেলাপ হবে। তোমার মত সুন্দরীর জন্য সবকিছুই করতে পারি। তারপর শয্যা তৈরি হলো। ফুলের নয়। ঝরা পাতার শয্যা। দুজনে উলঙ্গ হলো। অমিয়র দীর্ঘ লিঙ্গ রতি চুষতে শুরু করলো। অমিয় বললেন,ধীরে নারী। তোমার ওষ্ঠে আমার ওষ্ঠ। তোমার মাইযুগলের বৃন্ত কালো আঙ্গুর। আমি চোষণ করি। কুড়ি মিনিট কেটে গেলো। রতি পাগলীনি প্রায়। তারপর ধীরে ধীরে অমিয় যোনিদেশ দখল করলেন। চর্ব্য,চোষ্য,লেহনের মাধ্যমে নারীর মন মাতানোর খেলায় পারদর্শী অমিয় রতিকে কামবাণে বিদ্ধ করলেন। রতির উপোসী যোনীদেশ। পাগলী রতি, ঠেলে ফেললেন অমিয়কে পাতার বিছানায় । অমিয় হাসিমুখে সব আদর গ্রহণ করলেন।বিলাপ করলেন,পাগলের মতো,আমাকে গর্দান দিতে হলেও আর দুঃখ নাই। আমি তৃপ্ত। তুমি কি তৃপ্ত নারী। অমিয় দেখলেন,রতি বলছেন,হ্যাঁ প্রিয়। তুমিই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরুষ। বলতে বলতেই আবার তিনি জড়িয়ে ধরলেন আশার পুরুষকে। তারপর শুয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। গোপনে অমিয় বললেন,তুমি রাজার আশ্রয়ে থাকো। আমি তোমাকে ঠিক সুখে রাখবো।
তারপর রতি রাজার আশ্রয়ে গেলেন গ্রামবাসীদের কাছে বিদায় নিয়ে। সবাই সাগ্রহে পৌঁছে দিলো সুন্দরী রতিকে।আজ সে সুন্দর পোশাক পরেছে। রাজা বললেন,কি করে হলো তোমার এত বেশভূষা। রতি বললেন,তোমার জন্য রাজা। আজ আমি পছন্দের পুরুষ পেয়েছি তাই। রাজা খুব খুশি হলেন। গ্রাম জুড়ে তোড়জোড় শুরু হলো খাওয়া আর নাচ, গানের।রাজা পন্ডিত অমিয়ভূষণকে বললেন,আপনি কি এমন মন্ত্র দিলেন যে রতি পাল্টে গেলো। অমিয় বললেন,আমি আপনার গুণকির্তন করেছি ওর কানে। তাতেই ওর পাগলির মত অবস্থা। বিছানায় গেলে কি করবে এবার দেখুন।
যথারীতি রজনীকালে রাজা শয্যায় গেলেন। সেখানে অপেক্ষায় রতি। রতি প্রথমেই রাজাকে উলঙ্গ করলেন। তারপর দেখলেন, রাজামশাই ঘাঘরা তুলে লিঙ্গ প্রবেশ করালেন। তারপর বিলাপের সুরে বললেন, এবার দেখো তোমার কি দশা করি। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজা হাঁপিয়ে পরলেন। তারপর চিত হয়ে শুয়ে ঘুম। অমিয় একটি পাথরের বাটি রতির হাতে দিয়ে চলে গেলেন। রাজাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে খাইয়ে দিলেন দুধের সঙ্গে মেশানো ঘুমের বড়ি। রাজা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলেন। তারপর অন্দরমহলের অন্য ঘরে রতি ও অমিয়ভূষণ উলঙ্গ হলেন। অমিয়ভূষণ রতিকে কোলে তুলে দাঁড়িয়ে রতিক্রিয়ায় মত্ত হাতির মতো লাফালেন। প্রায় অর্ধ রজনী পরে রতি চলে এলেন রাজার ঘরে। কেউ জানলো না গোপন কথা।
পরের দিন রাজা ওরতি বনে বনে ঘুরলেন। রাজার বায়নামত কাজ করলেন। রতি এদিক ওদিক দেখছেন কিন্তু অমিয়কে দেখতে পাচ্ছেন না। রাজা স্নানের ঘরে গেলে রতি অমিয়র ঘরে দেখলেন আর একজন সুন্দরী তন্বীকে আনন্দ দিতে ব্যস্ত তার সাধের নাগর। রতির রাগ হলো। রজনীকালে অমিয়র ঘরে দেখা হলে রতি বললেন,দিনে অই কন্যাটি কে ছিলো। অমিয় বললেন রাজার বড় রাণীর কন্যা এখানে থাকেন। তিনি বিয়ে করেন নি আমার জন্য। তারও শখ, চাহিদা মেটায় আমি। এই সময়টা তোমার। এসো রতি,আমরা মিলিত হই।
রতির ক্রোধ হলেও তা প্রকাশ করে নি। পরের দিন সে রাজাকে নিয়ে চলে গেলো বনে। সেখানে আসল কাম শাস্ত্র শেখালো রাজাকে। রাজা পুঁথির মধ্যে সবকিছু লিপিবদ্ধ করার উপদেশ দিলেন রতিকে। রতির কথামত কাজ করে রাজা আনন্দ পেলেন অনেক বেশি। রতি পুরুষ তৈরির কাজে লেগে পরলো। শরীর পেরিয়ে এক ভালোবাসা তৈরি হলো রাজার প্রতি তার মনে। সে ভাবলো,অমিয় অহংকারী, তাই অন্য নারীতে আসক্ত। কিন্তু রাজা তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে নিজের সবকিছু ভুলে গেছে। এ তো ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই নয়। রতিকে সবসময় রাজা চোখে চোখে রাখে। যত্ন করে। এত ভালোবাসা রতি আগে কখনও পায় নি। তাই রাজাকে নিজের মনের মত করার জন্য গুপ্তশিক্ষা দিতে শুরু করেছে।
প্রায় দুবছর পরে রতি রাজাকে যৌনবিদ্যায় সম্পূর্ণ পারদর্শী করে তুললো। অমিয়ভূষণকে তার আর প্রয়োজন হয় না। কিন্তু তাকে এখানে দেখতে সে চায় না। তার পাওয়া প্রথম শক্তিমান পুরুষ অন্যজনের হয়ে গেছে,অনেকের হয়ে গেছে এই নিষ্ঠুর সত্য সে কোনোমতেই সহ্য করতে পারে না। তাই সে রাজাকে বললো,অমিয়ভূষণকে তাড়াও। রাজা বললেন,ঠিক বলেছো তুমি। ওর জ্ঞান আমাকে মানুষ করতে পারে নি। আমি ওর গর্দান নেবো। রতি বললেন,ক্ষমা রাজার শ্রেষ্ঠ গুণ। তুমি ওকে তোমার প্রথম রাজধানীতে পাঠিয়ে দাও।
অমিয় ভূষণ চলে এলো রাজার চার রাণীর কাছে। সেখানে রাজার নির্দেশে প্রধান হিসাবে অস্থায়ীপদে নিযুক্ত হলো। রাণীদের প্রতি ভালোবাসা রাজার নেই। এবার অমিয়ভূষণের চোখ গেলো রাণীদের প্রতি। রাণীরা এখন উপোসী ছারপোকার মতো, সে মনে মনে বলে। প্রায় পাঁচ বছর যৌন সঙ্গম তাদের স্থগিত হয়ে আছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। প্রথমে একরাতে সে বড় রাণীর কাছে গেলো। কাম শাস্ত্রে অমিয় পারদর্শী। রাণীকে ঘরে একা পেয়ে বললো,তুমি কি সুন্দরী। আজ পর্যন্ত তোমার মত সুন্দরী দেখি নাই। রাণী বিগলিত হয়ে বললো,তোমার মত সুপুরুষ আমার প্রয়োজন। অমিয় কামকেলি শুরু করে বললো,তুমি সুন্দরী। অথচ রাজা তোমাকে অবহেলা করে।
সে এখন অন্য নারীতে আসক্ত। তাহলে তোমরা কেন উপোসী হয়ে দিন কাটাবে। এসো আমরা মিলিতভাবে আনন্দ করি। বড় রাণী সময় চাইলেন। রাণীরা পরামর্শ করে দেখলেন,অমিয় সত্য কথা বলেছে। তারা তার প্রস্তাবে রাজী হলো। এদিকে অন্দরমহলের দাসীদের সেনাপতি ও তার সাথীদের ভোগ করতে দিলো অমিয়। ফলে শাসনকার্যের সমস্ত ক্ষমতা তার হাতের মুঠোয় চলে এলো। অমিয় একপ্রকার রাজা হলো অঘোষিতভাবে। তার প্রখর বুদ্ধির জোরে সে সুশাসনের মাধ্যমে সকলের সুখ,সুবিধার ব্যবস্থা করলো। ফলে অধিবাসীরা তার অধীনে এলো।সকলে বলাবলি করতে শুরু করলো,এইরকম রাজাই প্রয়োজন আমাদের।
চার রাণী প্রথম মিলনে বুঝে গেছে পুরুষশ্রেষ্ঠ অমিয়ভূষণকে। তারা তাকেই স্বামী হিসাবে বরণ করে নিলো। উদ্দাম আবেগে ভেসে গেলো পুরোনো সব স্মৃতি। অমিয়ভূষণ যৌনবিদ্যাকে অবশ্যপাঠের অন্তর্ভুক্ত করলো। ফলে নারী পুরুষের সম্বন্ধ ভালো হলো কয়েক বছরের মধ্যেই। পাঠশালাগুলোতে বয়স্কদের শিক্ষাদান শুরু হলো। সে জানতো,বেশির ভাগ সংসার যৌনতা বিষয়ে অজ্ঞতার জন্য ভেঙ্গে যায়। ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়ে যায় সমাজে।
আর এদিকে রাজা ও রতি প্রণয় আবেশে দিন কাটায়। রতির পরামর্শে রাজার কোনো অসুবিধা নেই। কোনো অভিযোগ নেই। রতির লেখা কামশাস্ত্রের পুঁথি দেশে বিদেশে সুনাম অর্জন করলো। পুঁথি উৎসর্গ করা হলো অমিয়ভূষণের নামে। রাজার সঙ্গে পরামর্শ করেই রতি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলো। কোনোক্রমে একটি পুঁথি অমিয়ভূষণের কাছে যায়। সে আবার স্মরণ করে রতির ভালোবাসা। সে বলে,ভালোবাসা শুধু গড়তে জানে। ধ্বংস তার অভিধানে নেই।অমিয়ভূষণ বুঝলো,রতির ভালোবাসার উপযুক্ত সে নয়। রাজাই তার উপযুক্ত প্রেমিক।
রাজার কাছে থাকতো তার বড় মেয়ে সোনা। সে অমিয়ভূষণের সঙ্গ পেয়েছিলো। তার জানা জ্ঞান কাজে লাগিয়ে দুই দেহরক্ষিকে কামশাস্ত্রে পারদর্শী করপছিলো। তারা এখন অভিজ্ঞ পুরুষ। সোনা তাদের বলে,নারীদেহ হলো বাঁশীর মতো। পারদর্শীর হাতে বেজে ওঠে সুর। আর আনাড়ি থুতু দিয়ে ভরিয়ে ফেলে বাঁশীর মুখ। পরে ভেঙ্গে ফেলে দেয় জলে। বাঁশী কোনোদিন সুরে বাজে না আনাড়ির হাতে।
সোনা বিবাহ পদ্ধতি স্বীকার করে নি। শরীরের শিল্প না জানলে বিয়ে সার্থক হয় না। অশান্তি, জীবনহানির মাধ্যমে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। অতএব শরীরকে জানতে হবে,বুঝতে হবে এটাই তার মতামত। এই বলে দাদু চুপ করলেন।
(পাঁচ)
অনুপমা ছোটো থেকেই বিভিন্ন ফুল ওফলের গাছের ভক্ত। তাছাড়া যে কোনো গাছের কাছে গেলেই সেই গাছের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পরে। গাছটার সঙ্গে কথা বলে,আদর করে, গোড়ায় হাত বুলিয়ে দেয়। সে বলে বাড়ির উঠোনের আমগাছটাকে,কি রে আমি আগের জন্মে তোর বোন ছিলাম? বুঝলি আমি আগের জন্মে আবার গাছ হবো। তোর ডালে ডালে আমার সোহাগ উথলে ওঠে। আমি তোর বোন হবোই। সুন্দর সহজ সরল জীবন নিয়ে আমি সুস্থ রাখবো জগতের সমস্ত জীব কুলকে। আমি গাছ হবো।
উঠোনের আমগাছটার ইতিহাস আছে। অনুপমার দাদু বি,ডি,ও অফিস থেকে চারা এনেছিলেন। তিনি উঠোনে ছায়া হবে, আর সিজনে কিছু আম পাওয়া যাবে বলে গাছটা লাগালেন। গর্ত খুঁড়তে গিয়ে হাতটার আঙুলে কোদালের চোট পরে কেটে গেছিলো সেদিন। অনুপমার ঠাকুমা রেগে বললেন,উঠোনের মাঝে আমগাছ লাগালে। তারপর আবার বাধা। অপয়া গাছ। পাতা পরে জঙ্গল হবে।দাদু কোনো কথা বলে নি। শুধু বলেছিলো,খবর্দার এই গাছে কেউ যেনো হাত না দেয়। কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে ছাড়বো।
তখন অনুপমা ছোটো। অনুপমা বললো থাক,ঠাকমা আমি পাতা পরিষ্কার করবো। তারপর ঠাকুমা, নাতনির মুখ চেয়ে আর কিছু বলেন নি। দাদু এবার দুবছর পরে বাড়ি এসেছে।থাকে অনেকদূরে। অনুপমা ভাবে,কেন,এতদূরে থাকে দাদু। একদিন ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা করে দেখবে। কিন্তু বলতে সাহস হয় না। ঠাকমা যদি বকাবকি করে।
তারপর অনেক বৈশাখ কেটে গেলো। শেষে অনুপমার আঠারো বছর বয়সে আমগাছের মুকুল এলো। এতদিন গাছে জল দেওয়া, পাতা কুড়িয়ে পরিষ্কার করা সবকাজ সে নিজেই করেছে। তার ভালো লাগে তাই করে। আমের শুকনো পাতাগুলো এক জায়গায় জড়ো করে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দিতো। পরিষ্কার হতো তাড়াতাড়ি।
বাবা, মা কে অনুপমার মনে পরে না। দাদুর কাছে শুনেছে, সে যখন এক বছরের মেয়ে তখন তার বাবা রোড আ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। মা তার এক বছর পরেই বাবার বাড়ি চলে যায়। মা তাকে নিয়ে যেতে চাইছিলো কিন্তু দাদু দেন নি। দাদু বলেছেন,ছেলের স্মৃতিটুকু তুমি নিয়ে যেও না বৌ মা। তাহলে আমি বাঁচবো না। আমার আর কেউ নেই ও ছাড়া। মা তারপর আর জোর করেন নি। একা চলে গিয়েছিলেন কাঁদতে কাঁদতে কোনো প্রতিবাদ না করে। তার মা নাকি এখন বিয়ে করেছে অনেক দূরে। মায়ের মুখ অনুপমার মনে পরে না। তাই মায়ের মায়া তাকে কাবু করতে পারে না। অনুপমা দেখতো,দাদু থাকে না বাড়িতে। তবু একটা ফর্সা, কটাপারা লোক ঠাকুমার ঘরে যায় প্রায়। তাকেও চকলেট দেয়। কিন্তু জানে না লোকটা কে? পাড়ার লোকেরা ওকে জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু ও বলে,আমি জানি না। তখন সবাই মুখ টিপে হাসে। ভালো লাগে না তার। মনে মনে বলে,একদিন ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা করতেই হবে। কিন্তু ঠাকুমা যদি রেগে যায়।
একদিন দুপুর বেলা ঘুঙুর পরা হাঁসটা কেমন হেলেদুলে চলেছে। অনুপমার পিছনে পিছনে চলেছে হাঁসটা। তাকে এখন সরস্বতী ঠাকুরের মতো লাগছে। বাহন তার চলেছে সঙ্গে সঙ্গে। ঘাটে শান বাঁধানো সিঁড়িতে সে বসে পরলো। আর হাঁসটা উড়ে গিয়ে পরলো জলে। ডুব দিয়ে তাকে খেলা দেখিয়ে চলেছে। সে জলে ঝুঁকে পরা গাছটার ডাল ধরে তুলে আনলো পানিফল। ছাড়িয়ে খেতে গিয়ে পানিফলের কাঁটা ফুটে গেলো। লাল এক ফোঁটা রক্ত চুঁইয়ে পরলো মাটিতে। পাশে চাঁদু এসে বললো,দে দে আঙুলটা দে। অনুপমার আঙুলটা মুখে নিয়ে চুষতে লাগলো। তার খুব সুড়সুড়ি পেলো। সে হাসতে লাগলো। রাজু বললো,জানিস না,মুখের লালায় ঘা পর্যন্ত ভালো হয়ে যায়। রাজু আঙুল ছাড়ছে না, খুব ভালো লাগছে। সেও জোর করছে না। একটা ভালো লাগা শিরশিরে ভাবে সে বিহ্বল। সে আঁচল থেকে কটা পাকা কুল দিলো রাজুকে, হাত ছাড়িয়ে। রাজু বললো,তোর সব সময় কাঁটা নিয়ে কাজ। কুলগাছেও কাঁটা থাকে। সে হাসতে হাসতে বললো,তুই তো আমার মিষ্টি কুল। তাইতো কাঁটা ভালোবাসি। রাজু পাশের পাড়ায় থাকে। কিন্তু তার সঙ্গেই তার ভাব বেশি। রাজু বলে অপরূপাকে,আমার মাকে আমার বাবা রোজ মারধোর করে। মাথা ফাটিয়ে দেয়। বড়ো হয়ে আমি এর শোধ নেবো। অনুপমা বলে,ওসব বলতে নেই। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। রাজু বলে,কিচ্ছু ঠিক হবে না। একটা রাক্ষস আমার ভেতরে আছে। তবু আমি আমার বাবাকে ভালোবাসি। তুই আমার থেকে সাবধানে থাকিস। রাক্ষসটা কখন জেগে উঠবে আমিও জানি না।
অনুপমার ভয় হয়। তার মনে পরে, রাজু আর চাঁদু তার দশজন বন্ধু, পুজো বাড়ির শ্যাওলা পড়া দেয়াল ঘেঁষে বসতো। পিঠে সবুজ ছাপ পরে যেতো। পুরোনো কারুকার্যের মুগ্ধতা ছাড়িয়ে ভালোবাসার গান বিরাট বাড়িতে প্রতিধ্বনি শোনাতো। বন্ধুদের মধ্যে চারজন মেয়ে ছিলো। দেবীকা বলতো, বন্ধু শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ করিস না। ভালো শোনায় না। কোনোদিন রাজু তাদের মেয়ে মনে করেনি। বন্ধু তো বন্ধুই। তার আবার ছেলে আর মেয়ে কি?বলতো রাজু। একই কাপে তারা কফি খেতো পুজো বাড়ির পাশের কফি হাউসে । ভাগে কম হলে রূপসী বলে বন্ধুটা রাস্তায় লোকের মাঝে দীনেশকে ফেলে মারতো খুব।তাদের বন্ধুদল বিপদে,আপদে কাজ করতো গ্রামে। তাই তাদের অনেকেই সম্মান দিতো। আর আদরের এই মার খেতেই দুষ্টুমি করে তার ভাগেরটা কম রাখতো। অভিভাবকরা কোনোদিন ছেলে মেয়েদের মেলামেশায় বাধা দিতেন না। দরজা ঘাটের বাঁধানো ঘাটে পানকৌড়ি আর মাছরাঙার কলা কৌশল দেখে পার হয়ে যেতো অবাধ্য সময়।
অন্ধকারে ফুটে উঠতো কালীতলার সার দেওয়া প্রদীপ। ঘরে ঘরে বেজে উঠতো শঙ্খধ্বনি। হাতগুলো অজান্তে চলে যেতো কপালে। তারপর হাত পা ধুয়ে ভাইবোন একসাথে বসে সরব পাঠের প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যেতো পাড়া জুড়ে। কিন্তু অনুপমার ভাইবোন ছিলো না। সে চুপচাপ পড়তো। নীরব পাঠ। আর তার ফলে তার মনে ভেসে উঠতো রাজুর মুখ। বইয়ের পাতা জুড়ে প্রেমের খেলা।
কে কত জোরে পড়তে পারে,পাড়ায় প্রতিযোগিতা চলতো। একবার অতনুদের বাড়ি পড়তে গেছিলো অনুপমা মাটির দোতলা ঘরে। বুলু কাকা বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি শুনতে পেলেন অতনু পড়ছে, ন্যাটিওনাল মানে জাতীয়, ন্যাটিওনাল মানে জাতীয়। ঘরে ঢুকে কাকা বললেন,ন্যাটিওনাল নয় ওটা ন্যাশনাল। ঠিক করে পড়। অতনু জোরে পড়ছে বলে উচ্চারণটা ঠিক হলো। এই অতনু সেদিন বুলুকাকা যাওয়ার পরে তার পাশে বসে পড়ছিলো। আর বারবার তার হাঁটুতে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলো। তারপর একটা আঙুল তার প্যান্টের ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো যোনীপথে। খুব ভালো লাগছিলো। কিন্তু একটা অপরাধবোধ কাজ করছিলো ভিতরে। পড়া হয়ে গেলে সে চলে এলো নীচে।
তারপর পড়া হয়ে গেলে একান্নবর্তী পরিবারের সবাই উঠোনে খেতে বসলো।অনুপমা দেখলো, কি সুন্দর পরিবেশে অতনু বড়ো হচ্ছে। রাজুর বাড়ি যদি এই পাড়ায় হতো, তাহলে বেশ হতো। আলাদা করে কোনো শিশুকে খাওয়া শিখতে হতো না,জোর করতে হতো না। সবার খাওয়া দেখে ধীরে শিখে যেতো নিজে খাওয়ার কায়দা।পরের দিন রাজুকে গল্প বললো। অতনুদের বাড়িতে পড়তে যাওয়ার গল্প। কিন্তু আঙুলের কথা বলতে পারে নি লজ্জায়।
রাজু শুনে বলতো, আমাদের কাকার মেয়ে, ছেলে সবাই পড়তে আসে আমাদের বাড়িতে। আমরা শুই সবাই একসাথে। কাকার মেয়ের সাথে মারামারি করি। শোওয়ার পালা আরও মজাদার। বড় লেপে তিন ভাই,বোনের ঢাকা। কেউ একটু বেশি টানলেই খেলা শুরু হয়ে যেতো রাতে। কোনো কোনো দিন ভোরে। মা আরও ভোরে উঠে শীতকালে নিয়ে রাখতেন জিরেন কাঠের খেজুর রস। সকালে উঠেই খেজুর রস। সেই দিনগুলো আর কি ফিরবে? বড় মন খারাপ হয় বড়ো হয়ে যেতো রাজুর।রাজুর গল্প শুনে অনুপমার অপরাধবোধ কমে যেতো। সে ভাবতো,তাহলে রাজুও কাকার মেয়ের সাথে এরকম করে। ওর তো নিজের কাকা নেই। পাড়ার কাকা হবে হয়তো। তাহলে রাজু তো সব কথাই বলে। ওগুলো বলে না কেন? ওসব বলতে নেই। সে ভাবে,চিরকাল ছেলে মেয়েরা গোপন করে যায় ভালোলাগার কিছু মূহুর্ত। এগুলো হয়তো বলতে নেই। আকাশ পাতাল চিন্তা করেও হিসেব মেলাতে পারে না অনুপমার মতো কিশোরী মেয়েরা।
তারা একসাথে ঘুরতো।অনুপমারা খেলতো নানারকমের খেলা। চু কিত-ত,কবাডি,সাতগুটি,ঘুরি ওড়ানো,ক্রিকেট,ব্যাডমিন্টন ও আরও কত কি। বন্ধুরা জড়ো হলে,এলাটিং,বেলাটিং সই লো,যদু মাষ্টার কইলো…, তারপর আইশ,বাইশ কত কি। হাততালি দিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে খেলতাম,কাটুরিস,চায়না প্লিজ,মেম সাব, মেইন আপ… । তারপরের কথা, খেলা ডুব দিয়েছে কোন অতলে জানিনা, অনুপমা বলতো, সব কথা পুরো মনে পরে না। ছেঁড়া, ছেঁড়া স্মৃতিগুলো হৃদয়ের পদ্মপুকুরে ভেসে উঠেই ডুব দেয়, আর হারিয়ে যায় ব্যস্ত সময় সংসারে। সেখানে আবেগ মানে ছেলেখেলা পাগলামি। তবু তার মনে হয়, এরকম পাগলের সংখ্যা আরও বাড়ুক। বাড়লে পাওনাটা মন্দ হয় না। ভালো পরিবেশে মানুষ হয়েছে অনুপমা ও রাজু। সেই রাজুর মনে কি করে রাক্ষস ঢুকলো বুঝতে পারে না অপরূপা। সে ভাবে,মানুষ হয়তো পাল্টে যায় পরিস্থিতির চাপে । যে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে সে হয়ে যায় ডাকাত। আর যে সংসারী হয়ে সুখে থাকতে চায় সে হয়ে যায় খেলার পুতুল, রূপাগাছির অপরূপা বেশ্যা।
অনুপমা ভাবে, তিরস্কারের থেকে জীবনে পুরস্কারই বেশি পেয়েছি। পুরস্কার বলতে মানুষের আদর, ভালোবাসা। অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা। এর থেকে বড় পুরস্কার আমার অভিধানে নেই। আমার যোগ্যতার বেশি, তার পরিমাণ। ঈশ্বর সময় হলেই প্রত্যেকের যোগ্য পাওনাটুকু দিতে ভোলেন না। শুধু প্রয়োজন ধৈর্য আর সহনশীলতা। সময় কিন্তু কারও কথায় এগিয়ে আসবে না বা পিছিয়ে যাবে না। অভিজ্ঞ লোকেরা প্রথমে ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। অন্য মানুষকে সহ্য করা, সম্মান করা ধর্মেরই নামান্তর। মানুষের জন্যই মানুষ। শুধু শুকনো লোক দেখানো ধর্ম যা মানুষকে ছোটো করে সেটা কখনই ধর্ম হতে পারে না। ধর্ম হচ্ছে অণুবিক্ষণের মতো। ছোটো জিনিসকে বড়ো করে দেখে। পোকা, মাকড়ও ঈশ্বরের করুণা থেকে বাদ পরে না। ভাবনা আমার ভালো কিন্তু ভাগ্যের চাকাটা যে বনবন করে ঘোরে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সে।
অনুপমা কদিন ধরেই দেখছে রাজু কতগুলো ছেলের সঙ্গে মেশে। তাদের কোনোদিন দেখে নি সে। রাজুকে জিজ্ঞাসা করলল বলে,অনেক দূরে বাড়ি ওদের। এখানে এলে আমার সঙ্গে দেখা করে যায়। অনুপমা বলে,তুই খারাপ হয়ে যাস না, ভালো হয়ে থাকিস। তুই আমার জীবনের ভরসা। আমার ভালোবাসার ধন।
রাজু ভাবে,অনুপমা আমাকে ভালোবাসে। সে আমাকে ভালো হতে বলে। আর তো আমরা ছোটো ছেলে নই। বড়ো হয়েছি। বুঝতে শিখেছি ভালোমন্দ। কি করে সে ভালো হয়ে থাকবে। বাড়িতে নিত্য নতুন অশান্তি। বাবা,মায়ের মারামারি। মা সন্দেহ করে বাবাকে। এখন আমিও সন্দেহ করি বাবাকে। বাবা রোজ রাতে কোথায় যায়?বারোটার পর বাড়ি ফেরে। এত জানাশোনা আছে তার। তবু সে জানতে পারে না। রাজু ভাবে,কোনোদিন যদি জানতে পারি, আমার বাবাকে কেড়ে নিচ্ছে কে? আমি তাকে খুন করবো। আমাদের বাড়িতে অশান্তি ঢোকানোর বদলা আমি নেবোই। অপরূপা বলে,তুমি পুলিশকে জানাও,আইনের সাহায্য নাও। কিন্তু বাবার ভয়ে অতদূর এগোতে সাহস হয় না। তবে মনে মনে ভাবে সে,এর শেষ দেখে ছাড়বো। রাজু মা কে বলতে শুনেছে,তুমি অস্ত্র নিয়ে ঘোরাঘুরি করা ছেড়ে দাও। অন্য মেয়েছেলের সঙ্গ ছেড়ে দাও। অন্যায় করে রোজগার করা ছেড়ে দাও। তা না হলে আমি রোজ তোমার সঙ্গে অশান্তি করবো। রাজু ভাবে,কি করে একটা ভালো ছেলে বড়ো গুন্ডা হয়ে যায়,ডাকাত হয়ে যায়। খুনি হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় পাগল সেজে,মাতাল সেজে। পরিবারের পরিবেশ ভালো না হলেই এইসব হয়।
(ছয়)
অনুপমা তার দাদুকে দেখেছে। অনুপমা ভাবে,দাদু তার জীবনের আদর্শ। মনমতো দাদু আমার খুব প্রিয় ছিলো। দাদু আমাদের জন্য নিরামিষ রান্না করতেন। কখনও সখনও দেখেছি নিজে ডেঙা পাড়া, থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। ব্রয়লার মুরগির ডিম ভালোবাসতো না দাদু। দেশি মুরগির ডিম আনতেন কিনে। নগদ টাকার টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন ঠাকুমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা। আমি পূর্ব মেদিনীপুরের মেয়ে। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো।একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ভূতের গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বার বার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,আজ কিন্তু ভূত আসতে পারে। জানিস তো ছড়াটা,ভর্তি দুকুরবেলা, ভূতে মারে তালা। থাপ্পরকে দাদু বলতো তালা। রেগে গেলেই বলতো,এক তালাতে ভুবন ঘুরিয়ে দোবে। আমি খুব ভিতু ছিলাম। আমার বন্ধুরা সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। দাদু কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম,বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই দাদু বলেছেন, আজ ভূত আসবে। দিনে ভূত দেখা যাবে । ছেলে, মেয়ে সবাইকে ধরবে। বস্তায় ভরে নিয়ে যাবে অন্য দেশে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম তলায়। আমের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পারছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে কালো টিনের হাতে ভূত হাজির।টিনের হাতে বস্তা। বস্তা ছুড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের । আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গেলাম। আমরা তাড়িয়ে নিয়ে গেছিলাম লোকটাকে। ভূত তখন ভয়ে পগাড় পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। দাদু মিথ্যা কথা বলে ভয় দেখাতেন। দাদু খুব ভালো লোক ছিলেন। ওষুধ মলমের স্পর্শে যেমন ফোড়া ভালো হয়ে যায়। তেমনি বিপদের সময় দাদুর উপস্থিতি সকল সমস্যার সমাধান করে দিতো। একবার ডেঙা পাড়ায় ডাকাত পরেছিলো। জমিদার বাড়িতে। তখন ফোন ছিলো না। জানাবার উপায় নেই। পাশের বাড়ির একজন দাদুকে ডাকতে এসেছিলো। দাদু ঘুম থেকে রাতে উঠে,সড়কি হাতে লোকজন ডেকে সিধে চলে গিয়েছিলেন। তখন লাঠি,সড়কি,বগি ছিলো প্রধান অস্ত্র। সড়কিখেলায় দাদুর সমকক্ষ কেউ ছিলো না। চারজন বাছা বাছা তরুণকে বললেন,আমার মাথায় লাঠি মারতে দিবি না। তারপর শুরু হলো লড়াই। বারোজন মরদ সবকিছু ফেলে লাগালো ছুট। জমিদার গিন্নি দাদুকে বললেন,আপনার জন্যই আজকে বাঁচলাম। ভগবান আপনার ভালো করবেন। বাড়ির মহিলারা দাদুকে মিষ্টিজল খাইয়ে তবে ছাড়লেন। বাকি লোকেরাও খেলেন। দাদুর লাঠি খেলার দলের কথা আশেপাশে সবাই জানতো। দাদুর মুখেই শুনেছি হাটবারে ডাকাত সর্দার হাটে এসেছিলো। বলেছিলো,আপনার মায়ের দুধের জোর বটে। আপনাকে পেন্নাম।সাহসকে বলিহারি জানাই। আপনি ওই গ্রামে থাকতে আর কোনোদিন ডাকাতি করবো না। দাদু বলেছিলে, ছেড়ে দে ডাকাতি। তোকে জমিদার বাড়িতে ভালো কাজ দেবো। তা বলে কোনো ডাকাত কি কোনোদিন ভালো হয়? মনে মনে প্রশ্ন করে নিজেকে। ভালো আর মন্দ মিলেমিশে মানুষের গঠন।
আজ আর দাদু নেই। এতবড় সাহসী লোক হয়েও দাদুর ঘরে শান্তি ছিলো না। দাদু বলতো,বাঘের ঘরে ঘোগার বাসা। দাদু আপশোষ করতো, নিজের বৌ যদি বেইমানি করে জগতে কারও সাধ্য নাই তাকে বাঁচায়। সে মরবেই। শান্তি তো কোনোদিন পাবেই না। দাদুর ক্ষেত্রে এই কথাগুলো সত্য হয়ে উঠেছিলো অভিশাপের মতো।
দাদুর মৃত্যু খুব মর্মান্তিক,ভয়ংকর। লোকে বলে,একহাত জিভ বেরিয়ে গেছিলো গলায় দড়ি দেবার পরে। সেই ঘটনা অনুপমার মনে পরছে।
আমি আর ঠাকুমা দুজনের সংসার। ঠাকুমা অসুস্থ। ঠাকুমা বলেন,তুই যাকে ভালোবাসিস, তাকে বিয়ে কর। আমি হঠাৎ মরে গেলে তোর কি হবে বলতো?
আমি বলতাম,কিছু হবে না ঠাকুমা। আমার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। আমি তোমার কাছেই থাকবো। ঠাকুমা বলেন এ আবার কেমন কথা? মেয়েরা বিয়ে না করলে হয় না কি?
আমগাছটাকে বলছে অনুপমা,ছোটোবেলার বন্ধু রাজুকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। রাজুও ভালোবাসে। কিন্তু রাজুর বাড়ির লোকজন রাজী নয়। আমরা লুকিয়ে দেখা করি। ঠাকুমা জানে,কিন্তু ঠাকুমাকে একা রেখে আমি চলে গেলে, ঈশ্বর আমাকে মাপ করবে না। আমি কি করবো বলো?তবু হয়তো একদিন যেতেই হবে। বিয়ের ফুল ফুটলে কেউ অবিবাহিত থাকে না।
আমগাছটা তার ডাল দুলিয়ে, পাতা নাড়িয়ে হাওয়া দেয়। বুদ্ধি দিতে পারে না। অনুপমা ভাবে,গাছগুলো কথা বলতে জানলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। গাছের নিচু ডালে বসে সে আকাশ পাতাল চিন্তা করতে আরম্ভ করলো।
মনে পরে দাদু যেদিন মারা যায় সেদিন ঠাকুমা খুব কাঁদছিলো। ঠাকুমার বিয়ের পর থেকে দাদুর সঙ্গে অশান্তি হতো। ঠাকুমার মুখে শুনেছে সে। ঠাকুমা বলেছিলেন,আমি আমাদের গ্রামের একটা ছেলেকে মানে…ভালোবাসতাম।
অনুপমা বলে, ঠাকুমা বলো না ঠিক করে। তুমি তো আমার বন্ধুর মতো। সব কথা বলা যায় বলো।
ঠাকুমা বলছেন,ছেলেটার সঙ্গে মিশতাম। ভালোবাসা হয়ে গেলো। আমার মা বাবা না থাকলে ছেলেটা সুযোগ বুঝে ঘরে ঢুকে পরতো। রান্নায় সাহায্য করতো। আদর করতো। চুমু খেতো। কিন্তু আমাকে যে ভালোবাসতো না সেটা আমি জানতে পারলাম দুবছর পরে। আমার বন্ধু বিমলের কাছে শুনলাম আরও অনেক মেয়ের সঙ্গে ও এরকম ব্যবহার করে। ওরা সাত ভাই। তাই কেউ ভয়ে কিছু বলে না তাকে। তারপর একদিন চুপি চুপি ও আমাদের বাড়ি এলো। আমি বলে দিলাম,বাবা,মা,না থাকলে আমাদের বাড়ি আসবে না। ও জোর করে আমাকে নগ্ন করলো। ও বললো,আর আমি আসার সুযোগ পাবো না
ও বললো, কেন? আসবো না কেন?
আমি বললাম,কেন, তুমি জানো না? সব জানো তুমি। হাজারটা মেয়ের সর্বনাশ করছো তুমি। নিজেকে খুব চালাক ভাবো তুমি না?
তারপর দেখলাম ওর মুখ পেঁচার মতো হয়ে গেলো। ও মরিয়া হয়ে গেলো। আমাকে চিত করে ফেলে চেপে বসলো। আমি হাত দুটো মাথার উপরে তুলতেই পেয়ে গেলাম কাটারি। অই কাটারির উল্টো পিঠে মারলাম এক ঘা। বাবারে বলে,ভয়ে পালিয়ে বাঁচলো শালা।
তারপর থেকে কোনো কথা ছিলো না। কিন্তু আমার বিয়ের পর অশান্তি ঢুকিয়ে দিলো আমাদের জীবনে। তোর দাদুকে সব কথা বলে দিলো। ও আমার অপমানের আমার কাছে মার খাওয়ার বদলা নিলো।
তোর দাদু তারপর থেকে আমাকে মারধোর করতো। সন্দেহ করতো। আমি বার ববার তোর দাদুকে বুঝিয়েছি। ওই খচ্চরটা আমার ইজ্জত নিতল পারে নি। তবু বিশ্বাস করতো না আমার কথা। আমাকে পেটাতো লাঠি দিয়ে। একবার মাথায় লেগে মরেই যেতাম। কোনো রকমে বাঁচলাম হাসপাতালে দেখিয়ে। সেখানেই পরিচয় হলো এক পুরুষের সঙ্গে। খড়কুটো ধরে ডোবার হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করলাম আমি। পুরুষটা ধান্দাবাজ, কামুক। আমার কথা শুনে বললো,কোনো চুতিয়া কিছু করতে পারবে না। আমি আছি তোমার সঙ্গে। টাকা পয়সার অভাব হবে না। শুধু চাই তোমার শরীর। একদম ষোলো আনা। আমি ষোলো আনাই দেবার প্রতিশ্রুতি দিলাম।
আমি বাধ্য হয়ে এক শক্তিশালী যুবককে প্রেমের খেলায় ফাঁসালাম। সে আমার ঘরে বসতো। আমাকে নিয়ে বেড়াতে যেতো। তোর দাদুকে ও বলেছিলো, যদি শুনি মারধোর করেছিস, সেদিন তোর শেষ দিন। আমি গুন্ডা,বদমাশ লোক। মাথা গরম হলে খুন করে দেবো। এই কথা বলে কোমর থেকে বের করে একটা বড়ো নেপালা দেখিয়েছিলো। তারপর তোর দাদু সোনাপাড়ার জমি দেখাশোনা করতো। আমার কাছে আসতো না। আমিও খবর নিতাম না। তোর দাদু সড়কিখেলায়, লাঠিখেলায় ওস্তাদ ছিলো। কিন্তু নেপালা দেখে,মারমুখী মূর্তি দেখে তাকে বললো,ঠিক আছে আজ খালি হাতে আছি। তোর মৃত্যু আমার হাতে। মনে রাখিস,আমি ফালতু কথা বলি না।
অনেকবার চেষ্টা করেও পারে নি। তবে তোর দাদুর হাতে একটা নেপালার কোপ পরেছিলো। সেই দাগ আজও আছে। আমি জানি,তোর দাদু এই লোকটাকে খুন করবেই।
তারপর তোর বাবা বড়ো হলো। বিয়ে হলো। তুই হলি। ঘর ভরতি আলো। আমার নাঙ, তোর জন্মদিনে বিরাট আয়োজন করেছিলো। তারপর হঠাৎ একটা পথ দুর্ঘটনায় তোর বাবা মরে গেলো। তোর মা তার মাসখানেক পরে চলে গেলো। তোর দাদু তোকে রেখে দিলো। তোর মা কে আমি বাধা দি নি যাওয়ার সময়। কারণ আমার বাড়িতে যে ঢ্যামণ আসতো তার নজর পরেছিলো তোর মায়ের গতরে। তোর মতোই সুন্দরী ছিলো তোর মা।
ধীরে ধীরে,সময়ের পাকে,তুই বড় হয়ে গেলি। তারপর তুই তো সব ঘটনা জানিস। তোর দাদুর ক্যান্সার হয়েছিলো লিভারে, অতিরিক্ত মদ্যপানে। তোর দাদু তখন বুদ্ধি করে এক রাতেআমার ঘর থেকে বেরনোর পর লম্পট ললোকটাকে সিপাই দিঘির জঙ্গলে সড়কি পেটে ঢুকিয়ে খুন করে এলো। আমি দেখলাম হাতে রক্তমাখা সড়কি।
বললো,তোর প্রেমিককে খুন করে এলাম রে খানকি মাগী এই বুড়ো বয়সে। শালা আমার সঙ্গে টক্কর,শালা আমার সঙ্গে পাঙ্গা। এবার তোর কুটকুটানি মরবে। তোকে মারবো না। বেঁচে থেকে তু শাস্তি ভোগ করবি। আমি ভূত হয়ে দেকবো।
তারপর আমি কিছু বোঝার আগেই গলায় দড়ি নিয়ে ঝুলে পরলো, তারই হাতে লাগানো আমগাছে।
ওই আমগাছটা সব জানে। ও তো আর কথা বলতে পারে না। ওই প্রধান সাক্ষী। তারপর পুলিশের ঝামেলা পেরিয়ে আজ এই অবস্থা। হয়তো আমার পাপেই তোর দাদু,বাবা মারা গেলো। এবার আমি গেলেই বাঁচি। অনুপমা বললো,না,না,ঠাকুমা সব বিধির লিখন। তোমার কপালে যা ছিলো তাই হয়েছে। দুঃখ কোরো না।
ঠাকুমা বলছে,তোরা দুজনে বিয়ে করে পালা। ওরা মানবে না ভালোবাসার বুলি। আজকেই পালিয়ে যা। অনুপমা কথাটা বলতে পারছিলো না। আজকে ঠাকুমা সব পথ সহজ করে দিলো।
(সাত)
অনুপমা ছুটতে ছুটতে ঠাকুমার দেওয়া সোনাদানা নিয়ে রাজুর সঙ্গে দেখা কোরলো। রাজু তখন বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিলো। বন্ধুদের সঙ্গে রাজু পরামর্শ করে, অনুপমাকে নিয়ে সোজা চলে গেলো সিপাই দিঘির জঙ্গলে। বললো,কি এনেছিস দেখা। অনুপমা বললো,সব সোনা এনেছি। নে এবার চ। ও অনুপমাকে চুমু খেলো। জঙ্গলে শুয়ে ওরা নিশ্চিন্ত হলো। তারপর বিয়ের আগেই ওরা মিলিত হলো প্রচন্ড আবেগে। অনুপমা নগ্ন হয়ে রাজুর ওপরে উঠে দীর্ঘস্থায়ী খেলা খেললো। রাজু পাল্লা দিয়ে সাড়া দিলো প্রচন্ড শীৎকারে। রাজু ভাবছে,শালি খানকির কায়দা কি করে শিখলো। খানকির বংশ তো।
হঠাৎ জঙ্গলে এলো কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা গুন্ডার দল। তারা বললো,এখানে তোরা কি করছিস। আমাদের আড্ডার কথা জেনে গেছিস রাজু। মেয়েটা কে রে? বেশ ডবকা মাল। একবার দেখি, বলেই অনুপমার উদ্ধত খোলা বুকে হাত দিলো। টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চাইলো তার মাইযুগল। একজন বললে,এক্কেবারে রেডি মাল। শালির রস গড়িয়ে পরছে। শালা গরম গরম,হাতে গরম।
রাজু মুষ্ঠিবদ্ধ হাত চালিয়ে দিলো একজনের মুখে। রক্ত পড়তে শুরু করলো। একটা ডাল ভেঙ্গে মারতে আরম্ভ করলো। অনুপমা দেখলো রাজু সবাইকে চেনে।কারণ রাজু বলছে,শালা বন্ধু হয়ে মুখোশ পরে চালাকি,রাজুর সঙ্গে। তোদের থেকে বড় গুন্ডা আমি। মুখোশধারী একজন বললো,আমরা তোর বন্ধু নই, যম। ওরা বললো,মেয়েটাকে ছেড়ে দেবো ছিবড়ে করে। কিন্তু তোকে মরতেই হবে। ওরা দড়ি দিয়ে রাজু আর অনুপমাকে বেঁধে ফেললো। অন্ধকারে পাড়ার এই জঙ্গলে কেউ আসে না। একটা বড় পাথর দিয়ে থেঁতলে দিলো বোধহয়, রাজুর মাথাটা। রাজু চিৎকার করে থেমে গেলো।
অনুপমা কিছু দেখার আগেই মনে ভাবলো, রাজু হয়তো মরে গেছে। অতবড় পাথর দিয়ে মাথায় মারলে কি আর মানুষ বাঁচে। তবু একটা আশা। সে বলছে,ভগবান আমাকে মারো কিন্তু আমার রাজু বেঁচে থাক। অনুপমা কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তার বুকে নির্মম ভাবে আড়াল করে বসে আছে দুই নগ্ন পাষন্ড। তার বুকযুগল দলে,মুচড়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে লম্পটের দল। রাজুর মরা মুখ সে ভাবতেই পারছে না। শুধু শুনতে পেলো,দে শালার মাথা থেঁতলে। কেউ যেনো চিনতে না পারে। তারপর নদীর জলে ভাসিয়ে দেবো। এই কথা শুনে অনুপমা ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো। সেই সুযোগে ওরা পাঁচজন অমানুষিক অত্যাচার করলো তার উপর। তারপর সবাই ওরা চলে গেলো,অনুপমাকে নগ্ন অবস্থায় ফেলে।
প্রায় দুঘন্টা পরে অনুপমার জ্ঞান এলো। দেখলো রাজুর দেহটা নেই। ওরা হয়তো গাড়ি করে নিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও বা কোনো নদীতে ফেলে দেবে। সে রক্তমাখা শরীর নিয়ে উঠলো। বুঝতে পরলো পশুরা তার সব সম্পদ কেড়ে নিয়েছে। কোনোরকমে ছেঁড়া জামাটা পরলো। ব্যাথায় টনটন করছে তলপেট। আর বাঁচার কোনো মানে হয় না রাজু নেই। পরে যাচ্ছে বারে বারে। সিপাই দিঘির এই জঙ্গলে আসতে মানা কোরতো ঠাকুমা। রাজু তাকে নিয়ে এলো। কতবার মানা করলাম শুনলো না। অনুপমা দেখলো দড়িটা ওর তার গলায় বেঁধেছিলো পশুরা কিন্তু সে মরে নি। টান করে বাঁধা তাও সে মরে নি। সে ভাবে মরে গেলেই ভালো হতো। ওরা হয়তো ভেবেছে,মরে গেছি আমি। দাদুকে মনে পরলো ওর। দাদু ডাকছে আর বলছে, গলায় দড়িটা শক্ত করে বাঁধ। ও আগে শুনেছে যাদের অপমৃত্যু হয় তারা এভাবেই ডাকে। অনুপমা দাদুকে বলছে,দাদু ওরা রাজুকে মেরে ফেলেছে। তাহলে আমি বেঁচে কি করবো। আমি তোমার কাছে যাবো। দাদু ডাকছে, দাদুর কথা শুনতে পাচ্ছে ও। দাদু ডাকছে,আয় আমার হাতে লাগানো বাড়ির আমগাছে আয়। ওখানেই ঝুলে পর। আমি আছি,আয়,আয়। অনুপমা ভাবের আবেশে বাড়ির উঠোনে এলো। এখন অন্ধকার রাত। মনেও কালো অন্ধকার, অনুপমার অন্তর জুড়ে,চাপ চাপ কালোর দলা পাকানো রক্ত। নীচু ডালে পা দিয়ে উঠে পরলো গাছে। দড়িটা শক্ত করে বাঁধলো ডালে।কোনোদিন কঠিন কাজ সে করেনি। কি করে দড়ি বাঁধলো সে নিজেও বুঝতে পারলো না। অবশেষে রাজুকে মনে করে ঝুলে পরলো ডাল থেকে।
সকালবেলা অনুপমার ঠাকুমা কাঁদতে শুরু করলো।মরা কান্না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখে, গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে নগ্নপ্রায় নাতনি। ঠাকুমা দেখলো,অনুপমা গলায় দড়ি দিয়েছে দাদুর মতো। আর দেখলো পাড়ার সবাই ভিড় করে এসেছে তার নাতনিকে দেখতে। ভিড়ের মাঝে রাজুকে দেখতে পেলো ঠাকুমা। রাজু বলছে,ঠাকুমা এই অভিশপ্ত আমগাছটা কেটে ফেলতে হবে। অনুপমার ঠাকুমা বলে,তোমার সঙ্গে কাল দেখা হয় নি অনুপমার। রাজু বললো,না তো,আমি কাল একটু মামার বাড়ি বেড়াতে গেছিলাম। আসতে অনেক রাত হয়ে গেছে।
-কিন্তু ও যে বললো,তোমার কাছে যাবে।
-না,ঠাকুমা, আমাকে তো বলেনি কিছু।
-না,ও আমাকে বলে বাড়ি থেকে বেরোলো। আমার কাছে সোনাদানা নিয়ে বললো,আমি রাজুর কাছে যাচ্ছি। তোমার কোন পাড়ায় বাড়ি বাবা।
-ও আপনি চিনবেন না। আমরা একই স্কুলে পড়তাম। ছোটোবেলায় এই বাড়িতে কত খেলেছি। আপনিও তো আমাকে দেখেছেন।
-ঠাকুমা বললেন, হ্যাঁ দেখেছি। আমি সব জানি। কিন্তু ও গলায় দড়ি দিলো কেন?
-ঠাকুমা, সোনা দিয়েছেন ওকে। ও একা একা অন্ধকারে বেরিয়ে গেলো। আপনি ভুল করেছেন ঠাকুমা। সোনাদানা আর অন্ধকারে একা যুবতী মেয়ে। না না, ঠাকুমা এটা আপনি ঠিক করেন নি। পাড়ার লোক বলুক। আপনি ভাবুন তো একবার।
রাজু দেখলো ওর পাশে ওর সব শাগরেদ হাজির। ওদের দেখে ডাকাতের ছেলে রাজুর সাহস বেড়ে গেলো। বাপকা বেটা..বললো,শুনুন ঠাকুমা পুলিশ যদি জানে,আপনি নিজে সোনা দানা সমেত একটা যুবতী মেয়েকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছেন, তাহলে ঝামেলা হবে। তারপর পুলিশ এলে পোষ্টমর্টেম হবে। যদি রেপ হয়েছে বুঝতে পারে আপনার নাতনির বদনাম হবে। কাগজে,কাগজে ছেপে যাবে আপনার বাড়ির ইতিহাস। আপনার পরিবারের ইতিহাস। আপনার সমগ্র ইতিহাস।
-তা হলে কি করা যায় বলো তো। মেয়েটা তো মরেই গেছে। তাছাড়া আমি বুড়ি। এই বয়সে আমি অত ধকল সইতে পারবো না। তুমি যা ভালো বোঝো করো। আমাকে বাঁচাও।
-ঠিক ভেবেছেন আপনি। আমার উপর ভরসা রাখুন। আমি দিল দিয়েছিলাম ওকে। আমার কথা মনে করলো না ও। কি নিষ্ঠুর তুমি অনুপমা।
ঠাকুমা রাজুর চোখ মুছিয়ে দিলেন। বললেন,যা হয়েছে,তা আর ফিরে আসবে না। তুমি পাড়ার লোক ম্যানেজ করে তাড়াতাড়ি শ্মশানে নিয়ে যাও।
রাজু তার দলবল নিয়ে পাড়ার লোকদের বললো,আপনারাই বলুন। একা বুড়ি মানুষ পুলিশের ঝামেলায় যেতে চাইছে না। তাহলে আমরা কি মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাবো। পাড়ার সব লোক ফিসফাস করলো। কেউ ঝামেলায় থাকবে না। একজন বয়স্ক মহিলা বললেন,নিয়ে যাও,ওর ঠাকুমাই তো মালিক। উনি যা বলবেন,তাই করো। আমাদের আপত্তি থাকবে কেন?
রাজু ভাবছে এখনও শালি, বুড়িটা টাকা দিলো না। মদ, মাংস খেতে হবে। পাড়ার লোক,বন্ধু,বান্ধব,শ্মশান খরচ খানকি বুড়ি…
-তা হলে,ঠাকুমা, চাঁদা তুলি।
-আরে,ছি,ছি বলো কি? টাকার কোনো অভাব নেই। যত লাগে দেবো। সব তো নাতনির জন্যই রাখা আছে।
দশ মিনিট পরে ঠাকুমা রাজুর হাতে কুড়ি হাজার টাকা দিলেন। বললেন,আরও লাগলে দেবো। টাকার কোনো অভাব নেই।
রাজু টাকা নেয় আর ভাবে,শালি,আমার বাবার কাছে ঝারা মাল। আমার বাবাকে খুন করেছে তোর স্বামী। তার ফল ভোগ কর শালি,খানকি।
তারপর হাসি হাসি মুখে বলে,আর কোনো চিন্তা নেই। আপনি চেয়ারে বসে দেখুন।
রাজুর নেতৃত্বে তার দল আমগাছে উঠে লাশ পারলো। ট্রাকটর চলে এলো। কুড়িজন লোক সঙ্গে করে চলে গেলো শ্মশানে।
বন্ধুকে আড়ালে বলছে রাজু,শালা এবার বুড়ির পালা। তারপর ওই জায়গায় গজিয়ে উঠবে আমাদের আড্ডা। শালা প্রথমে ক্লাব হবে,পাশে মন্দির হবে।
রাজু বলে উঠলো,বল্লো হরি…
সবাই সমস্বরে বলে উঠলো,হরিবোল…
আবার বল্লো,…
(আট)
ঈশানী নদীর সঙ্গে অজয় নদীর ভারি ভাব।বন্যা এলে অজয় নদ আর ঈশানী নদী প্রেম সোহাগে সব ভাসিয়ে দেয়।
একবার বন্যায় স্টেশনে নেমে সমর দেখলো শুধু জল আর জল।যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু জলের ঢেউ।ভেসে যাচ্ছে খড়ের চাল,বাসনপত্র,গোরু,মোষ,ছাগলের দল।আর একটু পরেই স্টেশনে জল উঠে পড়বে।আশ্বিন মাসে প্রতিবার সমর পুজোর কেনাকাটি করে গ্রামে আসে।জল প্রায় প্ল্যাটফরম ছুঁই ছুঁই।সমর সতর্ক হলো।একটা গ্রামের ছেলে এসে বললো,সমরদা বাড়ি এলে।কিন্তু যাবে কি করে? সমর বললো,তোর মালপত্র কিছু আছে নাকি?গ্রামের ছেলেটির নাম রঘু। সে বললো,আমি বন্যার জল দেখতে এসেছি। সমর বললো,আমার এই ব্যাগ দুটো নিয়ে যেতে পারবি। তোকে পাঁচশো টাকা বখশিস দেবো।রঘু রাজি হলো। বললো,তোমার যতগুলো ব্যাগ আছে আমাকে দাও। সমর বললো,তার প্রয়োজন নেই। তুই দুটো নিবি। আমি দুটো নেবো। কাঁধে ঝুলিয়ে নে। তারপর ওরা গাছ থেকে দুটো শক্ত ডাল ভেঙ্গে নিলো।কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে, হাতে লাঠি নিয়ে ওরা নেমে পরলো বন্যার জলে। কোমর অবধি জল। রঘু আগে আগে চললো।সমর বললো,তোর ভয় নেই। স্রোত বেশি হলে আমি তোকে ধরবো।হঠাৎ একটা সাপ ওদের কাছে ভেসে চলে এলো। বেশ বড় শাঁখামুটি সাপ।রঘু বলে উঠলো,বাবা গো। সমর লাঠি দিয়ে সাপটাকে একপাশে স্রোতের মুখে ঠেলে দিলো। সাপটা ভাসতে ভাসতে চলে গেলো দূরে।
প্রায় দুঘন্টা পরে ওরা গ্রামে এলো।গ্রাম চেনা যাচ্ছে না। সমর দেখলো,মাটির বাড়ি সব ভেঙ্গে গেছে। গ্রামটা কেমন ফাঁকা লাগছে। সমরদের একতলা পাকা বাড়ি। কিন্তু ঘরে জল ঢুকেছে। তাই ছাদে ত্রিপল টাঙিয়ে বাড়ির আত্মীয়স্বজন সব আছে। সমর রঘুকে টাকাটা দিয়ে ব্যাগগুলো ভাইয়ের হাতে দিলো।তারপর ছাদে উঠে গেলো।বৃষ্টি শুরু হলো আবার। রেডিও খবরে শুনলো সমর,বৃষ্টি আরও তিনদিন হবে।এক লাখ কিউসেক জল ছেড়েছে। বন্যার জল আরও বাড়তে পারে। হেলিকপ্টার থেকে চিড়ে,গুড় ফেলা হচ্ছে বন্যার্তদের জন্য।সতর্ক বার্তা জারি হয়েছে রাজ্যবাসীর জন্য। সমর রেডিও বন্ধ করে ভিজে জামা কাপড় ছেড়ে চা খেলো।বাড়ির সকলের সমরকে দেখে খুব আনন্দ।কিন্তু দুর্গাপুজোর আগে বন্যার জন্য সব আনন্দ জলে গেলো। সমরের ভাই অমর বললো,পুজো বাড়ির ঠাকুর জলে ভিজে গেছে। অসুরের রঙ উঠে গেছে। আবার রঙ দিতে হবে নতুন করে। সমরের বাবা ব্যাগ খুলে দেখছেন,ছেলে কি বাজার করেছে।জামা,প্যান্ট, কাপড়,ধূতিসব সুন্দর হয়েছে।সমরের বাবা খুব খুশি।তিনি বললেন,কাজের মেয়ে রাণী আর মুড়ি ভাজুনির জন্য কাপড় এনেছিস তো?সমর বললো,হ্যাঁ,দেখো অন্য ব্যাগে আছে।
বাবকে খুব শ্রদ্ধা করতো সমর। তাই বাবার আদেশ মান্য করে শত বাধা অতিক্রম করে ভাইকে নিয়ে সে বাবার কাছে এসেছে। বাবা কত কষ্ট করেছেন তাদের মানুষ করতে। গোমো থেকে হাওড়া ছুটে বেড়িয়েছেন এক কালে। এখন বুড়ো হয়েছেন। বাবাকে তাই কোনো দুঃখ দিতে চায় না সমর।
সমর গ্রামে বের হলে দেখলো বি রাজুলের ঘর নেই।সন্তু জলে দাঁড়িয়ে, রাজু,অনুপমা,দাদুর আমগাছে।দাদুর জনপতি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এই বন্যায়।সমর ছোটো থেকে বাইরে থাকে।তার জানাশোনা বড়ো বড়ো লোক আছে।
সন্তু বল, তুমি আমাদেরকে শহরে নিয়ে চলো সমরদা। বিরাজুল বললো,না আমরা সবাই এক হয়ে আবার গ্রাম নতুন করে গড়ে তুলবো।গ্রামের সবাই একমত হলো।সমরও সমর্থন করলো।সমর বললো,এবার বাঁধ হবে।নবীন জোয়ারের ফলে এক বছরের মধ্যে গ্রাম নব সাজে সেজে উঠলো। ভারতীয় গ্রামের মায়া ঘিরে ধরলো নব সভ্যতার শিকড়।
স্কোয়াড সাবধান। এক। বায়ে মুড়। এক। স্কোয়াড আগে বাড়ে গা আগে বাড়। এক দো এক।…..
– এইগুলাইন রাস্তায় ফালায়েন না ভাইসাহেব। রাস্তা নোংরা হয়। আলভি ঘুরে ছেলেটার দিকে তাকায়। ছেলেটার…..
চান্ডুলি গ্রামের মধু লরির ড্রাইভার।মধু বলছে মালিকের মাল লরি করে চলে যায় ত্রিপুরা,ঝাড়খন্ড,বিহার,উত্তরপ্রদেশ,পাঞ্জাব পর্যন্ত। সারা…..
অনেকদিন হলো স্নেহময় বাইরের বারান্দায় বেরোন না। বাইরে যেতে বড় অনীহা তাঁর। ঘর আর উঠোনের…..