উন্মাদোত্তম

সুমন মজুমদার
ছোটগল্প
Bengali
উন্মাদোত্তম

রাত নিশুতি হলে এ পাড়ায় কতগুলো কুকুর ডাকে। ওদের সম্মিলিত ঘেউ ঘেউ ডাকের মধ্যে এমন একটা কিছু আছে, যা শুনলে আমি ঘুমিয়ে থাকলেও চমকে উঠে বসি। মনে হতে থাকে, অন্ধকারে বুঝি কোন আঁততায়ীরা আসছে আমাকে নিতে। ওদের ছায়া ছায়া ঔর্ধত্যপূর্ণ অবয়ব দেখেই কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে। আসলে ভয় নিয়ে আমি অপেক্ষা করলেও কোনদিনই কেউ আসেনি। তারপরও রাতে ঘেউ ঘেউ শুনলে আমি অজানা ত্রাসে ভুগি। সম্প্রতি আমি বাজারের সবচাইতে রগরগে মাংশাসী দোকানটা থেকে একটা চাপাতি আর দা কিনেছি। আগ্নেয়াস্ত্র কেনার স্বামর্থ আমার নেই। যদি থাকতো, অবশ্যই চমৎকার দেখে একটা কালো চকচকে শরীরের স্বয়ংক্রিয় বন্দুক কিনতাম। বন্দুকের নল রঙটা এতটাই চকচকে হতে হতো, যাতে আমি হাসলে ওটার গায়ে চেহারা স্পস্ট দেখা যায়। একদিন অফিসের সবাই চলে গেলে, ইউটিউবে ঢুকে বন্দুকের দরদামের ভিডিও দেখেছিলাম। অস্ত্রের কালোবাজারের ওই ভিডিওতে বন্দুকের দাম যা দেখলাম, তাতেই বুঝে গেছিলাম যে এটা কেনা আমার কর্ম না। পত্রিকায়ও দেখেছি, সন্ত্রাসীরা কত মোটা টাকার বিনিময়ে অস্ত্র ভাড়া দেয়। কিন্তু আমার সে টাকা নেই, আর গায়ে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীর সিল পরে যাওয়া কাউকে আমি চিনিও না। চিনলে অন্তত বলতাম, ভাই আমি গরীব মানুষ। সারাদিন এটা ওটা নিয়ে খাটাখাটি করেও সংসার আমার বুকের উপর জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসেছে। অন্তত একটা দিনের জন্য হলেও আপনার অস্ত্র আর গুলিগুলো চাই। অকর্মন্য উচ্ছিস্টের মতো সমাজের আস্তাকুরে চাপা পরা আমি একদিন অন্তত মনের সুখে অস্ত্রের ক্ষমতা হাতে দাপিয়ে বেড়াব। এরপর দাম হিসেবে না হয়, যা খুশি তাই দিয়ে আমাকে খাটিয়ে নেবেন। কিন্তু কথাগুলো কাউকে বলা হয় না। ভিআইপির বাড়ির সামনে বালু রঙের উর্দি পরা কোতয়াল দেখি, রাস্তায় গল্পের জল্লাদের মতো কালো রঙের পোশাকে দেখি যমদূতদের গাড়ি হাঁকাতে। ওদের সবার হাতে কী সুন্দর সুন্দর সব অস্ত্র। ওরা বুঝতেও পারে না, কী লোভাতুর দৃষ্টিতে লোকাল বাসের ঠেলাঠেলিময় ফাঁক গলে জানলা দিয়ে আমি শুধু ওদেরই দেখি। মনে মনে ভাবি, ইশ কোনভাবে যদি ওদের একটা দোদণ্ড প্রতাপি বন্দুক হাতে পেতাম, তাহলে প্রথমেই আকাশের দিকে নল তুলে ট্রিগারের এক টিপে গোটা ম্যাগজিন খালি করতাম। গুলির শব্দে ভয়ে পাখিরা পালাত দিগবিদিক, প্রাণ ভয়ে কুকুরগুলো লুকোত কোন ল্যাম্পপোস্টের আড়ালে। দাঁত খিঁচিয়ে চলা সব গাড়ি, গলা টিপে ধরা ভিড়, কুয়াশার ছদ্মবেশ নেওয়া ধুলাগুলো পর্যন্ত থেমে যেত অনায়াসে।  মানুষ ছুটতো পড়িমড়ি করে। আর আমি বদ্ধ উন্মাদের মতো আকাশ খুনের আনন্দে চারপাশ কাঁপিয়ে হাসতাম। কিন্তু বন্দুক আর পেলাম কই, তাই কল্পনাতেই সব সার হয়ে রয়েছে। তবে আমার এই চাপাতি আর ধারাল দা কম কিসের। হিংসার মতো চকচকে ওদের দায়ে ঠিকই আমার ছায়া আমি দেখতে পাই। যখন ঘরের ক্ষয়ে যাওয়া সিমেন্টটায় কিচকিচে বালুতে দা-চাপাতি ধার দেই, ওরা যেন রক্ত চাই, রক্ত চাই, প্রেমাংশুর রক্ত চাই জিকির ধরে। আমি অবাক হয়ে ভাবি, ওরা কিভাবে প্রেমাংশুর কথা জানলো! কেমন করে ওরা বুঝেছে, কোনো কিছুতেই কোনোদিন কেউ কিছু দেবে না জেনেও কতবার ভেবেছি একাকী বাড়ির পাশের রোগা নদীটির কাছে বসে বসে। মানুষ যেমন একা, অসহায় নিজের কাছেই। একদিন যদি ধরে পড়ে যায় সে, তখন কোন অজুহাতে, কার নামে চোখ থেকে ফেরাবে মৃত্যুকে? ধার ফলার সেই অদ্ভুত জিকির আমাকেও প্রভাবিত করে। আমিও তখন ফিসফিস করে বলি- প্রেমাংশুর বুকের রক্ত চাই, হন্তার সাথে আপোস কখনো নাই।

আজ ঘুম থেকে উঠেই ঠিক করলাম ধার চকচকে দা-চাপাতি নিয়ে জনসমক্ষে ছুটে যাব। প্রতিদিন অফিস যাওয়ার সময় ফার্মগেটের ওভার ব্রিজটায় দেখি কেমন ছলাকলা মুখ করে সাড় বেঁধে কত রকম দোকানিরা বসেছে। নিচে নামলে দেখা যায়, ফুটপাত ধরে লাইন দিয়ে পণ্য সাঁজিয়েছে ঠেকায় পরা গলাবাজরা। আর রাস্তার দুই পাশ ধরে যখন তখন ছুটছে বাস-গাড়ি, হনহনিয়ে একে অন্যকে ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে ব্যস্তাতার ভান করা মানুষ। প্রতিদিন আমি ওদের দেখি আর অবাক হই। নিশ্চই ওরাও আমাকে দেখে অবাক হয়, নয়তো এমন অদ্ভূত চোখে তাকাত না। তবে আমি সেই দৃষ্টিকে পাত্তা দেই না। আমার কেবল মনে হয়, ওদের এই গোবেচারা জীবনযাপনই আজ আমার মতো অসংখ্য লুকোন মানুষের উন্মাত্তোম হওয়ার কারণ। সব মানুষের উপর, প্রতিটি জীবনের প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা হয়। মাস শেষে যখন মুষ্ঠিমেয় কটা টাকা নিয়ে আমি হিসাব করতে বসি, জীবন কিভাবে চলবে, কাকে কিভাবে খরচ দেব, কার কাছ থেকে কত ধার করা যায় ইত্যাদি ইত্যাদি, তখন গোটা দুনিয়ার উপর যেন আমার ক্ষোভ চড়ে যায়। ঠিক তখনই কেবল আমি চোখের সামনে রক্তের ছড়াছড়ি দেখতে পাই। পরশু বাড়িওয়ালা এসেছিল বাসা ভাড়া বাড়াবে। বাজারে দেখেছি আগুন লেগেছে চালের বস্তায়। পোকায় কাটছে রুটি দলা, সোনার দরে যেন বিক্র্রি হচ্ছে মটরদানাও । আজ বাড়ছে গ্যাস জল বিদ্যুৎ ওষুধ চিকিৎসার দাম তো, কাল উপরের দিকে ছুট লাগাচ্ছে একটু শান্তির সর্বনিম্ন দর। অথচ ধনীদের গোলা দিনকে দিন ভরে উঠছে আরও সোনা রূপায়। ব্যাংকে ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদদের হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপী ঋণ, লাখ লাখ কোটি যাচ্ছে বিদেশের বেগমবাজারে, ফাইভ স্টার হোটেল, রেস্তোরাঁ, বারে ঢেউ উঠছে নারী দেহের, উপচে পরছে বিদেশি সুরার পেয়ালা। ছোট্ট গরীব মজুরটির সর্বস্ব শ্রম কিংবা কৃষকের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফসলও যেন শুধু খানেওয়ালাদেরই পেট ভরাবে। বাকিরা মরবে আধপেটা, ধুঁকে ধুঁকে, পচা-গলা দূষিত কিছু খেয়ে। তবে এর মধ্যেও কমেছে শুধু একটা জিনিসের দাম। তা হলো মানুষের মাংস। যখন তখন যেথায় সেথায় কসাইরা আজ মানুষ জবাই করছে। উষ্ণ রক্তের ঝাঁঝাল নেশায় কেমন মাতোয়ারা চাকদিক। তাহলে আমি কেন উন্মাদোত্তম হবো না, কেন দা-চাপাতিটা নিয়ে দৌড়ে যেতে ইচ্ছে করবে না সব মানুষের মাঝে। আমি তখন কারও কথা শুনবো না, কারও দিন গুনবো না। তখন শুধু চারদিকে দলা দলা ফালি ফালি মাংস আর রক্ত দেখতে চাই। দুনিয়ার সবকিছু খুন করে আজ আমি নিজে খুন হবো। ‍পৃথিবীর প্রতিটি জিনিসের উপর আমার প্রতিশোধ চাই।

এখন সময় খানিকটা সন্ধ্যা সন্ধ্যা। আলো আছে, তবে খুব বেশি কালো নেই। একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের জন্য আমার আবারও খুব আফসোস হলো। কী আর করা, দা-চাপাতি হাতে নিয়েই ঝাঁপিয়ে পরতে হবে। দিগবিদিক শূন্য হয়ে আজ কেবল কেটে যেতে হবে সবার গলা, যাতে রক্ত ছিটকে এসে ঝকঝকে ভবনগুলোর দেয়াল রাঙিয়ে দেয়। যাতে বৃষ্টির জলের মতো রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নর্দমায় গিয়ে মেশে রক্তের ধারা। যাতে সদ্য কোরবানী হওয়া পশুর মতো জবাই হওয়া মানুষ জীবনে শেষবার তার হাত পা প্রবল স্বাধীনতায় তড়পাতে পারে। এই যে এত ব্যস্ততা, এত ছোটাছুটি, কোলাহল; মানুষগুলো বুঝতেও পারছে না, আমাকে দেখতে যত নিস্তেজ গোবেচারা মনে হোক না কেন, আমিই আসলে তাদের তৈরি সেই উন্মাদোত্তম হন্তারক। মুখ দেখে যদি মানুষের মনের ভাষা পড়া যেত, তাহলে নিশ্চই কেউ না কেউ আমাকে দেখিয়ে সম্রাট টাইবেরিয়াসের মতো বলতো, সিজার নামে রোমের গর্ভে যেমন এক বিষধর সাপ বেড়ে উঠেছিল, এই লোকটাও তাই। সত্যিই কখনো কখনো আমার নিজেকে ক্যালিগুলা সিজারের মতো লাগে। উন্মাদ, বিকারগ্রস্ত, বিশৃঙ্খল, অরাজক, সন্দেহপ্রবণ, হিংসাত্মক, প্রতিশোধ পরায়ন খুনি। আমার ভেতর দিনে দিনে এত ঘৃণা জন্মেছে যে, ক্ষমতা থাকলে আমি পৃথিবীর সব মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দিতাম। কেউ বাধা দিলে ক্রডিয়াসকে যেমন সিজার বলেছিল, তেমনটাই বলতাম- তুমি কি ভুলে গেছ হতভাগা, আমার হাতে অস্ত্র আছে। অস্ত্র মানে ক্ষমতা, আর ক্ষমতা যা ইচ্ছে তাই করার লাইসেন্স। এতদিন একা একা অন্ধকোণে গুমড়ে গুমড়ে আমি মরেছি, আজ তোমাদের মরার পালা। তোমাদের হাড় মাংসের প্রতিটি দলা আজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হবে শকুনের খাদ্য হিসেবে।

অবশেষে সন্ধ্যা নেমেছে। নির্মম রক্তক্ষয়ী এই শহরে জ্বলে উঠেছে ‍পূঁজ রঙের হলদেটে আলো। এর মাঝে অন্যান্য দিনের মতো ব্যস্ত ফুটপাতে আজও একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে নিরাশ ভঙ্গিতে। তার চোখ ভাবলেশহীন, অথচ ভালোভাবে দেখলে মনে হবে সে কিছু বলতে চায়। অদ্ভুত এই লোকটা কখনো সন্ধ্যা কখনো বা দুপুরের ভর রোদে নিজেকে মানুষের ভিড়ে ভাসিয়ে দিয়ে মানুষ দেখে। ওর হাত যেন কিসের অকুতিতে নিশপিশ করে, কিন্তু কিছু খুঁজে পায় না। অবশ্য এমনটা ভাবার কারণ নেই যে ও একা। তার মতো আরও কয়েকজন নির্লিপ্ত অথচ কিছু ধরতে চেয়ে হাত নিশপিশ করা মানুষকে একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় এই ফাটকাবাজির ক্ষমতাবাজ শহরের বিভিন্ন রাস্তায়। কারো কারো নিশ্চই ভয় হয়, যদি কখনও এই অদ্ভুত মানুষগুলোর একে অন্যের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, তাহলে তারা কী করবে? আপাতত এই উত্তর দেওয়ার সময় হয়নি।

সুমন মজুমদার। গ্রামের বাড়ি ভোলাতে হলেও জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। বাবা অমৃত মজুমদার ও মা ঝর্ণা মজুমদার। মিরপুর বাঙলা কলেজ থেকে এইচএসসি শেষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক। বর্তমানে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় সহবার্তা সম্পাদক পদে কর্মরত। বিভিন্ন পত্রিকা ও...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ