পাঠ প্রতিক্রিয়া ‘আমার সপ্তাহান্তেরা’- ইসরাত জাহান
উপায়ন “রাত জেগে বই পড়ার একটা আলাদা ভালোলাগা আছে। চারিদিকে চুপচাপ আর নৈঃশব্দ্যের ভিড়ে বইয়ের…..
‘বিষ্যুদবারের ভালোবাসা কী গভীরতম, কতটা অমলিন, এইদিনে কোনো কথা নেই, গান ছাড়া।’
লাইনগুলি পড়ে প্রথমেই আপনার মাথায় ঠিক কোন দৃশ্যটি ভেসে ওঠে! একবার ভাবুন তো! কবি নাঈম ফিরোজের কবিতার বই ‘উবে যাও জলচোখ‘ থেকে ‘বিষ্যুদবারের ভালোবাসা‘ কবিতাটি থেকে এহেন জিজ্ঞাসার সুত্রপাত। ষোলো সালে প্রকাশিত এই বইটি যে সময়ে এসে পড়ছি, সে সময়টা মনের অজান্তে হোক আর সজ্ঞানেই হোক বিষ্যুদবার নিয়ে আলাদা এক ফ্যাসিনেশনের দিকে নিয়ে যায়। হয়তো এক্ষেত্রে ব্যক্তির অবস্থান অনেকটাই সাহায্য করে গেছে। সেযাইহোক বিষ্যুদবার নিয়ে কিছু বলতে গেলে আর কিছু লেখা হবে না, সেটা অন্য ঘটনা। তারচেয়ে বরং এই কবিতাটির আরও কিছু অংশ আমার মতো বিষ্যুদবার ভক্তদের জন্য পাঠ করা যেতেই পারে,
‘মেরুদণ্ড তো তার প্রার্থিত আরামকুর্সি আর খোঁজে না ওইদিন?… বিজ্ঞ বিষ্যুদবারে। বেগুণী নীলচে আকাশস্থ লালরঙ মুন, চন্দ্রকলা আর চন্দ্রগ্রহণ এর আভাসমাত্র। পুনশ্চ, বিষ্যুদবারে ভালো- অভালো না খেলে আগমনী দিনটিকে আনন্দবাহী মনেই হয় না।’
রুটিন মেনে চলা মানুষগুলোই শহরের আশ্চর্য ফুল। এই বোধ যখন মাথা ছাড়া দিয়ে ওঠে, তখন এমন একটা দিন ঘিরে একটা কবিতায় যা ফুটিয়ে তুলেন নাঈম ফিরোজ, তা আমাদের কথাই বলে। এই কবিতাটিতে কোনো বাড়তি মেদ পাওয়া যায় নি। আতিশয্যের ভরাডুবি ছাড়া নির্ভার একটি কবিতা, ‘বিষ্যুদবারের ভালোবাসা’। তো এই ভালোবাসা, এই ঘোরে ডুবে যাবার আগেই ক্ষণ পাল্টাতে চাই। আর তখনই ‘স্কাইস্ক্রাপারস্নাত ঢাকার ছবি‘র দিকে চোখ চলে যায়। যে ছবির দিকে মনোযোগ দিলে মোহ ভঙ্গের জন্য হতাশ হতে হবে না। বরং এমন মনে হবে যে আরও গভীরে মিশে যাচ্ছে মানুষের চোখ। তো একবার রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলে যাক ‘স্কাইস্ক্রাপারস্নাত ঢাকার ছবি‘,
‘হাতের নাগালে বটলগ্রিন, বিবালদির টিউন।
চিলের কেন্দ্রাভিগ ছোবল উদ্বাহু কফিরং স্কাইস্ক্রাপার
ক্রিসেন্ট চূড়াবাঁধা সাদার মিনার, অত্যুন্নত প্যারাবোলা।
ওপারেও হাই তোলে সবুজে খয়েরি টাওয়ার্স, দালানকোঠা।
জানালাবিবশ দিন, মেঘময় কথার তুবড়ি, ঝুলিয়ে রাখা হ্যামোক।
অথচ বাবার কথা মনে পড়লেই ঢাকার রাধাচূড়া ও জারুলের গল্প শুরু
হয়।
এই দূর ইতিহাসবিশ্রুত সভ্যতামাখা চারশো বছরভর
কোন গানে মগ্ন ছিলে তুমি, শহর?’
কবিতাটির ভিতর দিয়ে একটা শহরকে যেভাবে দেখা গেলো, সে দেখা সুন্দর। আর সাথে যদি বিবালদির টিউন মিশে যায়, তবে তো ফোর সিজনই চোখে অথবা মননে ফুটিয়ে তোলে গোটা শহর। তাছাড়া লাইনে লাইনে যে উপমা খুঁজে পাওয়া যায়, সে উপমাও আমাদের চেনা, যেমন এ শহর ও তার অলিগলি আমাদের চেনা। আর চোখ বন্ধ করতেই যখন দেখি সবুজ খয়েরি টাওয়ার্স, একটা চেনা শহর দেখি নিমিষেই চোখের ওপারে থেমে গেছে। কবিতাটির একটা লাইন বিশেষভাবে ভাবিয়েছে, ‘অথচ বাবার কথা মনে পড়লেই ঢাকার রাধাচূড়া ও জারুলের গল্প শুরু হয়‘। এই লাইনটি নিঃসন্দেহে সুন্দর এমন নস্টালজিক কোনো সময়ের প্রতিফলন। কিন্তু পরিচিত শহরটিকে যখন ‘স্কাইস্ক্রাপারস্নাত ঢাকার ছবি’র মাঝে দেখি, তখন কি এক বিচ্ছিন্ন কারণে এই লাইনটিকে অপরিচিত মনে হয়। মনে হয় যেন হঠাত করেই একটা লাইন এসে জুড়ে গেছে। সে হিসেবে বিচ্ছিন্নতা আসাটাই স্বাভাবিক। যদিও পরিচিত শহরটির পরিচিতির পিছনে এইসব রাধাচূড়া ও জারুলের গল্পই মূলসুর। যে সুরে ভেসে ভেসে বলতেই হয়,
‘এই দূর ইতিহাসবিশ্রুত সভ্যতামাখা চারশো বছরভর
কোন গানে মগ্ন ছিলে তুমি, শহর?’
এবার ‘ফেলে না দেয়া পুরনো চশমার ফিরিস্তি‘ শোনা যাক। কবি নাঈম ফিরোজের ‘উবে যাও জলচোখ‘ কাব্যগ্রন্থ থেকে এই কবিতাটি কোন এক বিচিত্র কারণে আমাকে অতীতের দিকে নিয়ে গেছে। মনোযোগী পাঠক নিশ্চয় কবিতার ভিতর ডুবে যেয়ে নিজেদের অতীত দেখতে চাইবেন, তো সে সুযোগ নিতেই একবার পাঠ করে নেয়া যাক ‘ফেলে না দেয়া পুরনো চশমার ফিরিস্তি’,
‘উড়বো।
এটা আগেই ব্যক্ত করেছি বিভিন্ন কবিতায়।
তাই তো ক্রমবদল জ্যোতি নিয়ে কোটরনিহিত চোখ আজও
সংবেদনশীল।
ফ্রেড, রিমলেস, হাফ রিম, পোরশে-
ইতালির নাম লেখা এই ফ্রেমগুলো পড়ে আছে ট্রাংক কিংবা দেরাজে।
জানি, তাদের সাথে একই কাতারে ঘুমায়
লেন্সে জমানো অশ্রুবান, মেমোরির মনোলগ আর জোডিয়াকমুখিন
লিবিডোর সিলুয়েট।
মানুষের জীবনলয়তক অফুরান বিগতব্যবহারে চশমার জ্যোতি কমে কি?
বাবা-মার ত্যাজ্যবিত্তে উত্তরাধিকারমূলে চোখ পাওয়া যায়, চশমা তো
না।’
‘উবে যাও জলচোখ‘ কাব্যগ্রন্থের একটি উজ্জ্বল কবিতা ‘ফেলে না দেয়া পুরনো চশমার ফিরিস্তি‘। একটা যান্তব টাইমফ্রেম কবিতাটির শেষদিকের লাইনগুলিতে যেভাবে আঁকা হলো, এরই সাথে নানাবিধ শব্দের বাহার মিলেমিশে কবিতাটিকে অন্যমাত্রা দিয়েছে। বিশেষ করে কবিতায় ব্যবহৃত জিজ্ঞাসাটি ‘মানুষের জীবনলয়তক অফুরান বিগতব্যবহারে চশমার জ্যোতি কমে কি?‘, যেকোনো হৃদয়েই ছাপ রেখে দেয়। আর নতুন নতুন সব জিজ্ঞাসা এসে শান্ত করে দেয় যখন শেষের লাইনটিতে এসে চোখ থেমে যায়। যদি চোখ থেমে যায়, জিজ্ঞাসার উত্তরে কিছু কথা ঠিকই জমা রয়, তাই নিয়ে বিরতি খুঁজে চলে মানুষ। ঠিক সেই বিরতির দিকেই এগুচ্ছি আমি ও আমরা। তেমনি এক বিরতির কথা বলব এখন, যা বলতে গেলে ‘আর্কাইভসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম‘ কবিতাটি পাঠ জরুরী হয়ে পড়ে। এই কবিতাটির নামই হয়তো কবি নাঈম ফিরোজের আরও কোনো নতুন কাব্যগ্রন্থের নাম হতে পারে, এমন বিক্ষিপ্ত ভাবনা যদিও ব্যক্তি অর্থাৎআমার নিজের। কিন্তু যখনই কবিতাটির নাম চোখে ভাসে, এরকম কিছু ভাবনা ঠিকই আমাকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়। সেযাইহোক নাম বিষয়ক পাঁচালিতে না যেয়ে একবার কবিতাটির কয়েকছত্র পড়ে নেয়া যাক,
‘দ্বিপ্রহর, এখন নাবে রাত্রন্ধ লাভবার্ডস।
আক্ষরিক আপেক্ষিক আক্ষেপ আজো আসবে।
‘প্রচন্ড আবেগান্ধ’ এক অহং ভড়কে দেবে মানবকোষ।
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক জেগে ঘুমিয়ে এবার জাগিয়ে ঘুমিয়ো,
স্কাল।
এইরে আমি তো আর্কাইভসে, তবে কি কুম্ভকর্ণ
আর রিপ ভ্যান উইনকেল আধা- আধি?’
ভাষার মিশেলে কোনো কিছু গড়ে তুলতে চাইলে এর অন্তর্নিহিত অর্থ থাকা জরুরী বলছি না, কিন্তু একটা স্রোত তো ঠিকই খুঁজে ফিরি আমরা। এই কবিতাটি তেমনই এক স্রোতের খোঁজ দিয়ে যায়। আর কিছু দৃশ্যের খোঁজ দিয়ে যায়, কিছু ছবির খোঁজ দিয়ে যায়। নাঈম ফিরোজের কবিতার এই হলো অদমনীয় দিক, যে দিক আপনাকে ঠিকই কোনো না কোনো দৃশ্যে কিংবা ছবিতে মোহাচ্ছন্ন করে যাবে। আর সেক্ষেত্রে তিনি যেসব শব্দ ব্যবহার করে থাকেন কবিতায়, তার রূপ কখনো কখনো জটিল হলেও ঠিকই বোধের প্রশ্নে টিকে যায়। যদিও কিছু কবিতায় দাড়ি, কমার ব্যবহার কবিতা পাঠে বাধা দিয়েছে, কিন্তু সে বাধা ঠিকই দৃশ্যের কাছে হেরে যায়। কেননা জটিলের ভিতরেই তিনি সহজ। যে সহজের খোঁজ ‘আর্কাইভসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম‘ কবিতায় পাওয়া যায়। ঠিক তেমনি আরও একটি কবিতার খোঁজ দিতে ইচ্ছে করছে। ‘উবে যাও জলচোখ’ কাব্যগ্রন্থের আরও একটি উজ্জ্বল কবিতা ‘কাকতাড়ুয়া পারে আমি পারি না‘। কবিতাটি এই সময়ের জন্য আরও উজ্জ্বল তো বটেই। একবার পাঠ করে নেয়া যাক ‘কাকতাড়ুয়া পারে আমি পারি না‘,
‘কাকতাড়ুয়া পারে, আমি পারি না! এমনকি এই নথিক্লান্ত বিকেলও না! জেরায় জেরবার এজলাশের লালসালুর জ্যামিতিও না! ‘মেন ইন ব্ল্যাক’ কলরোল করে মনানুসারে অথবা ‘ট‘ মুদ্রার উষ্ণতায়, অর্থবোধক। আইনিজলশা থেমে গেলে রেশ রয় ক্রমান্বয়িক শুনানির, রূপকথাপ্রচল দীঘল কালোহাতের অপার অপারগতা, জুডিসিয়াল হাত বাজায় নিয়ত কলমসিম্ফনি… নিভৃতে কাঁদে কার বাণী?… আমি জানি। বস্তুত কাক তাড়িয়ে কখনো কোথাও মানুষের কান্না থামানো যায়নি।’
‘নিভৃতে কাঁদে কার বাণী?‘ এইরূপ জিজ্ঞাসা থাকা ভালো। আর কেনইবা কাক তাড়িয়ে কখনো কান্না থামানো যায়নি, এসকল কারণ নিয়ে যতবার ভেবেছি, চারপাশ থেকে ঠিকই বাতাসে অথবা কোনো অবসাদে এসকল কারণের যথার্থতা টের পেয়েছি। যদিও কবিতাই বলছে ‘ট‘ মুদ্রার উষ্ণতা কতটা অর্থবোধক হতে পারে। সে যাইহোক এই ভাবতে গেলে প্রসঙ্গ পাল্টে যাবে, আর প্রসঙ্গ যেহেতু পাল্টাবেই তো অন্যদিকেই পাল্টাক। সে হিসেবে একবার ‘জ্যোতি ও জজবন্দি, এবার‘ কবিতাটি পড়ে নেয়া যাক,
‘দুই শূন্য এক পাঁচ তুমি এলে? আমিই যেতাম নাহয় তোমারি মোকামে। ক্যালেন্ডার ও ডায়েরি কিনে আসার সময় স্টপওয়াচ ফেলে আসতাম,
বেভুল। গিলোটিনে তিলোত্তমাকে ঝুলিয়ে আবারও আসতাম ব্রডগেজে
ভেসে ভেসে। বুঝলাম অবারিত আক্যুমেন নিয়ে জীবনায়ন হলেও অদ্ভুত
আলোয় অকারণ জেগেছি এতাবৎকাল। এই বছরভর জজবন্দি খেলা
এড়িয়ে যাবো, ভেবেছি।’
বস্তুত এই জজবন্দি খেলা এড়িয়ে যাবার মতো দুরূহ কাজ আর কিছু নেই। মেলোডিক এই কবিতাটি একটানে পড়ে ফেলা যায়। আর পড়তে যেয়ে বারবার জীবন ও বোধের প্রশ্নে আপনাকে ভেবে যেতে হবে। তবু সময়ের কাছে যে সকল দাবী আমরা প্রকাশ করে থাকি, তা আদৌ মিটে নাকি! এই জিজ্ঞাসা রেখে কবি নাঈম ফিরোজের ‘উবে যাও জলচোখ‘ কাব্যগ্রন্থের কবিতা, যে কবিতার নামে এই বইয়ের নাম, সে কবিতাটির কিছু অংশ পড়ে আলোচনা শেষ করতে চাই।
‘উবে যাও জলচোখ
উবেছে যতসব উইকেন্ডের ঘুম,
ভিয়েন, গ্লুকোজবোতল ইত্যাদি।
ভাইব্রান্ট পেলবতা, রোদেলা শহরচিত্র আমাদের উরগ গতি
আকাশি অজিনে উত্তাপ নিয়ে
গ্রাফাইট উপত্যকা পেরিয়ে যাওয়ার দিনে
ক্ষীপ্রগামিনী চিত্রল হরিণের জলচোখে চিতার চিন্তা আসেনি।’
উপায়ন “রাত জেগে বই পড়ার একটা আলাদা ভালোলাগা আছে। চারিদিকে চুপচাপ আর নৈঃশব্দ্যের ভিড়ে বইয়ের…..
রুমী, খৈয়াম, হাফিজের কয়েক শতাব্দী পর এলেন গালিব। মির্জা গালিব। এত দিতে সুরাপাত্র ও…..
টমাস মান (Tomas Mann) – এর বুদেনব্রুক (Buddenbrooks) বইটি মূল জার্মান ভাষায় পড়ার পর কিছুটা…..
ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show (Last Episode) পূর্ববর্তী পর্ব এখানে>>>…..