উমাপদ করের শিরোনামহীন কবিতা

উমাপদ কর
কবিতা
Bengali
উমাপদ করের শিরোনামহীন কবিতা

এক.

এই বেলা শুনে নেওয়া যাক পাথরপ্রতিমা
তার চালি ঘিরে প্রজাদের বিষয় আশয়
দেশের মানচিত্রে ভরে থাকা চুমকি ও জুঁই
দিয়া জ্বেলে দেখে নেওয়া যাক ত্রিনয়ন, হতে চাওয়া পতাকা

কাঠামোকে বলি দেবী হও, রঙকে বলি পূর্ণিমা নিয়ে এসো
জেগে থাকো রাসের পুতুল
ঘাই মারো শিং, বলি দেবে এমন পশু
রাতের কিনারে এসে চাওয়াকে পাওয়া করে নেয় অলক্ষ মেঘ

কাউকে তো দিতে হবে ডালি, তারা কুড়োবে
ধুয়ে মুছে সাফ করতে হবে মনে লুকোনো রেকাবি
অধিনতার সাজ খুলে ফেলে চামচ ও হাতা
আমাকে রাতের আরতিতে ডেকো, ঘণ্টা বাজাবো

ফেলে দেওয়া শোকের পুনর্জন্মে এত আয়োজন
সুখের শাকে ভাত মেখে খেতে লজ্জা মানায় না
অসময়ে রাত এলে মানাতে পারে না পাখি
কোণ থেকে দেখে ফেলা প্রতিমাপাষাণ আমার মধ্যে প্রাণ বুদবুদ হতে থাকে।

দুই.

গলতে থাকা সোনা থেকে আংটি, সোনার আংটি
জল থেকে বরফ, বরফের চাঁই
আমার শৈশব থেকে আজকের আমি, শুধুই আমি
মাঝখানে পড়ে থাকা অনেকটা কার্পেট

আংটি ও অঙ্গীকার একই মুদ্রার সকাল বিকাল
বসন্তের কোকিল সেকথা ভালোই জানে
ঝুরো বরফের বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তুমি কি আদৌ ভিজতে পারো!
আমার আমিটুকু ছাড়া সবই যে বদলে যায়

প্রতারণার পায়ের মল ঝুমঝুম বেজে উঠতে পারে
জলের মধ্যে ডুবে ডুবে ভেসে যেতে পারে বরফ
আমার পায়জামা কবেই যে ছোট হয়ে বাড়মুডা, মনে নেই
আজ জলের মধ্যে কার যেন পুরোনো চপ্পল দেখি

সুন্দরী গালের টোল একবিন্দু জলে ভরে দিতে চায় চশমার কাচ
হুররে দিয়ে ওঠে বাতাসের শনশন
ফেলে ফেলে যাওয়া কথা থেকে স্টেনলেস স্টিলের থালা চমকায়
খুন হয়ে যায় হীরে বসানো সোনার আংটি।

 

তিন.

কতটা হাঁটলে ঘুমভরা রাতের পিল-টা আর খেতে হয় না
এখনও ঠাওর হল না ঠিক
জবাকুসুমের পর চায়ের কাপে চিনি থাকবে কি থাকবে না
এখনও জরাসন্ধের সমান দু-ভাগ

প্যারাসিটামলের শরীরে জ্বর, দিন সরানোর খেলায় মেতে থাকে
বকধার্মিকের বকটা, ধর্মটাও
রাতের বিছানা থেকে গরম ভাঁপের কণাগুলো কতটা তীক্ষ্ণ হলে
ঘুম-পারদ তলানিতে, স্বনির্বাচিত

ভাঙা ক্রাচের ওপর ভর করা দিনের দুপুর থেকে পাখি উড়ে গেলে
ভাবি, যাক, ঘুমের খোলশ ছেড়ে মুক্তি
ভাবি, গায়ের জামাটার শরীর ঢাকা ছাড়া বাড়তি ভূমিকা কিছু নেই
ঘুমিয়ে পড়ে না তবু, এত আঠা

খুশিকে নারী হতে বলি, সন্তোষকে পুরুষ
আমার ভেতরে তারা পরকীয়া করুক
আমি নাহয় ট্যাবলেটে ঘুম লিখে হাঁটতে বেরবো
আঁধার হওয়ার একটু আগে-আগেই।

 

চার.

আলুক্ষেতের সীমানা এবার আমার বাড়ির চৌহদ্দিতে
মখমল সবুজ চোখে এসে জুড়োয়
রেটিনাকে শান্তি দেয় যতক্ষণ চেয়ে থাকি ভুলভাল দেখা ফেলে
ফেরায় না ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’, গ্রহণ করে

বসতবাড়ির আরেকদিকে ফেরিঘাট, চরে ভাঙা নৌকার গুলতানি
ডিঙিনৌকো একা একা ভাসে, আমি দেখি
ফেরাবার কেউ তো নেই ফেরি-নৌকা ছাড়া
দুটোকেই এক দড়িতে বাঁধি

সব বলে ফেলার পর আলুক্ষেতের জন্য কিছু বাকি রইল না আর
ফেরিঘাটের জন্য সামান্য যা ফিরিয়ে আনা
এই চেয়ারের হাতল থেকে শিল্প উড়ে গেছে যেন
যেন অলস মস্তিষ্কে আঁকা গোটা একটা ক্যানভাস

আঁকিয়ের পরচুলা খুলে যাওয়ার পর কেমন জোকার লাগছে
তুলির ডাঁটে এসে বসেছে যত রাজ্যের কাক
রঙের কৌটো থেকে বেরিয়ে আসছে মস্করা আর টিপ্পনির জেল্লা
শিল্পের নামে আমার চোখের আরামে বাজপাখির ঠোঁট।

 

পাঁচ.

ফিরে আসুক কলমিশাকে ভরা কাঁসার থালা
হাত তোলো, কে কে চাও
মোটা আউশ-ভাতের লাল গন্ধ
গোল করে মাটিতে বসা মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে

নাচার, টমেটো-সস্, তোমাকে ঝাঁকাতে পারলাম না
বদলে তেঁতুল তুলনাহীন জিভে জল
মেয়েদের হাতে হলুদগুঁড়ো মিশে যাও
এর রং গন্ধ আঠা থেকে বেরিয়ে যাওয়া নেই, পাল তুললেই

নস্টালজিয়া হল বুঝি? বুঝি পালটে ফেলা জুতোর পুনরাগমন
ক্ষত হয় পুরোনো মরচে পড়া কাঁটায়
বাড়তে বাড়তে সেফটিক হতে পারে
লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করি, হা-ডু-ডু-তে মাঝেমধ্যে সে জিতে যায়

রামধনু আজও তো দেখি, দিদি যেটা প্রথম দেখিয়েছিল
তার রঙের সংখ্যা যেমন বেশি
বেশি ডিপ ছিল, আর বৃষ্টির পূর্বাভাস ঠিক যেমনটা দরকার
তানপুরা বাজিয়ে বাজিয়েও সেই সন্ধ্যাপূর্বটা আর আনা যায় না।

উমাপদ কর। জন্ম ১৯৫৫, স্থান বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ। বর্তমানে কলকাতাবাসী। পদার্থবিদ্যায় স্নাতক এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মচারী ছিলেন। যৌথ সম্পাদনা: ‘শ্রাবস্তী’, কর্মী: ‘রৌরব’ ইত্যাদি লিটিল ম্যাগাজিন। অল্পদিনের জন্য হলেও একসময় পারফর্মিং আর্টের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। নাটক, থিয়েটার, আবৃত্তি, ভাবনাট্য, নৃত্যনাট্য। অংশগ্রহণ করতেন বিতর্ক,...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..