প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
অনেকটা সময় ধরেই ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। একদম নট নড়ন চড়ন। যেন ভুলেই গেছে সিগন্যাল দিতে। লেডিস কামরার মধ্যে উসখুশ করছে দু একজন। ওদিকের একটা মেয়ে হাতের ঘড়িটা বারবার দেখে নিচ্ছে। দু-একজন নিশ্চিন্তের ঝিমুনি থেকে উঠে একবার দেখে নিয়ে আবার একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছে। কামরায় ভিড় প্রায় নেই। আপ ট্রেনের উপচে পড়া ভিড় এইসময় ডাউন ট্রেনে তেমন একটা থাকে না। জানলার পাশে বসে থাকা মেয়েটা বারবার মোবাইলের স্কিনে সময়টা দেখছে। এই সময়ই ট্রেনটা দুলে ওঠে। মেয়েটাও সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেটের কাছটায় এসে দাঁড়ায়।কত নম্বর প্ল্যাটফর্মে ট্রেনটা দিচ্ছে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করে মেয়েটা। প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে যেন দিন কাবার করে দিচ্ছে। রোজকার এক নাটক। প্ল্যাটফর্মে ঢোকার আগে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়তেই হবে। এদিকে যে তার ভীষন দেরী হয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রফেশনে সময়টা খুব গুরুত্বপুর্ণ। পেশাদারিত্ব ব্যাপারটা না থাকলে জীবনে উন্নতি করা যায় না। আর এদিকে দেরী হওয়া মানেই ওদিকেও দেরী হওয়া।
অবশেষে ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই এক লাফে নেমে ছুটতে থাকে সে। অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। রোজ যেন স্টেশনে ভিড় বেড়েই চলেছে। অফিসফেরত ‚ ব্যবসাফেরত ‚ নানা ধরনের জীবিকাফেরত যাত্রীদের ভিড় যেন সুনামির মত আছড়ে পড়ছে স্টেশনে। চারিদিকে শুধু কালো কালো মাথা। এদের পেরিয়ে সে উর্দ্ধঃশ্বাসে ছুটতে থাকে। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের লেডিস টয়লেটের সামনে আসতেই হাতের মোবাইল সেটটা ভাইব্রেট হতে থাকে। কলটা রিসিভ করে খুব নিচু স্বরে বলে‚ ‘এখুনি রেডি হয়ে যাব। প্লিজ একটু ওয়েট কর।’
টয়লেটে তখন ভিড় অনেকটাই পাতলা। সন্ধ্যে পেরিয়ে রাতের দিকে ঢলে পড়া দিনের এই সময় বেশিরভাগ মেয়েরাই বাড়ি ফিরে গেছে। কেউ কেউ অবশ্য তখনও ফেরেনি । আকূল হয়ে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে ট্রেনের খবরের জন্য অপেক্ষা করছে। কেউ কেউ হন্ত দন্ত হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে। কয়েকজন মাসী বসে গুলতানি করতে করতে পয়সা নিচ্ছে। এখানে টয়লেটে যাবার জন্য কতৃপক্ষ কোন পয়সা ধার্য্য না করলেও অলিখিতভাবেই মাথাপিছু দু টাকা দিয়েই ঢুকতে হয়। মাসীগুলোর মুখ তো মুখ নয় যেন নর্দমা। কেউ তর্ক করতে চাইলে এদের মুখের ভাষা যেভাবে ছোটে তাতে কানে হাতচাপা দিয়ে পালাবার পথ পায় না ভদ্রসভ্য বাড়ির মেয়ে-বউ রা। তার চেয়ে দুটাকা করে দিয়ে দেওয়াই শ্রেয়। এদের পরিস্কার যুক্তি‚ ‘এই যে তোমরা টয়লেট নোংরা করছ আর আমরা পরিস্কার করছি‚ তার জন্য তো রেলের কর্তারা আমাদের পয়সা দেয় না‚ তাহলে আমাদের চলে কি করে? ‘ এই মাসীদের এখানে কতৃপক্ষই রেখেছে কিনা সে প্রশ্ন অবান্তর। ঠেকায় পড়ে যাচ্ছ যখন দুটাকা দিতেই হবে। লোকের অত সময় নেই এদের নিয়ে রিসার্চ করার।
‘ কি রে উরবী তোর আজ এত দেরী?’ একজন মাসী কথা বলতে বলতেই তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়।
এই মাসীদের উপেক্ষা করার কোন উপায় নেই। এরাই এখানকার অল ইন অল বলা যেতে পারে। এদের হাতে রাখতে পারলে এই টয়লেটের ভিতরে আসা-যাওয়া-সময় কাটানো অবাধ। অবশ্য পুরোটাই অবাধ নয়। দু-দশ টাকা হাতে ঠেকাতে হয়। তবে সেটা ধরলে চলে না। তার ওপর এদের ওপরেই তো দায়িত্ব থাকে তাদের জিনিসপত্র দেখে-বুঝে রাখার। তাই পিঠের ব্যাগটা নামাতে নামাতে উর্বী বলে‚’ আর বলো না মাসী‚ রোজ লেটে ট্রেন ঢোকাচ্ছে আর রোজ আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।’ বলেই সে টয়লেটে ছোটে। এক বালতি জল ওদিকের ড্রাম থেকে তুলে এনে ঢেলে দিয়ে ঢোকে। হাইজিন ব্যাপারটা সে খুব ভালো বোঝে। টয়লেটেই মুখটা ভালো করে ফেসওয়াশ দিয়ে ধুয়ে নেয়। ভেতরেই একটা মাসী প্রায় আর্ধেক উদোম হয়ে শাড়ি ঠিক করছে। আগে আগে অস্বস্তি লাগত। এখন আর লাগে না। চোখ সয়ে গেছে। এখানে লজ্জা নামক জিনিসটার অস্বিত্ব নেই প্রায়।
ব্যাগ থেকে একটা রুমাল বার করে থুপে থুপে মুখটা মুছে নেয়। একটা ছোট কাপড় পেতে তার ওপর বসে পড়ে সে। ব্যাগ থেকে টেনে মেকাপ বক্সটা বার করে। একটা পোর্টেবল মেকাপ বক্স তাকে ব্যাগে সবসময়ের জন্য রাখতেই হয়। শুধু মেকাপ বক্স নয়‚ সাথে পোশাক‚ জুতো এসবও থাকে পেশার খাতিরে। এবার সে নিখুঁতভাবে নিজেকে সাজিয়ে তুলবে। আশে-পাশে আরও দু একজন তখন সেইভাবেই মেকাপ করছে।
‘উরবী তোর আই লাইনারটা দে তো?’
পাশের থেকে মেকাপরতা একটি মেয়ে হাতটা বাড়ায়।
‘চল ফোট‚ রোজ রোজ তোর সেই এক ভ্যানতারা। ফোকটে আমার আই লাইনারটা ইউজ করিস। শোন তোদের মত সস্তার জিনিস আমি ইউজ করি না। একটা আই লাইনারের দাম জানিস?’
‘বড় গুমোড় হয়েছে তোর। সেই তো আমাদের মতই রেন্ডিগিরি করিস। না হয়ে বয়স আছে আর দেখতেও মস্ত আছিস আর পেটে দুটো বিদ্যে আছে ‚ তাই বলে আমাদের এইভাবে হেয় করিস না। তোতে আর আমাতে কি তফাৎ রে? ‘
‘অনেক তফাৎ। বেশি বকিস না‚ আমার দেরী হয়ে গেছে এমনিতেই। কাস্টমার রেডি হয়ে যাবে।’ বলেই উরবী নিজেকে একটু একটু করে উর্বশীর মত সাজিয়ে তুলতে থাকে যত্ন করে। এদের সাথে বেকার কথা বলে লাভ নেই। এমনিতেই বেশ দেরী হয়ে গেছে। সব সড়কছাপ এরা। এখানেই থাকে। এদের সাথে মিশতে চায় না সে। তবু এখানে আসে‚ তৈরী হয় সেই খাতিরেই দুটো কথা বলতে বাধ্য হয়। না হলে এদের পায়ের নখেরও যোগ্যতা নেই তার সাথে কথা বলে।
প্রথম যখন এখানে এসেছিল রম্ভাদির সাথে তখন বমি করে ফেলেছিল। এই নোংরা টয়লেট ‚ গন্ধ‚ নোংরা জল ‚ কান- মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠা খিস্তি খেউড় আর তার মধ্যেই কিভাবে একটার পর একটা ব্যাচ সেজেগুজে বেড়িয়ে পড়ছে দেখে অবাকও কম হয়নি। রম্ভাদিও এখানে সাজত। বলেছিল‚ ‘এটা বেস্ট জায়গা বুঝলি‚ অন্য কোথাও সাজতে গেলে তো একটা ভাড়া বেয়ার করতে হবে‚ এখানে ওসবের ঝক্কি নেই। আর তুই যদি কোনদিন একটা পজিশনে চলে যেতে পারিস তখন না হয় একটা ডেরা কোথাও খুঁজে নিবি। ততদিন না হয়ে এইসব সয়েই রইলি। ‘
রম্ভাদি এখন আর আসে না এখানে। অন্য কোথাও একটা স্থায়ী আস্তানা পেয়ে গেছে নির্ঘাৎ। রম্ভাদির এই পেশায় আসাটা চাপে পড়ে। বাড়িতে অসুস্থ স্বামী‚ একটা মেয়ের সমস্ত দায়িত্ব ছিল রম্ভাদির। এই পথটাই কেন রম্ভাদি বেছে নিয়েছিল সেসব নিয়ে কথা হয়নি কখন। আর এত পার্সোনাল লেভেলে কথা বলা তার পছন্দের নয়। সে পার্সোনাল জীবন নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে না। অন্য কারও পার্সোনাল জীবন নিয়ে অহেতুক কৌতুহল দেখানোটাও অপছন্দের। সে যাই হোক রম্ভাদি হয়ত অন্য পেশায় সুবিধে করতে পারেনি‚ তাই আদিম এই পেশাকেই বেছে নিয়েছিল। মনের দিক থেকে কোনরকম ভার ছিল না রম্ভাদির। আর পাঁচটা পেশার মত এটাকে পেশা হিসাবেই নিয়েছিল। মনের ওপর কোন ভার তার নিজেরও নেই। কোন চাপে পড়ে যে সে এই পেশায় এসেছে তাও নয়। বস্তুত কাজ করার খুব একটা আর্থিক প্রয়োজনও তার ছিল না।
ক্লাস ইলেভেনে প্রথম রোমশ শরীরের আস্বাদন পেয়েছিল সে। আর সেইসময় নিজেকে আবিস্কার করেছিল সে। বুঝেছিল তার শরীর ভীষনভাবে এইসব ব্যাপারকে এনজয় করে। একের পর এক পার্টনার সে পাল্টেছিল। কোনো পাপবোধ ছিল না। থাকবেই বা কেন। ব্যাপারটা তো খুব সিম্পল। কেউ যেমন বেশি খায় তেমন কারও কারও শরীর বেশি উপভোগ করে। তারপর তো কলেজ আসা-যাবার পথে একদিন রম্ভাদির সাথে আলাপ হয়েছিল। তারপর নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এই পথে আসার। যেদিন বিরক্তি আসবে কেটে পড়বে। জীবন সম্পর্কে সোজাসাপ্টা দৃষ্টি নিয়ে চলতেই তার ভালো লাগে। অকারণ জটিলতা‚ আবেগ এসবের মূল্য তার কাছে বিন্দুমাত্র নেই।
আর নেই বলেই সে পুরোপুরি একা থাকার সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করেনি। বাবা-মাকে বলেছিল যে কাজে সে জয়েন করেছে সে কাজে লেগে থাকতে গেলে রোজ রোজ ফিরতে পারবে না। তাই সে একাই থাকবে। অশান্তি হয়েছিল‚ কান্নাকাটি। কিন্তু সিদ্ধান্ত থেকে তাকে টলানো যায়নি। একা একটা বাড়িতে ভাড়া সে পাবে না জানত‚ তাই ওয়াকিং হোস্টেলে জায়গা খুঁজে নিয়েছিল। একগাদা ইনফর্মেশন দিতে হয়েছে। নিজের কাজের জায়গার বিবরণ দেওয়াটা চাপের ছিল। কিন্তু ম্যানেজ করে নিয়েছে। টাকা ফেললেই অনেককিছুই সম্ভব।
একটু একটু করে নিজেকে উবর্শীর মত সুন্দরী করে তোলে সে মেকাপের ছোঁয়ায়। এই যে এখানে তার পাশে আর দুটো মেয়ে সাজছে‚ এরা সেজে গিয়ে কোন সিনেমা হলের সামনে ‚ নয়ত অন্ধকার কোন কোণে গিয়ে দাঁড়াবে। এদের সাজগোজ এদের পেশাকে নির্দেশ করে দেয় অবলীলায়। কিন্তু এইরকম উগ্র সাজ তার পছন্দ নয়। সে মনে করে সোবারনেস হল যেকোন সাজের মূল মন্ত্র। উগ্র সাজ‚ অহেতুক শরীর প্রদর্শন‚ ওসবের মধ্যে সে নেই। আর ঐ সেজেগুজে গিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানো তার দ্বারা সম্ভব নয়। রম্ভাদির মত তারও এজেন্ট আছে। তারাই কাস্টমার ধরে নিয়ে আসে একটা কমিশনের ভিত্তিতে। ভালো পয়সাওয়ালা কাস্টমার। উর্বশী এত সস্তা নয় যে‚ যে কেউ পেতে পারে তাকে। পেতে গেলে ভালোমত কড়ি ফেলতে হবে।
নিজেকে রুচিশীল পোশাকে মুড়ে ফেলে। তারপর মেকাপের যাবতীয় সরঞ্জাম‚ ছাড়া জামা-কাপাড়গুলোকে গুছিয়ে পিঠের ব্যাগটাতে তুলে ব্যাগটাকে দোয়ালের একটা গোপন খাঁজে ঢুকিয়ে দেয়। তারপর রোজকার মত ‘মাসীরা চললাম গো। ব্যাগটা দেখ‚ ‘ বলে বেড়িয়ে পড়ে। হাতের মোবাইলটা ভাইব্রেট করে ওঠে। কাস্টমার রেডি। একটা একটা করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে সে মিলিয়ে যায় স্টেশনের বাইরের ভিড়টার মধ্যে।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..