উড়ান

অজিতেশ নাগ
গল্প, ছোটগল্প, সমপ্রেম
Bengali
উড়ান

প্রায় আক্ষরিক অর্থে একটা ঠাস শব্দ উৎপন্ন করে একটা চড় এসে পড়ল সুমনার গালে। গায়ত্রী হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন। বাইরে তখন মে মাসের কিরকিরে গরম। একটা লুএর মত বয়ে যাচ্ছে। ব্রাত্য সেন, তার স্ত্রী গায়ত্রী আর একমাত্র মেয়ে যে ঘরে এই মুহুর্তে বসে আছেন, প্রায় নিঃশব্দে ঘর ঠান্ডা করার মেশিন চলেছে। তবুও যেন সামান্য ঘামের বিন্দু জমেছিল ব্রাত্যবাবুর কপালে। মেয়ের শেষ কথাটা চাবুকের মত আছড়ে পড়ার সাথে সাথে আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। যে মেয়েকে কোনদিন কান ধরে শাসন করেন নি, জন্মের ২৩ বছর পর তার গায়ে প্রথম হাত তুললেন তিনি। চড় মেরেই গুম মেরে গেলেন।

সেদিন গায়ত্রী সুমনার ঘরের চৌকাঠ পার করে বাইরের টানা বারান্দায় এসে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন। ভেবেছিলেন মেয়ে তার অনেক কালের, বলতে গেলে সেই নার্সারি থেকে বেষ্টফ্রেন্ড তিতলি’র সাথে ঘরে লাস্ট সেমিস্টারের ফিনিশিং টাচ দিচ্ছে। মেয়েদুটো রাত জেগে জেগে পড়ছে। তিতলি মেয়েটাকে গায়ত্রীরও খুব ভাল লাগে। মেয়েটার বাবা মা দুজনেই নেই। আহারে! তো তিনি একটা ট্রেতে দু কাপ কফি নিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন মেয়ের ঘরে। দরজা ঠেলতেই অবাক। আলো বন্ধ। ঘুমিয়ে পড়ল নাকি পড়তে পড়তে? অভ্যস্ত হাত লাইটের সুইচ খুঁজে নিতেই। ট্রে থেকে ঝনঝন শব্দে কফির কাপ মাটিতে পরে চুরমার। ততক্ষণে সুমনা, তিতলি দুজনেই উঠে বসেছে বিছানায়, দুজনেই সম্পূর্ণ নিরাবরণ।

মেয়ে তাদের বড় আদরের। ছোটবেলা থেকে প্রায় কোন আবদারই রাখেননি বা রাখার চেষ্টা করেন নি এমন নয়। ব্রাত্যবাবুরা তিনপুরুষের আমীর আদমি। গায়ত্রী বিয়ে করে এসে দেখছেন এই বাড়ির জমিদারী মেজাজ, বাদশাহি বোলবোলাও। শ্বশুরমশাইএর প্রায়ই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দ্বারিকের দই খেতে ইচ্ছা করত অথবা গোলবাড়ির মাংস। যাকে বলে রাজসিক হালচাল। শ্বশুরমশাইএর তিন ছেলে, আট মেয়ে। প্রথমে শুনে চমকে উঠেছিল গায়ত্রী। বাপরে! গায়ত্রীরও পরিবার অবশ্য কম দড় নয়। তবে এদের মত সমকক্ষ নয়। ছোটছেলে ব্রাত্যর সাথে গায়ত্রীর বিয়ে হয়। অমন জাঁদরেল শ্বশুরমশাইএর ছেলে হয়েও কিন্তু ব্রাত্য মাটির মানুষ ছিল। মাথা ঠান্ডা ছেলে হিসেবে খুব নামডাক ছিল। শ্বশুরমশাইএর মত নারীপরাধীনতায় বিশ্বাস করতেন না। তাই সুমনাকে মানুষ করেছিলেন একদম উন্মুক্ত পরিবেশে। কখন নিজেদের বিচারবিবেচনা মেয়ের ওপর চাপিয়ে দেন নি। পড়িয়েছেন বিখ্যাত ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে। সেটাই কি কাল হল? চিন্তা করে নিলেন একবার ব্রাত্য। বক্তব্য সবটা গুছিয়ে নিলেন মনে মনে।

– বিয়ে করব না কেন? নিশ্চয় করব।

– হ্যাঁ। সেটাই।

এগারো দিনের ট্যুরে জামশেদপুরে ছিলেন ব্রাত্য। ফিরে আসতেই সব শুনলেন। সব শুনে থপ করে বসে পড়লেন সোফায়। পরের দিন রবিবার। মেয়েকে ডেকে পাঠালেন ব্রাত্য। গায়ত্রীও আছেন। বাইরে তখন মে মাসের কিরকিরে গরম। পাতা নড়ছে না। ঘর ঠাণ্ডা করার মেশিনে হলদে অক্ষর জানান দিচ্ছে সবচেয়ে কম ডিজিট এখন এইমাত্র, এই ঘরে।

– আমি কালকের কাগজে বিজ্ঞাপন দিচ্ছি।

– কিসের বিজ্ঞাপন বাপি?

– তোমার বিয়ের।

– অসম্ভব।

– অসম্ভব মানে? বিয়ে করবে না?

– তা করব না কেন? তবে যাকে ভালোবাসি, তাকেই বিয়ে করব। তুমিই তো আমাকে বলেছিলে বাপি, সবসময় একহাত নিচ দিয়ে চিন্তা করতে। মানুষের মাথার একহাত নিচে হৃদয়। আমি হৃদয়ের কথাই শুনব, তাই না?

– চুপ করো। তোমার মা আমাকে সব বলেছে। ছিঃ ছিঃ। হালদার বাড়ির মেয়ে হয়ে তোমার এ কী অধঃপতন!

– কিসের অধঃপতন? আমি তিতলিকে ভালোবাসি। আর ভালোবাসা অন্যায় নয়। ইজ নট ইট?

– আমাদের সমাজে ওসব চলে না। তুমি কি বাচ্চা?

– বাচ্চা নয় বলেই বলছি। একটা মেয়ে একটা ছেলেকে বা ভাইস ভার্সা হলেই হাততালি দিতে হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে বাপি? জেন্ডার তো বড় কথা নয়। ভালোবাসাটাই বড় কথা। তোমার যেমন মা’কে ভালো লাগে, মোর প্রেসাইসলি, অপজিট সেক্সের মানুষ পছন্দ, সে ক্ষেত্রে তোমাকে যদি জোরজবরদস্তি একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিত, তুমি কী করতে বাপি?

এরপর সত্যি আর মাথা ঠিক রাখতে পারেন নি ব্রাত্য। এমনিতে অসম্ভব ঠান্ডা মাথার মানুষ তিনি। আর পারলেন না। ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিলেন। জীবনে প্রথমবার। গায়ত্রী চমকালেন আবার আর অবাক হলেন এই দেখে যে, এতে সুমনার তেমন কোন ভাবাবেগ হল না। সুমনা শুধু উঠে দাঁড়াল আর ভীষণ ঠাণ্ডা গলায় বলল, তোমরা আমাকে আটকাতে পারো না। তুমিই শুধু আইনজ্ঞ নও, আমিও আইন জানি। আর্টিকেল ১৯এ পরিষ্কার লেখা আছে সকল নাগরিকের সমান সুযোগের অঙ্গীকার। ২০০৯ সালের ২রা জুলাই দিল্লী হাইকোর্ট সাফ জানিয়েছে অ্যাডাল্ট মানুষের মধ্যে এই সম্পর্ক অপরাধের আওতায় পড়ে না, আর আমি অ্যাডাল্ট।

– তুমি আমাকে আইন শেখাচ্ছ? তাহলে এটাও জেনে রাখো ফের ২০১৩ সালে সেটাকে ক্যান্সেল করে ইললিগাল ডিক্লেয়ার করেছে মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট। তোমাদের ৩৭৭এ জেল হবে। এটা অপরাধ।

– ভালোবাসা অপরাধ নয় বাপি। আমি তিতলিকে ভালোবাসি। আর ওকেই বিয়ে করব।

ডুকরে কেঁদে উঠলেন গায়ত্রী। বোধহয় শেষ আশা ছিল মেয়েকে বোঝাতে পারবেন তার আইনজ্ঞ স্বামী। পারলেন না দেখে তিনি খড়কুটো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলেন, তোর দাদা তো আমাদের সব আশা ভেঙে চলেই গেল। আর ফিরবে সে? তোর ওপর যে আমাদের অনেক ভরসা সুমি।

– আমি তো তোমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি না দাদার মত। আমি আছি তো তোমাদের পাশেই। তিতলিকে নিয়ে।

– আর সন্তান? আমাদের নাতি নাতনি?

– হাসালে মা! ওসব তোমাদের সোকলড ধ্যানধারণা। তোমাদের মধ্যে ভালোবাসার অভাব ছিল বলেই আমাকে এনেছিলে। আমি তিতলিকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট ভালোবাসি। আর কোন ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই যে অন্য কাউকে দেব। আর যদি একান্তই দরকার পরে তাহলে অ্যাডপ্ট করব। সো সিম্পল।

কথা বলতে গিয়ে ব্রাত্যবাবুর গলা ভেঙে গেল, সো সিম্পল? আর আমি কীভাবে মুখ দেখাব? আমাদের এলিট ফ্যামিলি? সোসাইটি! হোয়াট’বাউট দ্যাট?

– দ্যাটস ইউর পার্সোনাল প্রবলেম। যে সমাজ শেষ জীবনে শুয়ে বসে অন্নধ্বংস করব বলে সন্তান কামনা করে, তুমি কি সেই সমাজের কথা বলছ বাপি? সরি, আমি ফিক্স ডিপোজিটের লোভে সন্তান আনব না। যদি অ্যাডপ্টও নিই, তবে আর যাই হোক নিজেদের ভবিষ্যৎ পাক্কা করতে আনব না।

ব্রাত্যবাবু আর কোন কথা বলতে পারলেন। একদৃষ্টিতে মেয়ের অপসৃয়মাণ চেহারাটা দেখতে দেখতে চোখদুটো আবছা হয়ে এলো।

দুই.

কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের একতলায় বিজিত দুকাপ কফি আর ফিস কাটলেটের অর্ডার দিয়েছে। পুরো কাটলেট আর কফি নিঃশেষ করতে যতটা সময় লাগা উচিত তার মধ্যে বিজিত এই কাহিনীটা আমায় শুনিয়েছিল। কফির শেষে একটা সিগারেট ধরিয়ে আমি প্রশ্ন করলাম, তুই এত কথা জানলি কী করে?

– সুমনা বলেছে আমাকে, সবটা।

– তুই

– হ্যাঁরে। আমি সুমনাকে ভালবাসতাম। ফ্র্যাংকলি, এখনও বাসি।

– সে কী রে! কোনদিন বলিস নি তো আমাদের? অ্যাটলিস্ট আমাকে

বিজিত চুপ করে সিগারেট খেতে খেতে বলল, কী করে বলব বল? তোদের ডেকে জানাতাম আমি একটা লেসবিয়ান মেয়েকে ভালোবাসি?

– তারপর?

– তারপর আর কী? ঘটনার দিন পাঁচেক পর সুমনা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। ওঠে আমাদের গড়িয়ার বাড়িতে। তিতলিও। বাবা মারা যাবার পর তো গড়িয়ার বাড়িটা ফাঁকাই পরে থাকত। সুমনার ওপর আমার ক্রাশটা কাউকে বলিনি। ভেবেছিলাম চমকে দেব। আলাপ হবার দিনসাতেক পরে ওই আমাকে জানিয়ে দিল। খুব কষ্টে অনেক স্বপ্নের মৃত্যুদৃশ্য দেখলাম, তবে সুমনা আমার ভালো বন্ধু হয়ে গেল। একদিন দেখা করে সবটা ডিটেইলসে জানিয়েছিল। আমিও হেল্প করে দিলাম।

আমি বললাম, তুই তো হিরো মাইরি। তারপর? ওরা বিয়ে করেছে? সুখে আছে? কোথায় এখন?

বিজিত বলল, তিতলি মারা গেছে।

– বলিস কী?

– হ্যাঁরে। তিতলিদের ছিল কনজারভেটিভ ফ্যামিলি। সব মেনে নেবে বলে একদিন ডেকে পাঠায় ওর নিজের দাদা। তারপর খালি ফ্ল্যাটে ওর ওপর তিনজন ছেলে। ওর দাদার বন্ধু সব। দাদারই প্ল্যান। ভেবেছিল পুরুষত্বের স্বাদ পেলে বোনটা নিজেকে বদলে ফেলবে। সো ইডিয়টিক। ন্যাচারালি মেয়েটা সুইসাইড করেছিল।

– আর সুমনা?

– ফের বিয়ে করেছে। আরেকটা মেয়েকে। এবারও ভালোবেসে। জানিস ওর বাবা মা মেনে নিয়েছে ওদের। ঠিক শুনছিস। ফাইনালি। আসলে ওরা তিতলির ঘটনায় ভয় পেয়েছিল। হয়ত সুমনার কথাই ঠিক। বাবা মা কেউই ফিক্সড ডিপোজিট হাতছাড়া করতে চায় না। অথবা অন্য অর্থে সিকিওরড বুঢ়াপা। আমি গিয়েছিলাম জানিস? ওদের বাড়িতে। লাস্ট সানডে।

– কী দেখলি?

– সুমনা একটা চাকরি পেয়েছে। একটা ছেলের মতই দায়িত্ব পালন করছে। সবাই মোটামুটি হ্যাপি দেখলাম।

– আর ওই মেয়েটা?

– গায়ত্রীদেবীর বৌমা? ওর নামটা যতদূর সম্ভব মনে পড়ছে রূপাঞ্জনা অর সামথিং লাইক দ্যাট। ভালো আছে। বেশ হাসিখুশি। রবিবারের সকালে রান্নাঘরে ব্যস্ত দেখলাম। শ্বশুর, শাশুড়ি নিয়ে জমিয়ে সংসার করছে। রূপাঞ্জনা আমাকে চমৎকার লুচি, আলুভাজা খাওয়ালো। সাথে নিজে হাতে বানানো বাসি সিমুইয়ের পায়েস। ব্রাত্যবাবু আর গায়ত্রীদেবী দুজনকেই হাসিখুশী লাগল। বাড়ির অন্য মেম্বারদের রিঅ্যাকশন জানি না, আলাপ ছিল না কোনদিনই, যা নাক উঁচু এক একজনের

আমি বললাম, সুমনার সাথে দেখা হল?

বিজিত সামান্য হেসে বলল, হ্যাঁ। সেদিন ওদের বাড়ি থেকে বেরোবার সময় দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে সুমনা আমাকে বলেছিল,

ভালো আছি জানিস। রূ ইজ টু গুড ইন বেড। লজ্জা পাস না। তোর জন্য পরের জন্মে, পাক্কা।

অজিতেশ নাগ। কবি ও ঔপন্যাসিক। জন্ম ভারতের উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়িতে। সাহিত্যের অন্দরমহলে ঘোরাঘুরি আজ প্রায় তিন দশক। সিগনেট, প্রতিভাসসহ মোট দশটি প্রকাশনী থেকে কবিতার বই আর তিনটি প্রকাশিত উপন্যাস। নিয়মিত লেখা দেশ, কৃত্তিবাস, রেওয়া, কবিতাআশ্রম, ভাষানগর ইত্যাদি বহু পত্রপত্রিকায়। সোপান সাহিত্য সম্মানসহ...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ