ঊষাহরণ রোড

মৃদুল শ্রীমানী
গল্প
Bengali
ঊষাহরণ রোড

ব্লক শহরটিতে পৌঁছে গেলাম অতি ভোরে। বাক্স প‍্যাঁটরা নিয়ে নেমে দেখি চায়ের দোকানে জল চড়েছে। একটি শীর্ণ অস্থিসার বৃদ্ধ নাকে, কপালে ও সর্বাঙ্গে তিলকসেবা করে মিহি সুরে নাম জপছে। চা খেতে খেতে দোকানীকে জিজ্ঞাসা করলাম, “সেটেলমেণ্টের অফিসটা কোথায়?”

“দাদা বুঝি কলকাতা থেকে এলেন?”

ছোট করে জবাব দিলাম, ” হ‍্যাঁ, কলকাতা থেকে। এখানে সেটেলমেণ্টের অফিসটা কোথায়?”

সহজ সরল প্রশ্নের সোজাসাপ্টা জবাব না দিয়ে দোকানী বলল,

“এই তো, ইনিই তো সেটেলমেণ্টের বড়বাবু ছিলেন। কুড়ি বছর হল রিটায়ার করেছেন।” দেখি, বৃদ্ধ বৈষ্ণবটি তদ্গত চিত্তে নামজপ করে চলেছেন।

ভক্তটির নামজপ সম্পন্ন না হওয়া অবধি আমাকে সেটেলমেণ্ট অফিসের অনুসন্ধান স্থগিত রাখতে হবে না কি! মহা সমস্যায় পড়া গেল। একটি দুটি করে লোক  উষ্ণ চায়ের সন্ধানে জড়ো হচ্ছিল। আমার সাথে বাক্স প‍্যাঁটরা দেখে তারাই কুতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমি কে, এবং কেন এসেছি।

সংক্ষেপে জানানো গেল আমার পরিচয়।

অমনি লোকগুলি সেটেলমেণ্টের কাগজপত্রের নানা কূটকচালি নিয়ে গল্প জুড়ে দিল। ব্রিটিশ আমলে যে গুণমানের কাজ হয়েছে, তা এখনকার নব‍্য বাবুদের চিন্তাচেতনার ক্ষমতার বাইরে, এমন মতও প্রকাশ করল তারা। আর তারপর খাজনাসংগ্রহ নিয়ে ভূমিরাজস্ব দপ্তরের লোকেদের দুর্নীতি নিয়ে রসালো মন্তব্য শুরু হল।

আমি বলতে চাইলাম যে, দুর্নীতি ঘটে থাকলে এলাকার সাধারণ মানুষের দায়িত্ব থেকে যায় তা উচ্চতর প্রশাসনের গোচরে আনবার। কিন্তু একেবারে সদ‍্য নতুন জায়গায় এসে কোনো বিবাদ বিসংবাদে জড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে হল না। ততক্ষণে বৃদ্ধ বৈষ্ণবটির নামজপ শেষ হয়েছে। তিনি একহাতে একটি চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে অন্য হাতে ফতুয়ার পকেট থেকে কি যেন খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। খুঁজতে খুঁজতেই বললেন, “আমাদের সময়ে ছিল সেটেলমেণ্ট অফিসার। তারা ছিল দুঁদে আমলা। তিন তিনটি করে বড়ো বড়ো জেলা তাঁরা সামলাতে জানতেন। এখনকার ডিএলএলআরওরা তাদের কাছে সব নস‍্যি। সেটেলমেণ্ট অফিসার পরিদর্শনে এলে কানুনগো তো কোন্ ছার, সার্কেল অফিসাররা পর্যন্ত ঠকঠক করে কাঁপত। আর তা হবে না ই বা কেন? সেটেলমেণ্ট অফিসাররা তো কাজ জানত। হুকুম হত ম‍্যাপ খোলো। তারপর পরতাল দিতেন। একটু ঊনিশ বিশ হবার জো ছিল না।”

আমার এইসব গল্প জানা। আমি জেনে গেলাম যে, এই সাত সকালে এঁদের কাছে সেটেলমেণ্ট অফিসের খোঁজ খবর জানতে চেয়ে লাভ নেই। তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করে দূরের দিকে চাইতে চাইতে হঠাৎ কাছে চোখ পড়তে দেখি ছোট একটা বিবর্ণ বোর্ডে লেখা সমষ্টি ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিকের করণ। নিচে ব্লকের নামটি লেখা। রঙ উঠে গেলেও অভ‍্যস্ত চোখে বুঝে নিতে কোনোই অসুবিধে হল না। ঠিক করলাম, প্রথমে অফিসে যোগদান করে তারপর ঘর খুঁজতে বের হব।

জানা কথাই যে, ভূমিসংস্কার দপ্তরের তৃণমূল স্তরের আধিকারিকদের কর্মস্থলে সসম্মানে থাকার জন্য কোনো উদ্যোগ কোনো তরফেই কেউ নেওয়া প্রয়োজন বোধ করেন নি। ইতিমধ্যে আমি দ্বিতীয় কাপ চা খাবার পর একটু সংবাদপত্রে চোখ মেলব ভেবে চা দোকানীকে জিজ্ঞাসা করতে সে আমায় একটি কাগজ ধরিয়ে দিল। লক্ষ্য করলাম, খবরগুলো যেন সবই কম বেশি জানা। তারপর লক্ষ করলাম, ওটি বিগত দিনের কাগজ।

একটু বিরক্ত হয়ে দোকানীকে সে কথা বলায়, সে বলল, “এই গাঁ গঞ্জে টাটকা কাগজ পাচ্ছেন কোথায় আপনি? এখানে সবই ধীরে সুস্থে চলে।” আমি ব‍্যাগ থেকে একটি বেস্টসেলার ইংরেজি নভেল বের করে পড়া শুরু করলাম।

বৃদ্ধ বৈষ্ণবটি বললেন, “মশায় ইংরেজি নভেল পড়া পছন্দ করেন?”

আমি সামান্য বিরক্ত হয়ে তাকালাম।

একটু কেশে গলাটা সাফ করে নিয়ে বৃদ্ধ বললেন, “বরেন্দ্রভূমির এইসব অংশে পথের পাথরে পাথরে লোমহর্ষক উপন্যাস আর পুরাণকথা। একটু চোখ মেলে তাকান, ইতিহাস কথা কয়ে উঠবে। শুনতে পাবেন, অতীতের রাজা রাজড়ার রথ চলার আওয়াজ।”

সাত সকালে এতখানি আমার সহ‍্য হল না। আমি বললাম, “এই চার কুড়ি বছর বয়স ধরে এসব প্রতিদিন শুনতে শুনতে আপনার ঘেন্না ধরে যায় নি?”

“ঘেন্না? ঘেন্না ধরবে কেন? আজও যে আমি শিখছি। এই যে দোকানের পাশ দিয়ে মেঠো রাস্তাটা চলে গেছে, এর নাম জানেন?”

আমি জিজ্ঞাসু মুখে তাকিয়ে রইলাম।

বৃদ্ধ স্মিত হেসে বললেন, “এ রাস্তার নাম ঊষাহরণ রোড।”

“অস‍্যার্থ?”

“হরণ” কথাটির মানে তো আপনাকে বলে দেবার নয় কানুনগো মশাই।”

বললাম, “হরণ কথাটির মানে জানা আছে। আপনি ঊষার কথা বলুন। কেনই বা তার হরণ?”

বৃদ্ধ মুরুব্বির চালে বললেন, “বাণ‍রাজার কথা জানেন?”

আমার মনে পড়ল, আকাশে অতি উজ্জ্বল একটি নক্ষত্রের নাম বাণরাজা। আর্দ্রা, মৃগশিরা, জ‍্যেষ্ঠা, স্বাতী, এমন আরো অনেক উজ্জ্বল নক্ষত্রে সাজানো আমাদের চেনা আকাশ।

বললাম, “শুনেছি।”

বৃদ্ধ জানতে চাইলেন, “কী শুনেছেন?”

আমার মুখ দেখে বৃদ্ধ বৈষ্ণব বুঝে গেলেন, উনি যে বাণরাজার কথা বলছেন, আমি তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানি না।

“অসুর বোঝেন?”

বললাম, “কেন বুঝব না? আমাদেরই মাঝে স্বর্গ নরক, আমরাই সুরাসুর।”

“পুরো নম্বর দেওয়া গেল না। অসুরবাণীপাল এর নাম শুনেছেন?

” দাঁড়ান, দাঁড়ান, শুনেছি। বিশাল লাইব্রেরি ছিল। পোড়া মাটির টালির বই। এক একটা টালি সে বইয়ের এক একটা পৃষ্ঠা!”

বৃদ্ধ উচ্ছ্বসিত। বললেন, “দেশটার নাম বলুন।”

“আসিরিয়া।”

“হ‍্যাঁ, ঠিক বলেছেন। জেনারেল নলেজে আপনি ভাল নম্বর পেয়েছেন। কিন্তু জানেন কি, সুর এবং অসুর আসলে দু ধরনের নৃগোষ্ঠী। অসুর একটি নৃগোষ্ঠী। অ অনুষঙ্গকে নঞর্থক ধরে নিয়ে বিপরীত নৃগোষ্ঠীকে বলা হল সুর। তারা নিজেদের দেবতা বানাল। অন‍্যদের বানাল দানব। বাণরাজাকে অনেকে বাণাসুর বলে। তিনি শিবের পরমভক্ত ছিলেন।”

বললাম, “রাবণও শুনেছি শিবের সাংঘাতিক ভক্ত ছিলেন। দেওঘরে জলাশয়ের গল্পও শুনেছি।”

“গালগল্প মশায়। সবটাই আগ্রাসনের গল্প। হিন্দু বলে যাঁদের চেনানো হয়, তাঁরা কারা জানেন?”

বললাম, ” হ‍্যাঁ, পঞ্চোপাসক হিন্দুর কথা শুনেছি।”

সহাস্য মুখে বৃদ্ধ জানতে চাইলেন, ” কি কি মনে আছে?”

“হ‍্যাঁ। সৌর, ব্রাহ্ম, বৈষ্ণব, শৈব, গাণপত‍্য।”

খুশি হয়ে বৃদ্ধ বললেন, “বাঃ, ভাল লাগল। না মশায়, আপনার পেটে দু এক কলম হলেও বিদ‍্যে আছে।”

আমি হাসব, না কাঁদব ভেবে পাই না। বললাম, ” অনুগ্রহ করে ঊষাহরণের গল্প বলুন।”

“সে আর একদিন বলব ‘খন। আজ নাতিটা বাণমাছ খাবে বলে বায়না ধরেছে। দেখি, মেলে কি না। রাসায়নিক সারের প্রকোপে সব মাছ মরে যাচ্ছে। দেশী বা পোলিয়াদের কাছে হয়তো পেয়ে যাব।”

আমি হাঁ ক‍রে বসে থাকি। খানিকবাদে দেখি সেটেলমেন্ট অফিসের সামনে ঝাড়ু দেবার কাজ চলছে। আমাকে দেখা মাত্র লোকটি বলল, “ঘর খুলে দেব সার?”

আমি বললাম, ” নতুন লোক দেখলেই কি অফিসের দোর খুলে দাও না কি? কেমনধারা পিওন তুমি?”

লোকটি হেসে বলল, ” আজ্ঞে হুজুর, পিওন আর হতে পারলাম কই? পিতাঠাকুর ছিলেন আপনাদের অফিসের পাঙ্খাপুলার। তাঁর শরীর খারাপ হতে আমিই পাখা টানতুম। তারপর ইলেকট্রিকের ফ‍্যান এসে গেল। “

আশ্চর্য, এখানে কথায় কথায় ইতিহাস!

এগারোটা নাগাদ একটি দুটি করে কর্মচারী আসতে লাগল। ভূমিসংস্কার দপ্তরে রেভিনিউ অফিসাররা সবচেয়ে দুর্বল থাকের মানুষ। এদের বদলি অফিসারের ধাঁচে, বেতন বা অন্যান্য প্রাপ্য কেরাণীর ধাঁচে। একজন আমিনবাবু যেচে আমায় ঘরের সন্ধান দিতে চাইলেন। আমি ঠিক করলাম, অফিসে আগে যোগদান করি, অফিস কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলি। তারপর এলাকার ভদ্রলোকদের সাথে আলাপ করে ঘরের ব‍্যবস্থা হয়ে যাবে।

বিএলএলআরও এলেন বারোটা নাগাদ। এসেই তিনি হাঁকডাক করতে ব‍্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমাকে দেখেই বললেন, ” এসেছেন? জয়েনিং লেটার লিখেছেন?”

আমি টাইপ করা চিঠিটি এগিয়ে দিই।

“বাঃ, আপনার ইংরেজির বাঁধুনি তো চমৎকার! তা, রেকর্ড বোঝেন তো?”

বললাম, “কাজ দিয়েই দেখুন না!”

বিএলএলআরও বললেন, “আস্তে আস্তে দেব। আপনি দেখুন আমি কেমন। আমি দেখব আপনি কেমন। ও হ‍্যাঁ, আপনার থাকা খাওয়ার ব‍্যবস্থা?”

আমি মৃদু হাসলাম। পকেট থেকে চাবি বের করে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, “যান, আমার ঘরে গিয়ে স্নান সেরে নিন। খাওয়াটা এই পথের সাথী হোটেলে সেরে নেবেন।”

বিকেলের মধ্যেই জানাজানি হয়ে গেল সেটেলমেণ্ট অফিসে এমন একটি বাবু এসেছেন, যিনি চায়ের দোকানে বসে ইংরেজি নভেল পড়েন। একটি স্থানীয় যুবক এসে যেচে আলাপ করতে চাইল। নাম বলল “আনন্দ। ” আরও বলল, “আমি একজন শিক্ষক। চলুন, আমাদের স্কুল দেখবেন।”

অবাক হয়ে বললাম, “স্কুল দেখে আমি কী করব?”

আনন্দ বলল, “না চলুন। আপনি দেখা করলে আমাদের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি খুব আনন্দ পাবেন।”

অফিস ছুটির পর যেতে হল। প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারিকে দেখলাম। অনিরুদ্ধ ঘোষ। মাত্র ত্রিশের কোঠায় বয়স ভদ্রলোকের। কিন্তু মেরুদণ্ডের দুরারোগ্য অসুখে একেবারে অথর্ব, চলা ফেরার শক্তিরহিত। সব সময় বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়, কেউ পাশ ফিরিয়ে না দিলে ফেরার সাধ‍্য নেই। কিন্তু, সারা মুখে আশ্চর্য উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে আছে।

গল্পে গল্পে জানা গেল অনিরুদ্ধ ঘোষ তাঁর বাবা মা দুজনকেই ছেলে বয়সে হারিয়ে নিজের চেষ্টায় বড়ো হয়েছেন। পৈতৃক ভিটের দখল পেতে জ্ঞাতিশত্রুদের সাথে প্রচুর আইনি লড়াই লড়েছেন। তারপর সেই সম্পত্তি হাতে আসায় গোটা বাড়ি জুড়ে ছোটদের স্কুল করেছেন। ব‍্যাপক খেটে, প্রায় দোরে দোরে ঘুরে বেঞ্চি টেবিল যোগাড় করেছেন। নাম দিয়েছেন কিশলয় কে.জি. স্কুল। এই ব্লক শহরের শিক্ষিত মধ‍্যবিত্ত লোকেরা অনেকেই নিজেদের ছোট শিশুকে বড়ো স্কুলে ভর্তির উপযোগী করে তুলতে কিশলয় কে.জি. স্কুলকে ভরসা করেন। শুনলাম, আশেপাশের এলাকা থেকে শিক্ষিত রুচিসম্পন্ন মেয়েরা প্রাণের টানে শিক্ষকতা করতে এগিয়ে এসেছেন। শুনলাম, বাচ্চারা খেলার ছলে পড়া শিখছে। নাচে গানে হই হই করে ছড়া বলছে, নামতা শিখছে। চলে আসার সময় অনিরুদ্ধকে বললাম, খুব ভাল লাগল।

সে বলল, “রোজ আসবেন কথা দিন।”

আশ্চর্য, রোজ আসব কি করে? একটি শিক্ষিকা এগিয়ে এসে বললেন, ” আসবেন স‍্যর, আপনারা মাঝে মধ্যে এলে অনি অনেক সুস্থ থাকবে।” মহিলার মুখে আশ্চর্য আলো খেলছিল।

ফেরবার সময় আনন্দ এগিয়ে দিতে এলেন। আমি মনে মনে যখন ভাবছি, নিজের মাথা গোঁজার জায়গা ঠিক না করেই অন‍্যের স্কুল দেখতে গিয়ে আর যাই হোক বুদ্ধির পরিচয় দিই নি …. মাথা কোথায় রাখব সন্ধ্যা হলে… তখন দেখি একটি পান দোকান থেকে আমাদের অফিসের এক আমিনবাবু হাতছানি দিয়ে আমাকেই ডাকছেন।

তখন আনন্দ বিদায় নিলে, আমিনবাবু পান দোকানীর সাথে আমায় আলাপ করিয়ে দিলেন।

” এই সন্তু নন্দীর বাড়িতেই আপনার বাসা ঠিক করে দিলাম স‍্যার। কাল থেকে রাঁধুনি একটি মেয়ে আসবে। আজকে হোটেলে কষ্ট করে খেয়ে নেবেন।” আমিনবাবুর মুখে একরাশ তৃপ্তির হাসি।

নতুন ঘরে শক্ত বিছানায় শুয়ে আধো অন্ধকারে আমার চোখের পাতায় অনিরুদ্ধ ও তার স্কুলের ছবি খেলা করে যাচ্ছিল।

সকালে উঠে দেখি রাঁধুনি একটি মেয়ে হাজির। তখনি না কি তাকে উনুন এবং রান্নার সরঞ্জাম কিনে দিতে হবে। বাড়িওয়ালা সন্তু নন্দীর স্ত্রী একদিনের জন্য তার একটি বাড়তি নড়বড়ে স্টোভ ব‍্যবহার করতে দিতে এগিয়ে এল। আমি ব‍্যস্ত সমস্ত হয়ে বাজারে গৃহস্থালি জিনিস পত্র কিনতে চললাম। পথে এক ব‍্যক্তি আলাপ জমালেন –

“মশায়, কাল কিশলয় কে.জি. স্কুলে গিয়েছিলেন?”

অবাক হয়ে বললাম, “তা গিয়েছিলাম।”

“কেমন দেখলেন?”

“তা, ভালোই তো। অনিরুদ্ধ, আনন্দ, সবাই বেশ ভাল।”

“আর কাউকে দেখেন নি?”

“না, আর কে? কাকে আর দেখব?”

কান এঁটো করা হাসি হেসে তিনি বললেন, ” ‘অ’ দেখলেন, ‘আ’ দেখলেন, আর ‘উ’ দেখলেন না?”

আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে তিনি বললেন, “আরে, ওই ঊষা। ওকে দেখেন নি?”

“কে ঊষা?”

“কেন, ফরসাপানা সুন্দর দেখতে মেয়েটা?”

আমি সাবধান হই। বলি, “আমি তো ঠিক খেয়াল করি নি। সবেমাত্র একদিন গিয়েছি।”

“ওই মেয়েটাই তো অনিরুদ্ধের … না, বউ আর বলি কি করে? নিয়ম পালন করে বিয়ে তো আর হয় নি। তবে বউই একরকম। অবশ্য, অনিরুদ্ধ তো চলতে ফিরতে পারে না, বিছানাতেও পাশ ফিরিয়ে দিতে হয়। সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে ঊষা কুমারী বলাও চলে।”

ভদ্রলোকের কথার ধরনে আমার প্রচণ্ড বিরক্তি লাগল। আমি আর কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে এগিয়ে গেলাম।

কাজের মেয়েটি বেশ চটপটে। তার হাতে রাঁধা ভাত তরকারি খেয়ে আমি সময়মতো অফিসে গেলাম।

আমি অফিসে পৌঁছে চেয়ারে বসে যাবার বেশ খানিকক্ষণ পরে একটি আধটি করে কর্মচারী এসে পৌঁছতে লাগল। একগাল হাসিমুখ নিয়ে একটি কর্মচারী বলতে এল – “এখানে স‍্যার কর্মসংস্কৃতির বাড়াবাড়ি নেই। কাজটা যা হোক উতরে দিলেই হল।”

আমি বললাম, “ঘরে আমি একা থাকি। তাস পাশাও খেলি না। এখানে যতক্ষণ থাকি, ততক্ষণ লোকের মুখ দেখতে পাওয়া। এইজন্যেই দশটা বাজতেই চলে এসেছি।”

তারপর লোকটি আমার পরিবারের খুঁটিনাটি খবরাখবর নিতে লাগল। আমিও ভদ্রতাবশতঃ টুকটাক উত্তর দিতে থাকলাম। এরপর ভদ্রলোক এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, “এখানে মুহুরিদের থেকে খুব সাবধানে থাকবেন। ওরাই বকলমে ল‍্যাণ্ডের অফিস চালায়। ওদের স্বার্থে ঘা পড়লেই ওরা ওপর মহলে লাগিয়ে আপনাকে ট্রান্সফার করিয়ে দেবে।”

আমার বলতে ইচ্ছে হল, সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, গোষ্পদে কি বা ভয়। কলকাতার ছেলে চাকরি করতে এসেছি  উত্তরবঙ্গের প্রত‍্যন্ত ব্লকে। এখানকার কোনো কিছুই কলকাতার সুবিধার সাথে তুলনীয় নয়। এখান থেকে আবার আমার ট্রান্সফার হলে ইতর বিশেষ কি আর হবে? কিন্তু সে কথা মুখে বলতে ভদ্রতায় বাধল।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে দু চোখের পাতায় একটি মিষ্টি মুখ খেলা করে যাচ্ছিল। তার হলুদ শাড়ি, চোখের কাজলে ভারি নম্র ও ভদ্র ভাব। আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম কে এই মেয়ে? কোথায় দেখেছি তাকে?

সহসা মনে পড়ল, কালই তো অনিরুদ্ধদের স্কুলে ঊষাকে দেখেছি। বিদায় নেবার সময়ে সে দরজা অবধি এগিয়ে এসেছিল। তার চোখে মুখে আশ্চর্য আলো ছিল। এতক্ষণ আমি তাকেই দেখছি মনে মনে! আশ্চর্য তো।

কলকাতার নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার হতে গ্রাজুয়েশন করার পর মুহূর্তেই চাপ অনুভব করি, নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। বিন্দুমাত্র অবহেলা করা চলবে না। আশ্চর্য সব বিকেলগুলো, আর তারাভরা আশ্চর্য সব রাত, আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টিমাখা দুপুরে আমি কেবল অঙ্ক ও ইংরেজি গ্রামারসহ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের উত্তর করা অভ‍্যাস করেছি। একটি জুতসই সরকারি চাকরির বেশি কোনো স্বপ্ন দেখি নি। পথে ঘাটে মেয়েদের মুখোমুখি যে হই নি কখনো, তা নয়। কিন্তু মেয়েদের মুখে এক আশ্চর্য বিভা খেলা করে, তাদের চোখে যে পরিযায়ী পাখিকেও বশ মানাবার মায়াকাজল মাখা থাকে, তা কোনো দিন জানতে পারি নি। এখনি মনে হল, আমার পাঁজরে কোথাও একটি গান বাজছে, তার স্বরলিপি সবটা আমি পড়তে না পারলেও, আমার চৈতন‍্যলোকের কোথাও হায়ারোগ্লিফিকসে তা লেখা আছে।

অফিসে থাকার সময় ঘাড় গুঁজে কাজ করতাম। আমার মন পড়ে থাকত কিশলয় কে. জি. স্কুলে। সন্ধ্যায় পায়ে পায়ে চলে যেতাম অনিরুদ্ধের শয‍্যার কাছটিতে। প্রায়ই দেখতাম সন্ধ্যার মুখোমুখি কলকাতা থেকে বাসে এসে পৌঁছনো খবরের কাগজ আনন্দ তাকে পড়ে শোনাচ্ছে। বাড়ির ভিতরে একটি ঘরে চলত শিশুদের নাচের ক্লাস। ঊষা তাদের নাচের তালিম দিতে দিতে ঠিক একটিবার উঁকি মেরে যেত। সংবাদ শুনতে শুনতে অনিরুদ্ধ মন্তব্য করত, “কত দরকারি খবর ওরা লেখে না। কেবল কোথায় খুন জখম গুণ্ডামি রাহাজানি আর পলিটিক্যাল মাস্তানি, তার খবরে ভরতি। গঠনমূলক ইতিবাচক খবরের প্রচারের দায়িত্ব ওদের নেই।”

আমি বলতাম, “কুকুর মানুষকে কামড়ে দিলে, তাকে খবর বলে না। মানুষ খেপে উঠে কুকুরকে কামড়ালে সেটা হল খবর।”

অনিরুদ্ধ রেগে উঠত। বলত, তা নয়, ওদের ওটা ব‍্যবসা।

আমি বলতাম, “স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে ব‍্যবসা করলে দোষ কিসের?”

অনিরুদ্ধ বলত, “ব‍্যবসা করাকে খারাপ বলব না, কিন্তু যাতে দেশের মানুষের মধ্যে উচ্চ আদর্শ জন্মায়, তার চেষ্টা করা সকলের কর্তব্য।” বলতে বলতে অনিরুদ্ধের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠত, রগের শিরা উঠত ফুলে। নাচের ক্লাস ফেলে দৌড়ে আসত ঊষা।

অনিরুদ্ধের গালে কপালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। তারপর আনন্দকে ধমক দিত, “কেন ওকে তোমরা বকাও?”

আমার হয়ে মাথা নিচু করে নিঃশব্দে ধমক হজম ক‍রত আনন্দ। তারপর সব চুপচাপ হয়ে গেলে আমি নাচের তালিম দেবার জন্য বিশেষ ভাবে শাড়ি পরা ঊষাকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে দেখতে বলতাম, “আপনার স্কুলের অনুষ্ঠান হলে আমায় যেন বলতে ভুলে যাবেন না। আপনার নাচ দেখব বলে শেষ মুহূর্ত অবধি বসে থাকব।”

একদিন ঊষা বলল, “আজ দুপুরে একটা সরকারি চিঠি এসে পৌঁছেছে। সেটা পড়েই ও খুব বিচলিত হয়ে পড়েছিল। আমায় স্কুল চালাতে হচ্ছিল। আমি ভেবেছিলাম আপনার কাছে চিঠিটা পড়ে বুঝে নেব।”

আমি বললাম, “কই, চিঠিটা দেখি?”

ঊষা বলল, “অনিরুদ্ধকে সে কথা বলতে ও আপত্তি করেছে। বলেছে, উনি একা থাকেন, একাকিত্ব কাটাতে অনুগ্রহ করে আমাদের এখানে আসেন। আমাদের ঝামেলা ওঁর ঘাড়ে ফেলা ঠিক হবে না।”

যন্ত্রণা সামলে এবার হাসিমুখ করে অনিরুদ্ধ বলল, “নিজের সমস্যা যে করে হোক নিজে সামলাতে হবে। হেরে গেলেও গৌরব থেকে যাবে আমি লড়াই করে তারপর হেরেছি। যুদ্ধের  আগেই আত্মসমর্পণ করে বসি নি।”

আমি কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না।

আমাকে ফেরার পথে এগিয়ে দিতে গিয়ে আনন্দ আভাস দিল স্কুল বাড়ির জমি নিয়ে কিছু লোকে সমস্যা করেছিল। মাঝখানে সবকিছু চুপচাপ ছিল। আবার নতুন করে ঝামেলা মাথাচাড়া দিয়েছে।

আমি জানতে চাইলাম, কারা ঝামেলা করছি?

আনন্দ বলল, “যেটুকু বলেছি, এর বেশি বলার অনুমতি নেই।”

ঘরে ফিরে এসে মনে হল রোগগ্রস্ত অনিরুদ্ধের উপর আমি একটা বোঝা মাত্র। সে আমার একাকিত্ব অনুভব ক‍রে বাস্তবে আমায় কৃপা করে। আমার কাছ থেকে ওরা কোনো সাহায্য আশাটুকু করে না।

পরদিন অফিসে বিএলএলআরও তাঁর চেম্বারে আমায় ডেকে পাঠিয়ে বললেন, “একটা ভেস্টিং কেস আপনাকে দিলাম। পড়ে দেখে একটা রিপোর্ট তৈরি করে দিন তো?”

ভূমি সংস্কার আইনে একটি পরিবার কতখানি জমি রাখতে পারবে, তার ঊর্দ্ধসীমা নির্দিষ্ট আছে। বিএলএলআরও যে ভেস্টিং কেসটি আমাকে দিলেন, তাতে এক ব‍্যক্তিকে এক সদস‍্যের রায়তী পরিবার ধরে নিয়ে অফিসে ডাকা হয়েছিল। তারপর রায়ত বা তার প্রতিনিধি না আসায়, জমি ভেস্ট করা হয়েছে।

দ্রুত হাতে রিপোর্ট বানিয়ে বিএলএলআরওর কাছে পেশ করতেই তিনি বললেন, “এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল?”

আমি বললাম, “ভেস্টিং কেস করেছেন একজন। আমি শুধু খুঁটিনাটি নিয়ম পালন হয়েছে কি না, সেটুকু দেখে দিয়েছি।”

আমার রিপোর্ট হাতে নিয়ে তিনি গলা নিচু করে জানতে চাইলেন, “কেসটা কাদের জানেন?”

আমি বললাম, “তা তো ভেবে দেখিনি। আপনি কেস স্টাডি করতে দিয়েছেন, সেই কাজটা করে দিয়েছি।”

বিএলএলআরও বললেন, “আমি আন্দাজ করেছিলাম। আপনার বয়স কম। নতুন চাকরি।”

আমি জানতে চাইলাম, আমার লেখায় কোনো ভুল ধরতে পেরেছেন কি না।”

সে কথা চাপা দিয়ে বিএলএলআরও বললেন, “কেসটা হল কিশলয় কে.জি. স্কুলের মালিকের। ওই যে রোজ সন্ধ্যায় আপনি যে বাড়িতে যান।”

আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল। এইজন্যই তবে গতকাল অনিরুদ্ধ অতোটা ধৈর্যহারা হয়েছিল। তার পরমুহূর্তে মনে হল আমার একটা গোপন অভ‍্যাস নিয়ে সবাই বুঝি কানাকানি করে।

লজ্জার মাথা খেয়ে সন্ধ‍্যাবেলায় আবার গেলাম অনিরুদ্ধের কাছে। আজ নাচের স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে ঊষা আর আনন্দ দুজনে অনিরুদ্ধের শয্যাপার্শ্বে বসে রয়েছে। শুয়ে শুয়েই অনিরুদ্ধ আমায় স্বাগত জানাল। আমি সংকুচিত হয়েই বসলাম। তারপর তাকে ভেস্টিং কেস ব‍্যাপারে আমি কি জানতে পেরেছি অল্পকথায় জানালাম।

অনিরুদ্ধ বললো, “আপনাদের ভূমি অফিসের ভূতের কীর্তি এটা। ছাপাখানার ভূতের কথা নিশ্চয়ই জানেন। তেমনি আপনাদের অফিসে পোষা ভূত আছে। তারা হাঁসের সাথে সজারুকে জুড়ে নতুন মানুষ তৈরি করে। তারপর দুটো লোককে একটা লোক বানিয়ে জমি বেশি দেখিয়ে ভূমিসংহার করে। বোকা লোকে ভাবে ভূমিসংস্কার হচ্ছে।”

আমার রাগ হচ্ছিল। অনিরুদ্ধের কাছে জানতে চাইলাম, “আপনার হাতে তথ‍্য কী আছে? ও পাল্টা জানতে চাইল, সরকারের হাতে তথ‍্য কী আছে?”

আমি বললাম, “আপনার বাবাকে নোটিশ করে ডাকা হয়েছিল। আপনার বাবা সেই নোটিশ সই করে নিলেও শুনানির দিন আসেন নি। তাই একতরফা জমি ভেস্ট হয়ে গিয়েছে।”

অনিরুদ্ধ বলল, “বাবার পক্ষে যাবার উপায় ছিল না। “

আমি বললাম, “কেন?”

একটু ব‍্যঙ্গাত্মক হেসে সে বলল, “আমি নাস্তিক। বাবাও নাস্তিক বামপন্থী ছিলেন। নইলে বলতাম, তিনি পরলোক থেকে নেমে আসার রাস্তা খুঁজে পান নি।”

অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে অনিরুদ্ধ বলল, “ভূমি আইনে ভেস্টিং এর তারিখটা তো আপনি জানেন কানুনগো সাহেব।”

তেতো মুখে বললাম, “ফেব্রুয়ারি মাসের পনেরো তারিখ, একাত্তর সাল।”

“হুঁ। ঠিক বলেছেন। ওই তারিখে রায়তের কতটা জমি তার হিসাব করে জমি ভেস্ট করা হয়। আমার বাবা বামপন্থী দলের সক্রিয় কর্মী হিসেবে ওই তারিখের আগেই মারা পড়েছিলেন। তাঁর লাশটি গুম করে দেওয়া হয়েছিল। না, তিনি শ্রেণীশত্রুদের হাতে মারা পড়েন নি। দলীয় নেতৃত্বের কিছু কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই তিনি রেনিগেড হয়ে যান। তারপর শাস্তি হিসেবে মৃত্যু। মারা যাবার কয়েকটি মাস আগে আমাকে কুমারী মায়ের গর্ভে তিনি রেখে যান। গভীর ভালবাসতেন দলীয় মহিলাকর্মীকে। রাতের আঁধার ঘন হলে নিঃশব্দে দেখা করে যেতেন আন্ডার গ্রাউন্ডে থাকা বামপন্থী যুবকটি। ফরম‍্যালি বিয়ে করার কোনো ফুরসৎ ছিল না তাঁদের। খুব যে আস্থা ছিল সামাজিক নিয়ম কানুনে, তাও তো বলতে পারি না।”

একসাথে এতগুলো কথা বলে হাঁফাতে থাকে অনিরুদ্ধ।

“শুনুন, দুটো সম্পূর্ণ আলাদা লোককে  ফরটি ফোর টু‌এ ধারায় রেকর্ড সংশোধন করে একটা লোক বানিয়ে,  সেই বানানো একটা লোকের জমি ভেস্ট করা যায়। তাকে অবিবাহিত নিঃসন্তান উত্তরাধিকারীহীন  বলা যায়। কিন্তু আমার মুখে চোখে এমন কিছু আঁকা আছে, যাতে গ্রামের বয়স্ক মানুষের মনে আমি ঠিক কার সন্তান, সে নিয়ে ধোঁয়াশা নেই। আমার ছোটবেলায় স্কুলে বরাবর ফার্স্ট হওয়া আর ছেলের দলে নেতাগিরি দেখে ওঁদের চোখে জল ঝরত। তাইতো বাস্তুটুকুর দখল পেতে আমার আটকায় নি। সে বাস্তু পুনরুদ্ধার করতে পেরে আমার দেশকে বিলিয়ে দিয়েছি। আপনাদের আইনে কারো বাস্তুজমি ভেস্ট করা যায় কি না, সে আপনি ভেবে দেখবেন। জানেন, আমি কপর্দকশূন্য ছিলাম। বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে স্কুল গড়েছি। গত পাঁচ বছর এই গ্রামে যে বাচ্চারা মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে, তারা সবাই ছোটবেলা থেকে এই স্কুলে পড়েছে। আবার তাদের বাপ মার কাছে গিয়ে ভিক্ষা করে পয়সা যোগাড় করে মামলা লড়ব।”

এদিন আর ঊষা আমায় চা খেতে অনুরোধ করল না। আনন্দ আমায় এগিয়ে দিতে এল না। শুনলাম আনন্দ আগামীকাল ভোরের বাসে যাবে কলকাতা। উকিলের সাথে কথা বলতে। শরীরের শেষ আভরণটুকু হাসিমুখে মামলার খরচ যোগাতে  সমর্পণ করে দিল ঊষা।

পরদিন অফিসে গিয়ে জানলাম বিডিও সাহেব আমায় ডেকেছেন। গেলাম তাঁর চেম্বারে। দেখলাম থানার ওসি বসে আছেন। আমাকে বসতে পর্যন্ত না বলে বিডিও সাহেব ধমক ধামক শুরু করলেন। আমি কখন কোথায় যাই না যাই, সব খবর তাঁর কাছে মুহূর্তে পৌঁছে যায়, এ কথা তিনি তিনবার করে শোনালেন। আর সরকারি ফাইলের তথ‍্য বাইরের লোকের কাছে পাচার করা গুরুতর অপরাধ সেটাও জানালেন। আমার কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছিল। আমি একটু প্রতিবাদ করতে যেতেই তিনি চিৎকার করে আমায় দাবড়ে দিলেন। রোদ মাথায় নিয়ে নিজের অফিসে ফিরতে ফিরতে প্রতিজ্ঞা করলাম, আর কখনো কিশলয় কে.জি. স্কুলে যাব না।

অফিসে এসে ফাইলের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখলাম।  কর্মচারীরা সকলেই এসে একবার করে আমায় দেখে গেল।

কাজের শেষে ঘরে ফিরে ইংরেজি নভেলে মন ঢেলে দিলাম। ঠিকে কাজের মেয়েটি বারবার জানতে চাইল আমার শরীর ঠিক আছে কিনা। তার কথার উত্তর করি, মনের সে অবস্থাটুকু আমার ছিল না। সকালবেলা দোকান খোলার আগে বাড়িওয়ালা সন্তু নন্দী বলে গেল, অফিসের পর ঘরে বসে টিভি দেখাই বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। তাতে আর যাই হোক দুর্নাম ছড়ায় না। আমি মনে মনে বলতে লাগলাম ধরণী দ্বিধা হও‌।

অফিসে রুটিনমাফিক কাজ ক‍রলে সবাই সন্তুষ্ট থাকে। তারপর তোমার কোটরে ঢুকে যাও। সমাজকে আলো দেখানো, সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখা তোমার কাজ নয়।

একদিন বিএলএলআরও আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, “ঘরশত্রু বিভীষণ কথাটা এতদিন বইতেই দেখেছি। কিন্তু এখন নিজের চোখে দেখছি।” অতো দুঃখের মধ্যেও আমার হাসি পেল। বিভীষণের বিরুদ্ধে নারীর শালীনতাহানির অভিযোগ ছিল না। রাবণের বিরুদ্ধে ছিল।

একদিন সকালে উঠে খবর পেলাম আনন্দ আর ঊষা রাস্তায় মরে পড়ে আছে। সন্তু নন্দীর বউ বলল, পঙ্গু অচল অনিরুদ্ধকে সামনে রেখে ওরা যা খুশি করত। কি করত ওরা, আমার চেয়ে ভাল কেউ জানে না। পাগলের মতো দৌড়ে গেলাম অকুস্থলে। দুজনের বিবস্ত্র দেহ পড়ে আছে। আনন্দের গলার নলি কাটা আর ঊষার স্তন ও যোনি ক্ষতবিক্ষত। জনতার মুখে ভাষা নেই। কেউ কেউ বলছিল ওদের মেলামেশা খুব বেড়ে গিয়েছিল বলে অনিরুদ্ধই না কি লোক লাগিয়ে ওদের খুন করিয়েছে। এসব কথার উত্তর দেবার প্রবৃত্তি আমার ছিল না। আমি গায়ের জামাটা খুলে ঊষার বেপর্দা মৃতদেহটা একটু ঢেকে দিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। খালি গায়ে রাস্তা দিয়ে আমাকে চলতে দেখে অনেকে অবাক হয়ে গেল।

ঘরে ফিরে আমার স্নান করতে ইচ্ছে হল না। খেতে মন চাইল না। অফিস যেতে পর্যন্ত ইচ্ছে করল না। সন্তু নন্দীর বউ দূর থেকে কয়েকবার উঁকি মেরে দেখে গেল আমি কি করছি।

বিকেল গড়াবার আগেই বিডিও একটি গাড়ি পাঠিয়ে আমায় দেখা ক‍রতে হুকুম করলেন। ওঁর চেম্বারে যেতে আমায় একটি কাগজ ধরালো ওঁর অফিসের বড়বাবু। দেখলাম আমার ট্রান্সফার অর্ডার। জেলা সদরে আমায় আগামীকাল সকালের মধ্যে যোগদান করতে বলা হয়েছে।

আমি কাতর মুখে তাকিয়ে বললাম, “চার্জ বুঝিয়ে দিতে সময় পাব না?”

ব‍্যঙ্গাত্মক হেসে বিডিও বললেন, “স্ট‍্যান্ড রিলিজ করা হলে ওসব দরকার করে না। এখনই আপনি বেরিয়ে পড়ুন। সার্কিট হাউসে বলে রেখেছি। আপনার মালপত্র সব কাল সকালের মধ্যে হাতে পেয়ে যাবেন।”

বিনা প্রশ্নে বিদায় নিতে হল। মনে হল, ঘাড়ধাক্কাও এর থেকে ভালো ছিল।

অনেক দিন পর একেবারে অন্য চাকরিতে ঢুকে পুরাতাত্ত্বিক গবেষণার নাম করে পৌঁছে গেলাম আমার সেই চেনা কিশলয় কে. জি. স্কুলে। সটান ঢুকে গেলাম অনিরুদ্ধের ঘরে। টান টান শাদা বিছানা। দেয়ালে বড়ো ছবিতে সে হাসছে। প্রধান শিক্ষিকার ঘরে ঢুকেই মনে হল ঊষা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

চেয়ারে আসীন তরুণী মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এসেছেন? আমি জানতাম, একদিন আপনি ঠিক আসবেন।” দেখলাম ওঁর টেবিলে একটি ছবিতে অনিরুদ্ধের মাথাটি কোলে নিয়ে ঊষা। তার একপাশে আনন্দ, অন‍্যপাশে আমি।

আমার চোখের জল বাগ মানল না।

প্রধানা শিক্ষিকা আমায় নিয়ে ক্লাসে ক্লাসে ঘুরিয়ে দেখাতে থাকলেন। প্রতি ঘরে হাসিমুখে অনিরুদ্ধ আমায় অভ‍্যর্থনা করছিল।

মৃদুল শ্রীমানী। কবি। জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। প্রকাশিত বই: 'জমি জরিপ,  কি দেখে জমি বাড়ি কিনবেন,  ফ্ল্যাট ও বাড়ি,  তথ্য জানার অধিকার', 'মানুষের বাঁচার অধিকার সংক্রান্ত- মেয়েদের আইন', 'সে একটি পল্লবিত...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..