ঋতব্রতা

অরবিন্দ ভট্টাচার্য
ছোটগল্প
Bengali
ঋতব্রতা

ফাল্গুনী  অমানিশার   কালো  অন্ধকারের  নিস্তব্ধতা খান খান করে দিয়ে মাঠ ঘাট পেরিয়ে  এগিয়ে  চলেছে রাজার অশ্বারোহী দল। দিগন্তভেদী শব্দে ভয়ার্ত নিশাচর পাখির দল  দিকভ্রান্ত হয়ে এ গাছ থেকে ও গাছ পালিয়ে  বেড়াচ্ছে।    তাঁদের আর্ত কলরবে কেঁপে উঠছে ধরাতল।  সামনে বর্তিকা বাহকের দল।  পেছনে পাল্কিতে চলেছেন দুয়ার বক্সী। সব শেষে  রাজ পুরোহিত। রাত শেষ হবার  আগেই পৌঁছে  যেতে হবে  জয়দুয়ার।

রাজবাড়ি থেকে নৈঋতে  নয় ক্রোশ পথ পাড়ি দিলে সর্বেশ্বর গড়। গড়ের পাশেই  ঘন অরণ্য প্রান্তর। সেই অরণ্য  ঘেঁষে জয়দুয়ার। এ পাশে গড় কামতেশ্বর। মাঝে স্রোতস্বিনী  পূণ্যতোয়া। বাসন্তী  নদীতে হাঁটু জল।  অমানিশার শেষ প্রহরে বিস্তীর্ণ বালিয়ারি ভেঙে শীর্ণকায়া পূণ্যতোয়া অনায়াসে পার হয়ে যায় সামন্ত বাহিনী।     বর্তিকার আলোয় নদীর জল চিক চিক করে ওঠে।  ছোট্ট পান্সিতে পাল্কি তুলে নদী  পার করে দেয় মাল্লারা।  যেতে হবে উত্তরে আরো দুই ক্রোশ। তারপর জয়দুয়ার। সেখানে এক জীর্ণ কুঠিরে উত্তরাকে  নিয়ে সুখে দু:খে ঘরকন্না করে রুদ্র কেতু। জাতে চণ্ডাল। শবদাহ করে দিন চলে কোন মতে। গাঁয়ের বাইরে অরণ্য প্রান্তে তাঁর বসত। পূণ্যতোয়া তার পড়শী, আপন জন। স্রোতস্বিনী বুক দিয়ে আগলে রাখে অচ্ছুত্‍ রুদ্র কেতুকে। বাপের সাথে ডিঙি নৌকোয় চেপে জাল দিয়ে মত্‍স শিকারে পটু হয়ে উঠেছে একাদশ  বর্ষীয় বালক সৌম্য  কেতু।   নদীর জলেই তার বেড়ে ওঠা। আম কাঠাল ফলসার বনে তাঁর অবাধ বিচরণ। মৃতদেহ সত্কারের কাজে এখনো নবিশ  সুদর্শন বালক সৌম্য কে দেখে  উচ্চবংশ জাত বলে ভ্রম হয়।

বন থেকে কাঠ কুড়িয়ে,  নদীর  বেলায় মোষ চড়িয়ে  এক মাত্র সন্তান চাঁদেরকণা সৌম্য কে নিয়ে বেশ  কেটে যাচ্ছিল  চণ্ডাল দম্পতি রুদ্র-উত্তরার।  কিন্তু নিয়তি বড় নিষ্ঠুর! ভোরের আলো ফুটতেই  অশ্বক্ষুর ধ্বনি একটু একটু করে স্তিমিত  আসে  অরণ্য প্রান্তরে। জয়দুয়ারে  রুদ্রর  কুঠিরের সামনে  এসে দাঁড়ায়  রাজার সওয়ার। পেয়াদার হাক ডাকে ঘুম জড়ানো চোখে ভয়ার্ত চণ্ডাল দম্পতি দুয়ারে এসে দাঁড়ায়। পাল্কী থেকে নেমে আসেন দুয়ার বক্সী,  পেছনে রাজ পুরোহিত। অচ্ছুত্‍ রুদ্র দুহাত জোর করে বলে ওঠে, “কি আজ্ঞা বলো ঠাকুর”। দুয়ার বক্সী বলেন, বড় ভাগ্যবান তুমি রুদ্র! দুয়ার বক্সী পড়ে চলে মহারাজের  আদেশ নামা –  “মানবাত্মার  কল্যাণার্থে  জয়দুয়ার নিবাসী রুদ্র কেতুর একাদশ বর্ষীয় সন্তান সৌম্য  কেতুকে আশ্বিন  মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথির পূণ্য লগ্নে   দেবী ভবানীর  প্রতি  উত্‍সর্গ করা হইবে”।    দশ একর নিষ্কর কৃষি জমি,  দুইটি নির্বীজ ঋষভ আর দ্বাদশ  সুবর্ণ মুদ্রা রুদ্র কেতুকে প্রদানে  মহানুভব মহারাজ সৌম্য  কেতুর রক্তঋণ হইতে  মুক্ত হইবেন” 

“একি কথা বলো ঠাকুর! আমি  দরিদ্র চণ্ডাল,  অস্পৃশ্য অচ্ছুত্‍। কেন এই রাজরোষ” ? আকাশ ভেঙে পড়ে রুদ্রর মাথায়। ঘন ঘন মুর্চ্ছা যায় উত্তরা। পিতার  আর্তনাদ শুনে কুঠির থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে সৌম্য। মায়ের বুকে আছড়ে পড়ে ড়ুকরে কেঁদে ওঠে নিষ্পাপ কিশোর। গাঁয়ের মানুষ দূরে দাড়িয়ে দেখে সেই করুন দৃশ্য। কারো মুখে কথা নেই।  কুঠিরের বেড়ায় পাইক সেঁটে দেয় সেই আদেশ নামা। দুয়ার বক্সীর পায়ে লুটিয়ে পড়ে রুদ্র কেঁদে বলে আমায় নিয়ে যাও ঠাকুর, মুক্তি দাও আমার সন্তানকে। “রাজার আদেশ  খণ্ডাবে কার হেন সাধ্য” –  বলে রাজ পুরোহিত। “দেবীর কৃপায় আগামী জন্মে তোমার  চণ্ডাল দশা থেকে মুক্তি ঘটবে হে  রুদ্র” – বলে  পাল্কিতে উঠে রাজনগরীতে ফিরে যায় দুয়ার বক্সী আর রাজ পুরোহিত। ফাল্গুনী দমকা বাতাসে জয়দুয়ার অরণ্য থেকে ঝরে পরা শুষ্ক পাতায় ঢেকে যায় রুদ্রর জীর্ণ কুঠিরাঙ্গন।

সন্ধানি বাজের মতো মৃত্যুর দূতেরা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে  সৌম্যর অপেক্ষায়। বেলা বয়ে  যায় একটু একটু করে।   ফিরে যেতে  হবে রাজনগরে।  এবার রাজ আজ্ঞা পালনে ব্রতী হয়ে ওঠে সামন্ত বাহিনী।   একমাত্র সন্তান সৌম্যকে দুহাতে বুকে আঁকড়ে ধরে ড়ুকড়ে  কেঁদে চলেছে  মা উত্তরা। সময় গড়িয়ে যায়। দু চোখের জল শুকিয়ে গেছে মায়ের। আবার মুর্ছা যায় ক্লান্ত অবসন্ন উত্তরা।  রাজার সেপাই অচেতন উত্তরার  কোল থেকে  ঘোড়ায়  তুলে নেয় সৌম্যকে। শীর্ণ হাতে পুত্রকে রক্ষা করার  শেষ চেষ্টা করেও  বিফল হয় রুদ্র। রাজার অশ্বারোহীরা সৌম্যকে নিয়ে ছুটে চলে রাজনগরের দিকে।

সৌম্য চলে যাওয়ার পর দু রাত্রি কেটে গেছে। অন্নজল ত্যাগ করে শুধুই কেঁদে  চলেছে উত্তরা। গাঁয়ের প্রান্তে  অচ্ছুত্‍ চণ্ডাল দম্পতির শান্তনায় এগিয়ে আসেনি কেউ,   ব্যতিক্রম শুধু উত্তরার সখী শূদ্র কন্যা পৃথা রজকিনী। জোর করে আহার তুলে দেয় পৃথা অভুক্ত উত্তরার মুখে।

সৌম্য চলে যাওয়ার পাঁচদিন পর শেষ রাতে ক্লান্তি জড়ানো ক্ষীণ কন্ঠে উত্তরা বলে রুদ্রকে,   “যেতে হবে রাজার দুয়ারে”। রুদ্র বলে, “রাজার বাড়ি অনেক দূর”।        নাছোড় উত্তরা বলে আমি যাবই। ভোরের আলো ফুটতেই বনপথ ধরে রাজনগরীর উদ্যেশ্যে  রওনা হয়ে যায় রুদ্র উত্তরা। নদীর ঘাটে এসে দাঁড়ায় চণ্ডাল দম্পতি। পাটনি পার করে দেয় পূণ্যতোয়া।  এবার  যেতে হবে ঈশানে। সূর্যের নিশানায় একটু একটু করে এগিয়ে চলে তাঁরা। পাঁচ ক্রোশ পথ পাড়ি দেবার   পর রাত্রি নামে তীর্থ ডাঙার হাটে।  পাশেই রাধা মাধবের মন্দির।   মন্দিরের দাওয়ায় শুয়ে সপ্তমির চাঁদের মৃদু   আলোতে   তন্দ্রাছন্ন  রাত কেটে যায় রুদ্র উত্তরার। ভোর হতেই আবার চলা। এবার উত্তরে। অনাহার ক্লিষ্ট শরীরে হেঁটে চলে ক্লান্ত রুদ্র-উত্তরা। সূর্য মাথার ওপর থেকে   ঢলে পড়েছে পশ্চিমে।  বেলা চার প্রহর। সামনে এসে দাঁড়ায় ছোট্ট নদী মরমা। আয়েসে পার হয়ে যায় সেই নদী। নদীর তীর ঘেঁষে  রাজপ্রসাদ। প্রসাদের সিংহদুয়ারে গিয়ে দাঁড়ায় রুদ্র উত্তরা । দুয়াররক্ষী দৌড়ে এসে পথ আগলায়। উত্তরা দুহাত জোরকরে বলে, আমায় যেতে দাও মহারাজের কাছে। তিনি আমাদের পিতা। আমি তাঁর কাছে আমার পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা চাইবো। অনেক অনুনয় বিনয়েও প্রহরী অনড় । এবার নিরুপায়  চণ্ডাল দম্পতি রাজ দর্শন প্রার্থনায় অনশনে ভূমিশয্যা গ্রহণ করে সিংহদুয়ার প্রান্তে। নগরীর মানুষজন বিমর্ষ জননীর কাতর আবেদনে  সহমর্মিতা জানিয়ে যায় চলে যায় এক এক করে। আলুলায়িত কেশে ভূমি শয্যায় পড়ে থাকে    অভুক্ত উত্তরা।  ধীরে ধীরে খবর পৌঁছে  যায় রাজার কানে।   মহামন্ত্রী উপাক্ষ দেব   আর  রাজগুরু বিশ্বেস্বর শাস্ত্রীকে  সঙ্গে নিয়ে  মহারাজ  দীপ্তেন্দ্র নারায়ণ নিজে ছুটে আসেন  সিংহ দুয়ারে। একমাত্র সন্তান সৌম্যর   প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে  মহারাজের পদতলে লুটিয়ে পড়ে উত্তরা ।  “ আমার প্রাণের বিনিময়ে,  আমার পুত্রের জীবন ভিক্ষা দাও প্রভু” বলে  ড়ুকরে কেঁদে ওঠে জননী।   জননীর  কাতর আবেদনে বিচলিত মহারাজ  পাথরের মূর্তির মত   নিথর দাঁড়িয়ে থাকেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর চলে যান প্রাসাদের  অন্ত:পুরে। চণ্ডাল দম্পতি পড়ে থাকে ভূমি শয্যায়।

বেলা দ্বিপ্রহরে সাজো সাজো রব পড়ে গেল  রাজপ্রসাদে। ধর্মপ্রবর রাজগুরু বিশ্বেস্বরের পরামর্শকে শিরধার্য করে ভক্তি ভাবাপ্লুত মহারাজ দীপ্তেন্দ্র  নারায়ণ তাঁর রাজ্য থেকে চিরতরে বিলুপ্ত  করে দিলেন  নর বলি প্রথা। রাজসভায় সমবেত মন্ত্রী, পণ্ডিত প্রবর,  সভাসদগণ সহর্ষে মহারাজের জয় ধ্বনিতে মেতে উঠলেন। রাজ আজ্ঞা   নিয়ে সিংহদুয়ারে  পৌঁছালেন  দুয়ার বক্সী। উচ্চস্বরে পাঠ করে চলেন সেই আদেশ – “প্রজাবত্সল মহারাজ দীপ্তেন্দ্র  নারায়ণের আদেশ অনুযায়ী রাজ্যবাসীর মঙ্গলার্থে অদ্য হইতে  কাত্যায়নী দেবী ভবানীর পূজার্থে রাজনগরে নর বলি প্রথা চির তরে বিলুপ্ত  করা হইলোঅত্র আদেশ মোতাবেক জয়দুয়ার নিবাসী রুদ্র কেতুর একাদশ বর্ষীয় কুমার সৌম্য কেতুকে অদ্য মুক্তির আদেশ প্রদান করা হইলো”।

একমাত্র সন্তানকে ফিরে পেয়ে  বুকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে চিত্কার করে কেঁদে উঠলোরুদ্র-উত্তরা ।  রাজনগরের  জনতা হর্ষধ্বনি  করে বলে  উঠলো “জয়  মহারাজ দীপ্তেন্দ্র  নারায়ণের জয়”।

অরবিন্দ ভট্টাচার্য। লেখক। জন্ম ও বাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের কোচবিহার।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ