এইতো জীবন

সুলতা পাত্র
ছোটগল্প
এইতো জীবন

প্রীতম কালিনগরের নদীর পাড়ে আজকাল প্রায় আসেন, কিছুটা ভালোলাগা আর কিছুটা সময় তাঁর স্ত্রীর স্মৃতি রোমন্থন করেন। ভীষণ ভালোবাসেন গোধূলি বেলাটা এইভাবে কাটাতে। ডুবে যান স্মৃতির সমুদ্রে। টেউগুলো কখনো আহত করে, কখনো প্রাণে দোলা দিয়ে যায় ভালোবেসে।
মনে হয় এই তো সেদিন বাবা-মায়ের পছন্দ করা, পাশের গ্রামের মেয়ে তুলির সাথে তাঁর বিয়ে হলো। তুলি ভারী ভালো মেয়ে। বিয়ে হয়ে যাওয়া এক ননদ ,শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামীকে নিয়ে সুখের নিকেতন গড়ে তুলেছিলেন।
প্রীতম ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন প্রাইমারি শিক্ষক। বিয়ের পর তুলি কে জিজ্ঞেস করেন, -‘কি গো তুমি এই গরীব সংসারে মানিয়ে- গুছিয়ে নিতে পারবে তো? তোমার বাবার কত জমি আছে, আমাদের তো তা নেই’।
তুলি ঘোমটা টেনে লাজুক হাসি হেসে উত্তর দেন, -‘তুমি কি যে বলো না গো, কত বিদ্বান তুমি, পাড়ার সকলে তোমায় কত মান্য করে। তাই তো বাবা তোমার সাথে বিয়ে দিলে। আমার দুই বোনের বর মস্ত জমিদার, কিন্তু আমার স্বামীর মত কি বিদ্বান? তুমি যখন আমার ভাইকে মুখে মুখে অংক করে দাও, সকালে অবাক হয়ে যায়’।
প্রীতমের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে বলেন, -‘ তুমি আমার সহধর্মিনী, তুমি সুখী হলে আমিও সুখী। শুধু অনুরোধ এই অভাবের সংসারে অভিমান না করে সব সময় পাশে থেকো’।
শেষ বিকেলের লাল সূর্য পৃথিবীকে আঁধারে রেখে, গভীর সাগরে ডুবে যাচ্ছে। কোথাও দূর দিগন্তে কোথাও সবুজের মাঝে, আবার কখনো লুকিয়ে যাচ্ছে মেঘের ভাঁজে ভাঁজে। তুলি বলেন, -‘তুমি বাবা মায়ের কাছে যাও আমি সন্ধ্যে দেওয়ার আয়োজন করি। মনে রেখো তোমার সাথে আমার জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক’। . ………
বিয়ের তিন বছর পর তুলির রাজপুত্রের মতো সুন্দর একটি পুত্র সন্তান হয়। তুলি আদর করে নাম রাখেন আকাশ। ভারী মিষ্টি ছেলে।………
আকাশ বড় হচ্ছে তুলি বলেন প্রীতমকে, -‘ শোনো আমাদের ছেলেকে ভালো ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াবো। তুমি কিন্তু না করতে পারবে না’।
প্রীতম অবাক হয়ে বলেন, -‘ আমাদের টাকা কোথায় এত? নিজে একটু দুধ পর্যন্ত খাও না, আমাকে আর ছেলেকে দিয়ে দাও। বাবা-মা গত হবার পর পুরো সংসারের দায়িত্ব নিজে তুলে নিয়েছো। সংসারের কাজের ফাঁকে সেলাই মেশিন চালাও এত পরিশ্রম তুমি সইতে পারবে তো’?
-‘ হ্যাঁ গো হ্যাঁ, সব সইতে পারবো। আমার খোকাকে যে করে হোক উচ্চশিক্ষিত করতেই হবে। দেখো আমাদের খোকা একদিন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবেই’।
– ‘সে না হয় হলো, কিন্তু তুমি বলো তোমার শরীরের প্রতি যত্ন নেবে, আমি তো স্কুলে থাকি। আমাকে আর খোকাকে ফল দাও তুমিও কিছুটা ফল, দুধ খেয়ো। সারাদিন মেশিনে বসে থাকো, তারপর সংসারের কাজ, চারটে গরু, হাঁস,মুরগি এদের ঝামেলা।এতসব কাজ করো,একটু ভালো খাবার না খেলে হয়’?
– ‘তুমি থামতো বাবু এই বয়সে সব সহ্য হবে। বয়স হলে খোকা আমাকে ফল, দুধ সব এনে খাওয়াবে। আর ভালো খাবার খাই না তোমায় কে বললো? গ্রামের পুকুরের জ্যান্ত মাছ, গাছের কত রকম ফল এগুলো কি কম? শুধু আপেল, বেদানা, মৌসম্বিকে ফল বলে বুঝি’?
‘তোমার সাথে তর্কে পারবো না, তুমি যা ভাল মনে করবে তাই কর। দেখো অসুস্থ হয়ে যেন পড়োনা, জানিনা তোমার ছেলে তোমার এই আত্মত্যাগের দাম দেবে কিনা’।
আস্তে কথা বলো খোকা পড়ছে, ভালো স্কুলে ভর্তি হতে গেলে রীতিমত পড়াশোনা করতে হয়। যাও তুমি ওকে পড়াও গিয়ে, সেটাই কাজের কাজ হবে। আমি ঠিক ভালো থাকবো। চিন্তা করোনা খোকার সংসার গুছিয়ে দিয়ে পাকা চুলে সিঁদুর নিয়ে তবে আমি যাবো, তার আগে যাচ্ছি না এই বলে রাখলুম তোমায়’। . ………….
দিন, মাস, বছর কেটে গেছে। বড় হয়েছে আকাশ, এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। মায়ের এত পরিশ্রম দেখে সে একদিন মাকে বলে, -“মা প্রচুর কষ্ট করছো আমার জন্য, এবার মেশিনের কাজ ছেড়ে দাও। আমি কয়েকটা টিউশন করে পড়া- শোনার খরচ চালিয়ে নেবো, লক্ষ্মী মা আমার কথাটা শোনো’।
তুলি সস্নেহে উত্তর দেন আমার কিছু হবে না বাবা। তুই এখন টিউশন করলে তোর পড়ার ক্ষতি হবে। আর তো কটা বছর,তুই মন দিয়ে পড়াশুনা করে একটা ভালো চাকরি পেলে, আর মেশিনে কাজ করবো না রে। যা পড়তে বস, হাওড়া থেকে কলকাতা ট্রেনে করে যাতায়াত কি কম কষ্ট’।
কারোর কথা শোনেনা তুলি। তার স্বপ্ন ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে, এই কষ্ট একদিন আর থাকবে না। সেই দিনের প্রতীক্ষায় দিন গুণতে থাকে সে। এমনিতে আকাশ সব সময় ছোটোবেলা থেকেই ভালো রেজাল্ট করে। টুয়েল্ভ পর্যন্ত ক্লাসে ফার্স্ট ছাড়া কোনদিন সেকেন্ড হয়নি। স্কুল ফাইনাল, হায়ার সেকেন্ডারি তে স্টার পেয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেও ভালো রেজাল্ট করে, ফোর্থ ইয়ারে ক্যাম্পাসিং এ চাকরি পেয়ে যায় ব্যাঙ্গালোরে টি. সি.এস কোম্পানিতে।
গ্রামে ডেঙ্গুর আবির্ভাব হয়, প্রীতমের বাড়ির পাশেই রামুর বিধবা মা ডেঙ্গু তে মারা যান। তুলি অসহায় রামুকে ওদের বাড়িতে থাকার জন্য ডেকে আনেন। রামুর বয়স তখন পনেরো বছর, সে মহাজনের বাড়িতে চাষের কাজ করতো। তার মা কয়েকটা বাড়িতে ধান সেদ্ধ,ঘুঁটে দেওয়া, চাল ঝাড়া, গরুর ঘাস কাটা এইসব কাজ করে দিতেন।মা ও ছেলের পরিশ্রমের পয়সায় টেনে-টুনে সংসার চলে যেতো কোনরকমে। বড় সাধ ছিল ছেলেকে বিয়ে দেবেন,বৌমা বাড়ি এলে হাত-পা ছড়িয়ে তার রান্না খাবেন, সে আর হলো না।
আকাশ চাকরি পাবার পর বাড়িতে টাকা পাঠায়, এখন আর প্রীতমের সংসার চালাতে টাকা-পয়সার অসুবিধে হয় না। যতটুকু জমি আছে রামু একজন লোক নিয়ে নিজে হাতে চাষ করে, বাস্তুটারও লক্ষ – নজর রাখে। নিজের হাতে সব্জি বাগান করে, কত রকম সব্জি হয় প্রিতমের বাড়িতে। পুকুর ভরা মাছ, গাছ ভরা ফল, সব্জির বাগান, গরু, হাঁস, মুরগি এইসব নিয়ে রামু ও থাকে বেশ আনন্দে, প্রীতম ও তুলির স্নেহের ছায়ায়। কাঁচা ইটের তৈরি দোতলা টালির বাড়িতে বেশ কয়েকটি ঘর আছে। একটি ঘরে রামু দিব্যি বহাল তবিয়তে থাকে বাড়ির ছেলের মতোই। ………..
একদিন ফোনে তুলি জিজ্ঞেস করেন আকাশকে, -‘হ্যাঁ রে খোকা আর কতদিন হাত পুড়িয়ে খাবি বাবা, এবার বিয়ে কর। তুই কি কাউকে পছন্দ করে রেখেছিস?নাকি আমরা মেয়ে দেখবো, লজ্জা না পেয়ে খুলে বল আমায়। তোর একটা বিয়ে দিলে আমরা নিশ্চিন্তে বুড়ো – বুড়ি থাকতে পারবো’।
আকাশ ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বলে, -‘প্রিয়াংকা আমাদের অফিসে চাকরি করে, ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। ওকে আমি বিয়ে করবো কথা দিয়েছি, তোমরা অমত করবে নাতো?আমি কয়েক মাস পরেই জানাতাম মা, আমাকে ভুল বোঝনা ক্ষমা করে দিও’।
‘নারে খোকা তুই এত চিন্তা করিস না, আমি তোর বাবাকে বলবো সব কথা। তোর বাবাও নিশ্চয় অমত করবে না। তুই তোর পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করবি, এতো ভালো কথা, এতে অমতের কি আছে? শরীরের দিকে নজর নিস, ভালো থাকিস বাবা’।
তুলির কাছ থেকে আকাশের বিয়ের ব্যাপারে সবকিছু শোনার পর, প্রীতম স্বতঃস্ফূর্তভাবে মত দিয়েছেন, না করেননি। বাবা ও ছেলের মধ্যে কথা হবার পর, ফাল্গুনের এগারো তারিখ বিয়ের দিন বাঁধা হয়। মেয়ের বাবা ও মা এসে দিনক্ষণ ঠিক করে গেছেন। আকাশকে আশীর্বাদ করার পর্ব ও সম্পন্ন করেছেন। তুলি ও প্রীতম ভাবি বৌমাকে আশীর্বাদ করে এসেছেন।
বিয়ের দিন এগিয়ে আসে, প্রীতমের বাড়িতে প্যান্ডেল বাঁধার জন্য লোকজনকে নিয়ে রামু ও ব্যস্ত। প্রীতমকে রামু বলে দিয়েছে, -‘বাবু তুমি শুধু আমায় আদেশ করবে, তোমার সব কাজ আমি করে দেবো। তোমাকে কিন্তু রোদে বের হতে দেব না। দোকানদারদের সাথে ফোনে তুমি কথা বলে নিও, লোকজন নিয়ে আমি বাজার করে আনবো’।
প্রীতম বলেন তুই তো আমাদের আগলে দেখেছিস বাবা, তোকে আমরা আমাদের আরেক ছেলের মতই ভাবি। কাপড়ও গয়নার বাজার তোর দাদাবাবু ও বৌদি মনি করবে । বাদবাকি কাজগুলো তুই,আমি আর তোর কাকিমা আমাদেরকেই তো দেখতে হবে’।
সবকিছু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। আকাশ ও অতসীর বিয়ে-বৌভাত শেষ হবার পর ওরা ব্যাঙ্গালোর ফিরে গেছে। অতসী কলকাতার মেয়ে, তাই অষ্টমঙ্গলা শেষ হবার দুদিন পর আকাশকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যায়। ওখান থেকে রওনা দেয় ব্যাঙ্গালোরে। তুলি মনের মধ্যে একটা চাপা অভিমান ছেলে ও বৌমার প্রতি পুষে রাখলেও প্রকাশ করেননি। তবে প্রীতমও বুঝতে পারেন, তাদের পুত্রবধূ এই বুড়ো -বুড়িকে কোনদিন মানিয়ে নিতে পারবে না। পাছে তুলি কষ্ট পান তাই তিনিও তুলিকে কিছুই বুঝতে দেননি।
বাস্তবটা এতই কঠিন যে, কখনো কখনো বুকের ভেতর গড়ে তোলা বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা একসময় যেন অসহায় হয়ে পড়ে।
শীতের আকাশে বাদল ঝরছে, অসময়ের মন কেমন করা বাদল। বর্ষার মধুর বর্ষণের নেই সেই তান, তুলি অভিমানী মন নিয়ে বলেন, – জানো? আমি যদি হঠাৎ হারিয়ে যাই এ পৃথিবী থেকে! দুঃখ করোনা আমার জন্য, ভালো থেকো তুমি। রামু দেখাশোনা করবে তোমাকে’।
প্রীতম জিজ্ঞেস করেন, এমন করে বলছ কেন আমায়? চিরকাল তো ছেলেকে ভালোবেসেছো, সে ছিল তোমার প্রাণ। বুড়ো বয়সে যদি বা তুমি আমায় সময় দিলে অনেকটা,এখন আবার চলে যাবার কথা বলছো। কি হয়েছে তোমার খুলে বলো আমায় লক্ষীটি’।
না গো কিছু না। আজকাল বুকে কেন জানিনা মাঝে মাঝে চিনচিন করে ব্যথা হয়। এতদিন তোমায় কিছু বলিনি ,একবার যাবে আমায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে?
নিশ্চয়ই, আগামীকালই যাবো। তুমি আজকাল এত মনমরা হয়ে থাকো কেন বুঝি না! চিন্তা করো না, কিছুই হয়নি তোমার, হয়তো অ্যাসিডের জন্য বুকটা ব্যথা করছে’।
হার্টের ডক্টর দেখানো হলে ধরা পড়ে, তুলির হার্টে চারটি ব্লকেজ। ডক্টর বলেন দেরি না করে সেন্ট বসানোর কথা। অনেক টাকার দরকার , বারণ করে তুলি আকাশকে জানাতে।প্রীতম ধানের জায়গা দুবিঘে বিক্রি করে দেয়।আকাশ প্রতি মাসে টাকা পাঠাতো সেই টাকা কিছু জমানো ছিল, আর ছিল তুলির কয়েকটি গয়না, তাও বিক্রি হয়ে গেলো।
অপারেশনের দিন রামু সহ প্রীতম, তুলির ভাই, প্রীতমের দিদি,জামাইবাবু, সকলে উপস্থিত ছিলেন নার্সিংহোমে। ভগবানের আশীর্বাদে অপারেশন সাকসেসফুল হয়,তুলি বাড়ি ফিরে আসেন কয়েকদিন পর। কিন্তু ডক্টর বলে দিয়েছেন যেন কোন প্রকার ট্রেস না নেয় তুলি। আর সুষম খাবার যেন খায়, সেই সাথে বিশ্রাম।
সময়ের সাথে-সাথে মানুষের জীবন বদলে যায়। আবার কিছু আপনজনও বদলে যায় সময়ের সাথে। প্রত্যেকের বয়স যত বাড়ে,জীবন থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। মাথার ওপর থেকে নিঃস্বার্থ আশীর্বাদ আর ভালোবাসার হাতগুলো ক্রমশ অদৃশ্য হতে থাকে। কালের স্রোতে তাঁরা হারিয়ে যান, তাঁরা কেবল থাকেন আমাদের মনোমন্দিরে, ঘরের দেওয়ালে,স্থিরচিত্রে। আমাদের ডাক নাম গুলো ও হারিয়ে যায় তাঁদের সাথে, এই নামগুলো যাঁদের দেওয়া, তাঁরাই যে আমাদের জীবন থেকে একে একে হারিয়ে যান।
আকাশ ও প্রিয়াঙ্কা অপারেশনের মাসখানেক পর এসেছিলো,তুলি ও প্রিতমের সাথে দেখা করতে। তুলির হার্টে সেন্ট বসানো হয়েছে কেউ জানায়নি। আকাশ বাবা মাকে বলে, -‘তোমরা সাবধানে থেকো আমিও প্রিয়াংকা কয়েক বছরের জন্য আমেরিকা যাচ্ছি। চাকরির সূত্রে। ওখানে প্রচুর পয়সা,এইসময় কিছু যদি উপার্জন না করি ভবিষ্যতে আর হবে না। তাছাড়া ওখানে কয়েকবছর থাকলে কলকাতাতে এসে ভালো চাকরি ও পেয়ে যাবো,ব্যাঙ্গালোরে থাকতেও হবে না’।
তুলি বুঝতে পেরেছিলেন, ওরা আর দেশে স্থায়ীভাবে আসবেনা ওখানেই থাকবে। তবুও বলেছিলেন, -‘সাবধানে থাকিস’।
প্রীতম বলেছিলেন, -‘বেশি দেরি করিস না খোকা তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে আসিস তোরা দজনে, আমাদের খুব কষ্ট হবে তোদের ছেড়ে থাকতে’।
আকাশ ও প্রিয়াঙ্কা আমেরিকা যাবার পর মনের ভেতরে যেন ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন তুলি। একমাত্র ছেলে বৌমাকে আজ দু বছর হয়ে গেল দেখেননি। রামু তুলিকে মায়ের মত শ্রদ্ধা করতো কিছুই করতে দিত না। বাড়ির রান্না থেকে শুরু করে সমস্ত কাজ সে নিজে করে। দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটানো যায়? মেটাতে যে হয় অনেক সময় বাধ্য হয়ে,অনেকেই তো মেনে নেন।বুকের ফোটা ফোটা রক্তবিন্দু দিয়ে বড় করা ছেলে মেয়েকে দেশে চাকরির অভাবে অনেক সময় বাধ্য হয়ে বাইরের দেশে চাকরি করতে পাঠাতে হয়। তবে অনেকে আবার ইন্দুর দৌড়ে এগিয়ে থাকার জন্য ইচ্ছে করেও বিদেশে যায় চাকরির জন্য।. ………….
তিন বছর হয়ে গেলো, আকাশ ও প্রিয়াঙ্কা দেশে আসেনি। প্রিয়াঙ্কার বাবা-মা অবশ্য পাসপোর্ট, ভিসা করে আমেরিকা থেকে ঘুরে এসেছেন। বৌমা গ্রাম্য শ্বশুর – শাশুড়িকে পছন্দ করেনা তাই ছেলের কাছ থেকে প্রীতম ও তুলি ডাক পাননি আমেরিকা যাবার। শরীরের আঘাতের চেয়ে মনের আঘাত মানুষের জন্য বেশি ক্ষতি করে, কারণ মনের আঘাতের কোন নির্দিষ্ট ঔষধ নেই। মৃত্যুর মতো সব শোকের স্মরণ সভা হয় না, অথচ হৃদয় ভাঙ্গার শোক মৃত্যুর থেকেও যে বড়।
ছেলে ও বৌমার অবহেলা, ছেলেকে না দেখে থাকা মেনে নিতে পারেননি তুলি। হৃদয় পারেনি তুলির বেদনার এত বোঝা নিতে। একদিন রাতে বুকে খুব ব্যথা শুরু হয়। অসহ্য যন্ত্রণাকে যতটা পারেন সহ্য করে কয়েকটা কথা বলে যান প্রীতমকে,-‘ওগো আমার বেলা ফুরিয়ে এসেছে তুমি আমাকে এবার হাসিমুখে বিদায় দাও। রামু তোমার সন্তানের মতো, ওকে বিয়ে দিয়ে এই বাড়িতে রেখো। ওরা তোমাকে দেখাশোনা করবে, খোকার উপর রাগ করোনা। বাবা মায়ের অভিশাপে সন্তানের অমঙ্গল হয়’।………..
তাড়াতাড়ি বাড়ির কাছাকাছি ডক্টর কে কল করেন প্রতিম। ডক্টর আসেন এত রাতে রামুর সাথে, তার আগে বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে তুলি। ডক্টর সান্তনা দেন প্রীতম কে, রামুকে না নিয়ে একাই বাড়ি যান, কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন প্রীতম। বলেন, -‘তুমি চেয়েছিলে শাঁখা – সিন্দুর পরে সতী লক্ষ্মী হয়ে বিদায় নিতে, চলেও গেলে। আমার কথা কেন ঈশ্বর শোনেন না বলতে পারো?শুধু তোমার মনের ইচ্ছে গুলোই পূরণ করেন, কি পাপ করেছি আমি’!
রামু পা জড়িয়ে ধরে বলে, -‘ বাবু চুপ করো মা ঠাকরুনের যে আরো বেশি কষ্ট হবে, তুমি কাঁদলে। কিছুক্ষণ পর কান্না থামান প্রীতম। স্ত্রীকে সাজান নববধূর বেশে, স্ত্রীর মাথায় সারারাত হাত বুলিয়ে দেন পরম আদরে।
ভোরে প্রীতম মুখাগ্নি করেন, দাহ কর্ম শেষ হবার পর বাড়ি এসে ছেলেকে মেসেজ লেখেন,- ‘তোমার মা আমাকে ছেড়ে ঈশ্বরের কাছে চলে গেছেন। ভালো থেকো তোমরা। রামু আমাকে লক্ষ- নজর খুব ভালোভাবে করছে। অন্য কোন অসুবিধে নেই, কেবল তোমার মা বাড়ি ছাড়া’।
আমেরিকাতে তখন সন্ধে আটটা বাজে, সবে প্রিয়াঙ্কা ও আকাশ অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছে। মেসেজটা দেখে আকাশ চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। বলে চলে একই কথা, -‘মাগো তুমি কত কষ্ট করেছো আমার জন্য, আমি যে তোমার কুলাঙ্গার সন্তান, কেন চলে গেলে মা’!
প্রিয়াঙ্কা সান্তনা দেয়, -‘ মা-বাবা কি চিরকাল থাকে? লক্ষ্মীটি এইভাবে ভেঙে পড়ো না’।
আকাশ প্রিয়াঙ্কাকে উত্তরে বলে, -‘তোমার জন্য মাকে হারালাম। আর নয় দেশে ফিরে যাবো আমি, বাবার প্রতি আমার দায়িত্ব – কর্তব্য আছে। থাকো তুমি এখানে’।
প্রিয়াঙ্কা বুঝতে পারে, আকাশ কে আটকানো আর সম্ভব নয়। জানায়, -‘আমিও যাবো তোমার সাথে, তোমাকে ছেড়ে আমি থাকবো কি করে’।
টিকিট কাটার ব্যবস্থা করে আকাশ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছোতে হবে বাবার কাছে, যত টাকা লাগে লাগুক। মাকে হারিয়েছে, বাবা কিভাবে দিন কাটাচ্ছে সেই চিন্তায় আকাশ ছটফট করতে থাকে।
আকাশ হোয়াটসঅ্যাপে লিখে পাঠায়, -‘ একি হয়ে গেল বাবা! কেন হলো? মা কি আমার ওপর অভিমান করে চলে গেলো! আমেরিকার পাট চুকিয়ে আমরা একেবারে দেশে ফিরছি, তাড়িয়ে দিও না। থাকতে দেবে তো ওই বাড়িতে? ওখান থেকেই আমরা কলকাতার অফিসে আসবো, কোনো অসুবিধা হবে না আমাদের’।
একাকীত্ব কতটা বিনিদ্র তার সাক্ষী প্রহর। রাতের গভীরতা জানে সাথীহারা পাখি।পথিকের নীরবতা বোঝে দীর্ঘায়িত পথ। বড় একা লাগছে প্রীতমের, তুলিকে ছাড়া বিয়ের পর এই প্রথম একা থাকা। আকাশ জন্মানোর সময়, বাবার বাড়িতে প্রীতম কে ছেড়ে থাকেন নি তুলি। শ্বশুরবাড়িতেই তুলি থেকেছেন আকাশ জন্ম হবার পর, কত স্মৃতি মনে পড়ছে প্রীতমের।
ছেলের মেসেজ পড়তে পড়তে অঝোরে কাঁদ ছিলেন প্রীতম,রামু খেতে ডেকে নিয়ে যায়। রামু ও কেঁদে কেঁদে বোঝায় প্রীতমকে, -বাবু এত কাঁদবেন না শরীর খারাপ করবে। আমি মুখ্যু মানুষ কাজ করে দিতে পারি, অসুস্থ হলে কে দেখবে তোমায়’?
প্রীতম পড়ে শোনায় রামুকে আকাশের মেসেজ। বলেন, -‘রামু রে তোর মা ঠাকরুনের কপালে সুখ নেই,ও শুধু সবাইকে সুখী করতে জানতো। তোর দাদা বাবু বৌদিমনি সেই এলো দেশে ফিরে, যদি আগে আসতো হয়তো এই ভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যেতো না তুলি’।
কয়েকদিন পর আকাশ ও প্রিয়াংকা আসে।শ্রাদ্ধের কাজ মিটে গেলে বাবার কাছ থেকে সব শুনে আকাশ বলে, -‘মায়ের বুকে যে সেন্ট বসানো হয়েছিলো, যদি আমাকে জানাতে যেতাম না আমেরিকাতে। সব দোষ আমার, আমি একটা কুলাঙ্গার। আমি জানি মা অভিমানে চলে গেছে। আমি টাকার মোহে অন্ধ হয়ে গেছিলাম’।
দুঃখের দহনে, করুন রোদনে কত বাবা- মায়ের জীবন ক্ষয়ে যায় তিলে তিলে। চলে যায় অকালে মরনের কোলে। কত ফুলের মত স্বপ্ন ঝরে পড়ে, অসময়ে শুকনো পাতার মর্মরে। আকাশে বাতাসে নিষ্ফল আশা বেদনার সুরে ভেসে বেড়ায়।

কাব্যশ্রী পুরস্কার, বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্য সাহিত্যের জনক সম্মান, শরৎ সাহিত্য সম্মান, বিভূতিভূষণ স্মৃতি সম্মান, লীলা মজুমদার স্মৃতি সম্মান প্রাপ্ত কবি ও ঔপন্যাসিক। কলকাতার বাসিন্দা সুলতা পাত্র মেদিনীপুর জেলার কাঁথি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। উনি স্কুল কলেজ ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখতেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ