এই আমি

জাকিয়া শিমু
ছোটগল্প
এই আমি

ছোটবেলায় একবার রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা হয়েছিল।

মেলা-বান্নিতে ধবধবে শঙ্খসাদা তুলার দাড়িগোঁফে আবৃত মাথাঝুলানি রবীন্দ্রনাথ বিক্রি হত। দেখতে অনেকটা সেরূপ রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার দেখা হয়ে গেল। আসল রবীন্দ্রনাথের ফটোগ্রাফ তখনও দেখার সুযোগ হয়নি। তো মাথাদুলানো রবীন্দ্রনাথ আমাদের গাঁয়ের শিরিষগাছ তলায়, চটের-বস্তার পরে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। আমরা, ছোটরা তার চারপাশে গোল হয়ে বসে আছি। আমাদের চোখে-মুখে জগতের কৌতূহল এসে ভিড় করেছে। তিনি আমাদের হাত দেখে ভবিষ্যৎ বলে দিবেন।

মাথাদুলানো রবীন্দ্রনাথ, খুব মনোযোগে তার ঝাপসা-ধরা আতশীদর্পণে কপাল কুঁচকে আমার হাতেররেখা পরীক্ষা করলেন। মুখে যথাসম্ভব গাম্ভীর্য ধরে রেখে শুধালেন, ‘তোর বিদেশ যাত্রা আছে কিন্তু’ । এরপর বেশ কিছুক্ষণ চিন্তিত মুখে আমার চোখের দিকে চেয়ে রইলেন; জ্যামেতিক কপালটা বারকয়েক কুঁচকালেন, শেষে বললেন ‘সেখানে এক ঝড়ের তান্ডবে তুই লণ্ডভণ্ড হবি’।

‘ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে’- মহাবাক্যটির মতো করে হলেও এই আমি আগাগোড়া বিদেশ-বিমুখ মানুষটা একসময় হুট করেই বিদেশ চলে এলাম। এবং রবীন্দ্রনাথের কথামতো ট্রাই-স্টেট-টর্নেডো’-এর চেয়ে ভয়ঙ্কর মাত্রার ঝড়ে তছনছ হলাম। তবে করোনা নামক সে-ঝড়ে শুধু আমি নই, পুরো মার্কিন মুলুকে এমন কোন পরিবার পাওয়া যাবে না, এর ছাপপোঁচ পড়েনি। আমার সংসারটা, ঝড়ের পরে লণ্ডভণ্ড হয়ে নুয়েপড়া গাছটার মতো ডালপালা খুইয়ে কোনোমতে টিকে রইল।

করোনার প্রথম ধাক্কায় আমার অবস্থা হলো বেগতিক। ঠাণ্ডার দোষ ছিল, তাতে বাড়তি সুবিধা পেয়ে আমাকে পুরোদস্তুর কাহিল করে ফেলল। একপর্যায়ে হাসপাতালে চলে যেতে বাধ্য হলাম। যদিও তখনকার অবস্থায় হাসপাতাল শব্দটা যমে শুনলেও ভয়ে ছুটে পালায়। সিকিভাগ রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে এমন নজির নাই।

আমি শ্বাসকষ্টের যন্ত্রণা সইতে না পেরে, সমূহ মৃত্যু জেনেও হাসপাতালমুখী অ্যাম্বুলেন্সে ওঠে পড়লাম। সেখানে উপচে পড়া ভিড়ের মাঝে আমার মতো অনেকের জায়গা হয়েছে করিডোরের ঢালা-বিছানায়, গাদাগাদি করে। কোনরকমের একটা তক্তপোশের ওপর বেহুঁশ হয়ে পড়ে রইলাম। তারমধ্যে থেকে খুঁজে-বেছে অবস্থা ভয়াবহ এবং বয়সে নবীন, গায়ের রঙ সাদা ( কালো হলে রক্ষা নেই তাদের নাকি বাঁচানোর কোন প্রচেষ্টাই করা হচ্ছে না। এমন অভিযোগ অবশ্য ফেলনা নয়, ঘটনাদৃষ্টে প্রমাণও মিলছে) তাদের বেড খালি হলে- কেউ মরে গেলে তবেই বেড খালি হয়, সেখানে তোলা হচ্ছে।

হাসপাতালে ভর্তির পর আমার অবস্থা আরও খারাপের দিকে গেল। বেশিরভাগ সময় আমি অচেতন হয়ে পড়ে থাকি। বেঁচে আছি, না মরে গেছি সেই-বোধের চেতনাটুকু টের পাওয়ার মতো অবস্থায় আমি নেই। মাঝেমধ্যে সুরাসক্তের মতো ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে দেখি, আশপাশের মড়াদের বিশেষ প্লাস্টিকব্যাগে পেঁচিয়ে বাইরে চালান করে দেওয়া হচ্ছে।

এরপর বানের জলের মতো কোথা থেকে আরও রোগী এসে নিমিষেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তুলছে। মাঝেমধ্যে টের পেতাম ডাক্তার- নার্সদের ফিসফিসানি শব্দ। মৃদুপায়ে আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করছেন। হয়তো মরার মতো পড়ে থাকা আমাদের মাঝ থেকে মড়ার খোঁজ করছেন। ডাক্তারের চোখ আমাদের শরীরের সাথে আঁকুশি গাছের মতো পেঁচিয়ে যাওয়া নলের পশ্চাৎভাগ যেখানে যুক্ত, সেই চৌকোণা মনিটরে।

একসময় জ্বরের-ঘোর কিছুটা কেটে উঠলে বুঝতে পারলাম আমি বিশেষ ব্যবস্থায় জায়গা পেয়েছি। তারমানে আমার সময় শেষ, দু’একদিনের মধ্যে আমার বিষয়ে ফয়সালা হবে। বাঁচা কিংবা মরা, যেকোন একটা। হাসপাতালে আসার আগে ভুরিভুরি প্রমাণও তার পেয়েছি। কতো চেনাজানা আপনজন চলে গেল। বিশেষ ব্যবস্থায় হাসপাতালে রোগীকে জেতা অবস্থায় মেরে ফেলা হয়। এটা শোনাকথা নয়, নিজচোখে দেখা।

হয়তো আমাকে তাদের মতো দু’একদিন বিশেষ ব্যবস্থায় (Intensive Care Unit) রেখে এবং অবস্থার নড়চড় না হলে, নলের বাঁধন টেনেটুনে খুলে নিশ্ছিদ্র ব্যাগে ভরা হবে। প্যাকেট চলে যাবে কোথাকার কোন গর্তে, কে জানে! তার খোঁজচিহ্ন আপনজন তো দূরে থাক, কাকপক্ষীও জানতে পারবে না। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মরছে, স্বজনরা কেউ তাদের হদিশ জানে না। নির্জন স্থানে বিশাল গর্তে একসাথে মাটিচাপা দেওয়া হচ্ছে।

বিশেষ ব্যবস্থায় আমার হুঁশ কিছুটা হলেও যেন ফিরতে শুরু করে। যদিও ডাক্তার-নার্সদের ফিসফিসানি ভিন্ন কথা বলে। তাদের ইশারা ইঙ্গিত বলে, আমি বড়জোর দু’একদিন টিকব। আমার চারপাশে অল্পবয়সী রোগী সংখ্যায় বেশি। তবে বয়োবৃদ্ধ কয়েকজনকেও চোখে পড়ল।

প্রথম অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হতে সবার মতো আমারও আপত্তি ছিল। ভয়ডরে ডুবে ছিলাম। তবে হাসপাতালের অবস্থা দেখে বলতে গেলে মরার ভয়টা পুরোপুরি উড়ে গেছে। বেঁচে থাকাটা কিংবা এ-রোগের নিরাময় বরং অস্বাভাবিক লাগছে। মরে যাওয়ার মিছিলে দৌড়ে এগিয়ে চলছি এবং তা খুব আটপৌরভাবে।

আমার চারিপাশের বেডে এই বেলায় যাদের দেখছি ,পরের বেলায় টের পাই সেখানে ভিন্ন মানুষ শুয়ে কাতরাচ্ছে। পরের দিন তারাও নেই আবার নতুন রোগী এসে ভর্তি হয়েছে। পাহাড়ি ঢলের মতো করে মানুষ মরছে। প্রতিমুহূর্তে যোগ হচ্ছে শতে শতে। মনে হচ্ছে আমিও মরে গেছি। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে গেলে মৃত্যুকে আটপৌরে একটা কাজের মতো মনে হয়। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে আমি নিজেও নিজের আশু-মৃত্যু প্রার্থনা করছি। হাসপাতালের প্রতিটা মানুষের আমার মতো একটাই প্রার্থনা। মৃত্যুসম যন্ত্রণা বেশিক্ষণ সয়ে যাওয়ার ক্ষমতা মানুষের নেই।

পাশের শয্যার বুড়ির বিশেষব্যবস্থা খুলে নেওয়া হল। গত দু’দিন ধরে বুড়ি স্থির অবস্থায় ছিল। মরার এপাড়েও না ওপাড়েও না- মধ্যিখানে। বড়ো ডাক্তার দু’তিন দিনে একবার আসার সুযোগ পান। চন্দ্রাভিযানের লোকদের মতো পুরোদেহ শঙ্খশুভ্র পোশাকে ঢেকে তিনি এবং অন্যান্য ডাকআর-নার্স রুমে ঢুকেন। তাদের দেখে আমার কিতাবে পড়া মৃত্যুদূতের কথা মনে পড়ে যায়।

শুভ্রবসনের মৃত্যুদূতেরা সাধারণত মুখে কিছু বলেন না। তিনপ্রস্ত মাস্ক, হেলমেট-এর ভিতর দিয়ে অবশ্য বলা-শোনার জো নাই। হাতের ইশারায় কাজ করেন। বড় ডাক্তার হাত নাড়িয়ে ইঙ্গিত করতে বুড়ির ব্যবস্থা খুলে নেওয়া হলো। অনেকটা বাংলা সিনেমার ভিলেনের মতো করে। ভিলেন হাতের ইশারায় খুনের নির্দেশ দেয়, সেরূপে। আজরাইল তার কাজ ঠিকঠাক মতো করল কিনা জানা গেল না! তার আগেই বুড়িকে বিশেষ প্যাকেটে পুরে বাইরে চালান করে দেওয়া হল। বুড়ির দৌলতে মুমূর্ষু আরেকজন জায়গা পেল।

এরপর মৃত্যুদূত ধীরলয়ে আমার বেড-এর নিকটে এসে দাঁড়াল। মাথার কাছ থেকে আমার ফাইলটা তুলে নিয়ে কী যেন কপাল কুঁচকে মনোযোগে দেখল। এরপর খানিকক্ষণ মনিটরে চোখ রাখলেন। আমি আধবোজা চোখে তার হাতের দিকে ঠায় তাকিয়ে রইলাম। আমার বুকের পাঁজরে তখন সমুদ্র ঢেউ উথালপাথালে বইছে। তিনি হাতে কোন ইশারা না করলেও মুখখানা বারকয়েক উপর-নিচে নড়ালেন। সেদিনের মতো আমি রক্ষা পেলাম।

আমি মোটেও ভালো-মন্দ বোঝার দশায় নাই। শ্বাসকষ্ট লাঘবে শেষ পর্যায়ের ব্যবস্থায় আছি। আমার সাথে সংযুক্ত মনিটর তা-ই বলে। মাঝেমধ্যে যন্ত্রটা ভয়ার্ত একটা আওয়াজ করে। সে সময় আমি মরে যাই।

তারমানে আমার ফুসফুস কৃত্রিমভাবেও শ্বাস নিতে পারে না। এ সময়ে মাঝেমধ্যে ডিউটি নার্স আলগোছে আমার পায়ের কাছে রাখা চৌকোণা যন্ত্রখানা পরখ করে যায়। আছি না মরে গেছি ! অল্পক্ষণ পরে অবশ্য আমার হুঁশ ফেরে। ডিউটি-নার্স আমার ফাইলে যাবতীয় অবস্থার রিপোর্ট টুকে রাখে। হয়তো আজকের দিনটার পর বিশেষ ব্যবস্থার এ সুযোগ আমার জন্যে থাকছে না। আমার শেষ সময়ের দৃশ্যপট চোখের উপর আপনাআপনি ভেসে বেড়ায়।

গহীন আঁধারে ডুবে থাকা বিশেষ ব্যবস্থার কামরায় সারাক্ষণ কবরের নিস্তব্ধতা থাকে। চোখজোড়া আপনাআপনি বুজে আসে। চেষ্টা করেও মেলতে পারি না। একটা বিষয় টের পাই। আমার মাথা ঠিকঠাক কাজ করছে না। এমন কী আমার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের নিয়ন্ত্রনও আমার নিজের সাধ্যের মধ্যে নেই। শত চেষ্টায়ও হাত-পা সামান্য নড়াচড়া করতে পারি না। ওদিকে ব্রেনের মেমোরি সেল-গুলি যেন উত্তাল সমুদ্রের লহরীর মতো দ্রুত গতিতে কোথাও ছুটে চলেছে। বহুকাল আগে পেছনে ফেলে আসা এবং আবছা আবছা মনে পড়া ধুলোজমে থাকা সেসব স্মৃতিরা পুরোদস্তুর ছায়াছবির মতো বদ্ধচোখের পাতায় অবিরত ভেসে চলেছে। আমি মূক-দৃষ্টিতে বন্ধচোখে সেসব দৃশ্য শুধু দেখে যেতে বাধ্য হচ্ছি।

এরপরের আর কোন ঘটনা আমার স্মরণে নেই। অর্থাৎ আমি জ্ঞান হারাই।

শেষমেশ অবশ্য অদৃশ্য নিয়ন্ত্রনকারীর নির্দেশে বেঁচে যাই। একসময় আমাকে হাসপাতাল থেকে সুস্থ তকমার সার্টিফিকেট ধরিয়ে বিদায় করা হয়। আমি যেদিন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসি, হাসপাতালের ডাক্তার-নার্স বিস্ময়ে হা হয়ে তাকিয়ে ছিল। গত সাতদিনে বিশেষ ব্যবস্থার সেই কামরায় দু’শ লোকের মাঝে আমি একমাত্র বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবান। পুরো ঘটনা আজও আমার কাছে একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়।

বাড়িতে ফিরেও আলাদা কামরায় একা থাকি, যদিও আমি তখন পুরোপুরি করোনা ভাইরাস মুক্ত। অবস্থাদৃষ্টে কিছুই বলা যায় না। এ-রোগের কোন নির্দিষ্ট ওষুধ নেই, প্রতিষেধক নেই। ভাইরাসমুক্ত বলে এ মুহূর্তে তেমন কিছু বিশ্বাসেরও জায়গা নেই। হাওয়ায় নাকি ভাইরাস ভেসে বেড়ায়। খুব জরুরি না হলে কেউ ঘরের জানালা কপাটও খুলছে না। চারদিকে সমানতালে তাণ্ডব চলছে। পথঘাট মানবশূন্য। সংবাদমাধ্যমগুলোতে চোখ রাখলে, অবস্থার ভয়াবহতা টের পাওয়া যায়। পুরো পৃথিবী তাকিয়ে আছে আমেরিকার দিকে। এমন বিপর্যস্ত অবস্থা পৃথিবীর অন্য কোন ভূখণ্ডে ঘটেনি। এত অমানবিক-বিপর্যস্ত অবস্থার ভিতর দিয়ে পৃথিবীকে এরপূর্বে কখনো হয়তো যেতে হয়নি। নিজের বাবা-মা, স্বামী-সন্তান প্রিয়জন একের পর এক মৃত্যুর মিছিলে মিশে যাচ্ছে। শেষদেখা বলে কিছু থাকছে না। কবরের স্মৃতিফলকটি পর্যন্ত থাকছে না।

আমাদের ঘরে আমরা পাঁচজন মানুষ। দু’হাজার স্কয়ার ফিটের তিন-কামরার বাসায় নিজেদের মধ্যে ছ’ফিট দূরত্ব রেখে চলি। যাবতীয় সুরক্ষা কবচ মেনে চলছি। পৃথিবীর বাঘাবাঘা ডাক্তার কবিরাজ করোনার প্রতিষেধক উদ্ধারে যারপরনাই ঘামরক্ত ঝরিয়ে যাচ্ছেন। কোনো কিছুতেই কিছু মিলছে না। একমাত্র মানুষের সংস্পর্শ থেকে পালিয়ে বেড়ানো ছাড়া অন্য কোন পরামর্শ এ মুহূর্তে কর্তাব্যক্তিরা দিতে পারছেন না।

বাতাসে সত্য মিথ্যার গল্প ভেসে বেড়াচ্ছে। যে যার মতো ঝাড়ফুঁক-টোটকা চিকিৎসা নিচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে আসলে কোন চিকিৎসা নেই। অক্সিজেন দিয়ে রুগীকে সাময়িক আরাম হয়তো দিতে পারছে। কিন্তু সুস্থ করে তোলার মতো দাওয়াই তাদের কাছে নেই। কৃত্রিমভাবে রুহ ধরে রাখার যন্ত্র চাহিদার কাছে অপ্রতুল। ডাক্তার-নার্সসহ হাসপাতালের সাথে যুক্তরাও গণহারে মরছে। মানুষ ঘরে মরে পড়ে আছে। পচে গন্ধ ছড়াবার অভিযোগেও কর্তৃপক্ষের সারা মিলছে না কারণ তারাও মরছে।

এমন একটা অবস্থায়, আমার স্বামী জামিলের শরীরে তীব্র জ্বরবোধ হলো। তেমন কঠিন কোনো লক্ষণ অবশ্য শুরুতে প্রকাশ পেল না। ঘরে টোটকা দাওয়াই চলল। তিনদিনের মাথায় শ্বাসকষ্ট শুরু হল। শ্বাসকষ্টের মাত্রা ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিল। হাসপাতালের সাহায্য পেলাম না। রাতের দিকে অবস্থা আরও বেগতিক হল। সময় বাড়ে অবস্থা অসহনীয় হয়ে উঠে। ওদিকে জ্বর কিছুটা কমলো, শ্বাসকষ্টের সাথে যোগ হল, নতুন আপদ- বুকের খাঁচা উছলে-ওঠা কাশি। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর দুয়ারে সে সাক্ষাত করছে।

একটা সময়ে হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ সম্ভব হলো। হাসপাতালের কথা শুনতে সবার মতো জামিলও খুব ভয় পেয়ে যায় এবং সহসা বসা অবস্থা থেকে ঘুরে পড়ে যায়। এবং সাথে সাথেই কার্ডিয়াক এটাক হয়। ততক্ষণে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স আমাদের ঘরের দোরে। জামিলের হাসপাতালে যাওয়া হয় না। জামিল চিরদিনের মতো চলে যায়। ওরা জামিলকে সাথে সাথে প্যাকেট করে জায়গা মতো নিয়ে চলে যায়। আমি মুহূর্তের মধ্যে ঘটে যাওয়া আমার জীবনের ভয়ঙ্কর ঘটনা স্থির চোখে তাকিয়ে দেখলাম। মিনিট পাঁচেক আগেও মানুষটা জীবিত ছিল, আমার সাথে কথা বলল, এখন সে একটা অবাঞ্ছিত প্যাকেট হয়ে চিরদিনের জন্য হাওয়া হয়ে গেল। মৃত্যু এতোটা সহজ বিষয় হয়ে গেছে আমাদের কাছে !

আমার ছোটমেয়েটা, জামিল চলে যাওয়ার ন’দিনের মাথায় একরাতের জ্বরে চলে গেল। ওর অবশ্য করোনা হয় নাই। সেরকম কোনো লক্ষণ ছিল না। তবে করোনা’র চেয়ে’ও ভয়ঙ্কর, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। যার কোন লক্ষণ থাকে না কিন্তু ভেতরটাকে ঘুণপোকা-খাওয়া বাঁশ-কাঠের মতো ঝাঁঝরা করে দেয়।

মেয়েরা স্বাভাবিকভাবে বাবা-আদুরে হয়। আমার ছোটো মেয়েটা তারচেয়ে একটু বেশিই ছিল। বাবার সাথে সারাক্ষণ আঠা-কাইয়ের মতো লেপটে থাকত। জামিল অসুস্থ হলে ওরা কাছে ঘেঁষতে পারেনি। মেয়েটা নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে সারাক্ষণ বাবার দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকত। চোখ বেঁয়ে দরদরিয়ে অশ্রু ঝরত। বাবা এভাবে চিরতরে হারিয়ে যাবে, সে তা মানতে পারেনি। এবং পরের কটাদিন অতিরিক্ত চুপচাপ হয়ে যায়। তারপর একদিন ভোরসকালে, সেও নাই হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। চারপাশে কতো লোক মরল। মরে মরে পরিবারগুলো ছাপা হয়ে গেল! আমি তার নগদ সাক্ষী হয়ে পড়ে রইলাম।

মৃত্যু বিষয়টা এখন আর আমার ওপর তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারে না, যেমনটা আগে ফেলত। এখন মৃত্যুর চেয়েও বেঁচে থাকাটা সহস্রগুন কঠিন মনে হয়। জামিল এবং আমার ছোট মেয়েটা চলে যাওয়ার পর আমি এবং আমার দু’মেয়ে সম্পূর্ণ অচেনা-অনভ্যস্ত একটা জীবনে হুট করে ঢুকে পড়লাম। একটা নির্জীব, অবসন্ন জীবনে।

কিন্তু আমরা আমাদের বিধ্বস্তজীবন নিয়ে কোথাও এমনকি সৃষ্টিকর্তার কাছেও কোনো অভিযোগ জানালাম না। যেন এমনটাই অবধারিত ছিল, যেমন করে দিনের শুরুতে সূর্য উঠে, বিকেল বেলায় অস্ত যায়- ঠিক তেমন অনিবার্য একটা বিষয় ! চতুর্দিকে মড়ার মিছিলের উপস্থিতি, আমাদের বোধের শেকড়কে চিরতরে উপড়ে দিয়ে গেছে। অনুভূতি খুইয়ে আমরা তিনটা যন্ত্রমানব, জ্যান্তমড়ার মতো দিব্যি জীবনের হাল টেনে চলেছি !

আপনজন, পরিচিতজনের ভাষায়- আমরা বেশ আছি। অনেকে অবশ্য আরও একপ্রস্ত এগিয়ে বলে, আমরা বেশ স্বাধীনভাবে চলছি। আমি ঠিক জানি না, পরাধীনের সংজ্ঞা কী! তবে এটুকু জানি, আমরা তিনটি প্রাণী কলের-লাঙ্গলের মতো বিস্তরজীবন মাঠে তরতর গতিতে ধেয়ে চলেছি অজানার দিকে। জামিল চলে যাওয়ার বছরখানেক পর আমি আগাগোড়া বাহিরের জগতের অচেনা-অজানা মধ্যবয়েসী একজন মানুষ, ঘর হতে খালি হাতে বেরিয়ে পড়ি।

গত দু’ বছর সময়ে আমি সকালের রৌদ্রের ঝিকিমিকি খেলা দেখিনি, বৈকালিক নিভে যাওয়া আদুরে আলোটাও নয়। খুব ভোরে দোকানের কপাট খুলি, সারাদিনের শেষে, বেশ খানিকটা রাত হলে তার ঝাঁপি টানি। একটা ভোর কিংবা বিকেল দেখবো বলে, শতবার উন্মুখ হয়ে আছি। জীবন নদীর নাওটা বুঝি শেষ খেয়াখাটে পৌঁছা অবধি আক্ষেপ আমার থেকেই যাবে।

পরবাসী আমাদের শুভার্থীর আকাল নেই। অহোরাত্র ডাকহরকরার ভূমিকায় নামা ফোনটার জিরোবার ফুসরত নেই একদণ্ড। নিজের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি, পাড়াপড়শি এমনকি গ্রামসম্পর্কের চাচা-মামারাও নিয়ম করে তাদের উপস্থিতি জানান দেয়। জামিলকে এদের সকলের চাহিদা মেটাতে নিজের এবং তার সংসারকে উপেক্ষা করতে বাধ্য করা হত। জামিলের ফেলে যাওয়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এখন আমাকে খুব কষ্ট করে ধরে রাখতে হয়েছে। রাতদিন খেটে নিজের সংসার সামলে তেমন কিছুই থাকে না। তারপরও আমি দিনরাত পরিশ্রম করে এদের চাহিদা মিটিয়ে যাই। কিন্তু দিন-কে-দিন এদের আবদার বাড়ে বহুগুনে।

ললাটের লিখন’ বলে হয়তো একটা কথা থেকে যায়। যত দোষ তা ওই সেই ললাটের! আমার উৎকণ্ঠাগুলো এখন তাদের ঘিরে, যারা অবিরত আমাকে তাদের সংসারের সংবাদে ব্যস্ত রাখে। আমি তাদের প্রায় ভেঙ্গেপড়া স্বপ্নগুলো জোড়া করে দিতে জীবনটাকে কলেরগাড়ির মতো সজোরে টেনে নিয়ে যাই। তাতে অবশ্য সবার চাহিদার জোগান ঠিকঠাক মতো হয়ে উঠে না। অভিযোগের পাহাড় জমে। আমি পাহাড়সম অভিযোগের উচ্চতা নামাতে পরিশ্রমের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিই।

এই আমার এককালে একটা হাসি-কান্নার উচ্ছ্বাসে ভরা নদীর মতো জীবন ছিল- এখন তা একরাতের স্বপ্নের মতো মনে হয়। এ-শহরে আমাদের সবই ছিল। দুনিয়ার বন্ধুস্বজনের সংস্পর্শে ব্যস্ত সময় বইয়ে যেত। অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেকেই আজ কেটে পড়েছে। ততদিনে অবশ্য আমিও একা বাঁচতে শিখে গেছি। তবে শুরুতে ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না যতোটা জলের মতো সহজ করে বললাম।

জামিল চাইত না আমি বাইরে কাজ করি। একটা সময় পর অগত্যা আমিও বন্ধ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।

জামিল চলে যাওয়ার পর আমার খুব মরে যেতে ইচ্ছে করত। নাহ, জামিলের শোকে নয়। সে সময়ে কোভিড-এর জীবাণু শরীরে ধারণের পর কেউ বেঁচে আছে সেটাই ছিল অস্বাভাবিক। জামিল চলে গেছে তাতে যতোটা না কষ্ট পেয়েছি তারচেয়ে সে চলে যাওয়ার পরের বেসামাল অবস্থায় নিজেদের ধরে রাখতে আরও বেশি কষ্ট পেয়েছি। দু’টো মেয়েসহ আমার সংসার চলে যাওয়ার মতো ব্যবস্থা এদেশের সরকারের করা আছে। এবং সে ব্যবস্থায় বেশ ভালোভাবেই চলে যাওয়া যায়।

কিন্তু স্বজনদের দায়িত্বের ভার আমাকে সরাসরি রাস্তায় নামিয়ে দিতে বাধ্য করেছে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, বহুআগের প্রজন্মের কারো অজানা পাপের ভার বোধহয় আমার কাঁধে এসে জেঁকে বসেছে। হাঁপিয়ে ওঠি। এ জীবন থেকে মুক্তি খুঁজি। কিন্তু ফাঁদেপড়া জীবনের দায়ভার থেকে বেরিয়ে আসার পথটা আমার জানা নেই।

মেয়েরা তরতর করে জংলা লতার মতো বেড়ে উঠছে। এ বয়সেই যন্ত্রের মতো চলতে শিখে গেছে। এদের কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই।

“বাবা ছাড়া পৃথিবীতে কোন চাহিদা থাকতে নেই” এমন অমোঘ সত্যটাকে কী চমৎকার করে এরা মেনে নিয়েছে। তাদের সাথে আমার দেখা হয়, রাতদুপুরে। আমি বাড়ি ফিরতে, ততক্ষণে তারা সারাদিনের ক্লান্তি ঝাড়তে ঘুমে চলে যায়। ঘুমন্ত মেয়েদুটোর মুখ দেখে নিজেও নির্ঘুমরাত কাটাতে বালিশে মুখ গুঁজি। কোভিডের জীবাণু শরীর থেকে সমস্ত শক্তি জোঁকের মতো শুষে নিয়ে তবেই ছেড়েছে। পরিণামে দিয়ে গেছে গা ভর্তি একগাদা রোগবালাই। পয়ত্রিশে পা দেওয়া আমার শরীর বুড়িয়ে গেছে সত্তরের জড়োথরো বয়স্কার দেহের মতো করে। শরীর-মনে বল নাই। প্রতিবেলায় একমুঠো করে ওষুধ খাই।

মাঝেমধ্যে মনে হয় আমার এ-জীবনটা থেকে ছুটি নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে কোনো অভিযোগ-চাহিদা আমাকে প্রতিনিয়ত হালের গরুর মতো ছুটে যেতে বাধ্য করবে না, কিন্তু সব-চাওয়া কী পাওয়া হয় !

জাকিয়া শিমু। পেশায় শিক্ষক। লিখছেন দীর্ঘদিন ধরেই। বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলা, যাকে বিক্রমপুরও বলা হয় সেখানে জন্ম তার। এখন আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ