প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
বাংলা পঞ্জিতে বৈশাখ ছুঁই ছুঁই করছে। কালীগঞ্জ বাজারের আজ হাটবার। বৈশাখ সামনে রেখে নানা আয়োজন আজকের হাটবারে৷ এই মহকুমার ছোট বাজারে কেউ কখনও ইলিশ মাছ তোলার সাহস করে দেখেনি। ইলিশের মৌসুমে অপেক্ষাকৃত বিত্তবানরা পেয়াদা পাঠিয়ে পদ্মাপাড় থেকে ইলিশ মাছের যোগাড়যন্ত্র করতেন। সেই ইলিশ রান্না হলে কালীগঞ্জের উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমের আরও তিন বাড়ির মানুষের নাকেও সেই গন্ধ যেতো৷ ইলিশের একটা পেটির টানে অনেকের প্রাণ বেচঈন হয়ে উঠতো। আজ সেই ইলিশই কিনা বিক্রি হচ্ছে স্বয়ং কালীগঞ্জের হাটে। পদ্মাপাড়ের দুজন ব্যাপারী এসে বসেছেন হাটে। সাথে নিয়ে এসেছেন বরফে চাপা দেয়া চার খাঁচা করে ইলিশ। ফি সপ্তাহের হাটবারেই ইদানীং তাদের দেখা যাচ্ছে। এলাকার সামর্থ্যবান-অসামর্থ্যবান সকলেই একবার হলেও সেই ইলিশ মাছ বিক্রেতাদের কাছে যায়। পাড়ার মধ্যবয়সী বউরা মুখের সামনে আঁচল টেনে তাদের বলে, “কিয়ো ব্যাপারী? ইলিশ মাছ দেখি কয়েকগা।” অন্যদের উপর খিটখিটে মেজাজ দেখালেও এই ক্ষেত্রে ব্যাপারীরা সদ্যপ্রস্তুত মোমের মতোই গলে যায়৷ খাঁচার মুখ তুলে সাদা ঘন মেঘের মতো গুঁড়ো আর দানাদার বরফের আস্তরণে চাপা পড়া ইলিশ মাছগুলোর হাঁ করে থাকা মুখ দেখায়। মনমেজাজ ভালো থাকলে কখনও কখনও হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগও দেয়। ওরা ইলিশ মাছ কিনবে না এমনটা জেনেই ব্যাপারীরা এই সুযোগ দেয়। কি করবে? বৈশাখ মাস পঞ্জিতে গড়ানোর আগেই তারা বেড়িয়ে পড়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে। বিকি বেশি হলে মাঝে মাঝে বার কয়েক নিজেদের পাড়ায় যেতে হয় বৈকি। কিন্তু তা শুধুই যাওয়ার জন্য যাওয়া। মায়ের মুখ দেখা হয় না, বউয়ের চিবুকের নিচের তিলে চুমু খাওয়া হয় না। খাঁচা ভরা ইলিশ নিয়ে আবার বেড়িয়ে পড়তে হয়। ওরা দক্ষিণে ছোটে, উত্তরে ছোটে। সময় পেলে পূর্ব পশ্চিমেও। ছুটতে ওদের ক্লান্তি নেই। ওদের ক্লান্তি মাঝরাতের হিসাবের খাতায় বাড়ির উঠানটার অভাব। ওদের ক্লান্তি মোলায়েম বিছানায় অর্ধাঙ্গিনীর বুকের ওপর এলোমেলো ভঙ্গিতে বিনুনি চালাতে না পারার আক্ষেপ। বরফের ভাজে ভাজে ইলিশের রুপালি চামড়ার ঝিলিক মাঝে মাঝে তাদেরও চোখ রাঙায়।
– কিগো ব্যাপারী? ইলিশ আইনছো নাকি? দেখি চাই?
নরু ব্যাপারীর আজ মনটা খুব বেশি আনচান করছে বাড়ির জন্য৷ রাতের স্বপ্নে পরলোকবাসী বাবাকে দেখেছে আবার। বাবা মারা যাওয়ার পর প্রায়ই স্বপ্নে আসেন বাবা। যেদিনই আসেন, সেদিনই নরুর দুনিয়াটা যেন উলটপালট হয়ে যায়৷ কি যেন একটার শূন্যতা কাজ করে ওর মাঝে।
– কিয়ো ব্যাপারী? আছেনি?
– হ আছে।
– তো দেখাও৷
নরু ব্যাপারী খাঁচার ওপরের ঢাকনা তুলে বিরস মুখে ইলিশ মাছ দেখায়। আবারও সেই লাল পেটিওয়ালা রুপালি রাণীটা। মুখ হাঁ করে শুয়ে আছে। নরু ব্যাপারীর তার সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটার ভাবসাব খুব বেশি সুবিধার দেখে না । কেমন যেন একটা উসখুস ভাব। স্বভাবজাত নারীসুলভ আচরণ তার মাঝে নেই। যেন জোর করে নারী হওয়ার প্রচেষ্টা। মাথার ওপর উঁচু করে খোঁপা করা চুল। কপালে ইয়া বড় একটা টিপ। নাকে অপেক্ষাকৃত কম মানানসই নোলক। কানের ওপর পরতে পরতে রঙ জ্বলে যাওয়া সোনালি রঙের গহনা। ঠোঁটে কাচা আলতার মতো লেপে দেওয়া গাড় লাল রঙ৷ শাড়ির বুনন ঔদ্ধত্যপূর্ণ। কোমরের ভাজ গলে বেশ খানিকটা মেদহীন ঝলমলে রুপোলী পেট দেখা যাচ্ছে। যেন হাঁ করে ওঠা কোনো এক ইলিশ মাছের পিঠ। মোম গলিয়ে তৈরি সেই পেটের মাঝে একটা সুগভীর কুয়া খুব সন্তর্পণে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কত মাঝি না জানি সেই কুয়ায় নাও ডুবিয়েছে। গভীর সেই নাভিটা যেন পুরুষের দীর্ঘশ্বাস।
– কিয়ো ব্যাপারী, লইবা নাকি দিবা?
হঠাৎ প্রশ্নে যেন থতমত খেয়ে যায় নরু। নিজেকে সামলে নিয়ে সেও পালটা প্রশ্ন ছোড়ে-নিবো না দিবো মানে? কি বুঝাইবার চাও স্পষ্ট কইরা কও।
– আহা! চ্যাতো কেন? এত শক্ত সোমত্ত রইছো, থুতনির নিচে খোঁচা খোঁচা দাড়িতেও পাক ধরছে। এখনও ঠিক কথা বুঝবার পাও না?
নরু দেখে মেয়েটার হাতে একটা বড় ইলিশ ঝোলানো। ইলিশের মুখটা হাঁ করে আছে। কোটর থেকে বের হয়ে পড়তে চাওয়া ওর বড় বড় চোখ দুটো যেন নরুর দিকেই তাকিয়ে আছে। তবে ইলিশের কোটরাগত চোখের দিকে না তাকিয়ে নরু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে। বয়স কত হবে? ওর প্রথম যৌবনের প্রেমিকা আশাপূর্ণার থেকে বয়সে ছোট হওয়ার কথা নয়, বরং বয়সে বড়ই হওয়ার কথা। হয়তো সতেরো বা আঠারো। কিন্তু ওর শরীর থেকে যেন হুরপরীদের সুভাস বের হচ্ছে যা এখন থেকে বছর পাঁচেক আগের ষোড়শী আশার দেহ থেকেও বের হতো না। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত কিশোরীর ঔজ্জ্বল্যে ঝলমল করছে ওর ঠোঁট, চিবুক, গাল আরও কত কী!
– ট্যাকাডা দেও, ইলিশ তো দিমুই।
নরুর দিকে একটা খেয়ালি উড়নচণ্ডী দৃষ্টিতে তাকায় মেয়েটি। হাতের টাকাটা পাকিয়ে বুকের কাছে শাড়ির ভাজে জন্ম নেয়া কাপড়ের কয়েকটা পরতের মাঝে দিয়ে বুকের ভাজে পুরে তারপর কেমন যেন একটা ইঙ্গিত করে নরুর দিকে।
– এইখান থাইকা নিবার পারবা ব্যাপারী? দেখো চাই নিবার পারোনি। পারলে নিয়া নেও।
নরুর ঘোরমতো লাগে। সজোরে ঘাড় নেড়ে না করে-না না, থাক। আমার পয়সা লাগবো না। তুমি যাও।
– আইজ নাহয় টেকা নাই নীলা বেপারী। তয় সমস্যা নাই, এই ইলিশের টেকাডা অন্য একদিন পুষায়া দিমুনে।
নিজের জামার বোতাম লাগাতে লাগাতে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় নরু। উঠে দাঁড়াতেই ওর কাঁধ থেকে ইন্দুর আঁচলের শেষ মাথাটা খসে পড়ে নিতান্ত কর্কশ ভঙ্গিতে৷ লুঙ্গির গিঁট শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে একবার ইন্দুর মুখটার দিকে তাকায়। প্রথম যেদিন ওকে হাটে দেখেছিলো সেদিনের মতো করে নয়। অন্যরকমভাবে তাকায় আজ ইন্দুর দিকে। ওর মনে যেন ইউসুফ জোলেখার জন্মদাতার বাতাস লেগেছে। ও যেন একজন অন্যরকম কৃষ্ণ, পুনর্জন্ম নিয়েছে এই পবিত্র বাংলায়। কাজেই ওর চরিত্রে আর কামভাব খেলা করা উচিত নয়। ওর চরিত্রে কাজ করছে ভালোবাসা। নিখাদ সোনার মতো নিখাদ ভালোবাসা। নিখাদ সোনা যেমন অল্প চাপে গলে যায়, সেও তেমনি গলে যাচ্ছে। নরুর বাড়িঘর নেই৷ প্রতি বৈশাখে ও মাছ ফেরি করে বেড়ায়। নরুর দেহঘড়ি আজ প্রায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই করছে। ও জন্মেছিলো দামোদর নদের তীরে। রহমান ডাকাতের তাড়া খেয়ে নিজ জন্মভিটা আর পৈত্রিক সম্পত্তি ছেড়ে বৃদ্ধ পিতাকে নিয়ে ছুটে এসেছিলো কলকাতা শহরে। সেখানকার হিসাব আত্মস্থ করার পর ওর বোধ হয়েছিলো ও একটা মরার দেশে জন্মেছে৷ যে দেশ কেবল ধর্মের মোড়ক মানে, ধর্মের সিল চেনে। চেনে না মানবতার স্বরূপ। সে দেশ মানবতা মানে না, সে মাটিতে মানবতা ও মানুষের দাম নেই-কেবল ছুটে চলার তাড়না। ওর মাঝে মাঝে মনে হয় ও জন্মেছিলো একটা পোড়া মানচিত্রে-যে মানচিত্রের বুকে গঙ্গা আর পদ্মার ঢেউ মিলেমিশে আছড়ে পড়লেও তাদের প্রশস্ত বুক চিড়ে গড়ে ওঠা বসতিগুলো সংকীর্ণ এক মানসিকতার ধারণ করতো। বাবা মারা যাবার পর বারো বছর বয়সে ও এসেছিলো যশোর। সেখান থেকে চাঁদপুর, কয়েকদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর কয়েকদিন ঢাকা। তারপরের কয়েকদিন মাগুরা, শরীয়তপুর। ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, মোহনগঞ্জ, মদন আর ইসলামপুর। এই বাংলার প্রায় সব জায়গার মাটির গন্ধ শুঁকে দেখেছে নরু। নাহ, কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য নেই পশ্চিম বাংলার মাটির সাথে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের মাটির। কিন্তু পার্থক্য কেবল এই মাটিতে ধপধপিয়ে ছুটে চলা মানবসন্তানদের৷ এদের বুকে জড়িয়ে রাখা ধর্মগ্রন্থগুলো অন্তরচক্ষু দিয়ে কখনও এরা পড়ে দেখেনি সৃষ্টিকর্তার বাণী। চর্মচক্ষু দিয়ে পড়ে দেখেছে বহুবার। কিন্তু আরবি, ফারসি, ইংরেজি বা অচেনা অজানা দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা সেই গ্রন্থগুলোর মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারেনি বেশিরভাগ বিশ্বাসীই। মক্তব আর বিদ্যামন্দির হেঁটে পায়ের নিচে এঁকেছে যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের মানচিত্র৷ কিন্তু শুনতে পায়নি সৃষ্টিকর্তার বাণী-ওরা সবাই আমার সৃষ্টি। এদের চোখে ধর্মের অন্ধকার ছানি-তাই এরা সূর্যের আলো দেখে ভয় পায়, চাঁদের আলোকে ভালোবাসে। জানে না সূর্য চাঁদের আলোয় আলোকিত-কোনো আলাদা পরিচয় চাঁদের নেই।
– কিয়ো ব্যাপারী, কি খেয়াল করো?
কাঁধের গামছাটা নামিয়ে নিজের মুখ আর কপালের ওপর জমে ওঠা ঘাম মোছে নরু। আসলেই তো! ও কী ভাবে? কী ভাবায় ওকে ওর মস্তিষ্ক? দশ পনেরো আঙ্গুল মাপের ওর ছোট্ট মাথায় কী খেলা করছে? ওর মনের ভেতরই বা কি চলে? নরুদের আদি বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যেতো দামোদর নদ। ছেলেবেলাটা সেই নদের পানিতে দাপাদাপি করেই কেটেছে নরুর। পানির ভেতর চোখ মেলে তাকাতে গেলে চোখ জ্বালা করতো। দম খিঁচে বেশিক্ষণ থাকতে পারতো না পানির নিচে। ভুস শব্দ করে ভেসে উঠে লম্বা কয়েকটা দম নিতো। সেই একইরকমভাবে আজও কয়েকটা দম নেয় নরু। তারপর ফিরে তাকায় ইন্দুর দিকে।
– আমারে একখান কথা জিগাইবার দিবা ইন্দু?
মুখে পান গুঁজতে গুঁজতে ইন্দু একবার তাকায় নরুর দিকে। লোকটার ভাবগতিক বুঝে উঠতে পারে না।
– কি কবেন? কয়া ফালান।
নরু একবার ভাবে কি বলতে যাচ্ছে সেটা নিয়ে। ওর মুখ কাঁপে, ওর ঠোঁট কাঁপে। মুখের ভেতর দাঁত দাঁতের সাথে ঘষে আসে, ঠকঠক শব্দ হয়। জিহ্বায় যেন চৈত্রের খরা। মুখের ভেতরটা ফেটে চৌচির হয়ে যায়। চেহারার চামড়া কুঁচকে আসতে থাকে।
– আমার লগে লইবা ইন্দু? চলো নাও ভাসাইয়া দেই। তুমি আর আমি।
এক মুহূর্ত অবাক চোখে তাকায় ইন্দু। নরুর কথার অর্থ তার অবচেতন মন ধরতে পেরেছে। কিন্তু ওর সচেতন মনে সেই অর্থ এসে পৌঁছায় কি? কী যেন একটা ভাবে ইন্দু। ওর চোখের ভেতর বৈশাখী বান আসে। যেন আস্ত একটা চন্দ্র পুকুর। সেই পুকুরের প্রতিটি জলকণায় যুদ্ধ ঘোষিত হয়। একে ওপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আলোড়ন তুলতে তুলতে ঘাটে এসে আছড়ে পড়ে। তবে একসময় সেই পুকুর শান্ত হয়। যেন একটা জমে যাওয়া অন্তঃসলিলা নদী। যার স্রোত নেই, যার কোনো শব্দ নেই। প্রচণ্ড কালবৈশাখীর দিনেও সেই নদীতে একখানা স্রোত ওঠা সম্ভব নয়-এমন একটি নদী। নিজের চোখ মুছে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ফেরার চেষ্টা করে ইন্দু। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে-“কি কন ব্যাপারী? দিলে কি হাওয়া বইলো নাকি? আইসেন, বিবাহ করায় দেই। আমার সুন্দরী সখী আছে কিছু। চিন্তা কইরেন না। বেশ্যাপল্লীর সখী না, আমার দেশের সখী। অনেকদিন হয় দেশ ছাড়লাম, তাগোর খবর জানি না। তয় শাদী হয় নাই তাগোর এখনও-এইটুকুন জানি।” এইটুকু বলে একবার তাকায় ব্যাপারীর দিকে। ব্যাপারীর ভাব শূন্য মুখটার দিকে তাকিয়ে কি বলবে তা যেন গুলিয়ে ফেলে বারবার। উপরের ঠোঁটটা জিহ্বা দিয়ে একটু ভিজিয়ে নিয়ে আবার বলে- “কিয়ো ব্যাপারী? কথা কানে যায় না? মনে কি বান উঠছে আবার? আমি কিন্তুক আর পারুম না, শইলডা মিইয়া আসতেছে। এখন ঘুম যামু। আপনেও ঘুম যান৷ এমনে ড্যাবড্যাবায়া চায়া থাকলে কিরাম করে ঘুমামু?” নরু জবাব দেয় না। ইন্দুর দিকে পেছন দিয়ে ও বিছানায় শোয়৷ পুরনো চৌকিটার হাড্ডিসার দেহের কচকচ আওয়াজ শুনে বোঝে, ইন্দুও শুয়েছে। ওর দিকে পেছন দিয়ে।
চুলোয় ভাত বসিয়ে দিয়ে ইন্দু আবার বিছানায় শোয়। একবার ঘুমন্ত নরুর মুখের দিকে তাকায়। ওর মুখের মধ্যে কেমন যেন একটা হাসি হাসি ভাব খেলা করে সারাদিন। সদ্য হাঁটতে শেখা সন্তানের স্বভাবজাত দুষ্টুমি দেখে সহৃদয় বাবারা যেরকম হাসেন ওরকম একটা হাসি। দীর্ঘদিন ধরে এই নরু ব্যাপারীকে চেনে ইন্দু। বছর কয়েক যাবত প্রতি বৈশাখে ওদের দেখা হয়। বৈশাখ মাস ঘনালেই আকাশের দিকে দিকে সাজ পড়ে যায়। আর সাজ পড়ে ইন্দুর মনে। একটা সময় ইন্দুরও স্বপ্ন ছিলো, ওরও সংসার হবে। ঘরকন্না হবে। মোটামুটি শান্ত একজন বর পাবে সে। সেটা যদি পশ্চিমপাড়ার রনি ভাইয়ের মতো হয় তাহলেও সমস্যা নেই। যে ইন্দুর কথায় বসবে, ইন্দুর কথায় উঠবে। ওর দিকে খুব নজর রাখবে-একটা কথারও নড়চড় করবে না। হয়তো একেই ভালোবাসা বলে। কিন্তু সেই সময়টাতে ভালোবাসা শব্দটা ওর জীবনের অভিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ভালোবাসা মনে আর মনের মাঝে হয় এমনটা বোঝার আগেই ও অন্যরকম ‘ভালোবাসা’র জোরপূর্বক অভিজ্ঞতা পেয়েছিলো। হয়তো সেটা ভালোবাসা ছিলো না, কাম ছিলো। পুরুষের প্রকৃত ভালোবাসায় কাম থাকে না। থাকে সঙ্গিনীকে আরও আপন করে পাওয়ার উন্মাদনা। সেটাকেও যারা কামের খাতায় ফেলেন তারা গণ্ডমূর্খ ছাড়া কিছু নয়। ইন্দু তখন দুকলম পড়াশোনা শিখেছে। প্রতিদিন ফোলানো বেণী দুলিয়ে দুলিয়ে রামু পণ্ডিতের পাঠশালায় যেতো। উঠানের কোণায় পোঁতা শিরিষগাছটার গা ঘেঁষে ওঠা পাঠশালার মাটিতে বিছানো চটে হাঁটু মুড়ে বসে শিখতো অ, আ, ক, খ। জোরে জোরে সুর করে করে পড়তো অ তে অজগর ঐ আসছে তেড়ে। না, অজগর আসেনি। একদিন রামু পণ্ডিত তার পাণ্ডিত্য দেখালেন। ইন্দু অবশ্য সেদিন বুঝতে পারেনি ঠিক কি ঘটছিলো তার সাথে। শুধু রামু পণ্ডিতের হাত দুটোর ওর শরীরের ওপর দিয়ে ইতস্তত ছোটাছুটির অনুভব করছিলো। ওর কপালের দুপাশের শিরাগুলোয় যেন ঘৃণায় মেশানো রক্তের স্রোত বইছিলো। শিরদাঁড়ার ওপর দিয়ে একটা হিমশীতল বরফখণ্ডের অস্তিত্ব বা উপস্থিতি অনুভব করতে পারছিলো সে। খানিক বাদে শাড়ির ভাঁজ খুলে ওকে শুইয়ে দিয়ে রামু পণ্ডিত যখন ধুতির গাছা খুলছিলেন ঠিক তখনই কয়েকজন লোকের হাঁকডাক শোনা গিয়েছিলো৷ লজ্জায় বা ভয়ে মুখ ঢেকে ফেলা ইন্দু পড়ে রয়েছিলো উলঙ্গ দেহে, রামু পণ্ডিত নিজের ধুতির গাছা শক্ত করে বেঁধে কেটে পড়েছিলেন দ্রুতই৷ আর সহ্য করতে পারেনি সেদিন ইন্দু। মূর্ছা গিয়ে দাঁতে দাঁত কেটে পড়ে রয়েছিলো রামু পণ্ডিতের পাঠশালায় বিছানো চটের বড় পাটিটার ওপর। জ্ঞান ফিরলে ওর আশেপাশের পরিচিত মুখগুলোকে দেখেও সেদিন তাদের অপরিচিত ঠেকেছিলো ইন্দুর কাছে। ওর সৎমা মুখ ঝামটিয়ে ওর বাবাকে বলছিলেন-“মাগিরে ভাতার আইনা দে। মাগির বড়ই জ্বালা। এই বয়সে মেলায়া দিয়া শুয়া পড়ে, আর বয়সে না জানি কি করবো। দুগ্গা দুগ্গা দুগ্গা! আর কী দেখাবে মা? এই মেয়েটা তো একদিন আমগোরে খায়া ছাড়বো। এরে তুমি তুইলা নাও।” উত্তরে ওর বাবা কিছু বলেননি। উঠানের পাশে বোনা শিমুলগাছ থেকে একটা ডাল ভেঙ্গে এনে বাড়িতে ঢুকেছিলেন। জামার হাতা গুটিয়ে একবার তাকিয়েছিলেন বৌ এর দিকে, একবার ঝিয়ের দিকে। সেদিনের পর থেকে ইন্দু যেন হঠাৎই খুব বড় হয়ে গিয়েছিলো। ওদের বাড়িতে আশ্রিত দূরসম্পর্কের মামা রমেশ একদিন ওকে বলেছিলো, “শহর যাবি? শহরে অনেক কাম ধান্ধা৷ জীবনটা নিজের মতো কইরা নিবার পারবি৷” ব্যাস, পোটলাটা গুছিয়ে রমেশের সাথে বের হয়ে পড়েছিলো ইন্দু৷ ইটনা বাজারে এসে একটা চায়ের দোকানে ঢুকে কার সাথে কি যেন কথা বলে মোটা একটা টাকার গোছা নিয়ে রমেশকে চলে যেতে দেখেছিলো ইন্দু। যাবার আগে ইন্দুকে যে লোকটার সাথে পরিচয় করে দিয়েছিলো রমেশ, সেই লোকটাই ওর চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে ভরা বাজার দিয়ে ওকে নিয়ে এসেছিলো। হয়তো বেশ্যাপল্লীর পরিবেশে মেয়েদের মানসিক অভিযোজনমূলক সমন্বিত কর্মকাণ্ডের প্রক্রিয়ার এটিও একটি অংশ। সেদিন ইন্দুর মনে হয়েছিলো, এইই ছিলো তার কপালে। নিজ গ্রামেও এর চেয়ে বেশি সুখের আশা ছিলো না ওর। গ্রামে রটে গিয়েছিলো মেয়েটির অপূর্ব মায়া শক্তি আছে। সে শক্তিতে বশীভূত হয়েই রামু পণ্ডিতের একজন ব্যক্তি ঘোরগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। ভুক্তভোগী নিজেই যখন সাক্ষী, তখন কী আর সেই কথা অস্বীকার করার উপায় থাকে? কাজেই সে কথা মেনেই নিতে হয়েছিলো সমাজের সকল মানুষরূপী জীবদের। ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের খড়গহস্ত নেমে এসেছিলো নমঃশূদ্র ইন্দুদের পরিবারে। ছোট ঘরে সুন্দরী মেয়ে হলে জন্মালে এমনই দশা হয়-এমনটা যদিও ইন্দুর সৎমার একান্ত নিজস্ব মতবাদ ছিলো তবু আস্তে আস্তে দেখা গেলো সবাই সেটাতে সহাবস্থান জানাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। এমনকি তার ঠাকুরমাও। কাজেই পতিতালয়ের দিনগুলো খুব বেশি লোমহর্ষক হয়ে উঠেনি ওর কাছে। গঞ্জের ব্যস্ত কোলাহলে ওদের মতো নগণ্য আত্মাবাহী দেহের ক্ষীণ আর্তনাদ সৃষ্টির পরই হারিয়ে যায়। কারোর কানে যায় না। ইন্দুর আর্তনাদও কারোর কানে যায়নি।
– তা ব্যাপারী, তুমি এই বাজাইরা মেয়েরে বিয়া করবার চাও কেন?
নরু ব্যাপারী এতক্ষণ মাথা নিচু করে তাকিয়ে ছিলো। সমবেত সভার দিকে মুখ তুলে তাকাতে ওর কেমন যেন একটা জড়তা কাজ করছিলো। সেটাকে কোনোভাবেই লজ্জার কাতারে ফেলা যায় না। জড়তার কারণটা অবশ্য নরুর অজানা।
– কিয়ো মিয়া? এম্নে চায়া আছো কেন? কি কারণে বিয়া করবার চাও ওরে?
নরু কি বলবে গুছিয়ে তুলতে পারে না। গত চার বৈশাখে ও এই বাজারে ইলিশ মাছ বিক্রি করেছে। কালীগঞ্জের বাজারে রুই, কাতল, মাগুর বা রাণী মাছের চাহিদা সারাবছর যেমনই থাকুক না কেন, ইলিশ মাছের গন্ধ পেলেই সবাই ওসব ভুলে যেতো। পুরো ইলিশটা কিনতে না পারলেও তিন চারজনে মিলে সমান টাকার ভাগ কিনে নিতো। সারা বছর যেভাবেই কাটুক, বৈশাখ জুড়ে ইলিশ খাওয়া চাই। রুপালি এই মাছের শরীরের মাদকীয় ঘ্রাণে নিজেদের বাড়ির আঙিনা ম ম করবে। সেই ঘ্রাণে আরও তিনবাড়ির কর্ত্রী নিজেদের স্বামীর কাছে বায়না তুলবে- “আনো না একগা ইলিশ, সইষ্যা দিয়া রান্ধি৷ পুলাউড়িগুলাইনরে দেই। ওগোরও তো খাইবার মন চায় নাকি?” তবেই না সার্থকতা! নরুর ওপর বাজারের অন্য জালুয়ারা ক্ষেপে ছিলো। থাকবেই তো। ওদেরই বা দোষ কোথায়৷ সারা রাত উন্মত্ত কামুক নদীর বুকে কাটিয়ে ধরা মাছগুলো নিয়ে সারাদিন বসে থেকেও যদি তার অর্ধেকেরও কোনো গতি না করা যায়, তবে কী আর পোষায়? ওদেরও তো ঘরকন্না আছে, সংসার আছে। দিনশেষে ওদেরও তো লুঙ্গির কাছায় চাল, ডাল বেঁধে বাড়ি ফিরতে হয়। বাজারে এসে যদি সবাই ইলিশের গন্ধেই সম্মোহিত হয়ে থাকে, তবে কি আর রুই-মাগুরের গতি হয়? কাজেই আজকের দরবারে বাজারের জালুয়ারাও তার বিরুদ্ধে এককাট্টা। বৈশাখে কালীগঞ্জ আসলে নরু ব্যাপারী বাজারে ইন্দুর ঘরেই রাত কাটায়-এমনটাও তাদেরই ছড়ানো। ফি বছর বৈশাখে নরুর প্রতি হাটবারে তিন-চার খাঁচা মাছ নিয়ে চলে আসা হয়তো ওদের আর সহ্য হয় না। এর একটা বিহিত যদি এই সমস্যার সমাধানে পাওয়া যায়, তবে ফাঁকা মাঠে গড়াগড়ির কীই বা দরকার?
– কিগো মিয়া, কইলা না? শাদি করবার চাও কেন তুমি ইন্দুবালারে? ওই মাগি কি জাদু করছে তোমারে?
পরিষ্কার চোখে দেখতে পায় নরু আগামী কয়েক ঘণ্টার ছক। পহেলা বৈশাখের আয়োজনে সকলেই যখন ব্যস্ত থাকবে তখন রহমান, আরমান আর মহসিন জালুয়ারা যাবে ওর বাজারের পাশের ঘরটায়। গিয়ে হয়তো আগুন জ্বালিয়ে দেবে। তার আগে কিছু লুটপাট করার চেষ্টা করবে। তারপর ছুটবে ইন্দুবালার ঘরে। ওকে হয়তো মেরেই ফেলবে। বা আশু ব্যাপারীর গুদামঘরে নিয়ে বেঁধে রাখবে যতদিন নরু না যায়। এদের চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওরা চায়না ইন্দুবালা ওর বাজারের ঘরটা ছেড়ে অন্য কারোর ঘরের ঘরণী হোক। ভদ্রবেশী মধ্যবিত্ত সমাজের আর কীই বা বিনোদনের সুযোগ? বাজারে একঘর পতিতা থাকলে অনেক ব্রাহ্মণ মুমিন ভদ্রলোকই একবার অন্তত চেখে দেখার সুযোগ পান। আর সে যদি হয় ইন্দুবালার মতো অপ্সরা, তবে তো কথাই নেয়। সবাই ওর মোমের গড়া নধর দেহটাকে নিজের আগুনে গলানোর স্বপ্নে বিভোর। এই বাজারের সবাইই ওর বাঁকা কোমরের ভাজে কোনো না কোনোদিন মুখ ডুবিয়েছে। না ডোবালেও ডোবানোর স্বপ্ন দেখে। বৈশাখ মাসের শেষে নরুর নায়ে যদি ইন্দু তার জীবন সঁপে দেয়, তবে এই আয়েশের কী গতিক হবে? বিচার যিনি চালাচ্ছেন সেই কাজী সাহেবের থুতনির নিচে এক মুষ্টি পরিমাণের চেয়েও বেশি দাড়ি। কথা বলার সময় সেই দাড়ি বাতাসে যেন দাড়িয়াবান্ধা খেলে। সেই ভদ্রলোকের শান্ত চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে সেখানেও একটা কামের চাকচিক্য দেখেছে নরু। যেন সেও এই নশ্বর দেহটার থেকে রুহের উড়াল দেবার আগেই অপ্সরা রূপ ইন্দুর দেহের প্রতিটি বাঁকের হিসাব কষতে চায়। সারাজীবন দরবারে দরবারে ঘুরে মানুষের ইনসাফ দিয়েছে সে। আজ নিজের ইনসাফের বন্দোবস্ত করতেই যেন বিচারকরূপে হাজির হওয়া এই দরবারে। নরুর ঘোলা চোখের সহজ চাহনিতে সবার বক্র চরিত্রেরই নিজস্বী আঁকা হয় যেন৷ নরু মাথা নিচু করে ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে আপন হিসাব কষে। পূর্বপাড়ার কেরায়া নায়ের মাঝি কামালের সাথে কথা বলতে হবে। নরুর নৌকাটা উত্তরদিকের ঘাটে বাঁধা আছে। মঈনপুরের ঘাটে বাঁধা থাকে কামালের নৌকা। আজ সন্ধ্যা গড়াতেই সে কেটে পড়বে এই শহর থেকে। বাজারের ঘরটা থেকে ইলিশের খাঁচা গুলো আনা যাবে না। ইন্দুকে নিয়ে এই শহর ছেড়ে অষ্টগ্রাম বাজার থেকেই নাহয় আরও গোটা চারেক নতুন খাঁচা কেনা হবে। তাতে খোয়ানোর কিছু নেই। জীবনঘড়ির একটামাত্র কাঁটা আজ পঁয়তাল্লিশ পার করতে যাচ্ছে। এই জীবনে অনেক কিছুই খুইয়েছে নরু। তবে এই বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন করে আর কিছু খোয়াতে চায় না সে। আচ্ছা, ইন্দু কি রাজি হবে? সহসাই ঘাড় নেড়ে আপন মনেই মুচকি হাসে নরু। সে জানে উত্তরটা৷
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..