ফিরে এসো
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
আমরা বলি মুক্তিযুদ্ধ আর আমাদের গ্রামের বয়স্ক, মুরুব্বিরা বলে সংগ্রাম। তাদের কাছে ১৯৭১ হল সংগ্রামের বছর। এই সংগ্রাম কথাটার ভেতর আলাদা একটা দ্যেতনা আছে, অন্যরকম রক্ত গরম করে দেয়া তেজ আছে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এরকম দুইজন মানুষ সড়কের মোড়ে ফরিদের চায়ের দোকানে বসে আছে। তাদের একজন আব্বাস আলি, শুনই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা। আরেকজন তার প্রতিবেশী, সহযোদ্ধা মালেক ফকির।
পৌষের সকাল। শীতের মিষ্টি রোদ খোলা সড়কের দুই পাশে খেলা করছে। শুনই গ্রামটা এখন আর গ্রাম নেই। গ্রামের গতরে চিকনাই বেড়েছে, কেমন যেন শহুরে শহুরে ভাব এসেছে। সাপের মত আঁকাবাঁকা কাদামাটির সড়ক পিচ ঢালাই হয়েছে, ঘরে ঘরে পল্লীবিদ্যুৎ এসেছে। আর শহরের বখে যাওয়া পোলাপানদের সাথে তাল মিলিয়ে গ্রামের উঠতি পোলাপানরা লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি-সিগারেট আর গাঁজা খায়। ফরিদ দোকান খোলার কিছুক্ষণ পরেই দুইটা ছোকরা, যাদের মুখের দাড়ি-গোঁফ হাতে গোনা যাবে, উদ্ধত ভঙ্গিতে দোকানে এসে পাঁচটা স্টার ফিল্টার সিগারেট চেয়ে নিল। এগুলোর দাম যে দিবে না তা এদের চাওয়া আর নেওয়ার ভঙ্গিতেই স্পষ্ট ছিল। আব্বাস আলি পাশে বসা মালেক ফকিরকে উদ্দেশ্য করে বললো, কী দিন আইলোরে গাঁও গেরামে! আট্টুয়া-গাট্টুয়া আবুদুবাইন বিড়ি-ছুরোট খাওনের বেলায় ময়-মুরুব্বি মানে না। মালেক ফকির কিছুটা ঝিমুনিতে ছিল। চোখ বন্ধ রেখেই উত্তর দিল, হুম, পুটকির তো ফুলডা পড়ছে না অহনো কিন্তু কত ভাব শইল্যে। স্বাধীন দেশের নাগরিক তারা। কওনের কিছু নাই। এই বলে সে খানিক হেসে নিল নিজের লম্বা ছায়াটার দিকে তাকিয়ে।
ফরিদ তাদের কথায় মুচকি হেসে বললো, গুড়ের চা খাইবাইন আফনেরা? আব্বাস আলি মাথা নেড়ে বললো, দে বাজান, দুই কাপ দে। সাথে কিন্তু টেহা নাই। ফরিদ দুইটা কাপ হাল্কা গরম পানিতে ধুয়ে চুলার ভেতর একটা শুকনো খড়ি ঢুকিয়ে দেয়। তারপর দুজনকেই অভয় দেয়- আফনেরার লাইজ্ঞিয়া ফ্রি, টেহা লাগদো না। আমি এতোক্ষণ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাঙ্গা বেঞ্চির এক কোণায় আস্তে করে বসলাম। বাড়ি থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি ফরিদের দোকানে গুড়ের চা খেতে। মালেক ফকির নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকালো। তারপর ধীর গলায় জিজ্ঞেস করলো, তুমি কোন বাড়ির? কার কিতা লাগো? সালাম দিয়ে বিনীত ভাবে বললাম, আমি ইসহাক আলি তালুকদারের নাতি। বৃদ্ধ দুজন আমার কথায় খুব খুশি হলো। আব্বাস আলি বললো, তুমি অইলা একজন মুক্তিযোদ্ধার নাতি। তোমার দাদা আমরার খুব কাছের মানুষ আছিন। এমন মানুষ এই দুনিয়াত আর আইতো না। সংগ্রামের সময় তোমার দাদা আমরারে যে কত সাহায্য করছে তা ইতিহাস। আটপাড়া থানা লুট কইরা বন্দুক আর গুলি তোমার দাদার কাছে আইন্যিয়া রাখছি। কথার ফাঁকে ফরিদ আমাদের তিনজনের হাতেই গরম চায়ের কাপ তুলে দিল।
দুই
চায়ে লম্বা চুমুক দিয়ে আমি আগ্রহ নিয়ে বৃ্দ্েধর দিকে ঝুঁকে বসলাম। আব্বাস আলি পঁয়তাল্লিশ বছর আগের স্মৃতিধূসর মাটি খুঁড়ে বললো, তোমার দাদা এক সময় কাপড়ের ব্যবসা করতো। নেত্রকোণা শহরের হরেন্দ্র-ধীরেন্দ্র সাহার কাপড়ের দোকান থাইক্যিয়া মালামাল কিন্যিয়া আটপাড়া বাজারে বেচতো। আমি তার কথায় সায় দিলাম, জী, আমার বাবার কাছে শুনেছি। আটপাড়া বাজারে দাদার অনেক বড় দোকান ছিল। বাবা নিজেও মাঝে মাঝে দাদার সাথে সেই দোকানে গিয়ে বসতো। পাশে বসা মালেক ফকির চায়ের কাপটা একপাশে সরিয়ে রেখে যোগ করলো, তুমি ঠিক কথাই শুনছো। আমরার শুনই গ্রামের একমাত্র বড় ব্যবসায়ী আছিন তোমার দাদা। আহা, কী যে ভালা মানুষ আছিন!
আব্বাস আলি চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলতে থাকে, সংগ্রামের সময় তোমার দাদা সংখ্যালঘু হিন্দুরার প্রতি খুব সহানুভূতিশীল আছিন। অনেক হিন্দু নিজের মালামাল তার কাছে জিম্মা রাইখ্যা ভারত গেছিলো গা। দেশ স্বাধীন হইলে এইসব মালামাল তারা তোমার দাদার কাছ থাইক্যিয়া অক্ষত অবস্হায় ফিরত পায়। আমতলার যোগেশ মাষ্টার তোমার দাদার কাছে একটি গাভি রাইখ্যা যায়। নেত্রকোণা শহরের সোনালী মেডিক্যাল হলের মালিক যতীনবাবু লাল রঙের একটা ফিলিপ্স রেডিও রাইখ্যা যায়। আমি অইলাম এইসব ঘটনার সাক্ষী। পাথরের মত নিশ্চুপ হয়ে আমি যুদ্ধদিনের কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে থাকি। শীতের রোদের তেজ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। আব্বাস আলির কথা আবার শুরু হয়।
নেত্রকোণা শহরের ছোট বাজারে হাসেমিয়া লাইব্রেরির কাছেই সুরেশ গোয়ালার চিড়া-মুড়ি, দই-দুধের দোকান আছিলো। বর্তমানে এইডা ঘৃত ঘর নামে পরিচিত। যুদ্ধের সময় সেই সুরেশবাবু আমরার গ্রামের বেপারি বাড়িতে কিছুদিনের জন্য আশ্রয় নেয়। পরে সেই বাড়ির আশ্রয়দাতাই তার দোকানডা দখল কইরা লয়। গ্রামের সবাই এই ঘটনা জানে। যুদ্ধ শেষ হইলে সুরেশবাবু আইয়া দেখে তার আশ্রয়দাতাই দোকানের মালিক অইয়া গেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’র উপেনের মতোই তার কান্নার কোন দাম রইলো না।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। ভেতরে কেমন যেন লাগছে। জিজ্ঞেস করলাম, সেই দখলদারের নাম কী? মালেক ফকির ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল, এখলাস বেপারি। নেত্রকোণা শহরে তারে এক নামে চিনে। শহরেই পাঁচতলা বাড়ি করছে। গাঁও গেরামে খুব একটা আসা যাওয়া নাই। শহরের বিশিষ্ট মানুষ অহন। কিন্তু আমরা জানি যুদ্ধের সময় তার আসল ইতিহাস!
আব্বাস আলি ফরিদকে আরেক কাপ চা দিতে বলে। খুব দ্রুত আমার ভুল ভাঙ্গতে লাগলো তার সম্পর্কে। কথাবার্তায় সামান্য একজন শিক্ষিত মনে হলেও তার রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা’ কবিতা পড়া আছে। হয়তো আরো অনেক কিছুই পড়া আছে। তা না হলে কেমন করে আব্বাস আলি বললো, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই বিঘা জমির উপেনের মতই সুরেশবাবুর কান্নার কোন দাম রইলো না’- এই কথাটি? কেন জানি পৌষের এই শীতের সকালেও আমার শরীরের সব লোম বল্লমের মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
তিন
মালেক ফকির লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে চলে যাওয়ার জন্য। সে তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বললো, হুদাই অত কথা কইতাছো। কিতা অইবো এই ইতিহাস এই ছেরাডারে কইয়া? আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকি, কোন উত্তর আসে না মুখে। আব্বাস আলি আমাকে হাতের ইশারায় তার পাশে বসতে বলে। তারপর বলে, দরকার আছে, অবশ্যই দরকার আছে সংগ্রামের ইতিহাস এইসব পোলাপানের জানা। এরা জানুক কারা দেশের শত্রু আর কারা দেশের মিত্র। স্বাধীনতার ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস আর বঙ্গবন্ধুর কথা যদি এরা না জানে তাইলে এই জীবন তো কুত্তা-বিলাইর জীবন! যার কথায় আমরা অস্ত্র লইয়া যুদ্ধ করছি, হেই বেডার কথাই যদি না জানে তাইলে এরচেয়ে বড় আফসোস আর নাই!
তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে থাকে- তোমারে আরেকটা কষ্টের কথা কই। বর্তমানে আমরার এলাকার বড় নেতা অইল বাচ্চু মিয়া। সে সরকারী দলের রাজনীতি করে। দুইবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ইলেকশন করছে। একবারও পাস করতে পারছে না। আগামিতেও নাকি দাঁড়াইবো। নামের আগে সাইনবোর্ড লাগায়- ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’। আসলে সে মুক্তিযোদ্ধা না। সে একদিনের লাইগ্যিয়াও যুদ্ধে গেছে না। আমরা যখন যুদ্ধের লাইগ্যিয়া প্রস্তুতি লইতাছি তখন বাচ্চু চোরের মত পলাইছে। তলে তলে শান্তি কমিটির দালালি করছে। যুদ্ধ শেষ অইলে বঙ্গবন্ধুর আদেশে আমরা আটপাড়া স্কুলের ময়দানে অস্ত্র জমা দিতাম গেছি সরকারী অফিসার আর পুলিশের কাছে। আমি, মালেক, তোমার দাদা সহ আরো বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা যার যার অস্ত্র-গুলি লইয়া ময়দানে হাজির হইছি। হঠাৎ দেখলাম বাচ্চু তার গায়ের চাদরের তলা থাইক্যিয়া একটা এলএমজি বাইর কইরা অফিসারের হাতে জমা দিতাছে।
আমি তারে এক পাশে নিয়া জিগাইলাম, তুই কোন জায়গায়, কার কমান্ডে যুদ্ধ করছস? সে অপরাধীর মত আমার দুই হাত জাবড়াইয়া ধইরা কইলো, তুই আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমি জানের ডরে যুদ্ধে যাই নাই। নানা জায়গায় পলাইয়া আছিলাম। অনেক কষ্টে আমি এই অস্ত্রডা জোগাড় কইরা জমা দিছি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে। তুই ছাড়া এই সত্য আর কেউ জানে না। তোর হাতে পায়ে ধইরা কইতাছি তুই আমারে মারিস না। তুই কারো কাছে এই কথা কইস না। সারাজীবন আমি তোর কাছে ঋণী থাকবাম। তুই যা কইবি আমি তাই শুনবাম। এই কথা কইয়া বাচ্চু এক দৌড়ে আমার সামনে থাইক্যিয়া অন্যদিকে সইরা গেল। অথচ আইজ সে বড় মুক্তিযোদ্ধা, আমরার চেয়েও বিরাট ক্ষমতার মালিক। কোন একটা দরকারে তার কাছে গেলে সে নানাভাবে হয়রানি করে আমরারে। পাত্তাই পাই না তার কাছে। কত দাপট আইজ তার! সে তার অতীত ইতিহাস ভুইল্যা গেছে। অকৃতজ্ঞ, বেঈমান, শান্তি কমিটির দালাল! কেউ তার বিরুদ্ধে, তার অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে কথা কয় না। গ্রামের সবাই তারে ডরায়। তারে কেউ শ্রদ্ধায় সালাম দেয় না, সালাম দেয় ভয়ে!
চার
আমি ঝাপসা চোখে আব্বাস আলির দিকে তাকালাম। আমার ভেতরটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। চলে যাওয়ার সময় আমার দিকে তাকিয়ে আব্বাস আলি একটা পরিতৃপ্তির হাসি দিল। তারপর বললো, আমার এখন চলে যাওয়ার সময়। অপেক্ষায় আছি কোন সময় উপরওয়ালার ডাক আয় আমার কাছে। ম্যালা দিনের জমানো ইতিহাস, সত্য ঘটনা বুকের ভিত্রে বেয়োনেটের মত ঘাই মারতাছিন। তোমার কাছে সেই ইতিহাস কইয়া যন্ত্রণার হাত থাইক্যিয়া কিছুটা মুক্তি পাইলাম। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা- এর চেয়ে বড় আর কোন পরিচয় নাই। তোমরা শিক্ষিত পোলাপান। তোমরার চিন্তা ভাবনা অনেক উন্নত। কোনোদিন দেশের সাথে বেঈমানি কইরো না। নিজের গ্রামরে, নিজের শিকড়রে অবহেলা কইরো না। গ্রামের অসহায় মানুষের জন্য কিছু করার চিন্তা যেন তোমার ভিত্রে থাহে। আমরা তোমরারে যুদ্ধ কইরা স্বাধীন দেশ দিয়া গেলাম। এই দেশটারে মায়ের মত ভালোবাসবা। আর এই চিন্তাটাই হইল তোমার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা! জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু!
লাঠিতে ভর দিয়ে আব্বাস আলি বাড়ির পথ ধরলো। আমি চোখ মুছে, বুক টান করে মাটিতে খুব জোরে পা ঠুকে তাকে স্যালুট করে কিছুক্ষণের জন্য ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম।
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
ভার্সিটির বাস ধরতে হয় আমাকে খুব সকালে। বাড়ি থেকে একটু হেঁটেই রিকসা। তারপর বাস। হাঁটা…..
আজকের সন্ধ্যাটা থমকে যাওয়া মেঘেদের। ঝিরিঝির বৃষ্টি ছিল দিনভর। ঢাকা শহরের পথঘাট জল কাদায় মাখামাখি।…..
জোছনা করেছে আড়ি আসে না আমার বাড়ি গলি দিয়ে চলে যায়, গলি দিয়ে চলে যায়…..