একজন কবির মৃত্যু

শামীম আহমদ
কবিতা
Bengali
একজন কবির মৃত্যু

অন্তিম ঊষা

অন্তিম ঊষা
অস্ফুট আলো
ফিনিক্স বিদ্রোহ লিখে বাতাসে ,দিনের শেষে ;
আমি উদ্ধত ঊষার উজ্জ্বল আলোয় লিখি
জীবনের জয়গান; কিন্তু এ গান হরায় বিধবার দীর্ঘ নিঃশ্বাসে,
এ গান বেদনার বিষে,নীল হয়ে মিশে এবুকের বামপাশে !

তবে এ গান আমি লিখি কার জন্যে
তবে এ স্বপ্ন আমি আঁকি কার জন্যে ?
যদি আমাকে এভাবে ঠেলে দাও দূরে ।

ইচ্ছে হয় , আমার প্রচণ্ড ইচ্ছে হয়
জীবনের প্রাপ্তিটুকুন যা আছে ঝুলিতে
শব্দে শব্দে গড়া অক্ষরের প্রতিমা গুলো
অসংখ্য নিদ্রাহীন রাতের চোখ থেকে খসে পড়া
মুক্তোর দানা ,আমার হৃদয়ের সমুদ্রে ওঠা সফেদ সমুদ্রসফেন
সব জ্বালিয়ে ভস্ম করে আমিও মিশে যাই
মৃত্ত্বিকার অণু থেকে পরমাণুতে ।

যেমন মুনির মিলেনা সন্ধান
পৃথিবীর  জঠরে রেখে যায় তার অনাগত সন্তান !

অবিশ্বাসের যূপকাষ্টে বাঁধা জীবন

আমার বিশ্বাস ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণবর্ণ  অবিশ্বাসের তলে,
এখানে শস্য নেই আদিগন্ত জুড়ে রয়েছে কেবলই
শস্যহীন  আগাছা,এগুলোতে দানা নেই
যা আছে তা কেবলই তুষ মাত্র ;
আমি এগিয়ে যাচ্ছি,
পিছন ফিরে দেখি কেউ নেই সঙ্গে
আমার সঙ্গীগণ সকলই হয়েছে বলি,
অবিশ্বাসের যূপকাষ্ঠে বাঁধা কেবলই মাথাহীন ধড়,
এখন প্রতিকি জীবন তাদের!

এখানে ক্ষুধার্ত  দুপুর পুড়ে হয়েছে খাক
সকালের সোনারোদ্দুর  মাখিনি আমি
কয়লা খাদানের অতল তলে বাঁচার তীব্র যন্ত্রনায়
কাটিয়েছি সময়,এখন বিমূর্ত সন্ধ্যায়
আমি কি কালো রাস্তার পিঠ ভেঙে ভেঙে
এগিয়ে যাচ্ছি শ্মশানের দিকে ! না ,আমি
ঐ দিকে যাবোনা ,আমি তপস্যাকে পুঁজি করে
দুহাত উদ্ধত করে মহারাত্রির মহামায়া ছিন্ন করে অন্ধকারের ললাটে এঁকে দেবো তমোহর তিলক ।

মহাকালের গর্তে উঠে জীবনের জয়গান

আমারও ক্লান্ত কপালের পুরো ভাঁজে নামবে বিকেল,
কামনার ব্যাকুলতা হয়তো থাকবেনা ,কেবলই থাকবে –
ঘাড়ের উপর জীবনের প্রকাণ্ড কুঁজ ,সময়ের চূর্ণ পাহাড়ে
স্মৃতির মিনার ভেঙে ভেঙে উঠবে তুর্যনিনাদ ;
মুখটা দুহাতের তালুতে ভর দিয়ে শুধু ফ্যালফ্যাল
করে দেখবে শেষের দৃশ্যপট,
যে যায় সে আর ফিরে আসেনা দৃষ্টির সীমানায়,
আষাঢ়ের রিমঝিম বরষায় ;

কদমের ডালে ভেজা কাক আনমনে ধ্বংসের ডাক দেয় !
দিনের সিংহদ্বারে লিখে রাতের পঞ্চনামা !
অন্ধকার গহ্বরে জন্মান্ধ সাপের মাথায় মণি
জ্বলজ্বল করছে,সে কী জানে তার মুল্য ?
তবে আমি এটুকুই জানি
হারিয়ে যাওয়া কালের গর্ত থেকে উঠে আসে-
নতুন প্রজন্মের বেঁচে থাকার তীব্র অভিপ্রায় ।

একজন কবির মৃত্যু

চলমান জাহাজ থেকে নির্গত ধোঁয়া যেমন
বাতাসে মিশে নীলাকাশে মিলিয়ে যায়
ঠিক তেমনি আমিও একদিন মিশে  যাবো-
মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে মহাব্যুমে ,

পড়ে থাকবে কেবলই শামীমের লাশ ;

বিশ্বাস করুন সবাই আমি মরতে চাইনা,তবুও
মরতে হবে আমাকে ,এ যে বিধাতার হুকুম ,
যেমন আমার পূর্বপুরুষগণ সবাই
মৃত্যুকে খুব আপন করে নিয়েছিলেন  অনিচ্ছা সত্যেও!

পাথরের স্বপ্ন থাকতে নেই কিন্তু মানুষ স্বপ্ন দেখে
মানুষ স্বপ্নের দাস,
স্বপ্ন দেখি আমিও ,বিশ্বকে হৃদয়ের
আয়নায় নিখুঁত ভাবে এঁকে দিতে চাই স্বপ্নিল তুলির আচড়ে ;
আমি তন্ময় বিস্ময়ে দেখেছি কবির আরাধনা ,
আমি দেখেছি বকধার্মিকদের বিরুদ্ধে কবির দ্রোহী ক্যালিওগ্রাফির
বিদগ্ধ আর্তনাদ,কাগজের পৃষ্টার পর পৃষ্টায়
সুপ্ত ভিসুবিয়াস ;
কখনো কবির দুটি হাতে লোহার শিকল
অথচ কবির হৃদয় মুক্ত , নিকষ কলো রাত্রিকে
পান করে করে পারদের মতো চোখের জল ঢেলে
কারার লৌহগরাদ গলিয়ে জোড়া দিয়েছেন
মানুষের মুক্তির কবিতায়
যেমন তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত ,
মহা দার্শনিক সক্রেটিস ,
যখন সক্রেটিসের মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে এলো
তিনি তাঁর পুত্র মিনেজেনাসকে বলেছিলেন
বাবা তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো ,তারপর
ধীর শান্ত অকুতোভয় তিনি,উদারচিত্ত হাসি মুখ তাঁর
তারপর জল্লাদ এলো গ্লাস ভর্তি হেমলক নিয়ে !
বল্লো একফুঁটাও বাহিরে যেনো না পড়ে ,
এরমধ্যে তিনি তাঁর সব কাজ সেরে নিলেন বিজয়ীর মতো
বীরদর্পে নিজের কাফন পরে শুয়ে পড়লেন
সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে
পিপাসার্ত পথিকের মতো নিমিষেই পান করলন
গ্লাস ভর্তি মৃত্যুরস হেমলক !
আস্তে আস্তে নিজের হাতেই নিজের মুখ ঢেকে
ঘুমিয়ে গেলেন জীবনের শেষ প্রার্থনা শেষে !
এভাবেই মৃত্যু আসে কবির কাছে শান্তির বারতা নিয়ে
কবি ঘুমিয়ে যান এক মহাঘুমে স্রষ্টার সান্নিধ্যে
এমন মৃত্যু যদি হয় মানুষের কল্যাণে আহ্ ….

শামীম আহমদ। কবি। জন্ম বাংলাদেশের সিলেটে, ১৯৬৮ সালের ১৫ই ডিসেম্বর। বর্তমানে লন্ডনে স্থায়ী।   প্রকাশিত বই: 'চেতনা' (১৯৯৩), 'পথিক' (২০১৫), 'মুছে যাওয়া পদচিহ্ন' (২০১৭), 'আগুনের সংলাপ' (২০১৮), 'নপুংসক নগরে' (২০১৮)।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..