–না স্যার।গরু তো আমার বাবা বর্গা নিয়েছিল।যখন নিয়েছিল তখন ছিল বাছুর।বাছুরটির দাম ধরা হইছিল পঁচিশ হাজার টাকা।এই পঁচিশ হাজার দেওয়ার পর যা বাকি ছিল তা দুইভাগ করে একভাগ আমারা পাইছি আরেকভাগ গরুর আসল মালিক নিয়ে নিয়েছে।
আমরা পাইছি সতেরো হাজার।বাবায় বলছে এই টাকা দিয়া আর একটা বাছুর কিনবে।
–ও তাই নাকি?
–হ।
ক্রমে গভীর হচ্ছে রাত।গেদু বার বার হাই তুলছে।
এক সময় তোষকের এক পাশে গেদু ঘুমিয়ে গেল।গেদুর খুব ঠান্ডা লাগছে।গত পড়শু পুকুরে গোসল করছিল দীর্ঘক্ষন।পুকুরের পানি একটু শীতল।
তার কারন পুকুর ভরা কচুরিপানা।আর চারপাশে বড় বড় গাছ।যার জন্য রোদের আলো খুব একটা পায় না।
যখন নাক ডাকা শুরু হল
কিসমত আলী কয়েক বার ডাকার পরও কোন সাড়া পেল না।
কিসমত আলীও বিছানো তোষকে দেহ এলিয়ে দিয়ে।
দুই ছেলের কথা,নাতী-নাতনিদের কথা
ভাবতে লাগলেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে
আবার আকাশের দিকে তাকালেন।
স্ত্রী গত হয়েছে আজ বিশ বছর হল।
এক রকম চেলেঞ্জ নিয়েই ছেলে দুটোকে মানুষ করেছেন।
বড় ছেলে সিভিল ইঞ্জিয়ারিংয়ে এমএসসি করে আমেরিকাতেই থেকে গেলে নাগরিকত্ব নিয়ে।
ছোট ছেলে স্থাপত্য বিদ্যার ছাত্র-পড়াশোনার পাশাপাশি জবও করছে।সব সময়ই তার ব্যস্ত থাকতে হয় প্রজেক্ট নিয়ে।
কিসমত আলীর এখন আর তেমন রাত জাগা হয় না।আগে জাগতেন।শুক্লপক্ষে।
রাত জাগলেই গভীর রাতে কুলসুমের ছায়া এসে গল্প জুড়ে দিত।
সুখদুঃখের।অনেক দিন যাবত কুলসুমের ছায়াটিও আসছে না।
আজকাল ছায়াটির জন্য কিসমত আলীর অপেক্ষা প্রবল হচ্ছে।
ফজরের আজান হচ্ছে।কিসমত আলী গেদুকে ডাকছেন।
-গেদু উঠ্ উঠ্ ভোর হয়ে যাচ্ছে—
রাত জাগার পরও যেহেতু ক্লান্তি অনুভূত হলো না
তাই বিছানায় গড়াগড়ি করে এক রকম বিরক্ত হয়েই উঠে পড়লেন কিসমত আলী।পানি ফোটানো ছিল।গোসল সেরে লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন।
একটা সময় সাহিত্যের প্রতি তার ঝোঁক ছিল।
অনেক রাত বই পড়ে কাটিয়েছেন।বই পড়া বাদ দিয়েছেন দশ কি বারো বছর।আজ কি মনে করে যেন পড়তে ইচ্ছে হল।কলেজে ঢুকতেই শিক্ষকদের সাথে কুশলবিনিময় করে
লাইব্রেরীর ভিতুরে ঢুকলেন এবং আশ্চর্য হলেন লাইব্রেরীর দুর্দশা দেখে।
লাইব্রেরীর বিভিন্ন জায়গায় মাকড়সার
জাল বুনে রেখেছে।টেবিল-চেয়ার এক রকম ধূলিতে ঢেকে আছে।
বইয়ের তাকগুলো দেখে বেশ রাগান্বিত হয়ে প্রিন্সিপালের রুমে গেলেন।
অনেকটা ক্ষোভ ঝাড়লেন।
এবং প্রিন্সিপাল যে লাইব্রেরিতে ভুলে ঢুঁ মারেন না তা বুঝতে পারলেন।
ইতিমধ্যেই
প্রিন্সিপাল দপ্তরীকে ডেকে সব পরিস্কার করালেন।
প্রিন্সিপাল জানালেন যে কলেজ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ধরণ এমনটি হয়েছে।
কিসমত আলী জানতে চাইলেন কেন বন্ধ ছিল।
আপনাকে তো জানানো হয়েছিল
বিস্তারিত।
কিসমত আলী ভাবনায় পড়ে গেলেন।
কি বিষয় জানানো হয়েছিল ঠিক মনে করতে পারলেন না।
আমাদের বাংলার প্রফেসর জনাব ওয়াদুদ এখনো তো সুস্থ্য হয়ে উঠেননি।উনি সুস্থ্য হলেই বিষয়টা ক্লিয়ার হবে।
আচ্ছা,আমি ঠিক মনে করতে পারছি না।
প্লীজ,আবার একটু বলুন।
প্রিন্সিপাল অবাক হয়ে গেলেন।
এত বড় একটি বিষয় উনার মনে নেই!
আমাদের নবীন অনুষ্ঠানে
বাইরের কিছু ছেলেপিলে ঢোকে পড়ে।
কিছুটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
—ও হ্যাঁ মনে পড়েছে।
তারপর,মেয়েটির কোন খবর পাওয়া গেছে?
—না।এখন পর্যন্ত সে রকম কোন সংবাদ পাইনি।তবে তদন্ত হচ্ছে।
এখানকার পুলিশও বিষয়টি নিয়ে বেশ তৎপর।খুব শীঘ্র হয়তো
কোন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসবে।
আপনী যদি স্যার একবার থানায় যেতেন,
তাহলে ওরা আরও আগ্রহ দেখাত এ ব্যাপারে।কয়েক দিন যাবত ভাবছি আপনার কথাই ভেবে আসছিলাম।
যাব যাব করে আর যাওয়া হল না।
সেভাবে সময় করে উঠতে পারিনি।
—–আচ্ছা,আমি একবার ওয়াদুদ সাহেবকে দেখতে যাব।থানার ওসির সাথেও কথা বলে দেখি উনারা কতদূর এগোলেন।
এমন সময় সাধারণত শিয়ালের ডাকাডাকি শোনা যায়।কিন্ত আজ কোন শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে না।এমন কি গাছ থেকে পাতা ঝরারও কোন শব্দ নেই।ডাল থেকে ডালে যে পেঁচাটি নড়েচড়ে বসতো তারও আজ কোন সাড়া নেই।কিছুটা আশ্চর্য হলেন কিসমত আলী।
চারপাশ নিরব,ঝিঁঝিরা ঘুমিয়ে গেছে।বাইরে দু একটা জোনাকের ওড়াওড়ি।
হঠাৎ গেদুর কণ্ঠ শোনা গেল।
—না।স্যার ঘুমিয়ে আছেন।আপনী আগামীকাল সকালে আসুন।
কিসমত আলী চমকে গেলেন।
গেদু কে এসেছে?কে? কে?
ওপাশ থেকে কোন উত্তর এলো না।
কিসমত আলী নিজেই দরজা খুলে দিলেন।
বাইরে তাকালেন এবং চোখটা ডলা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কে আপনী?
রাত দশটা।অথচ কিসমত আলী মেনে নিতে পারছেন না।উনি বলছেন এখন রাত দুটো।
আপনার হাতে ঘড়ি আছে? কিসমত সাহেব জানতে চাইলেন।
—জ্বী আছে,তবে ঘড়িটি নষ্ট।
—নষ্ট ঘড়ি হাতে রাখেন কেন?
—ঘড়িটা আমার খুব পছন্দের তাই।
কন্ঠটি কিসমত আলীর পরিচিত মনে হল।
কিন্তু কার তা নিশ্চিত হতে পারলেন না।
একঘণ্টা হয়ে গেল বিদ্যুৎ নেই।
কিসমত আলী ঘড়ির দিকে তাকালেন।
টাইমকন্যার নাভি বরাবর হাতির যে মাথাটা বসানো সেটা হলুদ থেকে নীল হয়ে গেছে।
ডান চোখটি ছিল ঘন্টার কাঁটা আর বাম চোখটি ছিল মিনিটের কাঁটা কিন্তু এখন তা উলটে গেছে।
যে শূরটি ছিল সেকেন্ডের কাঁটা সেটাও উলটো ঘুরছে এবং শূর জুড়ে যে সবুজ বাতি জ্বলত
সেখানে এখন ভয়ানক লাল জ্বলছে।
আর টাইমকন্যার দাঁত থেকে এক রকম আলো বেরোচ্ছে যা নির্ণয় করা যাচ্ছে না।
—আচ্ছা আপনার কি মনে হয় এখন রাত দশটা?
—না।
—তবে কি আমার ঘড়িটিও নষ্ট হয়ে গেল!
—আপনার ওটা কি সত্যি ঘড়ি?
আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।
—-হ্যাঁ এটা অনেক দামি ঘড়ি আর এটা তৈরি করতে অনেক ডলার খরচ হয়েছে।সময়ও লেগেছে দশ বছর।
—কি বলেন!
—হ্যাঁ।আপনী কি জন টেলরের ঘড়ি সম্পর্কে কিছু জানেন?
—-না।
—-কর্পাস কৃষ্টি কলেজে পড়তেন জনটেলর।
উনি উনার আবিষ্কৃত ঘড়িটি তাই কর্পাস কৃষ্টি কলেজকেই উপহার দিয়েছেন।
একবার আমরা তিন বন্ধু আমন্ত্রন পেলাম
এক সেমিনারে উপস্থিত থাকার জন্য।তখন ঘড়িটি দেখেছিলাম।আর আমরাও তিন বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমরাও একটি ঘড়ি বানাবো।ঘড়ির ডিজাইনটা আমারই করা।
—-ও আচ্ছা।তা ঐ পুতুলের নাভির মধ্যে হাতির মাথা,শুঁড় কেন?
—-এই শুঁড় সেকেন্ড এর খাজগুলো বসানোর কাজ করে।
—-ও আচ্ছা।তা ঘড়িটি কি দ্বারা চলে?
—ইলেক্ট্রিক মটর।প্রসঙ্গ পালটিয়ে কিসমত আলী বললেন–চা হবে?
—-হ্যাঁ মন্দ হয় না।
কেটলি থেকে ঢেলে যখন হাত বাড়িয়ে দিতে যাচ্ছিলেন তখন বিদ্যুৎ চমকালো।আর এতে
যতটুকু ডাক্তার কুলসুমের মুখ দেখা গেল
তাতে নিশ্চিত হতে পারলেন না কিসমত আলী।
চায়ে চুমুক দিয়ে কিসমত আলী বললেন—
ইদানীং আমার ঘুম কম হচ্ছে।স্লিপিং পিল খেয়েও কাজ হচ্ছে না।
—-আপনী কি কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত থাকেন?
কখনো কি দুঃখবোধ করেন?
বা কাউকে মনে করে বিষন্নতায় ভুগেন?
—ঠিক তেমন কিছু না।তবে আমার স্ত্রীকে খুব মিস করি।কয়েক মাস আগেও এ রকম মিস করতাম না।কারন তার সাথে মাঝেমাঝে গভীর রাতে কথা হতো।এখন আর কথা হয় না।এমন কি তিনি আর আসেন না।