একজন কিসমত আলী

অয়ন্ত ইমরুল
গল্প
Bengali
একজন কিসমত আলী
না-
কোথাও মেঘের আনাগোনা নেই।
পতনের দুঃখে কোথাও ভারি হচ্ছে গোধূলির কান্না।সন্ধ্যা তার সোনামুখী সুই দিয়ে রাত নকশি করবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
দূরে বেউড়বনে ঝিঁঝিঁ-র ডাকগুলো কি করুন!
ডাঙা ধরা বিল খুব ধীরে শান্ত হয়ে যাচ্ছে।সারি সারি তালগাছ–বাতাসে মৃদু শব্দ করছে তালের পাতারা।বাবুই বাসায় শোনা যাচ্ছে সন্ধ্যার শেষ কিচিরমিচির।
এখনো দু একটা চিল গুটিয়ে নেয়নি ডানা।
মধ্যবিলে মাছধরা নৌকায় এখনো জ্বলে উঠেনি লণ্ঠনের আলো।সন্ধ্যা আর একটু ভারি হলে শুরু হবে জাল ফেলা।
স্রোতের প্রতিকূলে নরেন মিয়ার ভেসাল
দীর্ঘক্ষণ পর উঠছে।সারা রাতে কতবার যে উঠবে তার হিসেব নেই।
উঠানের সাথে সাথেই আবার ডুবিয়ে
দিল।
হয়তো কোন মাছ উঠেনি-কিছু শামুক বা জলজ আগাছা কিংবা গুরো মাছ বলে।
সারা রাত জেগে জেগে চলবে তার মাছ ধরা।তারপর ভোরে ছুটবে বাজারের উদ্দেশ্যে।ভাল মাছ পেলে ডাক উঠবে।
কিসমত আলী
বিকেল থেকেই মাঠে বসে আছেন।
সম্ভবত,বিড়বিড় করে কিছু বললেন!
হতে পারে নরেনের জন্য কিছুটা দীর্ঘশ্বাস।অথবা
,বাবুইদের প্রশংসা স্বরূপ,দু একটা বুলি।কিন্তু তার দৃষ্টির ভঙ্গিতে যেভাবে অস্থিরতা ফোটে উঠছে,তাতে এর কোনটিই ধরে নেয়ার মতো মনে হচ্ছে না।কিছুক্ষণ পর পর
পথের দিকে তাকানো দেখে মনে হচ্ছে তিনি কোন কিছুর জন্য অপেক্ষা করছেন।
অনেকটা বিরক্ত হচ্ছেন,যতদূর দৃষ্টি রাখছেন কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না।
ইদানীং কেন যেন,কিসমত সাহেব খুব দ্রুত বিরক্ত হয়ে যান।কখনো সামান্য কিছু নিয়েই তার শুরু হয়ে যায় বাক-বিতণ্ডা।
অথচ সে কখনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বা একঘেঁয়ামিতেও ভুগেন না।রাতে ভাল ঘুম হয়।দিনের অধিকাংশ সময় তার গ্রাম দেখে,
গ্রামের মানুষের সাথে গল্প-গুজব করে কেটে যায়।
যে কেউ প্রথম আলাপেই বলে দিতে পারবে–খুব সুখী একজন মানুষ।
তিন বছর হল সে গ্রামের বাড়ী এসেছেন এবং নিয়মিত থাকছেন।
একটি টর্চলাইট,শীতলপাটি,তোষক ও
দূরবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে,এক রকম
হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এল গেদু।
বয়স বার কিংবা তের হবে।
–এই নিন স্যার আপনার যন্ত্রটা।
–কিসমত আলী কিছু বলতে চেয়েও
এভাবে হাঁপাতে দেখে চুপ হয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন
—-এত দেরি করলি কেন?
——স্যার আজ হাটবার তো,তাই বাবার সাথে হাটে গিয়েছিলাম।
আমাগো
গরুটি বিক্রি করে তবেই এলাম।
কি বলিস!
–তাহলে আগামীকাল থেকে
আমার দুধ ও দুধের সর আর খাওয়া হচ্ছে না?
না স্যার।দুধেল গরু তো আছেই।
বিক্রি হয়েছে ষাঁড় গরুটি।
–ও আচ্ছা।
কিসমত আলী অনেকটা অবাক হচ্ছেন।এই এক বছরে গেদু শুদ্ধভাবে কথা বলতে শিখে গেছে।
স্যার,চাঁদতারা তো পুকুর ঘাটে বসেও দেখা
যেত,এই মাঠে আসার কি দরকার ছিল?
কিসমত আলী চোখ থেকে দূরবীক্ষণ যন্ত্রটা নামিয়ে
ঘাড় ঘুরাতেই গেদু বলে উঠলো–
দুঃখিত স্যার–মাঝেমধ্যে ভুল হয়ে যায়।
এখানে বস্,আর চুপ করে থাকবি।
কিন্তু চুপ করে থাকার পাত্র গেদু না।
কথা না বলে থাকাটা ওর চরিত্রের সাথে মিলে না।
আর এ জন্য কিসমত আলীর কাছাকাছি ওর থাকতে ইচ্ছে করে না।
নিজেই সারাক্ষণ প্যাঁচাল পারতে চায়
আবার আমি কথা কইলেই দোষ–গেদু বিড়বিড় করে বলে।
গেদু কিছু বললি?
–না স্যার।
শোন,রাতের আকাশে উজ্জল নক্ষত্র দেখার আনন্দই আলাদা।
তার উপর কি সুনসান,শান্ত হয়ে আছে চারপাশ।আর ঝিরিঝিরি বাতাস গায়ের উপর জাগিয়ে দিচ্ছে অন্য রকম সুখ-শিহরণ।এগুলো তুই বুঝবি না।
—হু ঠিক ই বলছেন স্যার।
আমার বুঝোনেরও দরকার নাই।
বিড়বিড় করে হয়তো এই কথাই বলেছিল,গেদু।
—শোন,
এখন যে নক্ষত্রটি দেখছি,এর নাম হল আলডেবারান।
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই এটি পূর্বদিগন্তের উপরে দেখা যায়।
গেদু পূর্ব দিকে তাকায়,অনেকগুলো নক্ষত্র দেখে কিন্তু কোনটার কথা বলছে সেটা ও বুঝতে পারে না।শুধু তার কথায় মাথা ঝুঁকায় আর হু হু করে।
ভাল করে দ্যাখ-ঐ যে আদমসুরত।মাঝে তিনটি তারা,ডানদিকে তাকা,
কি দেখেছিস?
–হ্যাঁ স্যার।
–আর বামে তাকালে দেখতে পারবি
লুব্ধক।
এটির উজ্জলতা অনেক বেশী।
এটি নীল।জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত এটি
খুব স্পষ্ট দেখা যায়।
–এক মগ চা ঢাল।
গেদু কেটলি থেকে এক মগ চা ঢেলে দিয়ে কিছু বলবে মনে হচ্ছিল।
–তোর ইচ্ছে হলে পান করতে পারিস।
সাথে বিস্কিট এনে থাকলে খেয়ে নি।
গেদুর যে ইচ্ছে করছে না তা নয়,
স্যারের স্পেশাল চা বলে কথা।
এর আগে একবার এক মগ চা পান করেছিল গেদু
আর এই চায়ের স্বাদের গল্পটাও গেদু
এ তল্লাটে ছড়িয়ে দিয়েছিল।
স্যার-আর মগ নাই তো।
কিসমত আলী কিছু বলছে না দেখে
গেদু দ্বিতীয়বার বললো।
–ঠিক আছে তুই এই পেয়ালা নে।
গেদু মনে মনে এটাই চাচ্ছিল।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ হয়ে রইল।
হ্যাঁরে ষাঁড়টি কত বিক্রি হল?
–ষাট হাজার।
–বাহ! তাহলে তো তোদের কষ্ট এবার অনেকটাই কমে যাবে রে।
–না স্যার।গরু তো আমার বাবা বর্গা নিয়েছিল।যখন নিয়েছিল তখন ছিল বাছুর।বাছুরটির দাম ধরা হইছিল পঁচিশ হাজার টাকা।এই পঁচিশ হাজার দেওয়ার পর যা বাকি ছিল তা দুইভাগ করে একভাগ আমারা পাইছি আরেকভাগ গরুর আসল মালিক নিয়ে নিয়েছে।
আমরা পাইছি সতেরো হাজার।বাবায় বলছে এই টাকা দিয়া আর একটা বাছুর কিনবে।
–ও তাই নাকি?
–হ।
ক্রমে গভীর হচ্ছে রাত।গেদু বার বার হাই তুলছে।
এক সময় তোষকের এক পাশে গেদু ঘুমিয়ে গেল।গেদুর খুব ঠান্ডা লাগছে।গত পড়শু পুকুরে গোসল করছিল দীর্ঘক্ষন।পুকুরের পানি একটু শীতল।
তার কারন পুকুর ভরা কচুরিপানা।আর চারপাশে বড় বড় গাছ।যার জন্য রোদের আলো খুব একটা পায় না।
যখন নাক ডাকা শুরু হল
কিসমত আলী কয়েক বার ডাকার পরও কোন সাড়া পেল না।
কিসমত আলীও বিছানো তোষকে দেহ এলিয়ে দিয়ে।
দুই ছেলের কথা,নাতী-নাতনিদের কথা
ভাবতে লাগলেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে
আবার আকাশের দিকে তাকালেন।
স্ত্রী গত হয়েছে আজ বিশ বছর হল।
এক রকম চেলেঞ্জ নিয়েই ছেলে দুটোকে মানুষ করেছেন।
বড় ছেলে সিভিল ইঞ্জিয়ারিংয়ে এমএসসি করে আমেরিকাতেই থেকে গেলে নাগরিকত্ব নিয়ে।
ছোট ছেলে স্থাপত্য বিদ্যার ছাত্র-পড়াশোনার পাশাপাশি জবও করছে।সব সময়ই তার ব্যস্ত থাকতে হয় প্রজেক্ট নিয়ে।
কিসমত আলীর এখন আর তেমন রাত জাগা হয় না।আগে জাগতেন।শুক্লপক্ষে।
রাত জাগলেই গভীর রাতে কুলসুমের ছায়া এসে গল্প জুড়ে দিত।
সুখদুঃখের।অনেক দিন যাবত কুলসুমের ছায়াটিও আসছে না।
আজকাল ছায়াটির জন্য কিসমত আলীর অপেক্ষা প্রবল হচ্ছে।
ফজরের আজান হচ্ছে।কিসমত আলী গেদুকে ডাকছেন।
-গেদু উঠ্ উঠ্ ভোর হয়ে যাচ্ছে—
রাত জাগার পরও যেহেতু ক্লান্তি অনুভূত হলো না
তাই বিছানায় গড়াগড়ি করে এক রকম বিরক্ত হয়েই উঠে পড়লেন কিসমত আলী।পানি ফোটানো ছিল।গোসল সেরে লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন।
একটা সময় সাহিত্যের প্রতি তার ঝোঁক ছিল।
অনেক রাত বই পড়ে কাটিয়েছেন।বই পড়া বাদ দিয়েছেন দশ কি বারো বছর।আজ কি মনে করে যেন পড়তে ইচ্ছে হল।কলেজে ঢুকতেই শিক্ষকদের সাথে কুশলবিনিময় করে
লাইব্রেরীর ভিতুরে ঢুকলেন এবং আশ্চর্য হলেন লাইব্রেরীর দুর্দশা দেখে।
লাইব্রেরীর বিভিন্ন জায়গায় মাকড়সার
জাল বুনে রেখেছে।টেবিল-চেয়ার এক রকম ধূলিতে ঢেকে আছে।
বইয়ের তাকগুলো দেখে বেশ রাগান্বিত হয়ে প্রিন্সিপালের রুমে গেলেন।
অনেকটা ক্ষোভ ঝাড়লেন।
এবং প্রিন্সিপাল যে লাইব্রেরিতে ভুলে ঢুঁ মারেন না তা বুঝতে পারলেন।
ইতিমধ্যেই
প্রিন্সিপাল দপ্তরীকে ডেকে সব পরিস্কার করালেন।
প্রিন্সিপাল জানালেন যে কলেজ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ধরণ এমনটি হয়েছে।
কিসমত আলী জানতে চাইলেন কেন বন্ধ ছিল।
আপনাকে তো জানানো হয়েছিল
বিস্তারিত।
কিসমত আলী ভাবনায় পড়ে গেলেন।
কি বিষয় জানানো হয়েছিল ঠিক মনে করতে পারলেন না।
আমাদের বাংলার প্রফেসর জনাব ওয়াদুদ এখনো তো সুস্থ্য হয়ে উঠেননি।উনি সুস্থ্য হলেই বিষয়টা ক্লিয়ার হবে।
আচ্ছা,আমি ঠিক মনে করতে পারছি না।
প্লীজ,আবার একটু বলুন।
প্রিন্সিপাল অবাক হয়ে গেলেন।
এত বড় একটি বিষয় উনার মনে নেই!
আমাদের নবীন অনুষ্ঠানে
বাইরের কিছু ছেলেপিলে ঢোকে পড়ে।
কিছুটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
—ও হ্যাঁ মনে পড়েছে।
তারপর,মেয়েটির কোন খবর পাওয়া গেছে?
—না।এখন পর্যন্ত সে রকম কোন সংবাদ পাইনি।তবে তদন্ত হচ্ছে।
এখানকার পুলিশও বিষয়টি নিয়ে বেশ তৎপর।খুব শীঘ্র হয়তো
কোন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসবে।
আপনী যদি স্যার একবার থানায় যেতেন,
তাহলে ওরা আরও আগ্রহ দেখাত এ ব্যাপারে।কয়েক দিন যাবত ভাবছি আপনার কথাই ভেবে আসছিলাম।
যাব যাব করে আর যাওয়া হল না।
সেভাবে সময় করে উঠতে পারিনি।
—–আচ্ছা,আমি একবার ওয়াদুদ সাহেবকে দেখতে যাব।থানার ওসির সাথেও কথা বলে দেখি উনারা কতদূর এগোলেন।
কিসমত আলীকে কিছুটা চিন্তিত দেখাচ্ছে
ভাবছিলেন আজ ডাক্তারের কাছে যাবেন না।
তবু কি ভেবে যে এলেন,সেটাই বসে বসে ভাবছেন।
এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে।এখান থেকে কিসমত আলীর বাগানবাড়ী পৌছোতে দু ঘন্টা লাগবে
আর আজ এখানে রোগীর সংখ্যাও অধিক
সিরিয়াল মেইন্টেইন করতে গেলে অনেক রাত হয়ে যাবে।তাছাড়া ডাক্তার সাহেবও অনেক বিজি।যদিও বন্ধু মানুষ তবু —-
কিসমত সাহেব থানা হয়ে বাগানবাড়ী ফিরে এলেন।এসেই ছোট ছেলে নিলয়কে দেখে চমকে গেলেন।
—তুমি?
—এই তো বিকেলে এলাম।তোমার শরীর কেমন?
—-হ্যাঁ ভাল।
এই ভাল বলাটা নিলয়ের তেমন পছন্দ হলো না।
—কোথায় গিয়েছিলে?
আর গাড়ি নিয়ে যাওনি কেন?
—-থানায় গিয়েছিলাম।তুমি জানো না,গ্রামের সব রাস্তাঘাট গাড়ীর উপযোগী নয়।
—থানায়! নিলয় কিছুটা অবাক হল।
—-না।এমনি।ঐ কলেজে নাকি একটু ঝামেলা হয়েছিল তাই একটু ওসির সাথে কথা বলে এলাম।
—-ও আচ্ছা।বাবা একটা সারপ্রাইজ আছে।
বলেই ল্যাবটপ অন করে বিশাল এপার্টমেন্টের এলিভেশনটা দেখালো।
জানো বাবা–এই ডিজাইনটা চিপ আর্কিটেক্ট স্যার অনেক পছন্দ করেছেন।তাছাড়া জুরিবোর্ডও এই ডিজাইনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
কিসমত আলি বাহারি রঙের কম্বিনেশন দেখছেন এবং ফ্লাটগুলোকেও কেমন উজ্জীবিত মনে হচ্ছে।
সন্তানদের সাফল্যে পিতামাতারা যেভাবে আনন্দীত হোন কিসমত আলীর মুখ দেখে তেমনটা মনে হলো না।
—কি? তুমি খুশি হওনি?
—হ্যাঁ অনেক খুশি হয়েছি বাবা।
—-আগামী রবিবার ফ্লাইট।অফিস থেকে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি।ওখানে অনেকটা সময় থাকতে হবে।স্যার আমাকেই সিলেক্ট করেছেন।
কিসমত আলীর বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো কিন্তু চেহারায় তা প্রকাশ পেলো না।
—-ঠিক আছে যাও।নীলাদ্রির সাথে দেখা করো।
ওকে বলো এই ঈদটা যেন গ্রামে করে।সবাই কে নিয়ে যেন চলে আসে।
—ওকে বলবো।আমি আর দেরি করছি না বাবা।এখনি বেরোচ্ছি।ঢাকায় পৌছাতে আবার অনেক রাত হয়ে যাবে।ওখানেও অনেকটা কাজ আছে।
কিসমত আলী জানেন,থাকতে বললেও কোন লাভ হবে না।তবুও বললেন—
রাত করেই যাবে?
–যেতে হবে বাবা।বলেই সালাম করে বেরিয়ে পড়লো নিলয়।গাড়ি নিয়ে এসেছে,নিজেই ড্রাইভ করবে।তাই কিসমত আলীও বলে দিলেন
সাবধানে চালাইতে।
কিসমত সাহেবের ডাক্তার বন্ধু কিছুদিন পূর্বে আমেরিকা গিয়েছিল।কয়েক বোতল ব্রান্ডি নিয়ে এসেছেন কিসমত আলীর জন্য। আজ কয়েক গ্লাস গিলে নিলেন।অন্যদিনের তুলনায় আজ দু গ্লাস বেশিই খেলেন।পুরো শরীরটা চেয়ারের উপর ছেড়ে দিলেন।চোখ টলছে।
আজ অমাবস্যা।অনেকটা রাত হয়েছে।
এমন সময় সাধারণত শিয়ালের ডাকাডাকি শোনা যায়।কিন্ত আজ কোন শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে না।এমন কি গাছ থেকে পাতা ঝরারও কোন শব্দ নেই।ডাল থেকে ডালে যে পেঁচাটি নড়েচড়ে বসতো তারও আজ কোন সাড়া নেই।কিছুটা আশ্চর্য হলেন কিসমত আলী।
চারপাশ নিরব,ঝিঁঝিরা ঘুমিয়ে গেছে।বাইরে দু একটা জোনাকের ওড়াওড়ি।
হঠাৎ গেদুর কণ্ঠ শোনা গেল।
—না।স্যার ঘুমিয়ে আছেন।আপনী আগামীকাল সকালে আসুন।
কিসমত আলী চমকে গেলেন।
গেদু কে এসেছে?কে? কে?
ওপাশ থেকে কোন উত্তর এলো না।
কিসমত আলী নিজেই দরজা খুলে দিলেন।
বাইরে তাকালেন এবং চোখটা ডলা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কে আপনী?
—আমি ডাক্তার কুলসুম।আপনার বন্ধু ডাক্তার শফিক আমাকে পাঠালেন।
—-ও আচ্ছা।আসুন ভিতুরে আসুন।
কিসমত আলীর টাইমকন্যা জানিয়ে দিচ্ছেন
রাত দশটা।অথচ কিসমত আলী মেনে নিতে পারছেন না।উনি বলছেন এখন রাত দুটো।
আপনার হাতে ঘড়ি আছে? কিসমত সাহেব জানতে চাইলেন।
—জ্বী আছে,তবে ঘড়িটি নষ্ট।
—নষ্ট ঘড়ি হাতে রাখেন কেন?
—ঘড়িটা আমার খুব পছন্দের তাই।
কন্ঠটি কিসমত আলীর পরিচিত মনে হল।
কিন্তু কার তা নিশ্চিত হতে পারলেন না।
একঘণ্টা হয়ে গেল বিদ্যুৎ নেই।
কিসমত আলী ঘড়ির দিকে তাকালেন।
টাইমকন্যার নাভি বরাবর হাতির যে মাথাটা বসানো সেটা হলুদ থেকে নীল হয়ে গেছে।
ডান চোখটি ছিল ঘন্টার কাঁটা আর বাম চোখটি ছিল মিনিটের কাঁটা কিন্তু এখন তা উলটে গেছে।
যে শূরটি ছিল সেকেন্ডের কাঁটা সেটাও উলটো ঘুরছে এবং শূর জুড়ে যে সবুজ বাতি জ্বলত
সেখানে এখন ভয়ানক লাল জ্বলছে।
আর টাইমকন্যার দাঁত থেকে এক রকম আলো বেরোচ্ছে যা নির্ণয় করা যাচ্ছে না।
—আচ্ছা আপনার কি মনে হয় এখন রাত দশটা?
—না।
—তবে কি আমার ঘড়িটিও নষ্ট হয়ে গেল!
—আপনার ওটা কি সত্যি ঘড়ি?
আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।
—-হ্যাঁ এটা অনেক দামি ঘড়ি আর এটা তৈরি করতে অনেক ডলার খরচ হয়েছে।সময়ও লেগেছে দশ বছর।
—কি বলেন!
—হ্যাঁ।আপনী কি জন টেলরের ঘড়ি সম্পর্কে কিছু জানেন?
—-না।
—-কর্পাস কৃষ্টি কলেজে পড়তেন জনটেলর।
উনি উনার আবিষ্কৃত ঘড়িটি তাই কর্পাস কৃষ্টি কলেজকেই উপহার দিয়েছেন।
একবার আমরা তিন বন্ধু আমন্ত্রন পেলাম
এক সেমিনারে উপস্থিত থাকার জন্য।তখন ঘড়িটি দেখেছিলাম।আর আমরাও তিন বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমরাও একটি ঘড়ি বানাবো।ঘড়ির ডিজাইনটা আমারই করা।
—-ও আচ্ছা।তা ঐ পুতুলের নাভির মধ্যে হাতির মাথা,শুঁড় কেন?
—-এই শুঁড় সেকেন্ড এর খাজগুলো বসানোর কাজ করে।
—-ও আচ্ছা।তা ঘড়িটি কি দ্বারা চলে?
—ইলেক্ট্রিক মটর।প্রসঙ্গ পালটিয়ে কিসমত আলী বললেন–চা হবে?
—-হ্যাঁ মন্দ হয় না।
কেটলি থেকে ঢেলে যখন হাত বাড়িয়ে দিতে যাচ্ছিলেন তখন বিদ্যুৎ চমকালো।আর এতে
যতটুকু ডাক্তার কুলসুমের মুখ দেখা গেল
তাতে নিশ্চিত হতে পারলেন না কিসমত আলী।
চায়ে চুমুক দিয়ে কিসমত আলী বললেন—
ইদানীং আমার ঘুম কম হচ্ছে।স্লিপিং পিল খেয়েও কাজ হচ্ছে না।
—-আপনী কি কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত থাকেন?
কখনো কি দুঃখবোধ করেন?
বা কাউকে মনে করে বিষন্নতায় ভুগেন?
—ঠিক তেমন কিছু না।তবে আমার স্ত্রীকে খুব মিস করি।কয়েক মাস আগেও এ রকম মিস করতাম না।কারন তার সাথে মাঝেমাঝে গভীর রাতে কথা হতো।এখন আর কথা হয় না।এমন কি তিনি আর আসেন না।
—-আপনার কি ডায়াবেটিস,
আর্থ্রাইটিস, শ্বাসকষ্ট, ক্যানসার, স্ট্রোক, হূদেরাগ,
এ জাতীয় দীর্ঘমেয়াদি কোন রোগ আছে।
—-না।আমি এখনো অনেকটা ইয়াং এবং সম্পূর্ণ সুস্থ্য বোধ করি।কিন্তু ইদানীং ঘুম নিয়ে একটু চিন্তিত।কিন্তু এখন চিন্তা হচ্ছে আমার ঘড়িটি নিয়ে।
—আচ্ছা।আপনি শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করুণ।যেমনঃকাপড় ধোয়া,
বাগান পরিস্কার করা অঅথবা পুকুরে মাছ ধরা।
এক সপ্তাহ পর আমি আবার আসবো।
টাইমকন্যা আবারও সময় জানিয়ে দিচ্ছেন—
কিসমত সাহেব,এখন রাত তিনটা,জানালা বন্ধ করুণ।
কিসমত সাহেব জানালা বন্ধ করতে গেলেন কিন্তু বাতাসের তীব্রতায় তা করতে পারলেন না।
দশমিনিট ধরে গেদু ডাকাডাকি করছে কিন্তু
কিসমত আলির কোন সাড়া নেই।
টাইমকন্যাও কিসমত সাহেবকে ডেকে যাচ্ছেন
কিন্তু কিসমত সাহেবের সাড়া নেই।
অনেক ডাকাডাকির পর কিসমত সাহেবের ঘুম ভাঙল।উনি উঠেই দেখলেন টাইমকন্যা ডেকে যাচ্ছে।উনি সুইচ অফ করে দিলেন।বাইরে থেকেও ডাক শুনতে পাচ্ছেন।উনি টাইমকন্যার হাতে চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল।
গেদু ভিতুরে এসে দেখে স্যার উঠেছেন।
স্যার-বেলা কত হল দেখেছেন?
আপনী তো এত বেলা করে কখনো উঠেন না।
—আজ অনেক দিন পর ভাল ঘুম হলরে গেদু
কিসমত সাহেব হাই তুলে বললেন।
মা চা রেডি করেছে।আনবো?
—না।এখন আর চা নয়।নাস্তা খাবো।
একটু লাইব্রেরিতে যেতে হবে।ড্রাইভারকে বল
গাড়ি রেডি রাখতে।
ডাক্তার শফিক কে ফোন দিলেন।
—হ্যালো,
—হ্যাঁ,কেমন আছো?
তোমার ওখানে গতকাল গিয়েছিলাম।তুমি ব্যস্ত থাকাতে সাক্ষা করিনি। আচ্ছা,তোমার মেডিক্যাল কলেজে কি কুলসুম নামে কোন ডাক্তার আছেন?
—আমি খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি।তুমি কি আজ আসবে নাকি?
—-দেখি,সময় হয় কি না।
—-ওকে,আমি একটু ব্যস্ত আছি বন্ধু।পরে কথা বলছি।
কিসমত সাহেব বেরোনোর সময় খেয়াল করলেন গেদু তার পেটে চাপ দিয়ে বসে আছে।
—কি হয়েছে গেদু?
—-পেটে ব্যথা করছে।
—-বেশি ব্যথা হলে ফার্মেসী থেকে ঔষধ নিয়ে আসিস।
কিসমত সাহেবের গাড়ি নিয়ে লাইব্রেরীতে যেতে ঘন্টাখানেক সময় লাগলো।
এই এলাকাতে একটিই কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়।
এটির প্রতিষ্ঠাতাও কিসমত সাহেব।কিন্তু উনি তেমন এখানে আসেন না।যখন শ্যামলীর বাড়িতে থাকতেন বছরে দু একবার আসতেন।
উনি এলেই আগে লাইব্রেরীতে যাবেন।
বই পড়ার মানুষিকতা তৈরি করার জন্য লাইব্রেরী করেছেন।নিয়মিত বই কিনেও দিচ্ছেন তবুও লাইব্রেরীটিকে জমজমাট করে তুলতে পারেননি।
তেমন কাউকেও বই পড়ার জন্য লাইব্রেরীতে দেখা যায় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে কেউ বাড়িতে নিয়েও বই পড়ে না।
মাঝে মাঝে দু একজন আসে,পড়ার নামে আড্ডা দিয়েই চলে যায়।
আজ লাইব্রেরীতে প্রবেশ করেই বিস্মিত হলেন।
একটা মেয়ে শুধু পৃষ্টা উল্টাছে,
কিসমত সাহেব কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলেন।
—আপনার নাম কি?
মেয়েটি কিছুটা চমকে গেল।উঠে দাঁড়ালো।
কিসমত সাহেব লক্ষ্য করলেন মেয়েটির মন খারাপ।
—-কি বই পড়তে ভাল লাগছে না নাকি ভাল বউ খুঁজে পাচ্ছেন না?
—আসলে আজ কিছুই ভাল লাগছে না।
ভেবেছিলাম এখানে এলে ভাল লাগবে।
—আপনার নাম কি?
—-আমি ডাক্তার কুলসুম।শফিক মেডিক্যাল কলেজে পড়ছি।
কিসমত সাহেব একটু হলেও ধাক্কা খেলেন।
হেলোসিনেশন বিষয়টি নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন।
কিন্তু তার ভেতর সে রকম কোন লক্ষণ খুঁজে পেলেন না।
—কি নাম বললেন?
—কুলসুম।
—-ও আচ্ছা।শফিক আমার বন্ধু মানুষ।
এর মধ্যে প্রিন্সিপাল সাহেব এলেন।
–চলুন আমার রুমে।
কিসমত সাহেব প্রিন্সিপালের রুমে বসে আছেন।
কোন একটা বিষয় নিয়ে ভাবছেন।
নিরবতা ভেঙে বললেন—
স্যার,মেয়েটির লাশ পাওয়া গেছে।
কিসমত সাহেব মাথা নিচু করে ভাবছেন।
স্যার,স্যার কি শুনছেন?
–ও হ্যাঁ বলুন।
—মেয়েটির লাশ পাওয়া গেছে
—কোন মেয়েটি?
—-সেদিন যে মেয়েটির কথা বললাম
সেই মেয়েটির।মেয়েটির নাম কুলসুম।
আমাদের কলেজেরই প্রাক্তন ছাত্রী।ভর্তী হয়েছিল শফিক মেডিকেল কলেজে।
নবীন বরণ অনুষ্ঠানে এসেছিল।মেয়েটি গানও গাইতো খুব ভাল।
কিসমত সাহেব আবারও ভাবলেন।
আমি কি হেলোসিনেশনের সাথে আছি!
সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে বললেন–না।
–আচ্ছা,ওর বাবা-মা কি খবরটি পেয়েছেন?
—ওর বাবা-মা,দুজনই দেশের বাইরে।
লাশ ডোমঘরে নিয়ে গেছে।ওর বাবা-মায়ের সাথে যোগাযোগ এর চেষ্টা করা হচ্ছে।
কিসমত সাহেব কেন যেন উঠে দাঁড়ালেন।
এখানে থাকতে উনার একটুও ভাল লাগছে না।
লাইব্রেরীতে গেলেন কিন্তু ডাক্তার কুলসুম নামের মেয়েটিকে দেখলেন না।
ডাক্তার শফিককে ফোন দিলেন।শফিক জানালেন,কুলসুম নামের কোন মেয়ে উনার মেডিক্যালে নেই।
কিসমত সাহেব সরাসরি বাগানবাড়ি চলে এলেন।বসার রুমে ঢুকেই দেখতে পেলেন
লাইব্রেরীর সেই মেয়েটি।ডাক্তার কুলসুম।
গেদু কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
গেদুর মাকেও না।
আপনী এখানে?
—হ্যাঁ এলাম।উনি এবার লক্ষ্য করলেন।
মেয়েটিকে ঠিক নিলয়ের মায়ের মতো দেখা যাচ্ছে।নিলয়ের মা এই বয়সে ঠিক এমনটাই ছিলেন।কিসমত সাহেব।এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন।বাইরে কান্নার আওয়াজ হচ্ছে।
গেদুর মা কাঁদতে কাঁদতে আসছে।
কিসমত সাহেব বেরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন
কাঁদছো কেন? কি হয়েছে?
স্যার,গো গেদুর অবস্থা খুব খারাপ।
ওরে নাকি ইমার্জেন্সি ঢাকা নিয়া যাইতে অইব।
অনেক টাকাও নাকি লাগবো।
আমি এহন কি করমু।এত টেহা কই পাইমু।
—আচ্ছা,আচ্ছা তুমি কেঁদো না।আমি দেখছি কি করা যায়?
কিসমত সাহেব ঢাকা মেডিকেল কলেজে ফোন করে দিলেন আর ড্রাইভারকে বললে দিলেন গাড়ি নিয়ে গেদুর মায়ের সাথে যাওয়ার জন্য।
কিসমত সাহেব পুনরায় বসার ঘরে গেলেন।
ওখানে আর মেয়েটিকে দেখা গেলনা।
এবার কিসমত সাহেব নিশ্চিত হলেন,এটাই হেলোসিনেশন।
কিসমত সাহেব খুব সুন্দর দোতারা বাজাতে জানেন।দশ বছর হয়ে গেছে উনি দোতারাটা হাতে তুলেননি।আজ কি মনে করে যেন।
হাতে নিলেন।
একটা সুর উঠালেন।যে সুরটি তার ভিতরে চাপা ছিল।যা ভুলার জন্য তিনি সব সময় আনন্দে থাকার চেষ্টা করতেন।
কিসমত সাহেব আর একটা ব্রাণ্ডির বোতল বের করলেন।কোথা থেকে যেনো ভেসে এল গ্রামোফোনের—শুঁয়া উড়িল,উড়িল,উড়িল রে—-

অয়ন্ত ইমরুল। কবি। জন্ম ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের সাভার। প্রকাশিত বই: 'ছায়া সমুদ্র' (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৬), 'বুদ্ধের ভায়োলিন' (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৮), 'সাদা ধূলির দূরত্বে' (কাব্যগ্রন্থ, ২০২০), 'স্বৈর হাওয়ার হরিণী'  (কাব্যগ্রন্থ, ২০২০) এবং 'কিসমত আলী অথবা শূন্য' (গল্পগ্রন্থ, ২০২০)।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..