একটি খালি চেয়ার

ফারজানা নীলা
মুক্তগদ্য
Bengali
একটি খালি চেয়ার

আপনি আমাকে কী বিষয়ে জিজ্ঞেস করছেন যেন?

ও আচ্ছা হতাশা নিয়ে। আসলে আশা-হতাশা দুটোই একই লাগে এখন বুঝলেন। খুব বেশি উত্তেজনা বা আবেগ বা আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায় না আজকাল কিছুতেই।

জানেন আমি আজকাল কষ্টেরও কিছু পাই না। মানে ধরুন হৃদয় নিংড়ানো কষ্ট, দুমড়ে-মুচড়ে ফেলা যন্ত্রণা, আছে না কিছু যা মনে পড়লে হু হু করে কান্না আসে। পেটের ভেতর মোচড় দেয়। বুকটা খালি খালি লাগে। এমন কোনও অনুভূতি পাই না আজকাল।

এখন আবার ভেবে বসবেন না যে আমি খুব সুখের রাজ্যে আছি তাই কষ্ট যন্ত্রণা সব ভুলে গেছি। আবার যে সুখে নেই সেটাও বা বলি কী করে। কষ্ট তো পাচ্ছি না, তাই নাহ্!

তাহলে আমার এই অবস্থার ব্যাখ্যা কীভাবে দিবো বলুন তো? আপনার কাছে কি কোনও ব্যাখ্যা আছে?

আচ্ছা দেখি বুঝিয়ে বলতে পারি কীনা।

আমি দুঃখী মানুষ নই। কোনও কিছু না পাওয়া আমার জীবনে নেই। মানে এমন কিছুর অভাব নেই যা জীবনে খুব করে চেয়েছি কিন্তু পাই নি। বেঁচে থাকার জন্য যা যা লাগে, টাকা পয়সা ঘর গাড়ি স্বচ্ছতা আরাম আয়েশ সবই মোটামুটি পাচ্ছি। এই ধরুন মধ্যবিত্ত থেকে একটু উপরে।

এখন বলতে পারেন তাহলে কী নিয়ে আমার হতাশা? এটাই ভাবছেন তাই না? যে এই লোকের সবই আছে তাহলে কী নিয়ে সে কথা বলতে এসেছে?

হ্যাঁ আসলে আমি সেটাই জানতে এসেছি যে আমার মধ্যে কীসের হাহাকার কীসের হতাশা! সবকিছু সরলরেখার মত সোজা চলছে, তবু কেন ভেতরে আনন্দ নেই, বলতে পারেন? এই যে, সবকিছু পেয়েও সারাক্ষণ কী যেন একটা নেই নেই ভাব।

না না ভুল বলছি, নেই নেই ভাব নয় ঠিক। মানে পূর্ণতা ভাবটা পাই না। না ঠিক পূর্ণতাও নয়, এটা হচ্ছে এক ধরনের ‘কোনও কিছু ভাল না লাগা’।

আমার মনে হয় এই টার্মটাকে এইভাবেই ব্যাখ্যা করা যাবে ভালভাবে। আপনি তো পরিচিত  হবেন এই ব্যাপারটার সাথে। আমার মত নিশ্চয়ই আরও মানুষের সাথে আপনার পরিচয় আছে যাদের এই সমস্যা আছে।

হ্যাঁ যা বলছিলাম, আসলে আমি কোনও কিছু করেই তৃপ্তি পাই না। আবার বলতে পারেন তৃপ্তির অনুভূতি কেমন সেটাও জানা নেই। এই যে আমি রোজ অফিস করছি। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরি। এরপর আমি কী করি জানেন? টিভি দেখি। খাই, এরপর ঘুমিয়ে পড়ি।

এরপরের দিন একই রুটিন। সকালে উঠি অফিসে যাই, ঘরে ফিরি, খাই, টিভি দেখি আর ঘুমাই।

ছুটির দিনও প্রায় একই কাজ। শুধু অফিস যাওয়া ছাড়া। দেরি করে ঘুম থেকে উঠি, খাই, ঘরের কাজ করি, টিভি দেখা, খাওয়া আর ঘুম।

কোথায় ঘুরতে যাই কীনা জিজ্ঞেস করছেন?

না একদমই না। বন্ধু বান্ধবরা বলে এখানে সেখানে যেতে। কিন্তু আমার একদমই ইচ্ছে করে না কোথাও যেতে। একেবারেই না। কোনও কারণে বের হতে হবে জানলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। এমনকী মাঝে মাঝে বন্ধুদের ফোন আসলে কেঁপে উঠি ভয়ে। কারণ তাদের প্রতিবার মিথ্যা বলতে হয় বাহানা দিতে হয়, না যাওয়ার।

আড্ডা দিবো? ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠে। মানুষের ভিড়ে একদম যেতে ইচ্ছে করে না। কী মনে হয় জানেন? ওরা কথা বলবে আমি কী নিয়ে কথা বলব? আমার তো কিছু বলার নেই। আমি কারো সাথেই কিছু বলার মত পাই না। এমনকী আমার সঙ্গীর সাথেও কথা বলার মত কিছু পাই না। যদি কথা বলা রেকর্ড করা যেত তাহলে হয়ত বুঝতে পারতেন দিনে আমি কয়টা শব্দ উচ্চারণ করি।

অথচ আমিই আবার চিন্তা করি এই জায়গায় যাব সেই জায়গায় যাব। এটা দেখবো সেটা দেখবো। বা যখন বন্ধুদের বেড়ানোর ছবি দেখি, তখন আবার মনখারাপ হয়। কিন্তু আমার যাওয়া হয় না কোথাও। যাওয়ার যে একটা তাগিদ সেটাও আমার অনুভূত হয় না।

জানেন একবার কী হয়েছে, আমি অফিস থেকে এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে শুধুমাত্র বাসায় বসে ছিলাম। মানুষ ছুটি নেয় বেড়াতে যাওয়ার জন্য, বা কোনও উৎসবের জন্য। কিন্তু আমি ছুটি নিই বাসায় বসে থাকার জন্য। একই সোফায়, একই বিছানায় একই টিভি সেটের সামনে বসে থাকতে পারি আমি, দিনেরপরদিন। এটাই আমার বিনোদন হয়ে গেছে এখন। আমার যে বিরক্ত লাগে না তাও না। বিরক্ত লাগে। বসে থাকতে থাকতে অসহ্য লাগে। ইচ্ছে করে এখনই দৌড় দিই। কিন্তু ইচ্ছে ইচ্ছের জায়গায়ই পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় এই বিরক্ত হওয়াটাও এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

বন্ধুদের ফোন আসলেও ধরি না। এখন আর ফোনও আসে না। কে আপনাকে বার বার ফোন করবে যদি আপনি না ধরেন।

বলতে গেলে এখন আমার কোন বন্ধুও নেই। আপনি যদি এখন কোনও বন্ধুর কথা বলতে বলেন তাহলে আমি বলতে পারবো না। কারণ আমার কোনো বন্ধু নাম মনে নেই।

আমার প্রিয় কাজ কী জানতে চান? আমার কোনো প্রিয় কাজ আছে বলে মনে হয় না। একসময় ছিল। কানে হেডফোন গুজে প্রকৃতির মাঝে হেঁটে যাওয়া, আমার একটা প্রিয় কাজ ছিল। এটা তখন আমার কাছে টনিকের মতো কাজ করত। এখন এটা করতেও কোনোরকম আগ্রহ পাই না।

প্রতিদিন ঘুম ভাঙার পরে, সবার আগে কী মনে হয় জানেন?

কিছুই না। এই যে কিছু মনে হয় না এতে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়। প্রতিদিন। প্রতিসকালে। ঘুম ভাঙার পরে চোখ খুলে আগে কিছুক্ষণ জানালার দিকে তাকিয়ে থাকি। জানলা দিয়ে খানিকটা আকাশ অবশ্য দেখা যায়। এরপর তলপেটে চাপ পড়লে চোখ ফিরিয়ে বাথরুমে যাই।

আরও ব্যাখ্যা করে বলার দরকার আছে?

আছে না,  আচ্ছা তাহলে বলি, একসময় আমার বৃষ্টি অনেক ভাল লাগত। বৃষ্টি হলে আমি ঝাঁপিয়ে পড়তাম। এই তো কয়েক বছর আগেও আমি নিয়ম করে বৃষ্টিতে ভিজেছি। এখন অফিসের জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখা গেলে ভাবি, ছুটির দিনে বৃষ্টি হলে ভিজবো।

ছুটির দিনেও বৃষ্টি হয় তখন আমি আরও একটি অজুহাত খুঁজি। হয়ত ভাবি এইমাত্র গোসল করেছি, এখন ভেজা ঠিক হবে না। এখন মাত্র লোশন লাগালাম এখনই ভিজবো? ছাদ বন্ধ,  থাক; না ভিজি আবার জামা পালটাতে হবে।

বুঝতে পারছেন আমার এমন আর কী কী অজুহাত?

কী বলবেন এখন আমাকে? অলস, তাই না?

হয়ত। আসলেই অলস কীনা জানার জন্যই এখানে আসা। এই যে এভাবেই জীবনটা কেটে যাচ্ছে কোনওরকম চরম অনুভূতি ছাড়া সেটা কি ঠিক?

কী বললেন? কোনও ব্যর্থ প্রেম ছিল কিনা?

তা সে একটা ছিল। তবে সেটা নিয়ে এখন আর কোনও কষ্ট নেই।

মিথ্যে বলছি ভাবছেন? না না একদমই মিথ্যে বলছি না। প্রথম কয়েকবছর যন্ত্রণায় কেটেছে কথাটা ঠিক, কিন্তু এখন তাকে আমার ভাল করে মনেও নেই।

এমনকী তাকে ঘিরে যা যা পাগলামি করেছি, রাগে-অভিমানে-কষ্টে; সেগুলো মনে পড়লে এখন খুব হাসি পায়। ভাবি কী পাগলটাই না ছিলাম একসময়!

আবার মাঝে মাঝে মনে হয়, সেটাই মনে হয় ভাল ছিল। একটা অনুভূতি তো তীব্রভাবে অনুভব করতে পারতাম। হোক সেটা কষ্ট, না পাওয়ার বেদনা। কিন্তু গভীরভাবে হৃদয়-শরীর-জুড়ে অনুভব করতাম সে অনুভূতি।

তখন অবস্থা এমন ছিল, যেকোনো দুঃখী গান শুনলেই আবেগ জেগে উঠত ভেতরে। থেকে থেকে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠত। তাকে দেখলেই চোখে মুখে আনন্দের ঝলকানি দেখা দিত। থর থর করে শরীর কাঁপত।

এখন কোনও গানেই আমি আবেগ খুঁজে পাই না। কাউকে দেখলে বুকে মোচড় লাগে না। কেউ ছেড়ে যাবে এমন কোন ভয়ও কাজ করে না।

ভাবছেন আমার বর্তমান সঙ্গীর কথা? তাকে ভালবাসি কীনা?

এইতো ভুল বুঝতে শুরু করলেন। আমি আমার সঙ্গীকে ভালবাসি। সেও আমাকে ভালবাসে। আমরা একে অপরের সাথে সুখী। এতে কোনও সন্দেহ নেই। চাইলে আপনি তাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। তার আগে যে ছিল তার সাথে আমার একটা  ব্যর্থতার সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে বলেই তো অন্যজনকে ভালবাসতে পেরেছি। আমি তো আগেই  বলেছি, আমি একজন সুখী মানুষ।

তাহলে আমার সমস্যা কোথায়, এটাই তো আপনার প্রশ্ন?

আসলে সমস্যা আমি নিজেও খুঁজে পাচ্ছি না। শুধু জানি আর বুঝি আমি ঠিকঠাক কোনও অনুভূতিই অনুভব করতে পারছি না। একটা তীব্র সুখের অনুভূতি কেমন হয় আমি ভুলে গেছি। অথবা বুক ফাটা কান্না কেমন হয়?

মাঝে মাঝে মনে হয়, এইভাবে আমার বাকিটা জীবন কেটে যাবে। সকাল নয়টায় বের হবো, ৫টা পর্যন্ত কাজ করবো, ৬টায় বাসায় ফিরবো, তারপর টিভি দেখবো, ঘুমাবো। একই জিনিস তার পরের দিন এবং তারও পরের দিন করবো। এরপর একদিন হুট করে মরে যাব। মরে যাওয়ার সময় আমি তীব্র হতাশায় থাকব এই ভেবে, যে এক জীবনে কিছুই করা হলো না।

ছোটবেলায় আমার শিশুপার্কে যাওয়ার খুব শখ হতো। বাবার ছুটির দিনে প্রতিবার আমি চাইতাম বাবা যেন আমাকে শিশুপার্কে নিয়ে যায়। এক শুক্রবার আমি আমার সবচেয়ে ভাল জামা পরে রেডি হয়ে বসেছিলাম বাবা বিকেলে নিয়ে যাবে বলে। আমাকে নিয়েও গেলো। কিন্তু শিশু পার্কে না। এমনিতে বাইরে একটু হাঁটিয়ে নিয়ে আসল। আমি বার বার জিজ্ঞেস করছিলাম “আমাকে শিশুপার্কে নিবে না?”

বড় হওয়ার পর অবশ্য বুঝেছিলাম শিশুপার্কে যেতে, রাইড নিতে টাকা লাগে। প্রতি শুক্রবার আমাকে শিশুপার্কে নিয়ে যাওয়ার মত টাকা বাবার ছিল না। যেটা মধ্যবিত্ত পরিবারে স্বাভাবিক ব্যাপার।

জানেন, সেদিন আমার ভীষণ মনখারাপ হয়েছিল। বাবার হাত ধরে হাটঁছিলাম আর কান্না চেপে রাখছিলাম। আমি চাই এখন ঠিক ওইরকম মন খারাপ হোক। কান্না চেপে রাখার মত কষ্ট।

আমার জীবনটাকে কী জীবন বলে মনে হয় বলুন তো? মানুষের জীবন এভাবেই কাটার জন্য সৃষ্টি হয়? এটাই কি জীবন? আমি ঠিক এভাবে মরতে চাই না। আবার এভাবে বাঁচতেও চাই না। মরার আগে আমি বুকভরে শ্বাস নিয়ে যেন বলতে পারি একটা চমৎকার জীবন কাটিয়েছি।

এটা একটা রোগ তাই না? কোনও ওষুধ হবে এর? আপনাদের ডাক্তারি বিদ্যায় কী বলে এটাকে? সে যাইই বলুন আমাকে এর চিকিৎসা দিন।

আমি দিন শেষ করতে চাই চমৎকার রাত কাটানোর জন্য। ঘুম ভেঙ্গে দীর্ঘশ্বাস নয়, হাসি দিতে চাই। কাউকে দেখলে বুকের ভেতরে একটা বিট যেন মিস হয়। অথবা গভীর রাতে যখন ঘুম ভাঙবে যেন খুব কান্না পায়।

ঠিকঠাক বৃষ্টিতে ভিজতে চাই। বৃষ্টির জল যেন সারা গায়ের মনের ধুলোবালি মুছে দেয়।

একটা সবুজ পাহাড় দেখার জন্য যেন ছুটে যেতে পারি, যেভাবে প্রেমিকা হন্য হয়ে ছুটে যায় প্রেমিকের কাছে।

আমি ছুটির জন্য অপেক্ষা করতে চাই শুধু ঘরে বসে থাকার জন্য নয়। ছুটির অপেক্ষা করতে চাই দূরেকোথাও যাওয়ার জন্য। অজানা কোথাও, সমুদ্রে বা পাহাড়ে বা কোনও নির্জন জঙ্গলে। অন্তত যাওয়ার ইচ্ছে তৈরি হোক।

একটা নীল জলের সমুদ্রের সামনে বসে আমি ইচ্ছেমতো সৌন্দর্য দেখব। বালিতে গড়াবো। পানিতে ডুবে যাব। পাহাড়ের চুড়ায় উঠে মেঘ ধরতে চাইবো। কিছু না হোক, বিছানায় শুয়ে আকাশ দেখতে দেখতে চোখ যেন বুজে আসে। রেলিঙে দাঁড়ানো একটা চড়ুই দেখলে যেন মনটা খুশিতে ভরে যায়। অথবা বারান্দার মেঝুতে একফালি চাঁদের আলো ঢুকলে যেন সে আলোতে বসে ধ্যান করতে পারি।

প্রানখুলে হাসবো। ইচ্ছে মত নাচব। চোখ বুজে কানে হেডফোন দিয়ে মধুর কোন গান শুনব। খুব বেদনার কোনও গানে চোখ দিয়ে পানি পড়বে নিজের অজান্তে। আবার নাচের গানে নিজ থেকেই কোমর দুলে উঠবে।

দাঁড়ান দাঁড়ান, খুঁজে পেয়েছি। শব্দটা উৎফুল্লতা হবে। আমি উৎফুল্লতা হারিয়ে ফেলেছি। হ্যাঁ এটা খুঁজে পেতে হবে। বলেন কী করলে ফিরে পাওয়া যাবে?

ওমা একী! কোথায় আপনি? চেয়ারটা খালি কেন?

এতক্ষণ আপনি আমার সামনেই না ছিলেন? তাহলে এতক্ষণ ধরে কার সাথে বকবক করছি? কেউ নেই কেন? কেউ কি তবে শোনে নি আমার কথা?

এই যে শুনছেন? কেউ কি আছেন?

 

সম্পাদনা: শাহানাজ ইয়াসমিন

ফারজানা নীলা। গল্পকার, নারী ও প্রাণি সংরক্ষণ অধিকারকর্মী।  

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ