পানীয়। এই থেকে পানি এসেছে। জলপানি পেত আগের দিনে মেধাবী শিক্ষার্থীরা। জলপানি কথাটির আভিধানিক অর্থ বৃত্তি। সোজা করে বলতে গেলে স্কলারশিপ। ওই নামে এখন বলছি। ওকেই আগে জলপানি বলত। জলখাবার বলেও একটা কথা আছে। সেটা শুধু জল+খাবার নয়। ওর মানে হল মুড়ি, চিঁড়ে, খই, মুড়কি, গুড়, রুটি, ইত্যাদি মূল খাবারের ঘণ্টা তিন চার আগে একটু হালকা খাওয়া। সোজা করে আমরা টিফিন বলে চিনি। বাংলা ছড়ায় পড়েছি, জলপান করতে দেব শালিধানের চিঁড়ে, শালিধানের চিঁড়ে নয় রে, বিন্নিধানের খই, মোটা মোটা সবরি কলা, কাগমারির দই। সুকুমার রায়ের অবাক জলপান নাটকটা ছোটবেলায় কে না পড়েছে! জলপাই ফলের সূত্রে শুকনো পণ্ডিতীর বিরুদ্ধে চমৎকার একটি লেখা। মজার ব্যাপার, অবাক জলপান নামে একটা জলখাবার ফেরি করত বিকেলে। শহর কলকাতা আর লাগোয়া জায়গায়। কিন্তু, পানীয় কথাটা বেশ পরিচিত। সেই শব্দ থেকে পানি কথাটা তৈরি হয়। তরল পদার্থ ও গ্যাসীয় পদার্থ, রীতিমতো পদার্থবিজ্ঞান চর্চার প্রথম দিকে একরকম ভাবার প্রবণতা ছিল। বলা হত ফ্লুইড। যা কিনা ফ্লো করে। তো জল ও ধোঁয়া দুটোই ফ্লুইড। ওই থেকে ধূমপান কথাটা তৈরি হতে পারে। নইলে তরল জিনিস পান করি, তাতে প্রশ্ন উঠতে পারে, হার্ড ড্রিঙ্কস, সফট ড্রিঙ্কস এল কি করে? চা পান বলি, কিন্তু চা কফির অনুষঙ্গে ড্রিঙ্ক কথাটা ইংরেজি ভাষায় ব্যবহার করি না। স্পিরিট জিনিসটা কেমিস্ট সাহেবের কাছে তরল। সাহেবী গুরু পুরুতরা আত্মা, যা চোখে দেখা যায় না, স্পর্শ করা যায় না, তাকে বলে দিলেন স্পিরিট। অধ্যাত্মবাদকে বললেন স্পিরিচুয়ালিজম্। কোনো বক্তব্যের সারবস্তু অর্থে স্পিরিট কথার ব্যবহার আছে। অনুপ্রেরণা অর্থেও। যে বক্তৃতা শ্রোতাদের খুব উজ্জীবিত করে দেয়, তার সেই মাতন যোগ্যতা বোঝাতে স্পিরিট কথার প্রয়োগ রয়েছে।
বিদ্যুৎ যে অতি পরমাণু ইলেকট্রনের স্রোত, তা বোঝার আগে তাকে তরল গোত্রের ভাবা হত। ভিট্রিয়াস আর রেজিনাস। পরে চিনল পজিটিভ আর নেগেটিভ করে।
তরল অর্থে লিকুইড বুঝি। দুধ যাঁর সহ্য হয় না, তিনি সকলকে লিকার চা খাবার পরামর্শ দেন। লিকার বলতে আবার কারণবারিও বোঝানো চলে। অ্যামোনিয়া নামে গ্যাসটা জলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে ভারি আগ্রহী। খুব মিশতে পারে। খুব মিশে লাইকার অ্যামোনিয়া তৈরি হয়। পেট্রোলিয়াম গ্যাসকে কায়দা করে চাপ দিয়ে লিকুইফায়েড হয়।
সাধারণ ভাবে জল তৃষ্ণা মেটায়, তবে সব জল নয়। ছোটবেলায় পড়েছি, উষ্ণ জলে তৃষ্ণা মেটে না। চমৎকার জলকে সুপেয় জল বলে। জলের ছোঁয়ায় বীজের অঙ্কুরোদ্গম হয়। তবে সব জল জল নয়। ভারি জল নামে একটি জিনিস আছে। যে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন মৌলের রাসায়নিক সংযোগে জল হয়, তার হাইড্রোজেন মৌলের আইসোটোপ যদি ডয়টেরিয়াম বা ট্রিটিয়াম হয়, তাহলে তাকে ভারি জল বলতে হবে। তা পান করা চলবে না। তাতে পারমাণবিক পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজ চলে। দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু যদি দুটি অক্সিজেনের পরমাণুকে নিয়ে জোট বাঁধে, তাহলে যা দাঁড়ায়, তা জল নয়। হাইড্রোজেন পেরক্সাইড। জলে কিছু অক্সিজেন মিশে থাকে। মাছ তার শ্বাস যন্ত্র দিয়ে বিশেষ কায়দায় সেই অক্সিজেন ছেঁকে নিয়ে জীবন চালায়। ডাঙার অক্সিজেনে তার চলে না। সেই প্রয়োজন মেটাতে কই মাছের আলাদা শ্বাস যন্ত্র থাকে। ওইজন্য বলে কইমাছের জান। কাটার পর কড়ায় ভাজা ভাজা হতে হতেও সে জীবনের স্বপ্ন দ্যাখে। একমাত্র মেয়েদের সাথে তার তুলনা চলে।
জলকে অ্যাকোয়া বলা হয়, এ খবরটা আমায় দিয়েছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। কথামৃত পড়তে গিয়ে জেনে ফেলেছি। পরে বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে নবম শ্রেণীতে অ্যাকোয়া ফর্টিস কথা পেয়ে গেলাম নাইট্রিক অ্যাসিডের সূত্রে। দুর্গের ভিতর রাজা থাকেন। অ্যাকোয়া রিজিয়া সেই অ্যাসিডের রাজা। দুই রকম অ্যাসিড মিশিয়ে সোনা গলানোর কার্যকর জিনিস। অ্যাকোয়া টাইকোটিস নামে জোয়ানের আরক বানাত বেঙ্গল কেমিক্যাল। পেটরোগা বাঙালির পরম বন্ধু। তেলে জলে মিশ খায় না জানি, তবু একটা অ্যাসিডকে চেনানো হল অয়েল অফ ভিট্রিয়ল নামে। সালফিউরিক অ্যাসিডের ঘনত্ব বোঝাতে তাতে কত শতাংশ জল আছে জানতে হত। সালফিউরিক অ্যাসিডের চাইতে আরো গাঢ় আর কড়া জিনিস ওলিয়াম। ওতে তেলের কথাটা বলা আছে। পাথরের ভিতর থেকে তেলের মতো চটচটে জিনিস পেলে মানুষ তাকে নাম দিল পেট্রোলিয়াম। তার থেকে একটা গোটা পেট্রোরসায়ন শাখা খুলল। পেট্রোলিয়াম জাত জিনিসের কার্যকারিতা দেখে বলল তরল সোনা। শুরু হল পেট্রোরাজনীতি। ইরান ইরাক কুয়েত কাতারের মানুষ তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন।
কঠিন অভাব বোঝাতে বাঙালি কবি লিখেছিলেন তৈল বিলা কৈলুঁ স্নান, করিলুঁ উদক পান। উদক মানে জল। সাধারণ ভাবে তেলে জলে মিশ খেত না। আলট্রা সাউণ্ড দিয়ে তেলে জলে মিশিয়ে দিলেন বিজ্ঞানী। সাধারণ মানুষ তেলা মাথায় তেল দিত। যার উপর রাগ হত, তাকে জল অচল করত। জল অনেক কল্পনায় মিশত। পরমহংসকে দুধে জলে মিশিয়ে দিলে সে জল থেকে দুধকে আলাদা করে নিতে পারত। জলকে বলত অপ্। অপ্সরী হুরী পরীর স্বপ্ন দেখত মানুষ। মেয়েদের সাথে জলের তুলনা চলত। জলের মতো করে মেয়েদের পাত্রস্থ করা হত। আকাশের বুকে গাঙ দেখতে পেত মানুষ। আকাশগঙ্গা বলে চিনল নিজেদের গ্যালাকসিকে। পাশের গ্যালাকসিকে বলল অ্যাণ্ড্রোমীডা। কবিরা গান বাঁধত, কন্যা, তুমি হও রে গহীন গাঙ, আমি ডুইব্যা মরি।
জলের ধারে গড়ে উঠত সভ্যতা। মিশরে মেসোপটেমিয়ায়। ভলগা থেকে গঙ্গার ধারায় সভ্যতা বয়ে এসেছে। টেমস, রাইন, পো, মস্কোভা গড়েছে শহর। বরুণা আর অসি মিলে বারাণসী। দয়া নদীতে রক্তের বন্যা দেখে চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকের জন্ম হয়েছে। নীল নদের বন্যা মানুষকে জ্যামিতি শিখিয়েছে। নদীকে বলত দরিয়া। আমুদরিয়া শিরদরিয়া ছিল বিখ্যাত নদী। নদীকে সিন্ধু বলতেও অসুবিধা হত না। জল সরে গেলে সভ্যতা হয়ে যেত মহেঞ্জোদড়ো, মৃতের স্তুপ।
কেমিস্টের ল্যাবরেটরিতে কোনো কোনো পদার্থ থাকত যারা জলাকর্ষী। বাতাস থেকে জলীয় বাষ্প টেনে নিয়ে প্রভু নষ্ট হয়ে যাই। তাদের শুকনো করার জন্য নিরুদন প্রক্রিয়া ছিল। সালফিউরিক অ্যাসিডের পাত্রে জল ঢালা যেত না বিস্ফোরণের ভয়ে। জলের উপর থেকে ফোঁটা ফোঁটা সালফিউরিক অ্যাসিড মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি হত।
গুলিয়ে দেওয়া এবং ঘুলিয়ে দেওয়া ছিল বোদ্ধাদের কাজ। দ্রাবক এবং দ্রবণ কাজে লাগত। তরলে তরলে মিশে দ্রবণ হত। তারপর কোকাকোলার স্বাদ পেয়ে জানলাম তরলে ও গ্যাসেও দ্রবণ হয়। চর্ব্য চোষ্য লেহ্য আহারের পরে কোনো কোনো বাঙালি পেয় জিনিসটা দরকার করত। চর্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয় না হলে ফুল কোর্স খানা হত না। মদ্যপানের সুযোগ যাঁদের থাকত না, তাঁরা বিজলি গ্রিল খেতেন। দ্রবণ তৈরি হত গ্যাসে গ্যাসেও। কঠিনে কঠিনেও। তারপর প্রেমে পড়ার দিনগুলো এল। অনেকেই হাবুডুবু খেতেন। দেবদাস হতেন অল্প কেউ কেউ। দ্রবময়ীরা দোলাতেন এবং ভোলাতেন।
বেলা যে পড়ে এল জলকে চল। নীল যমুনায় জলের ধারে কদমতলে কেষ্ট ঠাকুর আছে। রাধার হিয়ায় টান দেয় সে, রাধার চোখে নাচে। জল নিয়ে পুরাণে ভাগবতে কত কথা। সরস্বতী ছিল নদী। আবার সরস্বতী দেবীও। দেবী সরস্বতী কৃষ্ণের কণ্ঠ থেকে উদ্ভূত হয়ে ছিলেন। প্রকাশিত হয়েই তিনি স্বয়ং কৃষ্ণকে কামনা করেন। যে কন্যাকে সৃজন করেছেন, তার সাথে বিহার করতে কৃষ্ণ রাজি হন কি করে। সরস্বতীকে কৃষ্ণ পরামর্শ দিলেন ব্রহ্মার সাথে লীলা করতে। ব্রহ্মা ছিলেন পদ্মের উপরে। শ্বেতকমলটি বাগিয়ে নিলেন সরস্বতী। বুদ্ধিজীবীরা জলধারার মতো। নিম্নগামী এবং বহুগামী। যখন যে ক্ষমতায়, তখন তার ভজনায় সিদ্ধহস্ত।
পৃথিবীর তিন ভাগ জল, একভাগ স্থল মুখস্থ করাতে চান পণ্ডিত। বিজ্ঞানী বলেন পৃথিবী পৃষ্ঠের তিন ভাগ জল, কিন্তু সুপেয় জল তার মাত্র দুই শতাংশ। তাই জল নষ্ট কোরো না। জলাভূমি বুজিয়ে বাড়ি বানায় মাটি মাফিয়া। শহর ডোবে জল সরতে না পেয়ে। যে শহর সামান্য বৃষ্টি হলে ডোবে, সেখানে আগুন নেভানোর জল পাওয়া দুর্ঘট। ছোট ছোট নদী আর খালের জন্য যে শহর ভেনিস অথবা আমস্টারডাম হতে পারত, তার খাল শুধু পথ নামে স্মৃতি টুকু থাক হয়ে রয়ে যায়।গড়পাড়, আপার সার্কুলার রোড বা ক্রীক রো হয়ে ইতিহাস বিলাসীর কলমে নড়েচড়ে ওঠে।
জলের দামে সরকারি কোম্পানি বিক্রি করে ওয়েলফেয়ার স্টেট। নীরজ রহস্যে ব্যাঙ্কের ভরাডুবি হয়। ভক্তের বোঝা ভগবান বয়, আর প্রডিগ্যাল সন ইয়েস ব্যাঙ্কের বোঝা স্টেট ব্যাঙ্ক বয়।
সাগর যাঁহার বন্দনা রচে শত তরঙ্গ ভঙ্গে , সেই নদীমাতৃক দেশের লোক, বোতলের জল কিনে খায়, তুলো আর আখ চাষ করতে গিয়ে গ্যালন গালন জল মাটি থেকে তুলে ফেলে জমিতে মরুভূমি তৈরি করে।
জল সোজা জিনিস নয়। বিশ্বের বড়লোক দেশ গরিব দেশে বিজনেস করে, কিন্তু গরিবের কষ্টে তাদের আঙুলের ফাঁক দিয়ে জল গলে না। বড়লোক দেশের নাগরিকদের মধ্যে যারা কালো মানুষ, তাদেরকে গলায় পা তুলে বিনা বিচারে মারা যায়। কিন্তু প্রতিবাদ হয়। এ যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে কে?
পুরাণকার বলেছেন সৃষ্টির আদিতে ছিল জল। সেই জলে অনন্ত শয্যায় ছিলেন বিষ্ণু। তাঁর নাভি থেকে একটি পদ্ম ফুটে উঠল। পদ্মে আসীন রইলেন ব্রহ্মা। তাঁর কর্ণমল থেকে জন্ম নিয়ে মধু আর কৈটভ, দুই দৈত্য খুব মারামারি লাগিয়ে দিল। বিশ্বজোড়া জলের এই জগৎটাকে বলে হাইড্রোস্ফিয়ার। জল তৈরিতে দুটি গ্যাসের যৌগিক প্রক্রিয়া। হাইড্রোজেন খুব দাহ্য। আর অক্সিজেন ভারি দহন সহায়ক। একজন পোড়ে, অন্যজন পোড়ায়। একেবারে মধু কৈটভ সম্পর্ক।
কার্যকারণ সম্পর্ক কথাটা সভ্য মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণে রাখে। বাস্তব জগতে ওটা কাজে লাগে না। সেখানে কারণবারির প্রভাব। তরল পদার্থ যে পাত্রে রাখো, তার আকার ধরে। যুদ্ধ পাকাতে চাইলে যুদ্ধোন্মাদরা কোনো একটা ছুতো চায়। মদ কথাটির সঙ্গে পঞ্চ ম-কার ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। অশান্তি সৃষ্টি করতে ইচ্ছে করলে যুদ্ধ পাগলরা দেশের মানুষকে মদ গেলান। দেশপ্রেমের মদ, জাতীয়তাবাদের মদ। মদ ছাড়া যুদ্ধ হয় না।
শব্দ তৈরি হয়ে ওঠা, তার ব্যবহারবিধি তৈরি হওয়া এক আশ্চর্য বিষয়। রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনীর মতো আকর্ষণীয়।