প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
শেষ পর্যন্ত ডাক্তার বাবু যে আশঙ্কাটা করেছিলেন সত্যবাবুর রিপোর্ট এসেছে সেটাই। ক্যান্সার। রেক্টামে ক্যানসার, ফার্স্ট স্টেজ। তিনি ভেবে পাচ্ছেন না, কীকরে তার বন্ধু সত্যকে কথাটা বলবেন! কিন্তু বলতে তো হবেই! আশার কথা এটাই যে, কেসটা একদম প্রাথমিক স্তরে। সঠিক চিকিৎসা হলে সেরে উঠবে এবং আবার ও সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে।
এদিকে সত্যবাবুর নেশা সবকিছু খুঁটিয়ে জানা। কী,কেন,কীভাবে তা জানাই সত্যবাবুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তিনি অনুসন্ধান করতে ভালোবাসেন।ক্যান্সার জানার পরই শুরু করলেন অনুসন্ধান। কীকরে তার শরীরে এই মারণব্যাধি বাসা বাঁধলো!অনুসন্ধানে তিনি জানতে পারলেন, পশুদের শরীরে কোষের বিভাজন হয়ে ফোঁড়ার মতো একধরনের লাম্প বা মাংসপিণ্ড দেখা যায়।এখন খোলা বাজারে সেসব পশুর মাংস বিক্রি হয় যত্রতত্র। অথচ, আগে ব্লকের পশু চিকিৎসক সেসব পশু খুঁটিয়ে দেখে সার্টিফিকেট দিয়ে চিহ্নিত করে দিতেন, সেগুলি খাওয়ার যোগ্য বলে। তা দেখে পৌরসভাগুলিতেও সেইসব পশুদের শরীরে ছাপ দিয়ে জনগণকে জানিয়ে দেওয়া হত,এগুলির মাংস খাওয়া যায়।
কিন্তু হায়!এখন আর সেদিন নেই।মানুষ মানুষের কথা চিন্তা করে না।নাহলে কি বিরিয়ানির ভেতর ভাগাড়ের মাংস দিতে পারত!বেলাগাম, নিয়ন্ত্রণহীন লুটেপুটে খাওয়ার খোলা বাজারে এখন যে যা আনছে তা কোনোরকম পরীক্ষানিরীক্ষা না করে, তাই কেটে বিক্রি করা হচ্ছে খুল্লমখুল্লা! তার থেকে রোস্টেড বা মটন তন্দুরি,শিককাবাব ও আরও কত কত মশলাদার মুখরোচক খাবার তৈরি হচ্ছে।এর থেকে কী সত্য বাবুর শরীরে ক্যান্সার রোগের জীবাণু আসতে পারে!
কিন্তু সত্যবাবু সাধারণত কোনও পশুর মাংস খেতে ভালোবাসেন না। ভোজবাড়িতেও তা এড়িয়ে চলেন।তবে,একেবারেই যে চেখে দেখেননি তাও না।হুইস্কি তার প্রিয় পানীয়। পরিমিত পান করার অভ্যেস তার আছে। সেখানে নিরুপায় হয়ে কয়েকবার মটন টিক্কা বা শিককাবাব, বা তন্দুরি চাটে খেয়েছেন। তবে, সেখান থেকেই কী!
কীভাবে এলো তার শরীরে এই জীবাণু! একি তার জিনে আছে! নিজের আত্মীয়, বাবার বাড়ি,মামার বাড়ি সব জায়গায় খোঁজ নিয়ে তিনি কোথাও সেরকম কোনও তথ্য পেলেন না।তাদের কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন,সেরকম কোনও তথ্য কেউ দিতে পারেনি।
তার মনের মধ্যে খোঁজ চলতে চলতেই তিনি চলে গেলেন মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল ক্যান্সার হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসকরা জানান, না ভয়ের কিছু নেই, তিনি সেরে উঠবেন। খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ নির্ণয় হওয়ার জন্য তাদের চিকিৎসায় সুবিধা হয়েছে, সেকথাও তারা জানান।মুম্বাইয়ের হাসপাতালে অপারেশনের আগে-পরে তিনি ভাবতে থাকেন, কীকরে, কীকরে তার শরীরে এই রোগ আসতে পারে!মুম্বাইয়ের চিকিৎসকদের কাছেও তিনি জানার চেষ্টা করেন কথায় কথায়। তারা বলেন, সত্যবাবুর শরীরে যে-ধরনের ক্যান্সারের জীবাণু পাওয়া গেছে, তা কোনও খাবারের মধ্য দিয়েই আসার সম্ভাবনা।
মুম্বাই থেকে ফিরে সত্যবাবু যেসব খাবার খেয়েছেন তার উৎস সন্ধানে করতে করতে দেখলেন,মানুষের সব খাবারই প্রায় বিষ!মানুষ লাভের জন্য, সামান্য কটা টাকার জন্য মানুষের জীবনের কথা ভাবে না।তার বাড়ির কাছেই সস্তার যে আমের আচার পাঁচ কেজির প্লাস্টিকের জারে করে তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে দেওয়া হচ্ছে ট্যানারিতে ব্যবহার করার প্রিজারভেটিভ,রং করা হচ্ছে নানারকম কেমিক্যাল দিয়ে।যা নিয়মিত খেলে মানুষের ক্যান্সার হতে পারে।শাকসবজি সব পেস্টিসাইডের বিষে চুবিয়ে বাজারে আনা হচ্ছে। সেগুলি তাজা রাখার জন্য দেওয়া হচ্ছে নানারকমের কেমিক্যাল, রং। ফলের অবস্থাও তাই।নিয়মিত কার্বাইড খেতে খেতে মানুষ এখন নীলকন্ঠ হয়ে গেছে। পোলট্রিতে মুরগিগুলোকে দ্রুত বড় করে তোলার জন্য হরমোন বা অ্যান্টিবায়োটিক যা দেওয়া হচ্ছে তা নাকি গরম জলে ফোটানোর পরেও থেকে যাচ্ছে!সেগুলো থেকেও কী মানুষ নানারকম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে না!
এরকম অবস্থায় সত্যবাবু যখন সত্যানুসন্ধানে প্রায় ব্যর্থ হচ্ছেন, তখন একদিন তার পুরোনো বিজনেস পার্টনার খোঁজ নিতে এলেন, তিনি কেমন আছেন এখন তার হালহকিকতের সুরতহাল করাই ছিল তার উদ্দেশ্য।
বিজনেস পার্টনার হলেও সত্যবাবু তাকে একসময় নিজের ছোট ভাইয়ের মতোই ভালবেসেছেন। তার বাড়ি অনেক দূরে এক শহরের উপকণ্ঠে। শহরতলি বলা যেতে পারে।সেখানে মানুষ সস্তায় জমি কিনে ঘরবাড়ি, বাগান তৈরি করেছে। এখানের মানুষদের প্রায় সকলে নিম্নবিত্তের। রোজ ঝগড়াঝাটি, ঝুটঝামেলা নিত্যসঙ্গী।সেখানেই বড় হওয়া সত্য বাবুর এই প্রাক্তন পার্টনারটি একদিন কাজ খুঁজতে খুঁজতে এসে হাজির হয়েছিল সত্যবাবুর কাছে।ছেলেটি মেকানিকাল নিয়ে পলিটেকনিক পাশ করার পরও চাকরি পায়নি।প্রায় বছর পাঁচেক নানা ঘাটের জল খেয়ে সত্যবাবুর কাছে এলে,তিনি তাকে পরামর্শ দিলেন একটা কোম্পানি করার।যাদের কাজ হবে, ইলেকট্রিকের জন্য সাব স্টেশন তৈরি করা।সে সময় এই কাজের প্রচুর চাহিদা।দেশব্যাপী তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সাব স্টেশন। ছেলেটিকে সামনে রেখে তিনি থাকলেন পিছনে। তিনি নিজে একজন বি ই, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।কনসালট্যান্ট হিসেবে তার কাজের অভিজ্ঞতা প্রচুর।তিনিও তখন এরকমই কিছু একটা করার কথা ভাবছিলেন।তিনি ছেলেটিকে বললেন, ‘চলো,আমরা একটা কোম্পানি তৈরি করি। যার ফিফটি পার্সেন্ট শেয়ার তোমার, ফিফটি পার্সেন্ট শেয়ার আমার।ইনভেস্টমেন্ট সব আমার।তোমাকে সে ব্যাপারে ভাবতে হবে না।কারিগরি সহায়তা, যন্ত্রপাতি সব আমি বলে দেবো। আমি যেমনভাবে বলবো তুমি কাজটা ফিল্ডে দাঁড়িয়ে থেকে সেটাই ভালো ভাবে করবে।মনে রাখবে,এলাইনে কাজের কোয়ালিটি এন্ড সেফটি হল আসল কথা। সেখানে কোনও আপোষ করা যাবে না।’
ভালোই চলছিল কাজ।দু’বছরে তাদের কোম্পানি বেশ ভালো ব্যবসাও করে।কোম্পানির সুনামও ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সত্যবাবুর এই পার্টনারটি কাজ করলেও টাকাপয়সার হিসাবে প্রায়ই গোলমাল করে।পার্টনার তার একমাত্র বোনকে বিদেশে পাঠিয়ে ঝাড়া হাত-পা হতে চাইছিলো।ওর মেধাবী বোনের সন্দেহের দৃষ্টি থেকে সে বহুদূরে থাকতে চেয়ে, বোনকেই দূরে সরিয়ে দেয়।খুব দরদ ছিল ওর বাবার জন্য! সেদিক থেকে দেখলে সে এখন নিষ্কণ্টক।সংসারে তাকে সন্দেহ করার মত বা বোলনেওয়ালা কেউ নেই।
কোম্পানি থেকে সত্যবাবু বেরিয়ে গেলেও তার প্রাথমিক বিনিয়োগের টাকা তিনি এখনো সবটা ফেরত পাননি।সে নিয়ে, তার মনে ক্ষোভ নেই। পৃথিবীতে অন্তত একজন মানুষেরও যদি কিছু ভালো হয় তবে হোক না! টাকায় কী হবে!পৃথিবীতে কে আর টাকায় সুখী হয়েছে!
সত্যবাবুর মনে পড়ে,এই পার্টনারই তো তার বাড়ি থেকে দেশি মুরগি বাড়ি থেকে কেটে এনে, তাই দিয়ে, নিজে তৈরি করে শিককাবাব বা অন্যকিছু বানিয়ে খাওয়াতো হুইস্কির সঙ্গে।
নানান কথার পর সময়মতো সত্যবাবু ওকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের বাড়িতে এখনো দেশি মুরগি পালন করো কি?’
ছেলেটি বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ করি তো,ঐ নিজেদের জন্য,সামান্যই। জানেনই তো পোল্ট্রির মুরগি আমরা কেউ খাই না। কিন্তু এখন তো আপনার শরীর খারাপ,ওসব হবে না, তাই আনিনি।
কোম্পানি তৈরির আগে তিনি নিজের গাড়ি করে একদিন ছেলেটির সঙ্গেই ওর বাড়িতে যান। উদ্দেশ্য ছিলো, ছেলেটিকে যাচাই-বাছাই করার কাজটি সম্পূর্ণ করা।সত্যবাবুর বাড়ি থেকে ছেলেটির বাড়ির দূরত্ব ১৫০ কিমিরও বেশি।দেখলেন, খুবই হতদরিদ্র পরিবার।মাটির ওপর টিনের চালের দোতলা বাড়ি, সামনের উঠোনে একটা গাই বাঁধা আর একপাল মুরগির বাচ্চা এদিকসেদিক চরে বেড়াচ্ছে। সামান্য কিছু জমিজমা থেকে সংসার চালিয়ে ওর বাবা ওকে পলিটেকনিক পড়িয়েছেন। না,ছেলেটার জন্য কিছু করতে পারলে সত্যবাবুর নিজের ভালো লাগবে ভেবেই, নিজের সঞ্চয় থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা পূঁজি দেখিয়ে কোম্পানি তৈরি করে দেন।ছেলেটিও বেশ অনুগত।প্রতি সপ্তাহে তারজন্য ঐ দেশি মুরগির মাংস এবং তার পছন্দের ব্র্যান্ডের পানীয়টি এনে নিজে হাতে তা কাবাব করে সত্যবাবুকে খাওয়াতেন।
পুরো ব্যাপারটা ফ্ল্যাসব্যাকে মনে পড়তেই, তিনি নিজে একদিন হঠাৎ করে চলে গেলেন ওদের বাড়িতে।সেদিন ছেলেটি বাড়িতে নেই। ওর মা ও বাবা আছেন। তারা তো সত্যবাবুকে কীভাবে খাতিরযত্ন করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তারা জানেন,তাদের ছেলের উন্নতির পিছনে সত্য বাবু।তারা এটাও জানে,ছেলে এখন স্বাধীন ব্যবসা করে।
মুরগিগুলো চরে বেড়ালেও তাদের জন্য জালঘেরা ঘর করা হয়েছে।তারা বেশ যত্নে আছে দেখলেই বোঝা যায়। আগের সেই মাটির বাড়ি এখন পাকা হয়েছে।দোতলায় বসার জায়গা হয়েছে সত্যবাবুর।সেখান থেকে তিনি মুরগিগুলিকে লক্ষ্য করতে থাকেন।মুরগি গুলি বেশ রাজকীয় চালে এদিকসেদিক ঘুরছে-ফিরছে আর খাবারের পাত্র থেকে খাবার খাচ্ছে। কয়েকটা মুরগির চালচলনে শ্লথতাও তার চোখ এড়ায় না।এরপর তিনি মুরগির খাবারের দিকে লক্ষ্য রাখলেন।বেশ কয়েকটা প্লাস্টিকের পাত্র থেকে সেগুলে খাচ্ছে!কী খাচ্ছে তা দেখার জন্য তিনি দোতলা থেকে নীচে নেমে এসে সেই পাত্রটার কাছে আসতেই একটা বাজে গন্ধ পেলেন। যেন মর্গে ঢুকছেন,এমনভাবে তিনি নাকে রুমাল চাপা দিলেন।কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে মুরগিদের সেই খাবার তিনি একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে স্যাম্পল হিসেবে সংগ্রহ করে তা দ্রুত ব্যাগে চালান করে দিলেন।
ছেলেটির বাবা, তাকে ঘরের ভেতরে এসে বসতে বললে। তিনি নীচের তলায় বসলেন। ছেলেটির মা তারজন্য চিনি ছাড়া এককাপ লিকার চা এনে দিলেন।তিনি মুরগি গুলোর দিকে তাকিয়ে চা পান করতে করতে ছেলেটির বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন,তার ছেলের কথা।প্রশ্ন শুনেই ছেলেটির বাবার চোখ ছলছল করে উঠল। তিনি চোখমুছে বললেন, ‘ছেলেটা আর আগের মত নেই বাবু। সকাল নটায় বেরিয়ে প্রতিদিন রাত দশটা-এগারোটা নাগাদ বাড়ি ফেরে নেশা করে। আমরা কিছু বললেই, আমাদের মারে।আগে শুধু আমার গায়ে হাত তুলত,আর এখন ওর মা’কেও ছাড়ে না।মেয়েটা কাছে থাকতে তেমন কিছু করার ভরসা পেত না।কিন্তু সে যে কোথায় কেমন আছে,তাই বা কে জানে! ওর অত্যাচারের ভয়ে আমরা চুপ করে থাকি। আগে যখন আপনার কাছে থাকতো, তখন কিন্তু এমনটা ছিলো না,জানেন! বিয়ে-শাদিও করছে না। ‘
সত্য বাবু শুনে অবাক হয়ে গেলেন।এত পরিবর্তন! তিনি জিজ্ঞেস করলেন,’কী করে এখন কাজটাজ।’
‘ঐ কোম্পানি তো আপনি ছাড়ার পরই শেষ। তারপরও কিছুদিন ঐকাজ করছিলো।কিন্তু সরকার নাকি ওরে ব্ল্যাকলিস্টেড না কি যেন করেছে,তাই কোলকাতায় না কি কাজ করে! তা বাবু, কী কাজ করে, তা কিন্তু বলেনি আমাদের। মাঝে মাঝেই দেখি,নিজেই মুরগি ধরে,কেটে পিস করে নিয়ে যায়! বলে,ফিস্টি হবে।’ বলে তিনি একটু থামতেই সত্য বাবু জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনারা বাড়িতে মুরগি খান না?’
‘না না।এই যে মুরগিগুলান দেখছেন, এগুলো ও বাড়ির কাউকে খেতে দেয় না। আমাদের কোনোদিন খাওয়ার মন গেলে আমরা ঐ পোল্ট্রির মুরগি কিনে আনি।’
সত্যবাবু বলেন,’আচ্ছা ও আমাকে কিন্তু নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে খাওয়াতো।খুব ভালো রান্না করে কিন্তু আপনার ছেলে।’
‘জানি না, ও তো প্রায়ই নিয়ে যায়। কাকে দেয়, কাদের দেয়, কেনই বা দেয় কে জানে বাবু!’
সত্যবাবু মুরগি গুলোকে দেখিয়ে আরো জিজ্ঞেস করেন,’আচ্ছা, কীরকম মুরগি গুলো ও কেটে মাংস করে নিয়ে যেত বা যায় দেখান তো আমাকে!’
তিনি শ্লথ গতির মুরগি দুটোর দিকে দেখিয়ে বলেন-‘ওই গুলোকেই ও আগে মারে।মারার সাতদিন আগে থেকে ওদের কীসব ইঞ্জেকশন দেয়!
ওদের শরীরে কখনো পায়ের দিকে বা বুকে কিংবা গলায় ফোঁড়া মত কিছু একটা হলেই ওগুলোকে ও আলাদা করে রেখে দেয়।তারপর ওগুলোই একটা একটা কেটে পিস পিস করে একেকদিন নিয়ে যায়।এখানে যতগুলো মুরগি দেখছেন সবগুলোর শরীরে ছোট-ছোট ফোঁড়া আছে। ওঃ! আপনাকে বলা হয়নি, ও নাকি দেশি মুরগির একটা পোল্ট্রি করবে বলছিলো।তারজন্য বাবুর এখন,আমার ভাইয়ের জায়গাটি চাই।ওরা তো কেউ থাকে না। ভাবুন বাবু, আপনিই বলুন, ওকে কি এইজন্য জমি বিক্রি করে পলিটেকনিক পড়িয়েছিলাম?’
ছেলেটির বাবা কথাকটি বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন।সত্য বাবু তাকে সান্ত্বনা দিয়ে ফিরে আসেন, আবার আসবেন বলে।
ফিরে এসেই গেলেন তার এক বন্ধুর ল্যাবরোটারিতে।
সেই বন্ধু পরীক্ষা করে বললেন, ‘কোথায় পেলি এগুলো বলতো?’
সত্যবাবু বলেন,’সেটা তো আমাদের জানার দরকার নেই।এগুলো কী,সেটা বল।’
তিনি বললেন,’ভাঙা দানাশস্য,আছে গম, বাজরা, ভুট্টা, আর আছে, খুব খুব ছোটছোট মাংসের টুকরো। আমার যতদূর অনুমান, সম্ভবত এগুলো মানুষের শরীর থেকে নেওয়া বায়োপসি করার স্যাম্পল। ‘
সত্যবাবু বলেন,’সে কীভাবে সম্ভব? বায়োপসির জন্য মাংসের টুকরো মুরগির খাবারে কীকরে যাবে! না- না,তোর কোথাও ভুল হচ্ছে! দেখ আবার ভালো করে।’
তিনি বললেন, ‘শোন সত্য,এলাইনে আমার এক্সপেরিয়েন্স তিরিশ বছরের হলেও ভুল হতেই পারে।বায়োপসির জন্য নেওয়া মাংসের টুকরো যেকোনো প্যাথলজি ক্লিনিকের কোনও স্টাফকে ম্যানেজ করতে পারলেই সংগ্রহ করা কিছু অসম্ভব নয়! শোন, ফরেনসিকে আমার এক বন্ধু আছে, আমি তার কাছে এই মাংসের টুকরো গুলো পাঠাচ্ছি, সে সব দেখে রিপোর্ট পাঠাক।তখন নাহয় আমাকে গাল দিস।তবে,তারজন্য কিন্তু কমসেকম দিন পাঁচেকের অপেক্ষা করতে হবে।’
সত্যবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ,তাই কর। আর প্লিজ, একটু রিকোয়েস্ট কর,যাতে একটু তাড়াতাড়ি করে রিপোর্টটা পাঠায়।’
সত্য বাবুর বন্ধুর বন্ধু যিনি ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ। তিনি এর প্রায় সাতদিন পর রিপোর্ট পাঠালেন। রিপোর্টে তিনি তার বন্ধুর মতকেই সমর্থন করেছেন।এবং সেগুলির মধ্যে ক্যানসারের জীবাণু পাওয়া গেছে বলেও জানান।
রিপোর্ট পাওয়ার পরই সত্য বাবু তার ডাক্তার বন্ধু, প্যাথোলজি ক্লিনিকের টেকনিশিয়ান বন্ধু এবং ছোটবেলার আরও কয়েকজন বন্ধুকে দ্রুত ডেকে পাঠান বাড়িতে।
একে একে সবাই বাড়িতে এসে উপস্থিত হলে, সত্য বাবু বলেন, ‘তোদের সবাইকে ডেকে আনার জন্য দুঃখিত। তোরা সকলেই ব্যস্ত মানুষ। কিন্তু তোদেরকে বিষয়টা না জানিয়ে আমার কী করণীয় তা স্থির করতে পারছি না।’
বন্ধুরা একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।তাদের মধ্যেই একজন বললেন,’সত্য হেজিটেট করছিস কেন? আরে বাবা,তুই ডাকলে কি আমরা না এসে থাকতে পারি? বল, বল,কী হয়েছে? ‘
সত্য বাবু বলেন,তোদের মত বন্ধু আছে বলেই পৃথিবীটা এখনো এত সুন্দর রে। মৃত্যুর দরজায় দাঁড়িয়ে আমি তার বিভৎসতার কিছুটা হলেও দেখেছি। আজ আমার আর হারাবার কিছু না থাকলেও, জীবন যে কী তা বুঝেছি মর্মে মর্মে। আজ তোদের সামনে আমি যেকথা বলবো,সেকথা কিন্তু তোরা গোপন রাখবি।এটা আমার অনুরোধ। এবার শোন, যেকথা বলতে তোদের ডাকা, আমি আমার রেক্টামের ক্যান্সারের কারণ খুঁজে পেয়েছি।তোরা তো জানিসই এটা খবার থেকে, মূলতঃ মাংস জাতীয় খাবার থেকে হয়। আমি অনুসন্ধান করছিলাম আমার মত করে।করার পর এখন আমি যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি সেখান থেকে এগোতে বা পিছোতে হলে তোদের পরামর্শ দরকার। আশাকরি, তোরা মতামত দিবি সব শোনার পর।তোদের নিশ্চয় মনে আছে, আমার ইলেকট্রিক কোম্পানির সেই পার্টনারের কথা!ওই ব্যবসা আমি করেছিলাম ছেলেটিকে সাহায্য করার জন্য,সেকথাও তোদের অজানা নয়। মূলধন হিসেবে যে পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়েছিলাম তার এখনো দুলক্ষ টাকা আমি পাইনি। সে-নিয়ে কিন্তু আমার কোনও দুঃখ নেই। বরং আনন্দ আছে। কেননা, কোম্পানি দু-তিন বছরের মধ্যেই দশলাখ টাকা লাভ করেছে। সে আলাদা কথা, যেকথা বলছিলাম, সেই পার্টনার, আমি যাকে এত বিশ্বাস করেছিলাম, সেই আমার শরীরে জেনে-বুঝে ক্যান্সারের জীবাণু প্রবেশ করিয়েছে বলে আমার অনুমান। কেননা, ওই ছেলেটি প্রতি সপ্তাহে আমার বাড়িতে এসে নিজের হাতে মুরগির তন্দুরি, শিককাবাব, এরকমই ড্রাই,হাফসিদ্ধ রান্না করে আমাকে খাইয়েছে গত তিনবছর ধরে।আমিও সেগুলো বেশ তারিয়েই খেয়েছি, সেকথাও স্বীকার করছি। আমি ওর বাড়িতে গিয়ে দেখে এসেছি ক্যান্সার আক্রান্ত মুরগিগুলোকে। যেগুলো ও চাষ করে বাড়িতে। ওদের খাওয়ারের সঙ্গে প্রতিদিন বায়োপসির জন্য নেওয়া মাংস খেতে দেওয়া হয়।সেগুলো কেটে ফেলার আগে সাতদিন ধরে কীসব ইঞ্জেকশনও দেয়! আমি ওর বাড়ি থেকে মুরগির খাবারের যে স্যাম্পল নিয়ে এসেছিলাম সেগুলির ফারনেসিক টেস্ট রিপোর্টও তাই বলছে। সেখানে এটাও স্পষ্ট লেখা সেগুলো ম্যালিগন্যান্ট,তাতে ক্যান্সারের জীবাণু পাওয়া গেছে। এরপর তোমারা বলো, আমার কী করণীয়।
সত্য বাবুর ডাক্তার বন্ধু বললেন, ” আশ্চর্য! এরকমও হয় মানুষ। তুই তার এত উপকার করলি, আর সে তোকে তিনবছর ধরে একটা পারফেক্ট মার্ডার উপহার দেওয়ার চেষ্টা করল! বাহ রে মানুষ!
প্যথলজি ক্লিনিকের বন্ধু ও অন্যান্যরা বললো, ছেলেটাকে সহজে ছাড়া যাবে না।ওনাদের এক পরিচিত বন্ধু এখন এসডিপিও,তার সাহায্য নিয়ে ছেলেটাকে আনঅফিশিয়ালি ক্লোজ করে ইন্টারোগেশন করে আগে জেনে নেওয়া হোক,কেন সে এমনটা করলো? সম্ভব হলে,ওর বাড়ি থেকে ঐ মুরগি গুলিরও পরীক্ষা করা হোক।
ছেলেটাকে ধরে তোলা হলো শিয়ালদার একটা অখ্যাত হোটেলে। সত্য বাবুরাও ছিলেন সেখানে। না,তাকে কোনও জোরজার করতে হয়নি,চড়থাপ্পড়ও দিতে হয়নি। নিজেই স্বীকার করেছে সব। বলেছে, সত্য বাবুকে পরিকল্পনা করেই নিয়মিত ঐ ক্যান্সারাক্রান্ত মুরগি খাইয়ে, তাকেও ক্যান্সারে আক্রান্ত করে সে মেরে ফেলতে চেয়েছিল।এটা সত্যি। তাহলে,সেই কোম্পানির পুরো মালিকানা, লভ্যাংশ,পুঁজির টাকা সবই হস্তগত করতে পারতো। সত্য বাবুর ভাগ্য ভালো তাই উনি বেঁচে আছেন এখনো। তা নাহলে, ওর মত অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে এভাবেই।এবং সে এটাও স্বীকার করে যে,এখন তার পেশা এটাই। কোনও স্বামী বা স্ত্রী তার স্ত্রী বা স্বামীকে এভাবে মেরে ফেলার জন্য ওর সাহায্য নেয়।প্রিয় হয়ে যে কোনও প্রিয়জনকে মারার জন্য এই পদ্ধতিই তো নির্ঝঞ্ঝাট! সাপ মরলো কিন্তু লাঠি ভাঙলো না।এর বাজার,চাহিদাও এখন বিরাট সম্ভবনাময়। আগামীদিনে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও এধরনের কিছু ফাঁদলে সে অবাক হবে না বলে জানায়।সবথেকে বড়কথা, ছেলেটির মধ্যে কোনও অনুশোচনা বোধ নেই! এটাই সকলে বলাবলি করছিলেন।
তাকে সত্য বাবু যখন ছলছল চোখে জিজ্ঞেস করলেন,ভাই আমি তো জ্ঞানত তোমার কোনও ক্ষতি করিনি,আমি তো তোমার, তোমার পরিবারের মঙ্গল চেয়েছিলাম, কেন? কেন,তুমি এরকম করলে?তুমি একবার বলে আমাকে দেখতে পারতে!
ছেলেটি খুব শান্ত গলায় বললো,
‘শুনুন আমরা প্রতিদিন যে ঘাস মাড়িয়ে হাঁটি,সেই ঘাস না মরলে তো পথ তৈরি হয় না।আমি অনুগ্রহ, ভিক্ষা চাইনি। আমি লড়েই নিতে চেয়েছিলাম।লড়াইয়ের পদ্ধতি একেকজনের একেকরকম হয়।”দেয়ার ইজ নাথিং ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার!’ ভাবুন, আমি যদি আপনাকে মারতে সক্ষম হতাম তাহলে আমার অবস্থান বদলে যেত।এ মানবসমাজে বড়লোকেরা তো ছোটদের মেরেই বড়লোক হয়!একটা জঙ্গলে বাঘ বা সিংহ তো অন্যান্য প্রাণিদের মেরেই নিজেরা পশুরাজ হয়।এতে তো কোনও অন্যায় নেই। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আমি শুধু সেই নিয়মটাকে ফলো করতে চেয়েছি এতে তো কোনও দোষ নেই!আপনারা কী পারবেন কিছু প্রমাণ করতে! পারলে থানায় অভিযোগ করে দেখতে পারেন। আপনারাই তো আমাকে টাকার জোরে, ক্ষমতা দেখিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে আটকে রেখেছেন। সত্যবাবুর বাড়িতে আসার খবর জানার পর,তার কঢাবার্তা সব শোনার পরপরই সব প্রমাণ লোপাট, আপনারা কিচ্ছু প্রমাণ করতে পারবেন না।’
সত্যবাবুরা সকলে ভাবতে থাকেন,সমাজে এমন মনোভাবেরও মানুষ আছে! এ কোন দর্শন! একে নিয়ে কী করবেন! কী অভিযোগ, কোথায় জানাবেন!অভিযোগ জানালেই কী তা প্রমাণ করা যাবে!
ওরা সকলেই ভাবতে থাকেন…
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..