একটি ফড়িং ধরতে না পারার বেদনা

অয়ন্ত ইমরুল
কবিতা, প্রবন্ধ
একটি ফড়িং ধরতে না পারার বেদনা

কবিতা কেন লিখি? প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিকই বটে। নিশ্চয়ই এর এক বা একাধিক কারণ রয়েছে। যেহেতু, সবাই কবিতা লিখেন না। কিন্তু যারা লেখেন তারা কেনইবা লেখেন?

কীসের তাড়নায়? তবে কবি ভেদে এর কারণ ভিন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক। কেননা, সব কবিই তার নিজস্ব দেখা দেখে, নিজস্ব ভাবনা থেকে, ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে কবিতা লিখেন।

একেজনের দেখার চোখ একেকরকম। কেউ নদী দেখে, কেউ দেখে নদীর ঢেউ। আবার কেউ দেখে সেই নদীর মাছ বা ঝিনুক। এই যে দেখা- এই দেখাকেই উপলব্ধির আলোকিত চৈতন্যে শব্দের যথার্থ প্রয়োগে কবিতার সুসজ্জিত অবয়ব নির্মাণ সকলেই করতে পারেন না। তাই সকলেই কবি নয়। তবে মানুষ মূলত স্বভাব কবি। প্রকৃতি মানুষকে এমনভাবেই তৈরি করেছে যে, তাদের প্রকাশের একটা ভঙ্গি থাকে এবং প্রত্যেকের ভঙ্গি আলাদা ব্যক্তি ভেদে। কেউ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে নিজের সেরাটা প্রকাশে পারদর্শী। কেউ গায়কীর মধ্য দিয়ে। কেউ কেউ নৃত্যের মধ্য দিয়ে। কেউ সাজগোজ, আর্ট, চিত্রাঙ্কন- একেকজনের প্রকাশভঙ্গি একেকরকম। কেউ লেখালিখির মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে চায়।

কেন লিখি?

একটি শান্ত পুকুরে ঢিল ছুঁড়ে মারলে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। তখন ভেতরে যে পুলক শিহরিত হয়, তার অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য লিখি। একটা ফড়িং ধরতে না পারার বেদনা থেকে কবিতা লিখি। আত্মকেন্দ্রিক আর স্বার্থকেন্দ্রিক মানুষেরা যখন পালিয়ে যায় কোন ঘটনা বা দূর্ঘটনার স্পট থেকে। তখন ভেতরের চাপা ক্রোধ প্রকাশ করার জন্য লিখি। চোখের সামনের জীবনপ্রবাহ আর অন্তর্জাগতিক জীবন প্রবাহের পার্থক্য তুলে আনার জন্য লিখি। এরকম অনেক কারণ রয়েছে কবিতা লেখার।

জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, ‘কবিতা ও জীবন একই জিনিসের দুই উৎসারণ’। কবিরা অনুভব করতে পারেন জীবনের মৌলিক সংজ্ঞা। আমি মনে করি কবিতা লেখা হল শব্দের খেলা।

দাবার ঘরে ঘোড়ার যেমন আড়াই চাল, তেমনি কবিতার ভেতর শব্দের সেই আড়াই চাল দেয়ার বাসনা থেকে এই ভ্রমণ। এই আড়াই চালে একরকম আনন্দ উপভোগ করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা হল, নিজের তৃপ্তির জন্য, নিজে আনন্দ পাওয়ার জন্যই মূলত কবিতা লিখি। লেখার পর হয়তো এ আনন্দ ভাগ হয়ে যেতে পারে, যদি কোন পড়ুয়ার নজরে যায়। আবার হয়তো সে পড়ুয়া আত্মস্থ করতে না পারলে তা ভাগ হবে না। তবে শব্দের ওপর শব্দ বসালেই কবিতা হয় না। ইঁটের ওপর ইঁট বসালে বড় জোর একটা দেয়াল হতে পারে, যা একজন রাজমিস্ত্রির পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ একটি বাড়ির গঠন দিতে গেলে অবশ্যই একজন প্রকৌশলীর প্রয়োজন। তেমনি কবিতার ক্ষেত্রেও। এই শব্দের খেলার ছলে কোন লাইন যদি দাগ রেখে যেতে পারে, তবেই স্বার্থকতা।

আমি মূলত কবিতা নির্মাণ করি। কারণ পূর্ব থেকেই কবিতা চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিচ্ছিন্নভাবে। যা সবাই দেখতে পায় না। যার দেখার দৃষ্টি প্রখর সেই কেবল তা দেখতে পায়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-

“এই যে প্রকৃতির অকাট্য নিয়ম, একে অতিক্রম করে পরিপাট্যে পরিছন্নতা পূর্ণতা দেওয়া এবং পরিপূর্ণ সুন্দরকে প্রত্যক্ষ রূপ দেয়া কোন আর্টিস্টের দ্বারা সম্ভব হয়নি এ পর্যন্ত, হবেও না কখনও। অপূর্ণ সৌন্দর্য আশা জাগাচ্ছে পূর্ণতার মানুষের মনে। এই পর্যন্ত হল মানুষের শিল্প রচনার কৌশল।”

কারও কারও ক্ষেত্রে লেখালেখি ঈশ্বরপ্রদত্ত, তা এমনিতেই আসে। কারও কারও ক্ষেত্রে প্রচুর পড়তে হয়। কবি দীপক রায় বলেছিলেন, তাদের সময়ে লেখা মুখস্থ করতে হতো। বাংলা স্যার বাধ্য করতেন ছাত্রদের মুখস্থ করাতে। এবং দীপক রায় তার সহপাঠীদের নিয়ে আড্ডায় বসতেন। কার কেমন মুখস্থ হল, তা ঝালাই করে নেয়ার জন্য তারা প্রতিদিন আড্ডা দিতেন। কবি আল মাহমুদ বলেছিলেন একটা কবিতা লেখার পূর্বে এক’শোটি কবিতা পড়ো। এ হল চর্চায় চর্চিত ধন। বিখ্যাত সাংবাদিক লেরি কিংকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার লেখালেখি, প্রকাশনী ও টিভি টকশো’র প্রশ্ন এত শক্তিশালী কীভাবে? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘লেখা বা বলার আগে পড়তে হবে। তাহলে আপনার লেখনী শক্তিশালী হবে।’ তাই কেন পড়ি এই প্রশ্নও অপ্রাসঙ্গিক নয়।

এই যে আমাদের নিত্যকাজ, কাজের প্রয়োজনে যাতায়াত মানুষের ভিড়ে। ভ্রমণ। ব্যস্ততা। সর্বোপরি যাপিত জীবনের আনন্দ-বেদনা, এসব লেখার কাঁচামাল হতে পারে। তবে নিরন্তর পড়া আর চর্চা করে যাওয়াতেই নিহিত ভাল লেখার কৃতকৌশল। সর্বোপরি মানুষিক দিক দিয়ে সুস্থ থাকতে হলে আমাদের পড়তেই হবে।

অয়ন্ত ইমরুল। কবি। জন্ম ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের সাভার। প্রকাশিত বই: 'ছায়া সমুদ্র' (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৬), 'বুদ্ধের ভায়োলিন' (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৮), 'সাদা ধূলির দূরত্বে' (কাব্যগ্রন্থ, ২০২০), 'স্বৈর হাওয়ার হরিণী'  (কাব্যগ্রন্থ, ২০২০) এবং 'কিসমত আলী অথবা শূন্য' (গল্পগ্রন্থ, ২০২০)।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..