প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
ট্রেনটা যখন কলাবতী স্টেশনে এসে থামলো তখন ঠিক দিনও নয়, রাত্রিও নয়। পৃথিবী নামক গ্রহে দিন-রাত্রির এই ক্রান্তিকালকে কারা সন্ধ্যা নাম দিয়েছিলো তা আজ আর আব্বাকে প্রশ্ন করবোনা। কারণ, আমার প্রতি উনার একফোঁটা মনোযোগ নেই। তিনি অনবরত ধূমপানে ব্যস্ত। আর এদিকে আমার ভাবুক মনের কল্পনায় সুন্দর আবাহনে চলছে নানা প্রশ্নের উঁকিঝুঁকি।
এই ধরুন, এই স্টেশনের নাম কলাবতী হলো কেনো! স্টেশনটা কে বানিয়েছে! স্টেশনের দক্ষিণে এতো ট্রেনের বগি পড়ে আছে কেনো!
সকল সংশয় সমাধিতে পাঠিয়ে সেই আব্বাকেই আবার প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে থাকলাম।
তিনি অন্যমনস্কভাবে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলতে লাগলেন, নিশ্চয়ই এখানে কলাবতী ফুলের আধিক্য ছিলো, তাই এই স্টেশনের নাম হয়েছে কলাবতী।
আমি চোখ মেলে ধরলাম চারদিকে , আবছায়াতে একটা কলাবতীর অস্তিত্ব ও চোখে পড়লো না। কোথাও কলাবতী নেই! আব্বার উত্তর মোটেই মনপুত হলো না।
দ্বিতীয় প্রশ্নটা স্মরণ করিয়ে দিতেই তিনি বললেন, এসব স্টেশন বৃটিশরা বানিয়ে গেছে।
এরপর তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকিয়ে রইলাম। ইতোমধ্যে আব্বা তৃতীয় প্রশ্ন ভুলে বসে আছেন।
আবারো আমি জিজ্ঞেস করলাম, ঐ যে ট্রেনের বগিগুলো অযথা পড়ে আছে, ওগুলো সরায়না কেনো? আব্বা, কণ্ঠে ভাবগাম্ভীর্যতা এনে বললেন, রেলের একটা জিনিস কেউ ধরতে পারেনা। রেলের জিনিস এভাবেই পড়ে থাকে। সময়মতো আবার রেলের কাজেই লাগে।
চারপাশে আলো-আঁধারির রহস্য। আব্বা যেন কি নিয়ে চিন্তিত। মনে হচ্ছে বাড়ি ফিরতে রাত হবে। আমাকে নিয়ে তিনি বাড়ি পৌঁছতে পারবেন কিনা সেটা নিয়েই চিন্তিত।
আমাকে উনার পেছন পেছন আসতে বললেন। আমরা একটা চায়ের দোকানে বাঁশ দিয়ে বানানো বেঞ্চিতে বসলাম। আমাকে কলা আর পাউরুটি খেতে দেয়া হলো। গরুর দুধের ধোঁয়া ওঠা চায়ে পাউরুটি ভিজিয়ে তৃপ্তিভরে খেলাম। তারপর কলাটাও সাবাড় করে ফেললাম। আব্বাও একই কায়দায় খেলেন।
সেই সকালে আমরা বাবা-মেয়ে চিটাগং থেকে রওনা দিয়েছি। আব্বা চট্টগ্রামে ছোটখাটো সরকারি চাকুরি করেন। আমরা সরকারি কলোনীতে বাস করি। গ্রামের বাড়িতে জমিজমা নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। সেজন্য আব্বা বাড়িতে যাচ্ছেন। সাথে আমাকেও এনেছেন।
কলাবতী স্টেশন পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বি দাঁড়ানো।
প্রকৃতি এখানে স্থবির। চারদিকে অদ্ভুত এক মায়া! কি বলা যায় এই মায়ার আবেশকে! মনে মনে আমি বলেছি, সাঁঝের মায়া। পশ্চিম আকাশে চলছে তখন শেষবেলার সিঁদুরে মেলা।
আব্বার একহাতে ব্রিফকেস। আরেক হাতে সিগারেট। তখনো গ্রামে রিকশার সেভাবে প্রচলন হয়নি। স্টেশন থেকে আমরা কোনাকুনি পথে রওনা দিতাম বাড়ির দিকে। কারণ, প্রধান রাস্তাধরে গেলে অনেক বেশি সময় লাগতো।
স্টেশন থেকে আব্বা আর আমি নেমে গেলাম জমির আলপথে। ঐপথে যাওয়ার মতো আর কাউকে পাওয়া গেলো না। ঝুপ করে রাত নেমে এলো। তাও আবার অমাবশ্যার রাত! আব্বা ব্রিফকেস থেকে টর্চলাইট বের করলেন। আমি সামনে, তিনি পেছনে। এবার তার হাতে সিগারেটের বদলে টর্চলাইট। আমরা সাবধানেই হাঁটছি।
দূরে গ্রামের প্রকৃতি আঁধারে ডুবে গেছে। কোনো কোনো বাড়ি থেকে বিন্দুর মতো পিদিমের আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। গ্রীষ্মের মাঠে বেশ বাতাস। তাই হাঁটতে অসহ্য লাগছেনা।
আমরা এখন মাঠ ছাড়িয়ে গ্রামে ঢুকে পড়েছি। ঘরের পাশ দিয়ে চলে গেছে পথ। টর্চের আলোয় সাদা পথরেখার দু’পাশের ঝোপ আমাদের যেন নুয়ে নুয়ে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
আব্বা একটু পরপর গলা খ্যাঁকারি দিচ্ছেন। ঘরের ভেতর থেকে হয়তো কোনো মুরুব্বি অধিক কৌতূহলে জিজ্ঞেস করছেন, আমাদের গন্তব্য কোথায়? আব্বাও সাথে সাথে বিনয়ের সাথে উত্তর দিচ্ছেন।
হঠাৎ দূরে হারিকেনের আলো হাতে দশ-বারোজনের একটা দল দেখলাম। আশ্চর্য! তাদের কাঁধে লাশের খাটিয়া। আমরা ধীরে ধীরে ঐ দলটির কাছে চলে এলাম। রাস্তার ডান পাশেই খানিক দূরে কবরস্থান।
আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, কে মারা গেছে! তারা বললো, মেয়েটি এ বাড়ির বউ। মানে রাস্তার বাম পাশের বাড়ির হাফেজ আলীর ছেলের বউ। ছেলে প্রবাসী । বিকেলে মেয়েটি মারা গেছে। মেয়েটির উপর নাকি জ্বীনের আছর ছিলো। মানুষগুলোর কথায় মনে হলো, মেয়েটির মৃত্যুর জন্য জ্বীন দায়ী।
ভয় পেলাম আমি! মারাত্মক ভয়! আব্বাও কি ভয় পেয়েছেন! উনিও মনে মনে ইয়াসিন সূরা পড়তে লাগলেন। আমার পা চলছেনা যেন। হাত-পা ভেঙ্গে আসছে।
এবার আব্বা টর্চটাকে ব্রিফকেসের সাথে ধরে আরেক হাতে আমাকে ধরলেন। বাপ-বেটি হাঁটছিতো হাঁটছি। আব্বা জীবনে যত সূরা-কেরাত শিখেছেন সব পড়ছেন। আমাকেও পড়তে বলছেন।
একসময় চলে এলাম আমাদের বাড়িতে। দাদা-দাদু আব্বার উপর খুব বিরক্ত হলেন। কেনো আমাকে নিয়ে এতো রাতে আসলেন। আব্বা বললেন, লাকসাম আসার পর ট্রেন অনেকসময় থেমে ছিলো। সেজন্যই দেরী হয়েছে।
আমার চাচাত ভাই মতি। আমার চেয়ে দুবছরের ছোট। গ্রামের স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। আমাকে পেয়ে সে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। রাতে তেলে ভাজা পুঁটিমাছ আর শুকনো মরিচের বাগার দেয়া ডাল দিয়ে তৃপ্তিভরে ভাত খেলাম।
এবার ঘুমানোর পালা। দাদুর একপাশে আমি আরেক পাশে মতি শুয়ে পড়লো।
“মতি, তুমি কি খাও?”
“বেতুইন্না কাঁচা আম!”
“আমাকে একটু দাও!”
“ওরে! আমনে না শহর থাইক্যা আইছেন। আমনে বুঝি এডি খাইবেন!”
“খাবোনা মানে! তুমি জানো আমি কত কাঁচা আম খাই!”
” নেন, এই লন অল্প কদ্দুর। আর নাই। খাশ বাইড়াগো মাঝারকিয়া আম গাছ থাইক্যা চুরি করছি।”
“মতি! এই মতি! আবার কোথায় যাও? “
” জ্বীন চালা দেখমু!”
“ওরে ব্বাস! কি কয় জ্বীন চালা! শোনো মতি, আমিও যাবো!”
“আমনে শহরের মানুষ! আমনে ডরাইবেন!”
“আরে নাহ! পাজি ছেলে! আমাকে নিয়ে চল!”
মতির পেছন পেছন আমিও রওনা দিলাম!
“মতি! এই মতি! আর কত দূর..?”
” ওই যে ওই বাড়িত!”
উঠানে কেবল মানুষ আর মানুষ। আমি আর মতি দাঁড়িয়ে আছি। ঘরের ভিতরে মধ্যবয়সী পুরুষের কর্কশ কণ্ঠের ধমক কানে এলো,” তুই রোগীর লগ ছাড়বিনি?”
“আঁরে ছাড়েন, আঁরে ছাড়েন! আঁই বাইরে যামু!”
” তোর জায়গা এই বোতলের মইধ্যে!”
“আন্নের আল্লার দোয়াই! আঁরে ছাড়েন! আঁই বোতলে ডুকতামনা!”
কবিরাজের সাথে রোগীর উপর আছর করা জ্বীনের কথার লড়াই এভাবে চলছে।
” মতি, মেয়েটি কে রে?”
” মেয়ে না! হেতাই এই ঘরের রইস কাকার বউ। রইস কাকা বিদেশ থাহে। হেতাইরে জ্বীনে ধরছে। অনে কবিরাজ আনছে জ্বীন ছাড়াইতো।”
“নতুন বউ?”
“হ..!”
হঠাৎ মেয়েটির আর্ত চিৎকারে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। ভিড়ের মধ্যে কেউ বলে উঠলো, ” এইবার জ্বীন যাইবো কই? দিছে চোখের মইধ্যে মইচ্চের গুঁড়ি লাগায়া।”
ভিতরে বউটির সাথে কবিরাজের তুমুল ধস্তাধস্তি চলছে। আসবাবপত্র ছোঁড়াছু্ঁড়ির আওয়াজ ভেসে এলো। বাইরে থেকে আমরা বুঝতে পারছি মেয়েটির গায়ে যেন অশুরের শক্তি। সে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে শিকলরূপী হস্তগুলোর বন্ধনকে এক ঝটকায় কুপোকাত করে দরজায় এসে দাঁড়ালো।
” আমার চোখে পানি দে! আমারে মাইরা ফালাইলো।”
মতি আমার গায়ের সাথে লেগে বলে উঠলো, “আপা, এইডা কিন্তু হেতাইর কতা না! এইডা কিন্তু জ্বীনের কতা!”
“চুপ কর মতি!”
এতোক্ষণে দরজায় দাঁড়ানো চিৎকার আর আহাজারিরত মেয়েটিকে দেখতে পেলাম।
হায়! এ আমি কি দেখছি! এ যে আমি! আমি কেনো ওখানে দাঁড়িয়ে আছি! “ম…..তি..! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ওরা আমার চোখে মরিচের গুঁড়ো লাগিয়ে দিয়েছে। তুই আমাকে বাঁচা।”
ধড়মড় করে উঠলাম। কোথায় মতি! কোথায় কবিরাজ! আহা! এই যে দাদু আমার পাশে। দাদুর পাশেইতো মতি। ঘরের মানুষগুলো সব অঘোরে ঘুমাচ্ছে।
কিন্তু আমি যে কথা বলতে পারছিনা। কিছুক্ষণ পর ঠাওর করতে পারলাম, আমি দাদুর পাশে বিছানায়। গতরাতে আব্বার সাথে আমি গ্রামের বাড়িতে এসেছি।
কটা বাজে!
এমন সময় ভোরের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দূরের কোনো মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। আর সাথে সাথে কুকুরের ঘেউ ঘেউ রাতের নৈঃশব্দকে আরো দূরে সরিয়ে দিলো বটে; তবে রহস্যের জটাজালে ডুবন্ত আমি মন খারাপের সমুদ্রে তখনো সাঁতরে চলেছি।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..