রজকিনী রামি
শেষ থেকে শুরু। আমি রজকিনী রামী,ধোপার বংশে জন্ম আমার।ঘাটে সখিদের সঙ্গে কাপড় কাচি। একাজটা আমি…..
রিংটা বাজছে তো বাজছে, অসহ্য, উহ। কেউ ধরছেনা কেন? কেউ কি নেই?
এতো মানুষ ঘরে অতচ সবাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকে,আমি আর পারিনা। শরীরও সঙ্গ দেয়না। অনেক হয়েছে ঘানি টানা।
ফাহিম দু’একবার ডাকতেই তমার ঘুম ভাঙ্গে। বলে ক’টা বাজে খেয়াল আছে তোমার?
কেন, কি হয়েছে?
উঠেই দেখ যা হওয়ার হয়েছে। বেলা গড়াচ্ছে।
এতো বার রিং বাজছে ধরলে না কেন? ফাহিম এমন ভান করলো মনে হয় রোজ এই কথা শোনে সে। আর কত স্বপ্ন দেখবে?
স্বপ্ন?
এসব ভালো লাগে না দয়া করে সংসারে মন দাও। বিরক্ত লাগে। ধপ ধপ করে ফাহিম অফিসে চলে গেলো কথাগুলো বলে।
তমা ধীরে ধীরে শোয়া থেকে উঠে বসল। অগোছালো চুলগুলো কোনোরকমে পেছিয়ে ঝুঁটি বাঁধল। ওড়নাটা অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে পেলোনা। বাসায় এতো লোকজন ওড়না ছাড়া চলাই মুশকিল। ওড়না না পেয়ে বারান্দার দিকে এগুলো তমা। বারান্দার দরজা খুলতেই কমলা রঙের রোদের আলো তার মুখ ছুঁয়ে দিলো।
মনে পরল ফাহিমের কথা সেতো বলল অনেক বেলা গড়িয়েছে কিন্তু মাত্র রোদের খেলা শুরু। চারদিক নীরবতা। আকাশটা পরিষ্কার। আকাশে চোখ বুলাতেই মাথাটা ভন ভন করে ওঠল। এই মুহূর্তে রং চা কাজ দিবে। বারান্দা ত্যাগ করার যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল দেখে শোভন মাঠে ফুটবল খেলছে। তমা একটু এগিয়ে মাথা হেলে দেখে সত্যি শোভনই তো।
তমার চোখ উপড়ে, নিঃশ্বাস ওঠানামা করছে প্রেসার মনে হয় বেড়ে গেছে। উচ্ছ্বসিত চোখে শোভনকে চেচিয়ে বলে,- কিরে বাবা তুই ওখানে কি করছিস? এই গরমে তোর না এজমা আছে। এতোদিন কই ছিলি? দাড়া দাড়া আমি নিচে আসছি।
কিন্তু শোভনের কোন খেয়াল নেই। কোথাও মন নেই সে খেলছে আর খিল খিল করে হাসছে। তমা ছুটে গেলো। কিন্তু লিফট খালি নেই। সাততলা বাড়িটির পাঁচ তলায় তমারা থাকে। লিফট পেতে দেরী হওয়াতে তমা সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলো। প্রতিটি ফ্লোরে যতজন তাকে দেখছে ততই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তমা খেয়াল করলেও মন দিলো না। সে ছুটছে শোভনের কাছে বুকে এক সাগর আনন্দ নিয়ে। কিন্তু…। তমা গেইট দিয়ে বেরুবে এমন সময় দারোয়ান বাধা দেয়।
আহা আপনে আবার আইছেন?
তমা ভ্রু -কুচকে বলে, আগে আসিনি তো।
হ বুঝছি।
আমার ছেলের কাছে একটু যেতে দিন।
ছেলে, কোথায় কোনদিকে?
মাঠে। একটু যেতে দিন যাবো আর তাকে নিয়ে আসবো।
কি কন আপা, আপনি এমনিতে পাগল আমাকেও পাগল বানিয়ে ফেলবেন?
কি বলছেন এসব?
দেখুন আপা নিষেধ আছে আপনি বের হতে চাইলেই আপনাকে আটকানো।
কেন ভাই?
আপনার মাথা খারাপ তাই।
কে বলেছে আপনাকে, দেখুন আমি সুস্থ।
পাগল কি কখনো বলে আমি পাগল হা হা হা। ব্যাঙ্গাত্তক স্বরে দারোয়ান হেসে উঠল। দারোয়ানের হাসি দেখে সত্যি তমার ইচ্ছে করলো পাগলের মতো তার গলা চেপে ধরতে। সুস্থ একজন মানুষকে খুব সহজেই পাগল উপাধি দিয়ে দিলো। সত্য-মিথ্যা যাচাই করলো না।
তমার পায়ের কাছে ঘরের বিড়ালটি পায়চারী করছিল। তমা তাকে কোলে নিয়ে উপরে উঠতে লাগলো। মানুষগুলোই আজ কত নিষ্ঠুর তাদের জ্ঞান আছে, বিবেক আছে, আছে বুদ্ধি। কথা বলতে পারার মতো ক্ষমতা আছে। অতচ পশু কত আপন হয়ে যায়। বুঝতে পারে এক সময় আদর কি ভালোবাসা কি। ভাবনাগুলো সাথে নিয়ে তমা তার ঘরে চলে এলো।
ঘরে ঢুকেই শুনতে পেলো রিং বাজছে। তমা চেচিয়ে বলে, রিংটা ধরার কেউ নেই কি? বাড়ির সবাই কই গেলো?
বৌমা কোথায় গিয়েছিলে?
ভাইয়া রিং বাজছে ধরুন প্লীজ।
কোথায়?
এইমাত্র শুনলাম।
তোমার কান বাজছে।
তমা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পরে গেলো। দারোয়ানের সাথে তর্ক করে পাগল বলে দিলো। ভাসুরকে বোঝাতে গেলে অন্যকিছু বলে বসবে।
মুহূর্তে শোভনের কথা মনে পড়তেই তমা আবার বারান্দায় ছুটে গেলো। কিন্তু নাহ! ততক্ষণে শোভন চলে গেলো। তমার চোখ ছলছল করে উঠল। মাথা নিচু করে ঝিম মেরে বসে ফিরে গেলো সেই সুখ স্মৃতিতে।
আম্মা আম্মা কেমন আছো?
আম্মা নয় ভাবী ডাকো।
নতুন বউ তমা তাই স্বামীর ওপর কিছু বলতে পারছে না।
…ভাইয়া, মা বলেছিল ভাবীকে মা ডাকতে।
…উহ আর একটা কথাও না। যাও পড়তে।
তমার খুব খারাপ লাগছিলো।
ফাহিম তার পাগড়ীটা খুলতে খুলতে তমাকে বলে, ভীষণ দুষ্ট এতো বড় হয়েছে এতটুকু ভদ্রতা শেখেনি।
তমার মাথা নিচু।এই মুহূর্তে তার মুখবন্ধ। নতুন বউ বলে কথা। অবিবাহিতের মতো পটর পটর কথা বলা যাবে না। বললেই বাঁচাল বলে তকমা দিয়ে দিবে। অবুঝ বালিকার মতো মাথা নেড়ে সায় দিতে হবে। তমার খুব ঘুম পাচ্ছিলো কিন্তু এই সময়? সারাদিন যে ধকল। সেই সন্ধ্যার পর থেকে লক্ষ্মী বউ হয়ে বসে থাকা কি কষ্ট রে বাবা…।
কত আনন্দ কাউকে বউ সাজতে দেখলে। কিন্তু আজ নিজের বেলায় খবর হয়ে গেলো। তমার ভাবনার মাঝে ফাহিম কাছে এলো। তমার দুরু দুরু বুক কাঁপছে। ফাহিম হুট করে তমাকে শুইয়ে দিয়ে আদর করা শুরু করে দিলো। তমা বিচলিত। বুঝতে পারলো তার স্বামী রোমান্টিক না। কি আশ্চর্য। কোথায় কি প্রথমে খোঁপা খুলবে একে একে গহনা ধ্যাত…।
যৌবনের সাধ পেলেও মনের তৃপ্তি অধরা হয়ে রইল তমার। সারারাত দেহের আদান -প্রদানের সাথে বাসর রাতের ইতি হলো। পরদিন ঘুম ভেঙ্গে দেখে শোভন পাশে বসে আছে। তমা ভয় পেয়ে দূরে সরে যেতে দেখল শোভন বলে, আম্মা তুমি ভয় পেয়োনা। ভাইয়া যাওয়ার পর আমি এসেছি। তোমাকে একদম পুতুলের মতো লাগছে।
তাই বুঝি?
সত্যি আয়নায় দেখো ।
তোমার নাম কি? শোভন।
কিসে পড়?
ক্লাস এইটে।
বাহ!
ভাইয়া শুধু বকে। এখন তুমি এসেছ আর বকবে না। আমার মা বলেছে ভাবী এলেই আমাকে আর কিছু বলবে না।
হুম। তমা শোভনের কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ঠিক আছে আসতে আসতে আমি সব ঠিক করে দিবো। তবে আমার সব কথা শুনতে হবে। শুনবে তো? একদম।
ঠিক আছে এখন যাও।
তমা ফ্রেস হয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে রান্নাঘরে খালা শাশুড়িকে দেখতে পেয়ে বলে আম্মা আমি রান্না করি।
আজ না তুমি নতুন কয়েকদিন পরেই তোমার হাতে সব তুলে দিবো। ওই ছোড়াটাকেও। তুমি দিব্যি সব গুছিয়ে নিও।
জী আচ্ছা। এভাবে অনেকটা সময় পার হলো। শোভনের সাথে তমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। শোভনকে তার নিজের সন্তানের মতোই মনে হয় এখন। আড়াল হলেই তমা চিন্তায় পরে যায় । সেদিন স্কুল থেকে দেরী হওয়াতে নিজে স্কুলে গিয়ে হাজীর। শোভনকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না। শোভনও আম্মা আম্মা করে কেঁদে দিলো। কিন্তু ধীরে ধীরে তমার আদর শোভনের জন্য কাল হতে লাগলো। প্রায় ফাহিমের সাথে তমার ঝগড়া হয়।
একদিন রাতে ফাহিম বলে, দেখো তোমাকে শুরু থেকেই বলেছি ওকে লাই দিওনা।
ছোট মানুষ।
অতো ছোটও না। এই ছোট শব্দটাই এক সময় বড় হয়ে দাড়ায়।
ও তোমার ভাই।
ঠিক।
তাহলে?
এতো উত্তর জানতে চেওনা।
তমার আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করলনা। দাঁতে দাঁত চেপে তমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো।
পরদিন শোভন টেবিলে খাওয়ার সময় হাসলে তমা মুখ গোমড়া করে রাখে। শোভন তা বুঝতে পারে। সে চুপচাপ নাস্তা সেরে স্কুলে চলে যায়।
তমা সারাদিন মনমরা হয়ে থাকে। শোভনের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। কী করবে সে বুঝতে পারছেনা। শোভন স্কুল থেকে ফিরে এসেই ভাবীর রুমে ঢোকে।
তমা বলে কিরে ফিরেছিস? শোভন ভেটকি হেসে বলে, হ্যাঁ ফিরেছি। এই দেখো কি এনেছি।
কি এনেছিস?
তোমার জন্য কদম ফুল।
ওমা সেকিরে তুই আমার জন্য এই ফুল এনেছিস?
হুমম। আমি জানি এই ফুল তোমার খুব প্রিয়। সেদিন তুমি ভাইয়াকে বলেছিলে কদমের মালা আনতে আমি শুনেছিলাম ।
তাই বুঝি?
হুম্ম।
ভাইয়া আনবেনা আমি জানতাম।
কেনরে? ভাইয়ার এসবে আনন্দ নেই। ভাইয়া শুধু টাকা চেনে শুধুই টাকা।
তমা কথা ঘুড়িয়ে বলে, তোকে আজ টিফিন দেয়নি মন খারাপ করেছিস?
নাহ এমন তো কত হয়েছে।
তমা অবাক হয়ে বলে কত?
খালা দেয়নি। আমি তো সৎ ভাই। আপন না। সৎ ভাইকে কেউ আদর করে? করে না। কথাটা শুনতেই তমার চোখ ভিজে গেলো। তমা কান্না চেপে ধরে শোভনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমি আছিনা মন খারাপ করতে নেই বাবা। শোভনকে অবহেলার স্পষ্ট কারন তমা এবার জানতে পারলো। কিন্তু তমা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো শোভনকে সে অবহেলা করবে না। মায়ের আদর দিয়ে মানুষ করবে। কিন্তু একদিন সব এলোমেলো হয়ে গেলো তমার স্বপ্ন পূরণ হলোনা। তমা কাপড় স্ত্রী করতে ব্যস্ত। তখনি ল্যান্ডফোন বেজে উঠল। তমা দৌড়ে ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে একটা কান্নার স্বর আসে আম্মা আম্মা কোথায় তুমি। হুট করে লাইনটা কেটে গেলো। তমা অস্থির। কই গেলো সে কাঁদছে কেন? তমা ফাহিমকে কল দেয়।
আহা তুমি বেশি চিন্তা করছো শয়তানটা কই যাবে আমার মাথা খাওয়া ছাড়া। ফাহিম এমন ভান ধরল যেন কিছুই হয়নি। ফাহিমের কথা গুরুত্ব না দিয়ে তমা তার ব্যাগ আর ফোনটা নিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে পরল শোভনকে খুঁজতে। সারাদিন শোভনকে খোঁজ করে পাওয়া গেলনা। হাঁটতে হাঁটতে তীব্র রোদে তমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। তমার আর কিছু মনে নেই। চোখ খুলে দেখে তার আশেপাশে অনেক লোকজন। তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। তমা তার কাপড় চোপড় ঠিকঠাক করতে করতে বলে, আপনারা কে?
একজন পথচারী বলল, সব কথা আপনার স্বামীর কাছ থেকে শুনে নিবেন। আমরা গেলাম। তমা ফাহিমকে জিজ্ঞেস করে, শোভনের খোঁজ পেয়েছ?
আগেও এমন হয়েছে চলে আসবে তুমি এখন রেস্ট নাও।
তমার বুক ফেটে যাচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। তবে আগের মতো নয়।
সে হার মানতে নারাজ। খুঁজে বের করবেই শোভনকে। ভাবী হয়ে না। মা হয়ে সন্তানকে খুঁজে বের করতে পিছ পা হবে না সে।
কিন্তু সেই খোঁজাটাই তমাকে আজ পাগল বলে ছড়িয়ে দিলো।
সম্পাদনা: রাখি রশিদ
শেষ থেকে শুরু। আমি রজকিনী রামী,ধোপার বংশে জন্ম আমার।ঘাটে সখিদের সঙ্গে কাপড় কাচি। একাজটা আমি…..
মালঞ্চার পথে ভোরবেলা। সূর্য সবে উঠছিল। বৈশালী দূর থেকে দেখতে পেল,বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ডে বালুরঘাটের দিকে মুখ…..
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
ভার্সিটির বাস ধরতে হয় আমাকে খুব সকালে। বাড়ি থেকে একটু হেঁটেই রিকসা। তারপর বাস। হাঁটা…..