একান্তে

বর্ণালী মাহমুদ
গল্প
Bengali
একান্তে

অস্থির মেয়েটিও একদিন চুপচাপ হয়ে যায়, যখন অনেক বেশী দেখার পরেও দেখার শেষ না হয়! যখন বাস্তবতা তাকে আপাদমস্তক গ্রাস করে একটু একটু করে! যখন কিছু আর বলার ভাষা হারিয়ে যায়, হারিয়ে যায় বোধশক্তি, ছিঁড়ে যায় সব হিসেবের খাতা, পুড়ে যায় রংতুলি, ভেঙে যায় পেন্সিলের শিস, যখন মনের খাতার প্রত্যেকটি পাতা পুড়ে বিভৎস ছাই; বিস্তীর্ণ চর্তুদিকে!

কোন এক দীর্ঘশ্বাস বিদীর্ণ করে নিঃশব্দ কৃষ্ণাঙ্গ রাতকে!

হুম, এটা সেই স্থিরতায় আবৃত অস্থির মেয়েটির গল্প! জীবনে যত কিছুই ঘটে যাক না কেন, জীবন যখন চলমান উপাখ্যান, তখন তার সাথে পথ চলতেই হয়! মেয়েটিও চলছে।

এই নিঃসঙ্গ জীবনটাকেই জড়িয়ে বাঁচে সে আজ! একা থাকা অনেকটাই আয়ত্ত করে নিয়েছে সে। তবে সবখানে, সবক্ষেত্রেই সে নীরব দর্শকের ভুমিকায়।

এমন একটা সময় তার পরিচয় সাম্যের সাথে। সে পরিচয় পর্বটাও অদ্ভুত ছিল! প্রথম পরিচয়ের পর থেকেই সাম্য ভাবায় রুনুকে! তার দ্যাখা যত পুরুষ, সে সব থেকে আলাদা ও!

দ্বিতীয় দেখা আরো অদ্ভুত! মনে হলে আরো অস্থির হয় রুনু। শুধু ভাবে, এমনই কেন সে? কেন নয় আর দশটা পুরুষের মতো?

রুনু দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী, অনেক পুরুষ তাকে পেতে, তার সাথে একটু সময় কাটাতে ব্যাকুল! এই অনেকের মধ্যে যে কয়জনকেই সময় দিয়েছে রুনু, প্রত্যেকেই চেয়েছে তাকে, না বন্ধু হিসেবে নয়! হয় প্রেমিকা রূপে, নয়তো বন্ধুত্বের পর্দার আড়ালে নিষিদ্ধ সম্পর্ক রূপে! রুনুর ঘৃণা উপচে পড়ে এই পুরুষদের জন্য। তাইতো সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু সাম্য যখন দেখা করতে চাইলো, অবাক হয়েছিল রুনু! এমন সময়ে কেউ কারো সাথে দেখা করতে চাইতে পারে, কখনো ধারণাই করেনি সে। কিন্তু সাম্য তাকে দেখা করতে ডাকলো, আর রুনুও ভীষণ অবাক চিত্তে দেখা করলো!

দ্বিতীয় ও তৃতীয় দেখা রুনুকে অনেক বিচলিত করে দিলো! সে বোধ করতে পারে এখন, তার সত্তার অনেকাংশ জুড়ে সাম্যের বিচরণ। তবু নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে সে, আরো একটু সময় নাও। আরো একটু দেখো, বোঝো, জানো! তবু চেতনে, অবচেতনে মন সাম্যকে ভাবে, সাম্যকেই খুঁজে! কেন? কারণ সাম্য সবার থেকে আলাদা, এই দুষিত সমাজে বাস করেও সে কিভাবে আলাদা হতে পারে!

দেখা হলে যেটুকু সময় একসাথে কাটায় ওরা, রুনু শুধু সাম্যের কথা শোনে! সাম্য খুবই স্পষ্টবাদি, সাবলীল প্রকাশ তার! রুনু মগ্ন হয়ে শোনে, তাই কথা শুনে কেটে যায় সুদীর্ঘ রাত, তবু রুনুর মনে হয় কেন আর একটু বেশি সময় পাওয়া গেল না!

তৃতীয়বার দেখা হবার পর কেটে গেছে বেশ কয়েকটি দিন, রুনু মনে মনে অস্থির সাম্যের সাথে দ্যাখা করতে! সাম্য নিজে থেকে দ্যাখা করতে বলছে না, রুনু বলতে চেয়েও বার বার নিজেকে সামলে নিচ্ছে, কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা অভিমানে! অবশেষে সব বাদ দিয়ে রুনু দ্যাখা করতে চাইলো। সাম্য রাজি হলেও বল্ল জানাবে। কিন্তু সে আর কিছু জানালো না! রুনু দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করলো সাম্যের, কোন খবর পেল না!

অস্থির রুনু ফোন দিল সাম্যকে, সে ফোনটাও ধরলো না! রুনু মনকে বোঝালো, হয়তো কোন জরুরি কাজে আটকে গ্যাছে! পরে নিশ্চই জানাবে। কিন্তু না, সাম্যের পক্ষ থেকে কোন যোগাযোগই হলো না! অভিমানী রুনুর চোখ উপচে জল গড়ালো। এভাবে কেউ তাকে উপেক্ষা করতে পারে, তার ধারণার বাইরে ছিল। চোখ মুছে রুনু মনে মনে ভাবে, আমি আর সাম্যের ডাকে সাড়া দেব না!

সাম্য আবার যোগাযোগ করে রুনুর সাথে, দিন চারেক পরে। জানায় দ্যাখা করতে চায়! সাম্যের আহ্বানে রুনুর অস্থিরতা আবার বাড়ে। সব রাগ অভিমান ভুলে সাম্যের সময় পাবার আকুলতায় সে রাজি হয়ে যায় দ্যাখা করতে।

দ্যাখা হয় ওদের, সাম্য বলে, রুনু শোনে! নিশ্চুপ শোনে, মনের ভিতরে কষ্টেরা দলামোচড় দেয়! চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে চায়, শক্ত হয়ে নিজেকে সামলিয়ে নেয় সে। অপেক্ষা যখন করেছে, উপেক্ষাও দ্যাখবে সে। অবাক রুনু ভেবে পায় না, এত অবহেলা পেয়েও কেন সে রাগ করতে পারছে না! শ্রুতি পর্ব শেষ করে রুনু বাড়ি ফেরে। নূতন বোধোদয় আসে, নিজেকেই চিনতে হবে, জানতে হবে নিজের ইচ্ছে ঘুড়ির লাটাই কতো দীর্ঘ সূতায় বাঁধা!

রুনু এরপরেও আরো দুবার সাম্যের সাথে দ্যাখা করতে যায়। এটুকু সময়ের ব্যবধানে সে আরো বেশি স্থির এখন। সে আজ ভালো করেই জানে, সাম্যকে সে ভালোবাসে। তবে এও জানে, সাম্য তার অতীতের ঘ্রাণে আজো বাঁচে, আর রুনু সাম্যের এ স্বকীয়তা অক্ষুণ্ণ রাখার প্রয়াসে নিজেকে বিলীন করে দিতে চায়!

শেষবার দ্যাখা হবার পরেও সাম্য রুনুর সাথে দ্যাখা করতে চেয়েছিল। রুনুও সম্মতি দিয়েছিল, যদিও মনে মনে ঠিক করেছিল সে যাবে না। তবে সে কষ্ট আর করতে হয়নি রুনুর! সাম্য তার গতানুগতিক স্বভাবে বলেছিল, সময় জানাব, জানায়নি। রুনুও আর জানতে চায় নি, আর জানতে চাইবেও না সে। যে ভালোবাসা একান্তই তার অনুভূতি, তা আর কখনোই প্রকাশ করতে চায় না সে।

তাই কাউকেই না জানিয়ে অচিরেই সে চলে যাচ্ছে, দেশ ছেড়ে, আপন ছেড়ে, অচেনার কাছে! শুধু একটি নিষ্পাপ ভালোবাসাকে নিভৃতে লালন করবার প্রত্যাশায়!

বর্ণালী মাহমুদ। গল্পকার। জন্ম বাংলাদেশে, বর্তমানে স্পেনের বার্সেলোনায় বসবাস।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..