প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
বুকের মধ্যরেখা বরাবর গলার কিছুটা নিচে ছোট্ট বেহেশতি তিলটার দিকে তাকিয়ে আছে হাসান৷ সুবিশাল আকাশের বুকে উড়ন্ত শালিকের সৌন্দর্য ঠিকরে বেরোচ্ছে সে তিলবিন্দুটি থেকে৷ আগেও বহুবার সে বহু কষ্টে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে সেখানে; খেয়াল রাখতে হয়েছে যেন চোখমণিটার অবস্থান কেউ ধরতে না পারে, দ্বীপাও যেন কিছু বুঝতে না পারে! জীবনের শ্রেষ্ঠ রাতটিতে পুরো আকাশের অধিকার যার, তার অমন ছোট্ট শালিকের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে বিস্ময়ের অন্ত নেই দ্বীপার চোখেমুখে— অন্ধকার ঘরে আঁধার চিড়ে কী দেখছে হাসান?
দ্বীপার ধারণা, এত বছরের প্রেমে হাসান কোনোদিন তার দিকে ঠিকভাবে তাকায়ওনি! তার অভাবনীয় সৌন্দর্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও কখনো করেনি৷ তবু দ্বীপার মনে হয়েছে, এ মানুষটাকেই তার দরকার! সম্পর্কের এতগুলো বছরে একবারের জন্যও মনে হয়নি এ মানুষটা সংসার করার যোগ্য নয়; এক দারুণ আবেগে সম্পর্কটাকে বেঁধে ফেলেছে হাসান৷ স্বভাবগতভাবে হাসানকে বেশিরভাগ সময়েই লাজুক ও দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয়; জীবনে একটি কাজই সে সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সাথে করেছে৷ ঠিক তিন বছর আগে নির্লজ্জের মতো গোটা বিশেক মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে জোরসে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বলে দ্বীপার সারা শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে! সে কম্পন আরো অসংখ্যবার অনুভব করেছে দ্বীপা— যতবার হাসান তার হাতটি স্পর্শ করেছে, যতবার তার চুলের ভেতর আঙুল ডুবিয়েছে, এমনকি কেবল দৃষ্টি নিক্ষেপেও শিহরণ জেগেছে কতবার!
শিল্পী: রিয়া দাস
অন্য অনেক মানুষের তুলনায় হাসানের একটি পৃথক ধরনের বৈশিষ্ট্য আছে৷ দ্বীপার কাছে এটা একটা রহস্য; সে বহুবার চেষ্টা করেছে এ রহস্যের নিগূঢ় উত্তরটি উদঘাটন করতে৷ এত বছরেও ওদের সম্পর্কের মিষ্টতা এতটুকুও যে কমেনি, তার একটা কারণ হলো কৌতূহল, রহস্য উন্মোচনের আকাঙ্ক্ষা৷ এটা তো ধ্রুব সত্য যে, একটি সম্পর্ক ততক্ষণই উপভোগ্য থাকে, যতক্ষণ সেখানে কিছু অজানা বিষয় থাকে, কৌতূহল থাকে, কিছু অনুদঘাটিত রহস্য থাকে৷ আপাতত দ্বীপার কাছে হাসান সম্পর্কে যে রহস্যটি বড্ড দুর্ভেদ্য সেটি হচ্ছে, হাসান সাধারণত প্রথম পরিচয়ের সময় মানুষের মুখ বা চোখের দিকে তাকানোর চাইতে বেশিরভাগ সময় তাদের হাতের দিকে দৃষ্টি নামিয়ে রাখে৷ শুরুর দিকে দ্বীপা ব্যাপারটি ধরতে পারেনি; সে ভেবেছে হাসান বোধহয় মাথা নিচু করে কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, অথবা যেহেতু সে কিছুটা লাজুক প্রকৃতির, তাই চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে তার সমস্যা হয়৷ অনেকটা সময় পরে দ্বীপা ব্যাপারটি ধরতে পেরেছে৷ এ নিয়ে একবার বেশ বিপাকে পড়তে হয়েছিল৷
প্রথম যেবার দ্বীপা হাসানকে বাসায় নিয়ে গিয়েছিল মায়ের সাথে পরিচয় করাতে, সেদিনের ঘটনা৷ বাড়িতে ঢোকামাত্র তারা দেখলো দ্বীপার মা মেহেরুন্নাহার বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন৷ তাঁর সেদিন কোথাও একটা বিয়ের অনুষ্ঠান এটেন্ড করতে যাবার কথা৷ দ্বীপা কোনোভাবে হয়তো ভুলে গেছে৷ এসব প্রোগ্রাম-ট্রোগ্রামে তার তেমন একটা আগ্রহ নেই৷ যা-হোক, এই মুহূর্তে মেহেরুন্নাহারের বয়স মোটামুটি দশ-বারো বছর কমে গেছে; ভারি গহনা ও বিলাসী সাজসজ্জার কারণে তিনি অনেকটা দ্বীপার বান্ধবীর বয়সে চলে এসেছেন৷ হাসান কথা বলছে মেহেরুন্নাহারের হাতের দিকে চোখ রেখে! তিনি খুব অস্বস্তি বোধ করছেন৷ ছেলেটা ইতোমধ্যেই দুবার অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার গলার অর্নামেন্টসের দিকে তাকিয়েছে৷ এই মুহূর্তে সে তাকিয়ে আছে তাঁর আঙুলে লেগে থাকা অর্ধলক্ষ টাকা মূল্যের আঙটি দুটোর দিকে! ব্যাপারটা তিনি মোটেও পছন্দ করেননি৷ তাঁর আরো সন্দেহ জেগেছে যখন তিনি জানতে পারলেন হাসানের বাবা একটি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক৷ এমন একটি ছেলেকে দ্বীপা কীভাবে পছন্দ করতে পারে এই ভেবে সপ্তাহখানেক তিনি ঠিকমতো ঘুমোতে পর্যন্ত পারেননি৷ যেহেতু দ্বীপার বাবা দেশের বাইরে থাকেন এবং তিনি মেয়ের কথার বাইরে কোনোদিনই হাঁটেননি, সেহেতু মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাবার যে খুব একটা মাথাব্যথা থাকবে না তা তিনি জানেন৷ এ কারণেই মেয়েকে নিয়ে যাবতীয় দুশ্চিন্তা তাঁকেই করতে হয়৷
শুধু দ্বীপার মা নন, তার বাসার আরো একজন আছে যে হাসানকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না৷ সে হচ্ছে টগর৷ নামটা প্রথমবার যখন শুনলো, হাসান খানিকটা ভড়কে গেল৷ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে স্বাভাবিক হলো এই ভেবে যে এত বড় ধনিক পরিবারের কাজের মেয়ে যে হবে, তারও তো কিছু বিশেষ যোগ্যতা থাকা উচিত৷ এ মেয়ের নামটিই বলে দেয়— যে-সে বাড়ির কাজের মেয়ে সে হতে পারে না৷ যাকগে সে কথা৷ প্রশ্ন হচ্ছে, টগর কেন হাসানকে সহ্য করতে পারে না? শুরুর দিকে ব্যাপারটা এমন ছিলো না; বরং দ্বীপাদের বাড়ির মানুষজনের মধ্যে টগরই হাসানকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতো৷ হাসান যখনই সে বাড়িতে যেত, আদর-আপ্যায়নে টগরই সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখাতো৷ হঠাৎ টগরের বিয়ে ঠিক হওয়ায় যেদিন সে বাড়ির কাজ ছেড়ে চলে গেল, সেদিনের পর থেকে সে বাড়িতে হাসানের আদর-আপ্যায়নেও এক রকম ছেদ পড়ে গেল৷
এর অনেক পরে, বিয়ের ঠিক সপ্তাহখানেক আগে দ্বীপার মোবাইলে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে ফোনকল৷ ওপাশ থেকে বললো,
“আপুমণি, আমি টগর৷”
দ্বীপা বললো, “কী রে টগর? কেমন আছিস? তোর বিয়েতে যেতে পারিনি রে, স্যরি৷ সংসারধর্ম ঠিকঠাক চলছে তো?”
কোনো এক অজানা কারণে, দ্বীপাকে অবাক করে দিয়ে টগর কোনো কথার জবাব না দিয়ে বললো, “আপুমণি, শুনলাম হাসান ভাইয়ের সাথে তোমার বিয়ে?”
দ্বীপা বললো, “হ্যাঁ, এই তো আগামী শুক্রবার৷ তুই কীভাবে জানলি?”
এ প্রশ্নেরও কোনো উত্তর না দিয়ে টগর বললো, “তুমি এ বিয়েটা কোরো না আপুমণি!”
“কেন রে? এ কথা কেন বলছিস?”
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে টগর বললো, “না, এমনিতেই৷ লোকটারে আমার তেমন সুবিধার মনে হয় না৷”
“কিন্তু তুইই তো হাসানকে বেশি পছন্দ….৷”
কথা শেষ হবার আগেই ফোন কেটে গেল৷
পরে হাসানের সাথে কথা বলে সে জানতে পেরেছে, মাস ছয়েক আগে হাসান চুরির দায়ে একজনকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিল৷ সে ব্যাপারেই সেদিন বিকেলে থানায় গেলে সেখানে টগরকে দেখতে পায়৷ জানতে পারে, লোকটা টগরের জামাই৷ এ কারণেই হয়তো টগর সেদিন ও রকম বলেছে৷
গত এক বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে৷ হাসান তার স্বভাবসুলভ মিষ্টতা দিয়ে সব জয় করে নিয়েছে— রাজা-রাণি-রাজকন্যা সব৷
অন্ধকার ভেঙে হাসানের ঠোঁট এগিয়ে গেল দ্বীপার কপাল বরাবর৷ আনন্দে-শিহরণে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে৷ কপাল-চোখ-নাক-ঠোঁট বেয়ে সে আদরের ঢেউ বয়ে যেতে লাগলো! গলার ঠিক নিচে ছোট্ট তিলটার ওপর নিপতিত হলো পৃথিবীর গভীরতম চুম্বন৷
জীবনের শেষ দিনগুলোতে জেলখানার চার দেয়ালের আবদ্ধ সময়ে হাসানের লেখা ২৩ পৃষ্ঠার চিঠিটিতে কেবল একটিই বাক্য লেখা— “ভালোবাসি! ক্ষমা কোরো!!”
২.
বিয়ের পরদিন সন্ধ্যার পর, হাসান তখনও বাসায় ফেরেনি, চুল আঁচড়াতে গিয়ে দ্বীপার হাত থেকে চিরুনিটা ছিটকে গেল৷ খাটের নিচ থেকে চিরুনিটা বের করতে গিয়ে সেখানে সে একটি বাক্স আবিষ্কার করলো৷ বাক্সটি খোলার সাথে সাথে তার মাথার মধ্যে চক্কর দিয়ে উঠলো! জ্ঞান ফেরামাত্রই দেখতে পেল হাসান পাশে বসে তার বুকের দিকে ঝুঁকে আছে৷ এক ধাক্কায় দ্বীপা তাকে দূরে ঠেলে দিল৷ হাসানের হাত থেকে পড়ে যাওয়া ছুরিটা হাতে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার ওপর৷ পেটের মধ্যে কোনো রকমে ছুরিটা চালিয়ে দিয়েই বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল! সরাসরি থানায় গিয়ে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে সে চিৎকার করতে লাগলো, “প্লিজ ওকে বাঁচান; আপনারা ওকে বাঁচান প্লিজ!”
পরে টগরের সাথে দেখা করে দ্বীপা৷ টগরের বাম হাতের তর্জনীর দিকে তাকিয়ে নিজেকে আর স্বাভাবিক রাখতে পারে না৷ টগরের তর্জনীটা হাতের মুঠোয় নিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে! অবশিষ্ট ১৬টি তর্জনী যার সবগুলোতেই ছোট্ট কালো তিল, সেগুলোর সাথে ঝুলিয়ে রাখা কাগজে উল্লেখিত নাম-ঠিকানা ধরে পুলিশের সহায়তায় প্রত্যেকের সাথে যোগাযোগ করে সে৷ কিন্তু তাতে শেষরক্ষা হয় না হাসানের৷ একটা সময় প্রচণ্ড অপরাধবোধ তাকে আত্মহননের পথে ঠেলে দেয়!
আজ হাসানের মৃত্যুর ঠিক এক বছর হলো৷ গত এক বছর দুর্বিষহ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গেছে দ্বীপার জীবন৷ আজ সে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে! রাত এগারোটা বেজে দশ মিনিট৷ হাসানের কবরের ঠিক পাশটাতে বসে আছে সে৷ হাতের ধারালো ছুরিটা বুকের উপরে কালো তিলটার দিকে তাক করা!
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..