আমি জানতাম না চব্বিশের জুলাইটা এত দীর্ঘ হবে
আমি জানতাম না চব্বিশের জুলাইটা এত দীর্ঘ হবে, আমি জানতাম না, অগাস্টকেও রাহুর মত গ্রাস…..
কেন লেখেন, কী লেখেন? এই প্রশ্নটি সরাসরি করার মধ্যে এক ধরনের ঔদ্ধত্য ও গ্রাম্য ব্যাপার রয়েছে। তাই প্রশ্নকর্তা বিনয়ের আশ্রয় নিয়ে লেখককেই লিখতে বলেন, ‘কেন লিখি কী লিখি’— এই শিরোনামে আত্মকথন। কেন লিখি কী লিখি, এই শিরোনামে বাংলা ভাষায় সম্ভবত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম লিখেছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময় গণসাহিত্য এবং কলাকৈবল্যবাদী সাহিত্য নিয়ে বিতর্কের শুরু হয়েছিল। সে কারণেই তিনি ‘কেন লিখি কী লিখি’ শিরোনামে কৈফিয়তমূলক নিবন্ধ রচনা করেছিলেন। এখন— এতোদিন পরও কী সেই প্রশ্নের মীমাংসা হয় নি?
বহু বিতর্কিত এই বিষয়ের ওপর অনেক লেখালেখি হয়েছে। এগুলো নিয়ে আর জাবর কেটে কী লাভ! সাহিত্যের ছাত্র ও একজন কবি হিসেবে সাহিত্যের ললাটে তকমা আঁটার চাইতে মৌলিক সাহিত্য বেছে নিতেই আমি অধিক আগ্রহী। কবিতা কবিতাই।
ওই যে, শেক্সপিয়র বলেছিলেন,
What’s in a name? That which we call a rose
By any other name would smell as sweet.
পুরাকালে গদ্য ছিল না। পদ্যে লেখা হতো সব। এই নিরিখেই হয়তো জার্মান দার্শনিক জোহান জর্জ হামআন (Johann Georg Hamann; ১৭৩০-১৭৮৮) বলেছিলেন, কবিতা মানব জাতির মাতৃভাষা (Poetry is the mother-tongue of the human race.) তখন সকল লেখককেই কবি বলা হতো। কবিতাকে বলা হতো অমৃত, আর কবিকে— অমর।
নিজের লেখা নিয়ে যদি কেউ উদ্বিগ্ন হন তা হলে তিনি প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড়ান। আমি আমার কবিতা নিয়ে কখনো উদ্বিগ্ন নই। ‘কবিতা আসে, কবিগণ ধরেন মাত্র’। ঐশী প্রেরণায় কবিগণ কাব্যরচনা করেন। হোমার থেকে শুরু করে হালের কবিরাও একথা বিশ্বাস করতে পছন্দ করেন। হোমার তো ‘ইলিয়ড’-এর তৃতীয় সর্গে বলেছেন, দৈব প্রেরণা ছাড়া শুধু কিংবদন্তীর উপর নির্ভর করে কেউ মহাকাব্য রচনা করতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছিলেন। তা ঠাকুরের লেখা থেকে আমরা জেনেছি। এই যে এই প্রেরণাবাদ— এ নিয়েও অনেক বিতর্ক। তবে নাস্তিক ছাড়া কেউ একে মতিভ্রম বলে উড়িয়ে দেন নি। যারা উড়িয়ে দেয়ার পক্ষপাতী তারাও কবিতা সৃষ্টির রহস্যময়তা স্বীকার করে নিয়েছেন। আমি ঐশী প্রেরণার কথা বলবো না। বলবো আমার বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতার কথা। আমি বিশ্বাস করি কবিতা আসে— বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো। ওই ঝিলিকটুকু কবিতার প্রাণ। ওই ঝিলিকের আলোয় বাদবাকী ভাবনাকে সাজাতে হয়। এই সাজানোর জন্য শব্দসম্ভার থেকে বেছে বেছে অবশ্যম্ভাবী শব্দ তুলে নিতে হয়। এতেও না হলে নতুন উপমা চিত্রকল্প নির্মাণ করে ভাবনাকে একটি অবয়বের মধ্যে, একটি শরীরের মধ্যে ধারণ করতে হয়।
আমি মনে করি, আমাদের চেনা জগৎ, আমাদের অভিজ্ঞতা, অধীত বিদ্যা, আনন্দ, বেদনা এবং গোপন ইচ্ছা আমাদের অবচেতন মনের মধ্যে ডুবে থাকে। এর খবর আমরা জানি না। আমাদের অবচেতন মনের গভীরে বিশাল বিশাল সমুদ্র রয়েছে। বাতাস সমুদ্রের জলে আঘাত করলে ঢেউ ওঠে। সমুদ্রের তলদেশে কম্পন সৃষ্টি হলে সমুদ্র ঊর্মিমুখর হয়ে ওঠে। সমুদ্রে তোলপাড় শুরু হলে তলদেশ থেকে বহুকিছু উঠে আসে। তেমনি কবির হৃদয় কোনভাবে আলোড়িত হলে ভাব ও ভাবনা উঠে আসে। ঐ ভাব ও ভাবনাগুলো বুদ্বুদের মতো। তাৎক্ষণিকভাবে ধরে না রাখলে তা উবে যায়। যে কারণেই হোক, সৃষ্ট আবেগ ভাবনার মাঝে আশ্রয় নিয়ে অবয়ব খোঁজে। ভাবনাগুলো অবশ্যম্ভাবী শব্দের ধ্বনি ও রূপকল্পের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে প্রজাপতির মতো মনের গুটি কেটে বেরিয়ে আসে। আমরা ওই ভাবনার প্রজাপতিকে কবিতা বলে সনাক্ত করি। এ হলো কবিতা সম্পর্কে আমার এক ধরনের অনুভূতি— অন্য অনেক ভাবে অনেক উপমায় কবিতার স্বরূপ নির্ণয় করা যায়। পুরাকাল থেকে সমসাময়িক কালের কবি, দার্শনিক ও সাহিত্যবেত্তারা কবিতার অসংখ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন। এতো সব সংজ্ঞার মধ্য দিয়েও কবিতাকে পরিপূর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় নি। প্লেটো, এ্যারিস্টটল, শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, শেলী, কিটস্, বায়রন, ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ, এডগার এলেন পো, রবার্ট ফ্রস্ট, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান ও ফজল শাহাবুদ্দীনসহ সহস্রাধিক কবি ও দার্শনিকের উদ্ধৃতি এখানে দেয়া যায়। এসব সংজ্ঞা উগরে এনে চিবোতে চাই না। তা করা শোভনও নয়। আমি কি লিখি তার সোজাসাপটা জবাব হচ্ছে— আমি আমাকে লিখছি প্রতিদিন। আমার প্রেম, আনন্দ, বেদনা, কাম, ক্রোধ, রাগ, মোহ, মাৎসর্য্য, স্বপ্ন এবং ¯্রষ্টাকে কবিতায় ধরতে চাই— আঁকতে চাই মাত্র। এই অঙ্কন প্রক্রিয়ার মধ্যে যখন থাকি তখন এক অনির্বচনীয় সুখ অনুভব করি। ভাব ও ভাবনার সঙ্গম যখন আমার ভেতরে চলে— তখন যে সুখ হয়, তা রতিসুখেরও অধিক। এই সুখ উদ্্যাপনের জন্যই আমি লিখি। আমি সমাজ বহির্ভূত কেউ নই, সমাজের নানা বিষয় আমাকে তাড়িত করে, আলোড়িত করে, সেই আলোড়ন থেকেও জন্ম নেয় কবিতা।
আমি কীভাবে লেখা শুরু করেছি এবং কীভাবে ‘কবি’ অভিধাটি আমার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তা সংক্ষেপে তুলে ধরছি। তখন প্রথম কি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। লিখতে শিখেছি। মা কি কারণে যেন মেরেছিলেন— মনে নেই। মার খেয়ে স্লেটে কিছু একটা লিখেছিলাম। মা তা পড়ে বলেছিলেন, টুটুল কবি হবে। কবি আমি হতে চাই নি। হতে চেয়েছিলাম মোহন কিংবা বাহরামের মতো দস্যু। হতে পারি নি। এরপর, ভবঘুরে হতে চেয়েছি— পৃথিবী দেখার জন্য। তাও হতে পারিনি। চুপি চুপি কবিতা লিখেছি। নিজের হাতে বাঁধাই করা খাতায়। কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশের অনেক আগেই পারিবারিকভাবে কবি স্বীকৃতি জুটে যায়। যদিও এর আগে স্কুলে পড়ার সময় মাথাটা আরো বিগড়েছে, তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি স্কুলে পোয়েট্রি ওয়য়ার্কশপ করাতে এলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সেই কর্মশালার পরে মাথায় আরো কবিতা লেখার ভুত চাপলো। সুযোগ পেলেই স্কুলের খাতায় কিংবা ডাইরি তে কবিতা লিখি, এর কারণে মাঝে মধ্যে বকা খাই শিক্ষকদের কাছে আবার পাশাপাশি খুন্তির বারি খাই মা এর হাতে। একবার তো আমার এক শিক্ষক সরাসরি আমাদের স্কুলের প্রিন্সিপাল ফাদার ভেন এর কাছে আমার নামে নালিশ করলো আমি ক্লাসের মধ্যেও কবিতা লিখি, কিন্তু নালিশ করতে গিয়ে আমার সেই শিক্ষক পরলো আরো বিপদে, ফাদার আমার লেখা কয়েকটি কবিতা পড়ে স্যার কে বললেন তুমি একটি শিশুর সৃজনশীলতা’কে কেনো বাধা দিতে চাইছ আর আমায় বললেন আমি প্রতিদিন তোমার লেখা কবিতা পড়তে চাই কবি। তারও অনেক পরে একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে কবি হিসেবে আমার আত্মপ্রকাশ ঘটে। তখন বিএসসি’র ছাত্র দিল্লীর সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে। অনার্স যারা পড়েন তাদের লেখা নিয়ে একটি দেয়াল পত্রিকা প্রকাশিত হতো। দেয়াল পত্রিকাটি ছিল লাইব্রেরিতে। ওখানের এক অংশে বাংলা বিভাগের সেমিনার ছিল। দেয়াল পত্রিকার কবিতা পড়তে পড়তে কয়েকটি কবিতার প্যারোডি করে ফেলি। শুনে পাশে দাঁড়ানো জনৈক কবিতা লিখিয়ে ক্ষেপে যান। আমি তখন বলেছিলাম, যে কোনো মুহূর্তে একই জায়গায় বসে এর চেয়ে ভালো একাধিক কবিতা আমি রচনা করতে পারি। লিখে দেখিয়ে দেয়ার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া হলো। একশ টাকা বাজি রেখে লিখতে বসলাম। জুরিদের বিবেচনায় আমার লেখা দু’টো ভালো কবিতা হওয়ায় একশ টাকা জিতে নিলাম। ওই টাকা দিয়ে সন্দেশ কিনে এনে ছাত্রদের মধ্যে বিতরণ করা হলো। রাতারাতি কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে আমার নাম ছড়িয়ে পড়লো। আমার নামের সঙ্গে ওরা জুড়ে দিলো ‘কবি’ অভিধাটি। এরই সুবাদে দিল্লি বাঙালি এসোশিয়েশানের ছাত্র সংগঠনের ম্যাগাজিন সম্পাদনার দায়িত্ব পেলাম। যারা ওই ম্যাগাজিনের জন্য কবিতা দিয়েছিলেন, তাদের লেখার বিষয়বস্তু ঠিক রেখে প্রায় সকলের নামেই কবিতা লিখে দেই। ছাপা কবিতা দেখে কেউ চটে যান নি, বরং খুশি হয়েছিলেন।
এরপর কবি সম্মেলন, দর্শনির বিনিময়ে কবিতা পাঠের আসর— এসব নিয়ে মেতে উঠলাম। তখন আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন আমার শিক্ষক অধ্যাপক জশপাল, ডঃ নরেন্দ্র কে সেগাল, প্রমুখ। কেন লিখি তা ইতোমধ্যে বলা হয়ে গেছে। কি লিখি সে বিষয় নিয়ে তুলোধুনো করার অধিকার বন্ধুদের উপরে এবং আমার পাঠকদের হাতে ছেড়ে দেয়া গেল। সবশেষে মার্জিনে কবি ও কবিতা সম্পর্কে দুটি কথা। কবিতার ঘোরে জীবনের দীর্ঘপথ পেরিয়ে এসে জেনেছি, কাব্য হচ্ছে মানুষের মর্মমূল থেকে প্রবাহিত চেতনার নাম। এই চেতনা-নদীর জল শুশ্রƒষার। শুশ্রূষার জল নিয়ে নদী বয়ে যায় কল্যাণের দিকে। কবিদের কেউ কেউ এই নদীটির বড় বড় ঢেউ, কেউ কেউ ছোট ছোট ঢেউ। কেউ কেউ নদীটির জলকণা। এই বোধে সকল কবি আত্মজনেষু। কবিতা লিখে অর্থ জোটেনি, পেয়েছি অপার ভালোবাসা। তবু একী তৃষ্ণা আমার অমৃতের তরে।
আমি জানতাম না চব্বিশের জুলাইটা এত দীর্ঘ হবে, আমি জানতাম না, অগাস্টকেও রাহুর মত গ্রাস…..
অভিশাপ মেঘের ভেলায় নিঃশ্বাসে ক্লান্তির ছাপ সবুজের নীড়ে আপন ঠিকানার খোঁজ এক ফালি সুখের নেশায়…..
পাখি দম্পতি পাখি গিয়েছিল কতদূর বনে তা কারো নেই জানা। ঠোঁটে ধরা লাল টুকটুকে ফল…..
তারা যেমন বলে, চোখে ধুলো দিলে থেমে যাবে আমার কাব্যময়তা অথচ আমি প্রামান্য দলিলের নই…..