প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নারী ও শিশু পাচার আটকাতে ব্যস্ত সোফিয়ার মোবাইলে ফেসবুক মেসেঞ্জারে কিছু ঢপের শাড়ি জামাকাপড় গ্রুপ ছাড়া যখন কোনো আনকোড়া ডাকের মেসেজ আসে না ঠিক সেইসময়ে অনেকদিন পর্যন্ত যে ডাকের অপেক্ষায় ছিল সেই ডাক এলো। মন খারাপের রঙহীনতার সন্ধ্যায় হঠাৎ “Free on Sunday morning?”
সোফিয়া চুপ। উল্টোদিকে কী জবাব দেবে বুঝে উঠতে না পেরে আবার যে বিরাট ট্রান্সক্রিপশনের বোঝা মাথায় চেপে আছে তাতে মনঃসংযোগ করল।
কিন্তু না মন পড়ে রইলো সেই মেসেঞ্জারের মেসেজে। শেষে কী মাস্টারমশাইর ডাক এলো নন্দিন। কেন এলো সেই ডাক, কিছু বোঝার আগেই বসন্ত বাতাসের ঝাপটে চুল এলোমেলো। না পেরে জবাব।
সোফিয়া: শনি রবিবার আমার পড়ানো থাকে। সেটা সল্টলেকে।
মাস্টারমশাই: Saturday bikel 5tai? we could meet for a cup of tea.
সোফিয়া: সত্যি অবাক।
ফোন বেজে ওঠে ও প্রান্তের পুরুষ মানুষটিকে সোফিয়া জানায় রবিবারে সেডিউলে তার ক্লাস না রাখতে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মনের কোনো এক গোপন প্রান্তের গভীর ইচ্ছা থেকে ক্লাস অফ করালো।
সোফিয়া: আমি এখনই খবর পেলাম যে, এই রবিবার আমার ক্লাস নেই। আমি সকালে যেতেই পারি।
মাস্টারমশাই: Sunday morning is better, it would be easier to return. 10.30? My cell no. is………I ask my friends to use it only if there is urgent business. I prefer communicating by email, sms, messenger, etc.
সোফিয়া: কোথায় দেখা হবে?
মাস্টারমশাই: At my place… ঠিকানা দিয়ে দেয়। অভিদীপ্তা কমপ্লেক্স……
সোফিয়া: সুরটা কেমন অন্যরকম। যাইহোক না কেন খুব ফরমাল। অথচ আমাকে ডাকছে।
এ ডাকের মানে বুঝতে না বুঝতে আবার মন দেয় কাজে।
শুক্রবার এই মেসেজ চালাচালি হয়েছিলো তাদের মধ্যে। সোফিয়া ভাবল হাতে আর দুটো দিনের অপেক্ষা। এটা কাউকে বোঝাতে পারবে না। এ আনন্দ একমাত্র নিজের সাথে ভাগ করে নেওয়ার। কিছু কিছু আনন্দ আর দুঃখ শুধু নিজেরই হয়।
১৪ বছর আগের ঘটনাগুলো এদিক-ওদিক থেকে হাত পা ঝাড়া দিয়ে উঠছে।
সোফিয়া: ২০১৪ সালে আরও একবার তোমার কাছে গিয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমার কোনো কথা শোনো নি সেইসময়ে। প্রায় তাড়িয়ে দিয়েছিলে তোমার বাড়ি থেকে, কষ্ট হয়েছিল কোথাও কিন্তু মনের মধ্যে ছিল ডাকতে তোমাকে হবেই।
ফ্ল্যাশব্যাক: আমাদের বসন্তদিন ছিল তখন। ন্যাশনাল লাইব্রেরি জুড়ে পড়ে থাকা হলুদ রাধাচূড়া আর লাল কৃষ্ণচূড়া লুটিয়ে পড়ত এর ওর গায়ে। আর চোখে চশমা এঁটে সোফিয়া খুঁজে চলত ঊনিশ শতকের ফাইল একটাই আশায় ঠিক সন্ধ্যে নামলেই কেউ একজন আসবে তাকে নিতে। সারাদিনের গল্প জমে থাকে তার জন্য। সোফিয়া তার গায়ের গন্ধটা চেনে, একটু উগ্র, ওয়াইল্ড। আর একটা অমলিন হাসি ছিল মুখ জুড়ে। তারপর তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে মাস্টারমশাই বাড়ি ফিরতেন। এমন কতদিন, কত সময়ে তাদের কেটেছে নিছক আড্ডা, গান আর কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে। সোফিয়ার সবচেয়ে ভালো লাগত যখন মাস্টারমশাই তার গান শুনতেন মন দিয়ে। বেলা পড়ে আসা বিকেলের ম্যাটম্যাটে আলোয় চোখে জল ভরে এলো। এইসব ভাবতে ভাবতে। অনেক কারণে সেই সম্পর্ক তারা রাখতে পারে নি। সোফিয়ার সেইসময়ে একটা ছোট নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছিল। যা মাস্টারমশাই কোনোদিনও জানতে পারেন নি, বা পারা সম্ভবও ছিল না। যাইহোক জীবন চলে, চলে যায় তাই তার আরেক নাম চরৈবেতি। আজও চলছে অলস পরিসর মেপে সেই আবেগ, গতি সবকিছু। শুধু মনের মধ্যে বেজে চলে এই আচমকা আমন্ত্রণের এক বিষাদযাপন। কত উত্থান পতন দেখলাম এই জীবনে সোফিয়া মনে মনে ভেবে চলে।
একবার সোফিয়ার এক গানের অনুষ্ঠানে মাস্টারমশাই গিয়েছিলেন, তার মনে আছে কী না জানি না, সোফিয়া তার একটি প্রিয় গান গেয়েছিলেন “অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া”, বেরিয়ে এসে মাস্টারমশাই কেঁদে ফেলেছিলেন বলেছিলেন তুমি এত ভালো গাও, গানটা নিয়ে কিছু করছো না কেন? আসলে সে তো কোনোদিনও নিজের জন্য সময়ই পায় নি, অন্যদের বিখ্যাত করতে তাদের কাজ করতেই দিন অতিবাহিত। সংসারে অশান্তি থাকলে আর যাই হোক না কেন কোনো ক্রিয়েটিভ কাজ হয় না।
আজ শনিবার। বেশ ডিপ্রেসিভ ওয়েদার। রোদ না উঠলে খুব মন খারাপ লাগে। মনের খোঁজ কতদিন রাখা ছেড়ে দিয়েছিল, আবার ভালো লাগছে নিজের মনের খোঁজ রাখতে, মনকে যত্ন করতে।
আর কিছুক্ষণ তারপরেই দেখা হবে। এমনটা হচ্ছে কেন? একটা টিনএজ টিনএজ ভাব। কতদিন বাদে দেখব, কথা বলব, কেমন আছ তুমি। কী করছ এখন। অবসরপ্রাপ্ত জীবন কেমন কাটছে। সব মিলিয়ে অনেক প্রশ্ন। সময়গুলো মনে হচ্ছে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। সিকোয়েন্স হারাচ্ছে। কে কার পরে বুঝে ওঠার আগেই আবার ট্রান্সিক্রপশনে মনোযোগ। কালকের আগে কাজ শেষ করতে হবে। একটা ফ্রেশ মুডে যেতে চায় তার কাছে।
রাত বাড়লে কষ্টও বাড়ে যে। সারারাত ঘুম আসে না। গলা শুকোচ্ছে। এপাশ আরও পাশ। ডাকলে কেন আমাকে এর উত্তেজনায় সে ঘুমোতে পারছে না। এত অবুঝ কেন আমার মন। ধৈয হারাচ্ছে। নিস্তব্ধ রাতের বারান্দায় বেরিয়ে এসে সিগারেট ধরায়। নিথর এক টান। জ্বলতে নিভতে থাকা এক আকাশছোঁয়া বিল্ডিং এর আলো। মন চল নিজ নিকেতনে। শীতের হাওয়ার যে নাচন ধরল মনে তার পরশ তুমি কি পেলে না পেলে না, পাবেও না। এ একান্তই আমার।
সাধারণত রবিবারের সকালে দেরী করে ঘুম ভাঙে, কিন্তু কাল তো সারারাত ঘুমোয় নি। ভোর হতে দেখা, আলো ক্রমে আসছে জীবনের পথে। একা জেগে থাকা রাত ক্রমশ তার মর্মস্পর্শী শীতায় জড়িয়ে নিচ্ছিল। কেউ নেই কেউ থাকে না। জীবন আসলে একার এ অনুভূতির মর্মার্থ বুঝেছি সেদিন থেকে মনকে শান্ত করেছিলাম, কিন্তু তোমার ডাক সেই শান্ত মনকে কেন অশান্ত করল আজ। তবে কি আজও তোমার প্রতি বিশেষ অনুভূতিটি রয়ে গেছে? সময়ের অপেক্ষা, অপেক্ষা উত্তরের।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট সময় ১০.৩০ আর সোফিয়া বেরল ৯.৩০। এতো আগে কেন? কিছু টুকটাক কিনে নিয়ে যাবে। আজ আর মনে পড়ছেনা মিষ্টি খেতে ভালোবাসতেন কী না? সময় অনেককিছু যে ভুলিয়ে দেয়।
বাতাসে হাওয়ার তালে এ কোন ইঙ্গিত! শীতেও কেন এই বসন্তের ডাক। মোড়ক খুলে নতুন করে ভালোবাসাকে দেখছি, তোমাকে। যে তুমি গভীর এক অনুভূতির সাথে একাকার।
আজ কি নিজেকে সাজাবার দিন? কী পরব? যে সোফিয়াকে শেষ দেখেছো তারচেয়ে অনেক পাল্টে গেছে। নিজেকে পাল্টাতে ভালোবাসে। গতি আসে। চুলের সামনেটা এখন স্ট্রেইট। আগে তো যেখানেই যেতাম সেখানেই খোঁপা, অন্য কোনো চুল সংক্রান্ত ফ্যাশন করার অধিকার ছিল না। চরম অশান্তি থেকে বাঁচতে শেষমেষ খোঁপায়। সেই আমি এখন চুলই বাঁধি না। কোনোদিনও চুল বাঁধতে ভালো লাগত না। আজও লাগে না। বেশ ঢেউ খেলানো চুল পিঠ বেয়ে নামবে আর মাঝেমাঝে তুলে নেওয়া মন্দ নয়। এতকিছু ভাবতে গিয়ে দেরী না হয়ে যায়। লং ড্রেস চাপিয়ে বেরিয়ে পড়া। সামনের দোকান থেকে একটু হলুদ ফুল কিনতে চাইল, ভাবতে ভালো লাগল দরজা খুললেই একতোড়া হলুদ ফুল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে বুকের ওপর। না না এইসব আনকাট ডিসকাশন থাক, এইবার গন্তব্য অভিদীপ্তা।
সোফিয়া: কতদিন পরে কেউ অপেক্ষায়। ওয়েটিং ফর গোডো।
বাডি থেকে অভিদীপ্তাতো সবমিলিয়ে গাড়িতে লাগে ১০ মিনিট। হেঁটেও পৌঁছানো যাবে। হাতে সময় আছে আর বিকেলের হাঁটা ও উত্তেজনা কমানো একঢিলে দুই পাখি। এইসব বড় বড় আবাসনে ঢুকতে বড় কষ্ট পেতে হয় সিকিউরিটিকে প্রমাণ দিতে দিতে। কেন থাক এমন বাজে জায়গায়। দম আটকায় ছি! ভালো লাগে না। হাওয়া দোল দেওয়া গাছের ফাঁক ফোকোর দিয়ে হেঁটে পৌঁছানো টাওয়ার নং ৩। আবার নাম লেখ, উফ নিজের নাম ভুলিয়ে ছাড়বে মনে হচ্ছে। একজন একটা ফোন করল ওপরে আপনার গেস্ট এসেছেন।
লিফ্টের কাছে পৌঁছে সোফিয়ার মনে হতে লাগল এইবার উত্তেজনায় সিওর হাট আ্যটাক করবে। ১৫ তলা, লিফ্টের দরজা খুলে গেল একটু এগোতে না এগোতেই চেনা গলা।
এসো এসো।
দরজা বন্ধ হতেই সেই উগ্র গন্ধটা জডিয়ে ধরল। তার মনে হল একটা চুমু খাই। ঠিক আগের মত করে, দরজা বন্ধ হলেই ঠোঁটের আলতোতা শুষে নেওয়া। কিন্তু না সংযত হও, নিজেকে এই আবেগে ভাসিও না। কাগজের নৌকা বানাতে বানাতেই কত জীবন চলে যায় ভাসানো আর হয় না, মাস্টারমশাই।
কথা শুরু হওয়ার অপেক্ষায়।
বল খবর কী? তোমাকে আজ আমি আমার কারণেই ডেকেছি। সম্পূর্ণ মেডিকাল গ্রাউন্ডে। তার আগে চা হয়ে যাক।
টুকটুক করে চেয়ার ঘুরিয়ে রান্না ঘরের দিকে তারা। সোফিয়া ব্যাগ রেখে পিছু নেয়।
১৫ তলার বারান্দা থেকে ধূসর আবরণে ঢাকা শহরের নোনা ধরা স্মৃতি খেলা করে তার মনের ভিতর। একসময়ে এ বাড়িতে ছিল তার অবাধ যাতায়াত। যে কোনো জায়গায়, যে কোনো সময়ে কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই। আজ এতদিন বাদে যখন ভিউ ফাইন্ডার চালিয়ে রিওয়াইন্ড মোডে ক্যামেরা বসিয়েছে তখন সে বড্ড মলিন, ধুলো ঝাড়া হয় নি কিন্তু আস্তরণ সরালেই নিপাট হয়ে পড়ে আছে।
চা ভিজতে দিয়ে আবার লিভিং রুমে ফিরে আসে তারা।
ছটফট না করে বস। আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনার দরকার আছে তার জন্যই ডেকেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম তোমাকে লিখে পাঠাব কথাগুলো তারপর ভাবলাম যে তোমাকে যতদূর চিনি (সোফিয়া ভাবে এখনও তুমি আমাকে চেন) খুব ব্যস্ত হয়ে পড়বে তাই ডেকে পাঠানো। সময় গড়িয়ে গেছে অনেকটা, সম্পর্কটাও আর সেই জায়গায় নেই কিন্তু কথাগুলো বলা খুব দরকার।
চা ভিজে ওঠে, পাপড়িগুলো খুলে পুরো পাতাগুলো নিজেকে মেলে ধরেছে। সুগন্ধ হাল্কা লিকার হাতে নিয়ে যে যার মত আবার পুরণো জায়গায়।
টেবিলগুলো যথারীতি ধুলোর আস্তরণে কাহিল মনেও বোধহয় সেই ধুলোর ছোঁয়াই লেগে আছে।
মাস্টারমশাই: আমি প্রথমেই বলতে চাই তোমার কাছে আমি ভীষণভাবে ঋণী। ২০০৪ সালে আমি যখন পডে যাই তখন তুমি যেভাবে আমার পাশে ছিলে সেখান থেকেই আমি অত তাড়াতাড়ি রিকোভারি করতে পেরেছিলাম। এটা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই।
সোফিয়ার চোখে অজান্তেই জল এসে যায়। এতদিন বাদে এইসব কেন। তবে কোথাও একটা তৃপ্তির আনন্দ ছিল।
কিন্তু এর সাথে আর ও কিছু কথা আছে। ডাক্তারের অ্যাডভাইস অনুযায়ী তোমাকে ডেকে পাঠানো। ২০০৫ সালে যখন আমাদের সম্পর্কটা ভেঙ্গে যায় তারপর থেকে দীর্ঘদিন আমি তোমার ওপর রাগ আর ঘৃণা ছাড়া কিছুই করতে পারি নি। সেটা থেকে বেরুতে না পারলে শান্তি নেই। তাই তোমাকে ডেকে বলতে চাইলাম এতোকিছুর পর তোমার প্রতি আমার আর কোনো ঘৃণা নেই রাগ নেই। তবে এটাও ঠিক তোমার সাথে যোগাযোগ থাকবে না। আর কোনো মেসেজের জবাব দেব না। এটাই শেষ দেখা।
সোফিয়ার সবকিছু গুলিয়ে গেল এক লহমায়। অনেক আশা নিয়ে যে সে ছুটে এসেছিল, অজান্তেই। আচ্ছা যদি ক্ষমাই করে দিতে পার তাহলে তো বন্ধুত্ব রাখতে আপত্তি কোথায়।
সোফিয়া: তুমি কি নিজেকে ভয় পাচ্ছ? আবার যদি জডিয়ে পড় অমার সাথে, আবার ট্রমা। আসলে নিজের প্রতি সাবধান বানী দিতেই আমার আজকের নেমন্তন্ন। তুমি ডাকলে আর আমি তো এক ডাকেই চলে এলাম সাতপাঁচ না ভেবেই। এতোটাই কনফিডেন্ট আমি। আর তুমি কী না আমাকে ডাকলে অস্থির করতে। কেন? এই তোমার গ্র্যাটিচুড!
১৫ তলা থেকে এক ঝলকে ঝাপসা হয়ে আসে চারপাশ। বৃষ্টি না হলেও ঝাপসা হয় চারপাশ। অন্তলীন এক কামনা তোমার প্রতি। এতো বছর এতো উত্থান পতনের পরেও এক ডাকে ছুটে আসা। সব হারানো তুমি জানো না। কোথায় ছিলে তুমি তখন আমার সেই নিদারুণ সময়ে একটা সৌজন্যের ফোনও কর নি। খোঁজ নিয়েছিলে কেমন আছে সোফিয়া। নাও নি। অনেক অভিমান। আমি ক্ষমা চাইতে গিয়েছিলাম তাড়িয়ে দিয়েছিলে। আসলে আজও তুমি তাড়িয়ে দিতেই ডেকেছে আমাকে, বন্ধুত্ব দিয়ে গ্রহণ করতে নয়। এ এক ধরনের নিষ্ঠুরতা।
আমরা প্রসঙ্গান্তরে যাচ্ছি। কিন্তু আমি আর সোফিয়া কিছুতেই এই আলোচনা থেকে কোনো সিদ্ধান্তের দিকে পৌঁছোতে পারলাম না, যে আসলে আমি কী করব??
ইতোমধ্যে মাস্টারমশাইয়ের তো বেশ কয়েকটি ফোন এলো।
আর তুমি যে বললে আমার থেকে ২২ বছরের বড় হয়ে তুমি সেদিন খুবই ইমম্যাচিওর এর মতো কাজ করেছিলে তাহলে, আজকে তো আরও বেশী ইমম্যাচিওর এর মত কাজ করলে শুধু তাই নয় অমানবিক কাজ। এরচেয়ে যোগাযোগ না করতে পারতে, আমি তো চালিয়ে নিচ্ছিলাম জীবন। এতো ঠুনকো জীবন, অত অসহায় তো নই তাহলে কেন তোমার কাছে দূর্বল হয়ে পড়ছি।
দূর্বলতা আর আবেগ ঝাপটা মারছে সোফিয়ার মনের ভিতর। একবার মনে হচ্ছিল নিজেকে উজার করে দিই তোমার কাছে, অভিমান আটকে দিল।
মাস্টারমশাই: ভালো থাকাটাই খুব জরুরি। নিজেকে ভালো রাখা। তুমি ভালো থাক। তুমি কোনো সম্পর্কে যাচ্ছ না কেন?
সোফিয়া: যাদের আমি পছন্দ করি তারা যে আমাকে আর পছন্দ করে না। ঠোঁটের কোলে মিষ্টি হাসি আটকে রেখে।
মাস্টারমশাই: আরে এখন অনেক ডেটিংয়ের সাইট আছে সেগুলোতে যাও খোঁজ পাবে নতুন বন্ধুর।
সোফিয়া: তোমার কি আমার সম্পর্ক রইল না রইল! বলতে ইচ্ছা করছিল তুমি কে বলার?
মাস্টারনশাই: জীবন বড় লম্বা তোমাকে যতদূর চিনি পারবে না একা সামলাতে। আর যত বেশি একা থাকবে ততই তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে।
সোফিয়া: কতদূর চেন তুমি আমাকে আর। সব ঝামেলা একাই সামলেছি, সামলাই। জান না।জানতে চাও নি। আর একা থাকা, সে তো অভ্যেস তুমি যদি থাকতে পার তাহলে আমিও পারব। আর যদি চাই তোমাকে বাদবাকি জীবনের জন্য, দীর্ঘ নিশ্বাস পড়ে।
এ এক অদ্ভুত গেরোতো এতদিন বাদেও সোফিয়া কেন এতো কষ্ট পেল ওই বাক্যটা শুনে, এরপর আর যোগাযোগ রাখব না, আর কোনো ঝামেলা নিতে পারব না। কিসের ঝামেলা বন্ধুত্ব রাখা মানে এসব। জানি না। মাথার ভেতর তালগোল পাকাচ্ছে। সোফিয়ার সত্যি খুব চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
প্রসঙ্গ পাল্টায়। কারণ সোফিয়া বুঝতে পারে এ বিষয়ে ঘ্যানঘ্যান করে লাভ নেই। সম্পর্ক তো ঢেউয়ের মতো, যেতে দাও; ফেরার হলে আপন ছন্দে ফিরে আসবে।
সোফিয়া: সারাদিন কী কর?
মাস্টারমশাই: পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্ডলে অনেক গোয়েন্দা গল্প ডাউনলোড করি আর পড়ি।
সোফিয়া ইতি উতি দেখে। একসময়ে অবাধ যাতায়াত তোমার সংসারে ছিল। কী অযত্নে সমস্ত জিনিস পড়ে আছে। এরচেয়ে আমার বাড়ি পরিস্কার থাকে। বইপত্রগুলো অগোছালো। মনে হচ্ছিল এক্ষুণি নেমে পড়ি ঘর গোছাতে। তুমি কে? কেন গোছাবো ঘর?
মাস্টারমশাই: মুভমেন্ট খুব রেস্ট্রিকটেড হয়ে গেছে। কলকাতায় কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কোনো সিনেমা হলে রাম্প নেই, থিয়েটার দেখতে যেতে পারি না, সেখানেও হুইল চেয়ার নিয়ে ওঠা যায় না। কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার উপায় নেই। হুইল চেয়ার ঢোকানো যায় না। যাই মাঝে মাঝে শপিং মলে বাজার করতে। আর বন্ধুরা আসে বাড়িতে, বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে খাই। এভাবেই চলে জীবন। আর রেকর্ডিং করি বাচ্চাদের জন্য। যারা দৃষ্টিহীন তাদের জন্য করলাম, ভোদর বাহাদুর, ক্ষীরের পুতুল। এখন এটাই ভালো লাগে। বিদেশে যাওয়ার উপায়ও নেই। হুইল চেয়ার বাউন্ড মানুষদের জন্য টয়লেট নেই ফ্লাইটে। ইচ্ছে থাকলেও যাওয়ার উপায় নেই। এ নির্মম সত্য, তাই মেনে নিয়েই জীবন। তাও আমার অনেক বন্ধুর অসুখী দাম্পত্যযাপনের তুলনায় ভালো আছি। খাসা আছি।
পাতা ঝরার আওয়াজ কানে আসে। উত্তরে হাওয়ার কাল। দোল দেওয়া হাওয়ায় হুহু করে বুকের ভিতর। কষ্ট হচ্ছে। সোফিয়ার মনে হয় আমি থাকলে কত যত্ন করতাম। তখনও তো আমরা কত জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম। আমি সঙ্গে থাকলে তুমি খুব আনন্দে থাকতে। সেই অমলিন হাসি। সেই গায়ের গন্ধ!
ইতোমধ্যে দুজনেরই কয়েকটা ফোন আসে। টুকটাক কথা সেরে তারা আবার নিজেদের প্রসঙ্গে।
মাস্টারমশাই: কলকাতা ছাড়তে চাই। বরাবরের আমার প্রিয় জায়গা শান্তিনিকেতন, সেখানে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকব ভাবছি। এ মালের শেষে সেটা দেখতে যাব। বাড়িওয়ালার সাথে প্রাথমিক কথায় মনে হয়েছে আমার মতন করে কিছু সুযোগ সুবিধা করে নিতে দেবেন। যাব সেইসব কথাই বলতে। নির্জন জায়গা ভালো লাগে। নিজের মতো সময় কাটানো।
সোফিয়া: একটা মানুষ সে তার মুভমেন্ট রেস্ট্রিক্ট করে দেবে সরকারের কোনো মাথা ব্যথা নেই।
মাস্টারমশাই: মানুষ খেতে না পেয়ে রাস্তায় ফুটপাতে দিন কাটাচ্ছে আর আমি বলব আমি কেন সিনেমা নাটক দেখতে পাচ্ছি না, আমার জন্য রাম্প তৈরি হোক। এ হাস্যকর। আমাদের মত মানুষের সংখ্যা ক্রমশ আরো কমছে, তাই এ নিয়েই জীবন।
সোফিয়া: সত্যি মেনে নেওয়া আর না নেওয়ার মাঝের লাইনটা ডিসলভ হয়ে যাচ্ছে। সময় কতদূরে পাঠিয়ে দেয় দুটো মানুষকে। তাদের প্রতিদিনের বাঁচা না বাঁচা কত অজানা হয়ে গেছে আজ। তার বাইরে যে নিছক আড্ডা সেটা খুব সুন্দর। আমাদের দৈনন্দিন বেঁচে থাকাগুলোকে আমরা কীভাবে অতিক্রম করি। তুমি পারলে সমস্ত বাঁধা সরিয়ে নিজেকে ফাংশনাল রাখতে। সেটাই অনেক বড়। অনেকে তো পারে না মেনে নিতে।
মাস্টারমশাই: আমি দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে প্রতিবন্ধী ভেবে এসেছি তবে এখন সেই জায়গা থেকেও বেরিয়ে গেছি যখন ওই দৃষ্টিহীন বাচ্চাগুলোর সাথে কাজ শুরু করলাম। পৃথিবী এত সুন্দর তা তো আমি দুচোখ ভরে দেখলাম, তার রূপ, রস গন্ধ অনুভব করলাম। ওরা তো পারল না। প্রতিবন্ধকতা কি সেটা ওরা মর্মে মর্মে অনুভব করে। আমি নই।
সোফিয়া: জীবন তো নদীর মত, বহতা। কী যে এইসবের জবাব হয় সোফিয়া নিজেও জানে না। শুধু পাতা ঝরার আওয়াজ বাড়তে থাকে। বাইরে ধূসর শহরের রঙ আরো ধূসরতর। জীর্ণতার আলগোছে পড়ে থাকা। এ কেমন শহরে আমরা থাকি যেখানে মানুষ মানুষের জন্য ভাবে না। তাহলে কি চিন্তার দুর্দশার সূত্রপাত এখান থেকেই?
বেলা গড়িয়ে যায়। আড্ডা শেষ হয় না। আর ও কত গল্প না বলাই থেকে যায়। সোফিয়ার নিজের কথা প্রায় বলাই হয় না। তিন চার ঘণ্টা কেটে গেল অথচ মনে হচ্ছে আর ও সময় চাই। স্নান খাওয়া বাকি। বাড়ি ফিরে আবার সেই ট্রান্সক্রিপশন নিয়ে বসতে হবে।
সোফিয়া:আমি এবার উঠব।
মাস্টারমশাই: হ্যাঁ আমাকে ও অনেক ফোন আ্যটেন্ড করতে হবে।
সোফিয়া এগোতে থাকে জুতো পড়বে বলে। আবার সেই গন্ধটা। তাড়া করে ফিরছে তাকে।
মাস্টারমশাই: আজকের মত তাহলে এখানেই শেষ। ভালো থেক। তোমাকে কথাগুলো বলে বোধহয় আমি নিজে হাল্কা হলাম। এরপর আরো ভালো থাকতে পারব আশাকরি। আমি চাই তুমিও ভালো থাক।
সোফিয়া: আজকের মত শেষ মানে কী? তুমি তো বললে আর দেখা হবে না।
মাস্টারমশাই: মুচকি হেসে। হ্যাঁ তাই তো।
সোফিয়া: দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে মন খারাপ করছে।
মাস্টারমশাই দরজার লক খুলে বেরিয়ে আসেন পেছনে সেফিয়া লিফটের দিকে এগোন তারা।
লিফ্ট ওপরে উঠছে। সোফিয়া ভাবে আর ও সময় নিক লিফ্ট আসতে।
লিফ্ট আসে। বেলা পড়ে আসা নরম আলোয় তোমায় দেখে নেওয়া। এ শেষের শুরু না কি শুরুর শেষ! লিফটে ঢুকে যায় সে। লিফ্ট বন্ধ হচ্ছে। বন্ধ হওয়ার আগ মুহূর্তে আমি কিন্তু মেসেজ করবো। পাতা ঝরার আওয়াজ বাড়তে থাকে, আর উত্তর আসার আগেই লিফ্টের দরজা বন্ধ হয়। লিফ্ট নামতে থাকে দ্রুত কোনো এক পাতালমুখী শহরের অন্দরে।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..