এক গ্লাস হুইস্কি

দেবশ্রী চক্রবর্তী
গল্প
এক গ্লাস হুইস্কি

জীবনের পাওয়া আর না পাওয়ার এই চক্রব্যূহের আবর্তের মাঝে বসে থাকোতে থাকোতে চারপাশটা কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে আসে। এ তো মৃত্যুর সমান। মৃত মানুষ আর টিসার মধ্যে কোন পার্থক্য কি আছে? না কোন পার্থক্য নেই। মৃত মানে তো প্রাণহীন, যেমন এই বাড়ির আসবাবপত্র গুলো। এই সব কিছুর সাথে আজ সে একাত্ম অনুভব করে। গত এক বছরে বাইরের পৃথিবীর কতটা পরিবর্তন হয়েছে সে অনুভব করতে পারেনি। বাইরের পৃথিবী আর তাঁর মধ্যে যেন কয়েক হাজার আলোকবর্ষের ব্যাবধান। টেবিলের ওপর রাখা হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে ছাঁদের দিকে তাকাল সে। ঝলমল করছে ঝাড়বাতি। যার আলো ছড়িয়ে পড়ছে অন্ধকার ঘরের প্রতিটা কোনায়। কিন্তু সত্য কি সে সব অন্ধকারকে সরিয়ে দিতে পারে? না পারে না। বাজারের থেকে কেনা ঝাড়বাতির এত ক্ষমতা নেই। টিসার নিজের প্রতি করুণা হয় আজকাল। সারা জীবন প্রতিটা সম্পর্ককে সে গুরুত্ব দিতে দিতে আজ তাঁর এই পরিণতি। সবাইকে খুশি করতে করতে কখন যেন সে হারিয়ে গেল।টিসা আবার হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে সামনের দেওয়ালের দিকে তাকাল। লাল দেওয়ালে ঝাড়বাতির আলো এসে পরে ঝলমল করছে, ছয়মাস আগে এরকম এক লাল শাড়ি পরে নব বধূর বেশে সে অপেক্ষায় ছিল তার স্বামীর। সেদিন যেন কোন এক দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হতে চলেছিল। সত্যিই তো দীর্ঘ এক প্রতীক্ষাই বটে। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েটি তার সম্পূর্ন অস্তিত্বে সতীত্বের এক কাল্পনিক আবরণে আবৃত করে রেখেছিল এক সম্পূর্ন অজানা মানুষের জন্য। যে মানুষটিকে সে কোন দিন দেখেনি, তার হাতে সে তুলে দেবে তার জীবনের সেই অমূল্য সম্পদ। কি যে আনন্দ হয়েছিল সেদিন। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান টিসা পেরেছে সেই অসাধ্য সাধন করতে। আজকালকার মেয়েদের থেকে সত্যিই সে আলাদা, নিজেকে অমূল্য এক সম্পদের মতন লাগল।

দরজায় একটা আওয়াজ পেতেই টিসা চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে নিয়েছিল। সভ্য ভদ্র হয়ে থাকতে হবে, বেহায়া মেয়ে গুলোর মতন প্রথম থেকে আলাপী হলে চলবে না। মায়ের প্রতিটা কথা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছিল।

রজনীগন্ধা ফুলের গন্ধে টিসার মন অবশ হয়ে আসছিল। মামাতো দিদি শুভ্রার মুখে সে শুনেছে প্রথমটা মনে হবে যেন এক ভূমিকম্প এসে চারদিক হেলিয়ে দিলো। ধীরে ধীরে এই ভূমিকম্পের অভ্যাস হয়ে যাবে। সে চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত দিয়ে অপেক্ষা করছিল সেই কম্পনের। টিসার মনে হল বিছানায় এসে কেউ বসল। এই প্রথম একজন পুরুষের শরীরের গন্ধের সাথে সে পরিচিত হল। পুরুষ মানুষের গায়ের গন্ধ আর ফুলের গন্ধ মিলেমিশে এমন এক গন্ধ তৈরি করল যা টিসাকে উত্তেজিত করে তুলল।সে আর চোখ বন্ধ করে বসে থাকোতে পারছিল না।

টিসা চোখ খুলে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জীবনের এক নির্লোজ্জ চিত্র তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। সমাজ যে চিত্রটিকে কত সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে তুলে ধরে মেয়েদের রঙ্গিন স্বপ্ন দেখান হয়। টিসার মনে হল সে যা দেখছে এই এক দৃশ্য কি সমাজের প্রতিটা মেয়েকেই দেখতে হয়? না তা তো শুভ্রা দি বলে নি। সে ভূমিকম্পের কথা বলেছিল। তাহলে কি এই সেই ভূমিকম্প। এর সাথেই নিত্য সহবাসের সাথে সে অভ্যস্থ হয়ে উঠবে। টিসার মাথা ঘুরতে লাগল। বহুদিন আগে চিড়িয়াখানায় এক বনমানুষকে দেখে তার গা গুলিয়ে উঠেছিল। সেই বনমানুষের প্রতি ভয়ংকর ঘৃণা এত তীব্র ছিল যে সে ভুলেও কোন দিন আর চিড়িয়াখানায় যায় নি। কারণ চিড়িয়াখানায় যদি তার সাথে আবার দেখা হয়ে যায়, তাহলে মনে আরো বেশি বিকৃতি দানা বাঁধবে। টিসার মনে হল মানুষ যাকে বেশি ঘৃণা করে, সেই জিনিশ মানুষের সাথে সবরকম ভাবে জুড়ে যায়।

সে তাকিয়ে দেখল তার ফুলশয্যার খাটে এক লোমশ নগ্ন পুরুষ বসে তার গোপনাংগে ধার দিচ্ছে, লোকটার ডান হাতে একটা গ্লাস। পরে সে জেনেছিল, এই পানিয়টির নাম হুইস্কি। লোকটাকে দানবের মতন মনে হচ্ছিল, সে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিল টিসার দিকে। লোকটা কোন কথা বলে না, সে প্রতি রাতে হুইস্কির গ্লাস হাতে নিয়ে গোপন অঙ্গে ধার দেয়, তারপর মোবাইল ফোন খুলে কিছু দ্যাখে। টিসা শুধু আওয়াজ পায়। পরে সে জেনেছে এই সব আওয়াজ নারী পুরুষের সঙ্গমের আওয়াজ, চূড়ান্ত উদ্দীপনায় এরকম আওয়াজ বেরহয়। কিন্তু এসব দৃশ্য তার কাছে ভয়ংকর মনে হয়। বিয়ের পর রাজনের বাবা মা আত্মীয় স্বজন সবাই চলে গেলে এই বিশাল ফ্ল্যাটে টিসা একা হয়ে পরে। সারা দিন ভয়ংকর নিঃসঙ্গতা আর রাত হলে এক দানবের সাথে রাত্রিবাস। টিসার বারবার শুভ্রাদির কথা মনে পরতে থাকে। দিদি বলেছিল ধীরে ধীরে এসবের সাথে অভ্যাস হয়ে যাবে তার। কিন্তু সেরকম তো কিছু হল না। কয়েক মাস কেটে গেছে তাদের বিয়ে হয়েছে, কিন্তু লোকটাকে চেনা তো দূরে থাক, তার সাথে বসে দুদণ্ড কথাও তো বলা হয়নি। বিয়ের ফুলের সাথে সাথে টিসার জীবনের সব আশা আকাঙ্ক্ষা, রূপ,রস,গন্ধ সব কিছু শুঁকিয়ে যেতে লাগল। এই কয়েক দিনের মধ্যে বিয়েটা কিরকম যেন পুরোন হয়ে গেল। নিজের মামাতো দিদি শুভ্রাকে সে দেখেছে বিয়ের পর কত সুন্দর সাজগোজ করে সে তার বরের সাথে বেড়াতে যেত। কিন্তু তার স্বামী তো তাকে কোথাও নিয়ে যেতে চায় না। তার দিকে তাকিয়ে দেখে না, তাই হয় তো সাজগোজের প্রতিও তার মন নেই।

খালি গ্লাসের দিকে তাকিয়ে ছিল টিসা, হঠাত মনে হল কেউ যেন পাশের ঘরে কথা বলছে। এখন তো সে এ বাড়িতে একা, তাহলে কথা বলছে কে? হুইস্কিটা মনে হয় একটু বেশি হয়ে গেছে, স্বামীর সহধর্মীনির সব গুনি তার মধ্যে যেন বিরাজ করছে। টিসা আবার গ্লাসে কিছুটা হুইস্কি ঢেলে নিয়ে পাশের ঘরে চলল। পাশের ঘরের থেকে এক মহিলার গলার আওয়াজ আসছে। টিসা হুইস্কিতে চুমুক দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে দাঁড়ায় সামনের ঘরের দরজার সামনে। এঘর আর ওঘরের মাঝের দরজাটা যেন এক দর্পন। দর্পনের মধ্যে দিয়ে টিয়া নিজেকে দেখতে পেল। সে বিয়ের লাল শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে তার স্বামীর সামনে। টিসার স্বামী এক মনে কম্পিউটারে কাজ করে চলেছে। টিসা তাকে বলল, রাজন , দেখতো আমাকে কেমন লাগবে আজ যদি বিয়ে বাড়িতে এই শাড়ীটা পরে যাই। রাজন তাকিয়ে দেখছে না। সে একমনে কাজ করে যাচ্ছে। এক সময় টিসা বিরক্ত হয়ে বলল, রাজন, তুমি কেন কথা বোলো না আমার সাথে? এত দিন আমাদের বিয়ে হয়েছে,আমি আজ পর্যন্ত তোমাকে ঠিক করে বুঝে উঠতে পারলাম না। তুমি কি চাও না চাও কোন কিছু আমি বুঝতে পারিনা।

টিসা দেখতে পাচ্ছে রাজন ল্যাপটপের কিবোর্ড থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে এবার টিসার দিকে তাকিয়ে দেখল। রাজনের দু চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে। এক মুখ ঘৃণা নিয়ে সে টিসাকে বলল, এখানে থাকোতে হলে এরকম ভাবেই থাকোতে হবে, আমার তোমার প্রতি কোন আকর্ষন নেই। আমার বাবা মায়ের কথায় শুধু এই বিয়েতে রাজী হওয়া। একটা বাচ্চার কোনক্রমে জন্মদিতে পারলে আমিও মুক্ত। অনেক হয়েছে, তোমার মতন এরকম গেঁয়ো একটা মেয়ের সাথে থাকতে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। কথা গুলো শেষ হবার আগে টেবিলের ওপর রাখা মোবাই ফোঁটা বেজে উঠল। টিসা দেখতে পাচ্ছে, তার মধ্যে লোলা নামটা ভেসে উঠছে। লাল শাড়ি হাতে নিয়ে টিসা তাকিয়ে আছে রাজনের মুখের দিকে। সে দেখতে পাচ্ছে রাজনের সারা মুখের বিষাদ মুছে আনন্দে পরিণত হয়েছে, সে নিজের চুল ঠিক করতে করতে লোলার সাথে কথা বললতে থাকল। সামনে টিসা দাঁড়িয়ে আছে , সে দিকে ভ্রূক্ষেপও করলনা সে। এটাই যেন স্বাভাবিক। এরকম হওয়াটাই উচিৎ।

হুইস্কির গ্লাসে চুমিক দিয়ে টিসা ফিরে এলো নিজের সোফায়। সে দেখতে পাড়ছে সারা ঘরের দেওয়াল যেন মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে পরিণত হয়েছে। তাতে ভেসে উঠছে একটি নাম, লোলা।

টিসা ধীরে ধীরে গ্লাসটা শেষ করে এগিয়ে গেল ঘরের এক কোনে রাখা গাছটার দিকে। সারা গাছে ফুল এসেছে। গাছের পাশে রাখা টেলিফোন। টিসা দেখতে পাড়ছে টেলিফোনের রিসিভার তুলে আরেক টিসা তার মায়ের সাথে কথা বলছে। মেয়ে তার মাকে অনুরোধ করছে, মা আমি আর পারছি না। আমি ফিরে যেতে চাই এবার।

টিসা দেখতে পাড়ছে, সে ফোনের রিসিভারটা রেখে ঘরের এক কোনে বসে কাঁদছে। এ দৃশ্য দেখে টিসার খুব রাগ হল। ও ছুটে গিয়ে গাছটার থেকে ফুল, পাতা, ডাল সব কিছু ছিঁড়ে ফেলতে লাগল।

এতক্ষণ টিসার চিত্র পাঠকরা দেখতে পেলেন হুইস্কির গ্লাসের এই ধারে। এই হুইস্কির গ্লাসের আরেক দিকে আরেকটি চিত্র আছে, আর তা হচ্ছে রাজনের। আজ সে অনেক রাতপর্যন্ত অফিসে কাজ করছে। সে একা বসে কম্পিউটারের সামনে কাজ করছে আর হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। রাজনকে খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে। সে এবার মোবাইল ফোন তুলে কারুকে ফোন করছে। ওপারে কেউ ফোন ধরতেই রাজন বলল, লোলা , প্লিজ আজকের রাতে কারুকে একটা জোগাড় করে দাও। হ্যাঁ, হোটেল রাজমহলের রুম নাম্বার ১০১ ।

ওপার থেকে সম্মতি পেয়ে রাজন অফিস থেকে নিজের গাড়ি করে চলল হোটেল রাজমহলে। রাজমহলের এই ১০১ নম্বর ঘরে নিত্য যাতায়াত তার। ফ্রিজ থেকে বরফ বার করে সে গ্লাসে দিয়ে চুমুক দিতে দিতে মনে হল দরজায় কেউ নক করল।

রাজন বলল, দরজা খোলা আছে, চলে এসো।

দরজা খুলে আগন্তুক প্রবেশ করল ঘরে। রাজনের মনে হল সারা ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। সে দাঁড়িয়ে আছে তপ্ত তাওয়ার ওপর। রাজনের হাত থেকে গ্লাসটা পরে গেল।

টিসা তার লাল রঙের ব্যাগ থেকে মোবাইল বার করে ফোন করল , তারপর বলল,

-লোলা, আমার এই কাস্টোমার পছন্দ না। তুমি আমাকে অন্য কারুর সাথে চেঞ্জ করে দাও।

ওপার থেকে লোলার সম্মতি পেয়ে টিসা ঘর বেড়িয়ে চলে গেল।

দেবশ্রী চক্রবর্তী। কবি, লেখক ও ঔপন্যাসিক। দেবশ্রীর জন্ম ১৯৮২ সালের ৯ ই এপ্রিল। উত্তর ২৪ পরগণার ইছাপুরে। আদি নিবাস বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কৈশোর কেটেছে ইছাপুরে। ইছাপুর নবাবগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর ব্যারাকপুর রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্স...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..