এক চুটকি স্রোত

নীলিমা দেব
কবিতা, প্রবন্ধ
Bengali
এক চুটকি স্রোত

কবিতা কেন পড়ি

ভ্রমণ চোখের হার্দিক তৃপ্তি, দৃশ্যের দোলাচলে দুলতে দুলতে নৌকোটা জলের তাথৈ-এ গুলিয়ে ফেলে সুধ-বুধ। একটা আবেশ, সুখ, আনন্দ, মোহে বিবশ হয়ে যায় সেই সময়ের টুকরো টুকরো প্রতিচ্ছবি। ঠিক তেমনি কবিতা মনের চেয়েও বেশি আত্মার ভ্রমণ। কোথায় উৎস আর কোথায়-ই বা ভেসে যাওয়া ঋতুর সালোকসংশ্লেষ তা কী আর বোঝা যায় কিংবা বোঝানো? অনন্তের দিকে ছোটে যাওয়া মৌলিক মোশন  স্রোতের উনুনে দিয়া বুনে নীরবে ।

যখন থেকে কবিতা একটু আধটু পড়ি তখন থেকেই তার প্রতি একটা নাড়ির টান অনুভব করি। মনে হয় একটা ধারাবাহিক খোঁজ অনন্তের গীতবিতান ছুঁয়ে ফেলতে চাইছে, ভিতরের দরজা জানালায় টোকা দিয়ে দিয়ে জানিয়ে যাচ্ছে এক সূর্যে কত ধূপ, দিনটা রাতের কাঁধে মাথা রাখছে আর বলে যাচ্ছে অন্ধকার মানেই সম্ভাবনা আর আলো তার সংস্কার। যদিও হাতেগোনা কিছু কবিতাই এই অধমের পড়া হয়েছে এই পর্যন্ত। বিশাল সমুদ্রের আমি কিছুই জানিনা, কিছুই পড়িনি। সংগ্রহও খুব কম। ধীরে ধীরে সুযোগ জমিয়ে তার কোমল ছায়ায় বিলীন হবার স্বপ্ন পাতি রোজ। যদি পৌঁছই! ততদিন অব্দি নাগালের শব্দঢেউয়ে এগিয়ে যাওয়া নদীর আকাশে ছিপ ফেলে বসা। কিছুটা আলো অনুভূত হবার পর তাকে পাশে নিয়ে তার লীলায় লালা ভিজিয়ে দেওয়া। কিছুটা অন্ধকার খুলে রাতের গায়ে টাঙিয়ে দেওয়া ভোরের সরগম। না দেখাটাকে কাছে থেকে দেখার উন্মত্ততা, না পাওয়াটাকে নিজের করে পাওয়ার স্বাধীনতা। একটা জলাশয় হেঁটে আসে পায়ের কাছে আর তার সব জলের ফোঁটা পাপড়ি মেলে মেলে বয়স্ক হয়ে যায় ঘুমের গ্রামারে। বাংলা থেকে মাইল দূরে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষার মেজাজে মায়ের খুশবু চেটে চেটে আচমকিত হাওয়া ধাক্কা দেয় এই প্রবাসী মণিকোঠায়-

কবিতা পড়তে পড়তে নতজানু হই শব্দের আড়ালের কাছে, ধ্বনির কুহুর কাছে। সহস্র আয়না নরম হয়ে আসে অভিনীত সময়ের দোলনায়। কত ফাঁক আলপথে ঢুকে যায় চোখের শৈশবে। ভিতর থেকে ভাষার নবান্ন ছড়িয়ে পরে অলস পাতে, একটা তাগিদ নৌকোর সমীকরণ নিয়ে উঁকি দেয় মাঝির পাশবালিশের ওমে! অস্ফুট আলো মেদ ঝেড়ে চেতনায় প্রবেশ করে বৈকি, বিশাল সমুদ্রের একমুঠো জলকে ছুঁতে পারার নিবিড় একাগ্রতা ভিতরের ঈশ্বরকে ফুঁ দিয়ে আত্মা অব্দি হেঁটে যায়।

ভিন্ন কলমে ভাষার দৃষ্টি, কত রং শিকার করে ব্যক্তিগত মুন্সিয়ানায়। অবাক হয়ে পাখির সাঁতার দেখি আর পাতা উল্টাই।

কবিতা কেন লিখি

কবে লিখলামই বা কবিতা? যেদিন সত্যি লিখতে পারবো জানবো কবিতা আমাকে চাইছে প্রথমবার! নিজেকে আবিস্কার করতে চাওয়াটা আমাদের সহজাত, কিন্তু পারি কতদূর? তাই যা কিছু মনকে মন দিয়ে বসে তাকেই খুঁজে খুঁজে গ্রাফ করে নিই শব্দের আয়েসে। চারপাশের সময়কে খুঁটে খুঁটে লেহ্য করতে চাই বিলি কাটা জলের সহজে। গুছিয়ে আনতে পারি না সব এলোমেলোদের। ন্যারেটিভ ভেঙে ভেঙে আবেগের জুস গ্লাস পাল্টাতে পাল্টাতে শেষমেশ ফ্ল্যাট। সংকোচিত শব্দের বর্তমান ঘর ডেকে আনে কলমে। ভোর ভারি হতে হতে এঁটেল হয়ে যায় কত নৈঃশব্দ্যে। তাকেও তো ধারণ করতে হয় কোথাও না কোথাও। খাঁচার ভেতরে সূর্য ছটপট করে আর তার সূর্যাস্ত ভিজিয়ে দেয় ভেতরের গোধূলি। তাকে নক্ষত্রের লেজ দিয়ে মুছে স্থাপন করতে হয় কোন ভাষার দেয়ালে। এটুকুই আমার পূজা। ইডলি-সাম্বার এর রসায়ন কুরাল- ত্রিকুরালের ঝুঁকি নিয়ে বাল্মীকির নিঃশ্বাসের গল্প রেখে যায় কালির কলোনিতে।  গঙ্গা থেকে স্নান তুলে এনে ভিটেমাটির ম্যাটিনি হাঁচি দেয় অনুভবের জাঁতকে। তার জন্মকেই কবিতা ভেবে ছেঁটে ফেলি খেয়াল- বেখেয়ালে।

দুয়ারে দুয়ারে ভোর এর তিলক কেটে বেডরুমের কলিংবেল বাজলে মা এর মুখ কোলে নিয়ে বেঁচে থাকা আলো ইমন গায় আরও একবার। মরুগান টেম্পলের শ্লোক মাথায় হাত বুলিয়ে যায় মৃদু। সমুদ্রের জলের ধোঁয়ায় চোখ মুছে মুচমুচে হয় একমুঠো দিনের জ্যোৎস্না। পথ ফাঁক হয়। মসৃণ হয় দৃশ্যের মেঘ। রান্নাঘরে হাত -বাটায় রবিঠাকুরের ধুন।

কত ঢেউ সাগর ফিরিয়ে দেয়। কত জ্যোৎস্না আগুন মেখে খায় অবেলায়। দুইয়ের ভারসাম্য সময়কে সাক্ষী করে টুকে রাখি নীরব অশ্রুর পাশে।  ঋতুক্ষয়ের শব্দ কানে বাজলেই ফাঁক হয়ে যায় নির্মাণ। বিনির্মাণ করি। ছায়া দিয়ে মুড়ে ফেলতে চাই ঘর। আর শ্রাবণ হয়ে ঝড়ে পড়া সন্ধ্যা অতীত মেলে শয্যায়। তাকে রোপণ করি পুনরায়। সেটুকুই জার্মিনেশন। কত শব্দ খসে পড়ে, কত ধ্বনি মুছতে পারে না আত্মার দাগ! ক্রমে ধুলোর কাছে বসি আর ভাবি কবে লিখতে পারবো মায়ের পূর্ণিমা যার পালকে ঝুলতে থাকবে এক পশলা বৃষ্টির কারনাম!

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..