এক সকালে রাহনুমা

শাহনাজ পারভীন
গল্প
Bengali
এক সকালে রাহনুমা

– শুভ সকাল।

– সকাল সকাল না এসে কি করব? আজ হাসপাতালে রোগীর অনেক চাপ।

সুন্দর সকালের ঝকমকে রোদের রশ্মি রাহনুমার চোখ থেকে অপারেশন শেষে সারা রাতের কষ্ট, ক্লান্তি, এলোমেলো স্বপ্ন, নির্ঘুম ব্যথা, বেদনা সব দূর করে পুরোপুরি জ্ঞান ফিরিয়ে আনে। দরজায় মৃদু অথচ গভীর শব্দ ওর চোখ খুলে দরজায় শুভ্র পোশাকের নার্সকে দেখে স্বভাব সুলভ অভ্যাসেই অভিবাদন জানায়। কিন্তু ওর অভিবাদনের এই উত্তরে ও হকচকিয়ে যায়। নিমিষেই তাকায় সদ্য বিবাহিত দীর্ঘ খোলা ভেজা চুল, সিঁথিতে চওড়া সিদুর, টিকোলো নাকে উজজ্বল রংয়ের নাকফুল, কানে ঝিকিমিকি পাথরের লম্বা দুল, ঠোটে কড়া রংয়ের লিপিষ্টিক দেওয়া নার্সের দিকে। যার মনটা উড়–উড়–, চোখের পাপড়ি অশান্ত এবং বড়ই চঞ্চল তার পদধ্বনি। খুব শান্ত সকালে সামঞ্জস্যহীন হেভি ওয়েটের মেকাপের নার্সের সাথে গতকালের দেখা চঞ্চল সাদামাটা সাজের নার্সকে মেলাতে পারে না ও। চোখ জ্বালা করে। বেশিক্ষণ তাকাতে পারে না। অতি আস্তে চোখ ঘুরিয়ে ওর চোখের সমান্তরালের দেওয়ালের দিকে তাকায়। ঘড়িহীন দেওয়ালটা দেখে সময়টা আঁচ করতে চায়।

গতকাল যখন রাহনুমা এ হাসপাতালে ভর্তি হতে আসে তখন রাইয়ানের বুকিং করা পাঁচশ সাত নম্বর রুমে ঢুকেই ওর চোখ কুঞ্চিত হয়। ভর দুপুরেও আলো ছায়া অন্ধকার খেলা করে যেন। পাশে দাড়ানো বড় ভাই মুহূর্তেই পড়ে ফেলে ওর সে কোঁচকানো চোখের অস্পষ্ট পৃষ্ঠা। ওর বড় ভাই ফরিদপুর শহরের বড় ব্যবসায়ী। পোড় খাওয়া মধ্য জীবনের দোর গোড়ায় দাড়িয়ে এই বিশাল পৃথিবীর বিপুল জড় প্রিন্টেড গ্রন্থ পাঠ করবার চেয়ে মুহূর্তেই পৃথিবীর কোটি কোটি জীবন্ত গ্রন্থ- মানুষের মুখ পড়তেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে এবং এই ব্যাপারে সে সিদ্ধহস্ত যেটা এর আগেও বহুবার রাহনুমার কাছে প্রমাণিত।

কিছুটা গুমোট অন্ধকারাচ্ছন্ন জানালা বিহীন দেয়ালের সাথে সেটে থাকা বারান্দায়এ্যাটাষ্ট টয়লেটের রুমটা যে এক মুহূর্তেই ওর আপাত সৌখিন বোনটা অপছন্দ করেছে সেটা আর কাউকেই তাকে বলে দিতে হয় নি। চট করেই রুম থেকে বের হয়ে যান তিনি। কিছুক্ষণ বাদেই অচঞ্চল রাহনুমাকে ডেকে বারান্দায় নেন।

– একটা প্রশস্ত খোলামেলা এসি রুম আছে। এখনি রাইয়ানকে ফোন দে। ওটা বুকিং দিতে বল।

– এসি রুম খালি আছে?

-হ্যা, আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি। মাত্র একটি রুমই ফাঁকা আছে। ওকে এখনি বল।

রাহনুমা কেন যেন ভাইয়ের কথার গতির সাথে সচল হয়ে তাল মেলাতে পারে না। মোবাইল ওর হাতেই। এমন নয় যে, সেটা এই মুহূর্তে ব্যাগে রয়েছে। হাজারো খুটিনাটি জিনিষের ভিরে তাকে খুঁজে ফিরতে বেগ পেতে হচ্ছে। তার পরেও কেন যেন কলিং নবে চাপ পড়তে অযথা সময় চলে যায়। ও জানে, ওর ফোনে রাইয়ান তার সিদ্ধান্ত মোটেও পাল্টাবে না, বরং উল্টো চেঁচামেচি করবে। ও ঠিক কি করবে, তা বুঝে উঠতে পারে না।

– শোন

একটু দৃঢ় অথচ নীচু স্বরে ওর কানের কাছে মুখ সরিয়ে আনে ওর ভাই। যেন বা মহা অপরাধ করে ফেলেছেন তিনি।

– শোন, ওকে বল, এই রুমের চেয়ে ওখানে যে বেশি টাকা পেমেন্ট দিতে হবে সেটা তুই দিয়ে দিবি। ওখানে পার ডে পাঁচশ টাকা বেশি। যে কয়দিন থাকা লাগবে সেই পেমেন্টটা তুমি করবে। আর শোন, বলেই ওর বাপের মত বড় ভাই যে সেই ছোট বেলা থেকে এগারটা ভাই বোনের দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি তার নিচু কণ্ঠকে আরো খাদে নামিয়ে বললেন এই টাকাটা আমিই তোকে দেব। কিন্তু রাইয়ানকে বলবার দরকার নেই। বলো, তুমিই টাকাটা পেমেন্ট করবে। ঠিক আছে?

বড় ভাই আনোয়ার সাহেব দেখেন- মুহূর্তেই ছোটবোনের মেঘে ঢাকা মুখটায় ঝকঝকে রোদের বন্যা খেলা করছে। হাতের মোবাইল সচল হয় নিমিষেই।

অবশেষে পাঁচশ পাঁচের এই রুমটাতে যখন সবাই হৈ হুল্লোড় করে ঢোকে তখন রাইয়ানকে সবচেয়ে বেশি গর্বিত মনে হচ্ছিল।

রাহনুমার চোখ যায় ব্যালকনির বৃহৎ কাচের দিকে। সেখানে বিন্দু বিন্দু শিশির জমে কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে আছে। তার উপর রোদের রশ্মিতে চৌদিক আলোর ঝিলিক ফেটে পড়ছে। লাল নীল সবুজ হলুদ গোলাপি চোখের সামনে হাজার তারার ঝিলিক ফুটে সরিষার ফুল ধরে থোকা থোকা। মাত্র আগের শুভ সকালটা ও শিশির বিন্দুদের সাথে সরিষার ফুলের সাথে ভাগ করে নেয়। দেয়ালে থাকা এসির স্কিনে তাকায় রাহনুমা। সতেরো স্কেলে পুরো ঘরটা কেমন পৌষের শীতে জমে আছে। রাইয়ানের মমতার হাত ওর কপাল ছোঁয়। কিভাবে একটি যুদ্ধময় রাত পার হলো। ও আবার ফিরে যায় ওর স্বপ্নের গভীরে। কিন্তু জবরজং রংয়ের নার্সের উত্তরে ঠাণ্ডা হয়ে যায় রাহনুমা। হ্যা নার্স। আমাদের সেবার নারীরা… মেয়েরা…। কিন্তু ক্যানুলার ইনজেকশানটা ওকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে বারবার। ব্যান্ডেস করা জায়গাটায় অজান্তে হাত যায় আবারও। এই ঘোর আবার স্বপ্ন…

মুহূর্তেই ওর ছোট বেলার সেবার নারীর কথা মনে পড়ে। ফুলি। উন্মত্ত যৌবনা টিকোলে নাকের ফিটফাট শরীর। আম্মা মারা যাবার পর রান্না করতে এসেছিল। ওদের ফার ফরমাস খাটতো। ওরা প্রথম প্রথম ডাকতো ফুলি ফুপু বলে। ওদের সে পাড়া মাতানো ডাকে সত্যিকারের ফুলি ফুপু একদিন প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলেন।

– কিরে, ঐ কাজের ছেমরি এখন আমার নাম দখল করল? এই বলে দিচ্ছি, এখন থেকে আর কোনদিন আমাকে ফুলি ফুপু ডাকবি না। ঐ তোদের ফুপু। একমাত্র ফুলি ফুপু।

-ফুপু কি বলেন? আপনাকে না ডেকে কি আমাদের দিন চলবে?

রাইমার কণ্ঠে উস্মা খেলা করে। সেও ফুপুর ছাত্রী ছিল।

ফুলি ফুপু আব্বার চাচাত বোন। নিঃসন্তান। রাহনুমাদের বাড়ির সাথে লাগোয়া ফুলি ফুপুর নিরিবিলি নির্ঝঞ্ঝাট ছোট্ট ছবির মত দেওয়াল ঘেরা বাড়িটা। ফুলের সুবাস ঘেরা মৌ মৌ আঙিনা। ফুপুর বিয়ে হয়েছিল জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের সাথে। ফুপু সেখানে সংসার করে নি। বিয়ের কয়েকদিন পরই ফিরে এসেছে বাবার ভিটেয়। ফুপা অনেকদিন অপেক্ষা করে ফুপুর ইচ্ছায় অন্য সংসার করেছে। সেই পক্ষের ছেলেমেয়েরা প্রায়ই আসে ফুপুকে দেখতে। অনেক বাজার ঘাট করে আনে। শাড়ি কাপড়, মাছ, মিষ্টি, ফলমুল। ফুপু গর্বিত হয়ে সারা পাড়া বিলায়। ছেলেমেয়েদেরকে পাড়াময় ঘুরিয়ে আনে। তখন ওরা বুঝতে পারত না ফুপুর আদিক্ষ্যেতা। বড় হয়ে বুঝতে পেরেছে তার আসলে সন্তান হবার কোন সম্ভাবনা ছিল না। বড়রা বলত- ওর ফুল নেই। ফুলের নাড়ি নেই। আহা রে, ফুলের মত মেয়েটা… তাই সে হাসিমুখে এখানে ফিরে এসেছে। এখানেই তার রাজত্ব। ঘর বাড়ি উঠোন বাগান। সবজি ক্ষেত, গোলাপের ঝাঁড়, বেলী, সন্ধ্যা মালতির থরে থরে ফুটে থাকা আঙিনা। সকাল হলেই সারা পাড়ার ছেলেমেয়েদেরকে লম্বা বারান্দায় সুর করে কোরআন শিক্ষা দেওয়া। বিনা বেতনে। তবে একটা শর্ত ছিল। তার যে সব ছাত্র বা ছাত্রী যে যে কাজে পারদর্শী ছিল তাকে তা করে দিতে হত। সকালের সুর করে পড়া শেষ করেই কেউ দীর্ঘ জাঙলায় ঝুলে থাকা একটা লম্বা লাউয়ের নিচ থেকে কিছুটা কেটে নিয়ে মিহি করে ভাজি কুটে দিল। বাকিটুকু ঝুলত মাচানে। যতটুকু লাগত, ততটুকু একটু একটু করে রোজ কেটে নিত। গাছে থাকলে তাজাও থাকবে, বড়ও হবে। কেউ পাকা হাতে ছোট্ট চুলা ধরিয়ে ছেকতে লাগল রুটি। কেউবা শিল -পাটা পেতে বাটতে থাকলো দুপুরের রান্নার প্রস্তুতিতে। কেউ বা দায়িত্ব পেল-

– বাজার বেলায় আসিস বাবা আনিস, আজ কিছু তাজা মাছ কেনাব। দুধ কিনে দিবি। পায়েশ রাঁধব বিকেলে। রোজী তুমি আজ দুপুরে আসবা। স্কুল বন্ধ না?

-হ, আজ শুক্রবার। স্কুল বন্ধ।

-তাইলে দুপুরের রান্না আজ তুমি করবা।

-ঠিক আছে ফুপু। আমি রান্না করব আজ। এখন তাইলে যাই?

-যাও।

-রানি, তুমি ঘরটা ঝাড় দাও। পারুল তুমি উঠোন টুকু পরিষ্কার কর। জুই, তুমি ফুল গাছে পানি দাও আজ।

-ঠিক আছে ফুপু।

কিন্তু রাহনুমার মনে আছে, ও কখনো ফুপুর গৃহস্তের কোন কাজের দায়িত্ব পায় নি। সে পেত শিক্ষকতার দায়িত্ব। সেই ছোট বেলা থেকেই সবাই তাকে অন্যরকম সমীহের চোখে দেখত। তার নিজের পড়া শেষ করে তার চেয়ে যারা ছোট ছিল, কিংবা কখনো বা তার চেয়ে যারা বড় তাদেরও সবার পড়া নিত। পড়া দিত। সব শেষে সবার পড়া শেষ হলে ফুপুর সাথে লাউ ভাজি আর রুটি খেয়ে বাড়ি আসত। ফুপু বলত-

– কইরে বুড়ি, আমার আর মনির রুটি ভাজি বারান্দায় দে। আজ আমরা বারান্দায় বসে খাই। তুই ও আয় এখানে। পানির জগে ঠাণ্ডা পানি ভরে নিয়ে আয় কল থেকে।

ফুপু ডাকত তার অন্য ছাত্রীকে। ফুপু বরাবরই রাহনুমাকে মনি বলে ডাকত। ওর এখনো মনে আছে একটু বড় হতে না হতেই কোন ভাল ছেলে দেখলেই, কোন ভাল ছেলের খবর পেলেই ফুপু শুধু ঘটকালি করত। ফুপুর ঐ বিষয়টা ছাড়া আর কোন দোষ খুঁজে পেত না রাহনুমা। বিশেষ করে ফুপুর আরো ছয়টা বোনের ছেলেরা প্রায়ই আসত তাকে দেখতে। ফুপু তাদেরকে ছেলে আদরে ভরিয়ে রাখত সব সময়। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর একটা বর হোক মনির, সেটা সে মনে প্রাণে চাইত। আর চাইত মনি বড় হয়ে মস্তবড় টিচার হবে। ভার্সিটির। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সে যাবে পড়াতে।

তখন থেকেই ওর মনে স্বপ্ন জমা হয় বড় হয়ে সে টিচার হবে। সেই সারা পাড়ার গার্ডিয়ান, সম্মানিত ফুলি ফুপির সাথে ওদের সেবার নারীর নাম মিলে যায়। তার পর থেকে ওরা আর তাকে ফুলি ফুপু ডাকত না। ডাকত রান্না ফুপু।

খুব কাজের ছিল রান্না ফুপু ফুলি। এক অমাবস্যার রাতে ফার্মের জলিল চাচার সাথে মিলে ভুতের ভয় পাইয়ে দিয়েছিল ওদেরকে। বেশ কিছুদিন কানাকানি হবার পর তাকে ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন নতুন আম্মা। ফুলির টিকোলো নাকের সাথে মিল আছে এই সদ্য বিবাহিতা আগুন্তুক নার্সের নাক। শক্ত সুতোয় গাঁথা পুথির মালার পাশাপাশি দুটো পুথি যেন। পাশাপাশি এক মাপে। একটি হারিয়ে ফেললে পুনরায় তাদের আলাদা করা কঠিন। ফুলির টিকোলো নাকের ডগায় উজ্জ্বল রংয়ের নাকফুলের পাথরটির কথা উঠলেই ও অন্য জগতে হারিয়ে যেত। বিয়ের রাতে বর নিজে হাতে পরিয়ে দিয়েছিল সেটি। বরের দ্বিতীয় বিয়ের আগে নতুন কনে চেয়েছিল তার প্রথম বিয়ের নাকফুলটি। সেটি চাইতেই ও চিরদিনের জন্য ওর বরের দাবি ছেড়েছিল, কিন্তু নাকফুলটি নাক থেকে কখনো খোলেনি ফুলি। যেই হিসাব রাহনুমা সারাটা জীবন মেলাতে পারে নি, এই পদ্ম ফুলের মত বর্ণিল সকালে বহুদিন পর কেন আবার সেই পুরোনো হিসাব রাহনুমার মাথার ভেতর জট পাকাতে চাইছে রাহনুমা তা বুঝতে পারে না। নার্সের দিকে চোখ পড়তেই যেন ফুলি তার স্বভাব সুলভ হাসিটি হেসে ওঠে।

-পাতা পানি দিয়েছে। আপনি কি এখন গোছলে যাইবেন আম্মা?

-এখন না। একটু দেরি হবে। ক্লাস তো এগারটায়।

– হেই তো কতা শোনে না। আপনারে না জিগাইয়াই প্রতিদিন আগে আগে পানি দ্যায়। হ্যারে দিয়ে তো কিছুই হুনন যায় না। কওন যায় না।

– ঠিক আছে। অসুবিধা কী?

-পানি তো গরম অইয়া যাইবো। হ্যায় বোজে না? পুকুরের পানি বেশিক্ষণ বালতিতে রাখন যায় না। গরম অইয়া যায়।

-যাক না, অসুবিধা কি। এখনো আমার অনেক হোম ওয়ার্ক বাকি। জটিল অংক মিলছে না। তুমি যাও তো।

– হেইডা আমারে আগে কইবেন তো। টেবিলে তো খাওয়োন লাগাইছি। অসুবিদা নাই আমি আবারো গরম করতাছি। আপনি আপনার ছুবিদামত খাইয়া লইয়েন। আমি দুপুরির ব্যবস্থা করি গিয়া।

সেবা নারীদের দেখলেই কেন রাহনুমার এখনো পর্যন্ত ফুলির কথাই মনে আসে ও জানে না। সকাল বিকাল সন্ধ্যা রাতের সারাটা সময়। যখন ওর জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় ছিল তখন ওর পাশে ছিল ফুলি। এক রাতে সারা পাড়া কেঁপে কেঁপে ওঠে। ডাকাত ঢুকেছে পাড়ায়। রহিমা ম্যাডামের বাড়িতে প্রথম ঢুকেছে তারা। গুনে গুনে রহিমা ম্যাডামের দুইশ শাড়ি আর ভরি দশেক গহনা তাদের চাই। সারা পাড়া জেগে উঠেছে। ভয়ে আতঙ্কে বাচ্চারা চুপ। বড়রা আতঙ্কিত। সেই রাতে রাহনুমার ঘরে নিচের মেঝেতে পাটি পেতে ঘুমিয়েছিল ফুলি। সেদিন যে ওর কি নির্ভরতায় পেয়েছিল। খুব আস্তে আস্তে কথা বলেছিল ওরা। কোন ভয় পায় নি সেদিন রাতে। আজও সে সুখস্মৃতি ওর চোখে জ্বলজ্বল করে জ্বলে।

ওর ক্লান্ত চোখ দেখে রাইয়ান অত্যন্ত দ্রুত হাতে মেঝে থেকে সোফার গদি গুলো সোফায় সেট করে রাখছে। হাসপাতালের এই রুমে ও নিচেয় ঘুমিয়েছিল। কেবিনের অন্য ছোট খাটটিতে দুই ননদ মোটা কাথা গায়ে দিয়ে রাত পার করেছে। কথায় কথায় বারান্দার দরজা খুলতেই ব্যস্ত রাস্তা জেগে উঠবার ছন্দ বেজে ওঠে রাহনুমার কানে। রাত জাগা এ্যামব্লুয়েন্সের মর্মান্তিক কান্না ওর গেটে যেন সশব্দে থামে। ঘুমহীন ট্রাকের ছন্দহীন গান ওর মস্তিষ্কে ঝড় ওঠায়। রিকশার টুংটাং শব্দটাও এড়ায় না ওর কান। হকারদের হাঁটাচলা, সকালের হেঁটে চলা স্রোত কিংবা সাত সকালের হরতাল বিরোধী মিছিল। সব মিলিয়ে ওর কোলাহলময় জীবনের জলছবি ভেসে ওঠে। ও আবার যেন কোথায় হারিয়ে যায় মুহূর্তে। এক, দুই, তিন… চার পাঁচ, ছয়…এই ঘুম, এই জাগরণ, এই স্বপনের সাথে বাস্তবের মেলবন্ধন। এই জেগে ওঠা, এই ঘুমিয়ে পড়া… সব মিলিয়ে একাকার হয় রাহনুমা।

গতকাল ডা. নার্গিস খুব করে চেয়েছিল ওকে লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দেবার জন্য।

-আমরা গল্প শুনব আপনার। গল্প শোনাব। কিন্তু ও তাতে রাজি হয়নি।

– থাকনা, আপনি আমাকে পুরোপুরি অজ্ঞান করুন।

জ্ঞান ফেরা নিয়ে ভয় ছিল ডাক্তারের। লোকাল অ্যানেসথেসিয়ায় পুরোপুরি জ্ঞান ফেরার মুহূর্তটুকু যে কি ভয়ঙ্কর তা আগের সিজার অপারেশন থেকে রাহনুমা জানে। টলটলায়মার জলের উপর ভেসে বেড়াতে হয়। কম্বল দিয়ে জড়িয়ে রাখতে হয় এক- দুই- তিন। ভীষণ কাঁপুনি দিয়ে জীবন ও মৃত্যূর সন্ধিক্ষণে ঘুরে বেড়াতে হয়। রাজি হয়নি রাহনুমা। তারচেয়ে বরং পুরোপুরি ঘুমিয়ে যাওয়া ভাল। হাসতে হাসতে ডা. নার্গিস বলে ফেলেছিল-

– যদি আর জ্ঞান না ফেরে?

-তাও বা মন্দ কি?

-বা, সাহস তো কম নয়?

-তাই নাকি?

ঔ হেসেছিল ডা. মঈন আর ডা. নার্ঘিসের সাথে।

ঔ এক সময় সেবার নারী হতে চেয়েছির। ওর প্রিয় বন্ধু স্বপনের বেবীহীন লাইফটাকে ওর একটু খুশি করে দেবার ইচ্ছে ছিল খুব। ও তো ইচ্ছে করলেই টেষ্টটিউবে হাসাতে পারত ওদের সন্তানহীন দাম্পত্যের দীর্ঘ অবসান। ওর বন্ধুস্ত্রীর সে ক্ষমতাটুকুও নিঃশ্বেষ হয়েছে। কয়েকবার লক্ষ লক্ষ টাকা পেমেন্ট করেছেও, কিন্তু ফলাফল শুন্য। যা হবার তাই হয়েছে প্রতিবারই। একবারও পজেটিভ আসেনি রেজাল্ট। বার বার রেজাল্ট নেগেটিভ দেখে ওর স্ত্রী আর রাজি নয়। দিনকে দিন সে কেমন অসামঞ্জস্য আচরণ করছে। তাই রাহনুমার এই অন্য রকম একটি ইচ্ছে হয়েছিল। বলি বলি করেও বলা হয়ে ওঠেনি রাইয়ানকে। ও জানত না রাইয়ান বিষয়টাকে কিভাবে নেবে? রাইয়ান এমনিতে খুবই আধুনিক, সহনশীল। কিন্তু ওর বন্ধুদের ব্যাপারে ওর সহিষ্ণুতা সহ্যের মধ্যে পড়ে কি না তা ওর বুঝে উঠতে সময় লাগে বৈকি। এরই মধ্যে হঠাৎই ওর জটিল অপারেশন। কোন প্রিপারেশন ছাড়াই। কালক্ষেপন করে ঝুঁকি নিতে চায় নি ওরা। ওর বন্ধুদেরকেও বলা হয়নি বিষয়টি। কিংবা বলা হয় নি কোন কলিগকে। ও আর সেবার নারী হতে পারল না কারো। ওর সে ক্ষমতাটুকুও নিঃশেষ হল।

গত বছর ওর জুনিয়র কলিগ তানিশার গলব্লাডার অপারেশনে সিনিয়র কলিগ সমাপ্তের বাড়াবাড়ি রকম সতর্কতায় তানিশা যখন কোন রকম বাড়তি ঝামেলা কিংবা ইনফেকশান ব্যতিত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরল, তার আগেই সমাপ্তের কাঁপুনি দিয়ে জ্বর গেল টানা তিনদিন। তারপরই বমি, মাত্রাজ্ঞানহীন বমি। অবশেষে সে ঢাকা, বাংলাদেশ করে অবশেষে চেন্নাই থেকে ব্রেন টিউমারের জটিল অপারেশন শেষে মৃত্যূর সাথে পাঞ্জা লড়ছে এক বছর। এ বেলা বাড়ি তো ও বেলা হাসপাতালে, এই হাসপাতালে তো এই বাড়ি। ক্রমাগত ছোট থেকে আরো ছোট হয়ে আসছে ওর জীবন। বিছানা আর ঘর। ঘর আর বিছানা। সেই হুল্লোড়ময় জীবনের চিরচেনা গণ্ডি পেরিয়ে সমাপ্তের দিন এখন বিছানায় ঠিকানা নিয়েছে। এই সব নানা ঘটনা অঘটনে রাইয়ানকে বলা হয়নি স্বপন বেলী দম্পতির কথা। বলা হয় নি ওর মনের গভীরে বেড়ে ওঠা ছোট্ট আকাক্সক্ষার কথা, যা দিয়ে পূর্ণ হতে পারত ওদের অন্য রকম জীবনের কিছুটা সময়।

সমাপ্তের কথা মনে আসতেই এক পা দু পা করে সুহিতা সামনে চলে আসে। সুহিতা আর সমাপ্তের সুখি জীবনের প্রেমময় সকাল কিংবা খুনসুটিপূর্ণ বিকেলগুলো কেমন মায়াময় থাকতো গোধুলি রঙা আকাশের মত। ওরা যখন এক সাথে ক্যাম্পাসে নামত, ধোঁয়া ওঠা কফির মগে জমিয়ে আড্ডা চালাত, কিংবা গরম পিঁয়াজু আর ঝাল মুড়িতে হাসতে হাসতে চোখে জল ঝরাত তখন অন্যদের চোখে ছিল দিব্য ভালবাসার রং, কিংবা ঈর্ষার চিকন রহস্যময় দ্যুতি। আহা! জীবনটা এমন কেন? রাতের পরেই আসে উজ্জ্বল দিন! কিংবা দিনের পরেই আসে অন্ধকার রাত? কিংবা সকালের পরেই নামে অনাকাঙিক্ষত রাত, আবার রাতের পরেই ঝরে সকালের সূর্য়চ্ছটা! ওরাই ছিল ক্যাম্পাসের সুখি দম্পতি। যদি সুহিতার কথাই বলি, সে ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সহনশীলদের একজন। যদি সমাপ্তের কথা বলি, সেও ছিল পৃথিবীর মধ্যে সহিষ্ণুতার প্রতিক! ব্ন্ধু অন্ত প্রাণ তাদের। সভা, সেমিনার, আড্ডা, বিয়ে, জানাযা, মিলাদ মাহফিল কোথায় ছিল না তারা? দু কানে শুনলেই ছুটে যেত সহাস্যে। আর সমাজ, কিংবা মানুষেরাও… তারাও যেন! এ শহরের কোন প্রোগ্রাম ওদের ছাড়া শেষ করবার কথা চিন্তাও করে নি এতদিন। অথচ এখন? দিব্বি চলে যাচ্ছে সব কিছু। রাজনীতি, সমাজনীতি, পরিবারতন্ত্র…। মাত্র তো কদিন। দিনের হিসেবে তিনশত পয়ষট্টি, আর বছরের হিসেবে মাত্র একটি বছর। অথচ সময়ের ব্যবধানে এখন আর সুহিতার মুখোমুখি হতে ভয় পায় ওরা। সমাপ্তের সামনে শুধু জড় পদার্থের কাহানা।

নতুন বিয়ে হওয়া নন্দিনী। সেও তো নন্দন কাননের ফুল হয়ে উঠল দুদিনেই। তারপরে সব বিষিয়ে গেল মেহেদীর রং শুকাতে না শুকাতেই। রাহনুমার জীবনটাই বা কদিনের? এরই মধ্যে ওর এই জটিল অপারেশন? কি জানি, ও কি আবার আগের মত সাধারণ জীবনে ফিরে যেতে পারবে? খুব কম সময়ের সাজেশান পেয়েছে এক্কেবারে ছোট বেলার বান্ধবী সাথীর কাছ থেকে-

-এটা কোন ব্যাপারই না, দেখছিস না আমাকে? দিব্বি চলে যাচ্ছে সবকিছু। এই বয়সে তুই তো আর নতুন করে বাচ্চা নেবার কথা চিন্তা করছিস না? তাহলে উটকো ঝামেলাটা এমনিতেই দূর হল। ও জিনিষটা থাকা মানেই রিস্ক। তাছাড়া তোর ওভারি দুটো থাকছে। হরমোনের কোন প্রব্লেম হবে না। হরমোন রিপ্লেসমেন্ট করতে হবে না, কিংবা আলাদা কোন মেডিসিনও নিতে হবে না। তাহলে ভয় কিসের? দেখলি না, সালমা ম্যাডাসের মা বিরাশি বছর বয়সে কিভাবে ক্যান্সারের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ল। তার থেকে এই বরং ভাল। একটুও চিন্তা করিস না তুই। পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই আসল। দেখছিস না সমাপ্তকে? রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না বন্ধু…।

– আমি যে স্বপন বেলীকে একটা টেষ্ট টিউব বেবী দেবার কথা ভাবছিলাম?

– মানুষ তো কত কিছুই ভাবে। সব কিছু কি শেষ পর্যন্ত পূর্ণতা পায়? না হয়?

– তা ঠিক। তারপরও।

– তারপরও আবার কি? তুই যে স্বপন বেলীর জন্য এ রকম একটা উন্নত— ভাবনা ভেবেছিলি তার জন্য তোকে স্যালুট।

– সেটা কোন সমাধান নয়। নয় বাস্তবায়নও।

– সমাধান নয় সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আমরা অন্য বন্ধুরা তো কেউ এইভাবে কোনদিন ভাবিনি। বিশ্বাস কর, এটা আমাদের ধারনারও বাইরের বিষয়। আমরা কোন সমাজে বাস করি তুই বুঝিস না?

– কি বলতে চাচ্ছিস তুই?

– কেন, তুই বুঝতে পারছিস না?

– একশ বার।

-তাহলে?

-তাহলে আবার কী?

– কিন্তু তোর আমার আমাদের কি জীবনের প্রতি হাত আছে কোন?

-তা নেই। তবে…

– তবে আবার কি? আমরা কি ইচ্ছেমত কিছু করতে পারি? তিনি আমাদের দিয়ে সবকিছু করিয়ে নেন। মানুষের উপকার, শুভতম কিছু। সব… সবকিছু…। নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোন ভাল আছে। আর ভাবিস না। আজই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যা।

– প্রস্তুতি লাগে না?

– কিসের প্রস্তুতি। পৃথিবীতে কোন কিছুরই প্রস্তুতি লাগে না। এই যে আমরা বলাবলি করছি এইটেই তো অনেক বড় প্রস্তুুতি। অনেকেতো এই বলাবলিটুকুরও সময়টুকুও পায় না। তাই না?

– তা ঠিক। তবে…

– তবে আর কোন কথা না। যা বাসায় যেয়ে রাইয়ানকে বলে ঠিক কর সব।

দুদিনেই যাবতীয় টেষ্ট শেষে সব আয়োজন শেষ করে ওরা। তারপরই অন্য এক রাহনুমার নতুন জন্ম হয়। যে আর ইচ্ছে করলেও পৃথিবীতে অনেক কিছু করতে পারবে না। নানান ভাবনার সুতো ভেদ করে এই সাত সকালেই প্রিয় বান্ধবী সাথী ঢোকে হুড়মুড় করে। একগাদা গোলাপের ছড়াছড়ি। গন্ধের সাথে ছন্দের মাতলামো ঢেউ ওঠে পুরো কেবিনময়।

-শুভ সকাল।

-শুভ সকাল।

– কাল তো হাত পা ছড়িয়ে দিব্যি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিলি। আর আমরা? বাবারে, রাইয়ান ভাইয়ার সে কি টেনশান? কেমন আছিস এখন?

– ভাল।

– আজ অফিসে অডিট আছে। তাই চলে এলাম সকাল সকাল। এখান থেকেই অফিসে যাব। আজ আর সারাদিন আসতে পারব না মনে হয়।
রাহনুমা পরিপূর্ণভাবে চোখ মেলে। ঝলমল করে হেসে ওঠা সাথীকে দেখে। ওর চোখ ভরে জল আসে। কণ্ঠ থেকে শত চেষ্টাতেও একটি শব্দ বের হয় না। ও বুঝতে পারে না, একটু আগে ওর মুখ থেকে বের হওয়া শব্দটার সঠিক গূঢ়ার্থ। ও জানে না, সত্যি সত্যি আজকের সকালটা ওর জন্য শুভ কিনা?
ও কি অন্য জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসে কিংবা বাস্তব থেকে অন্য জগতে ঢুকে যায়, তা আর বোঝে না তখন।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..