প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
কুকুর, মনিবের মৃত্যুতে খুব উতলা হয়ে উঠলো। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অবিরাম। খাবারও খাচ্ছে না ঠিকমতন। বাড়িতে কোর্মা-পোলাওয়ের আয়োজন চলছে। জম্পেশ খাওয়া দাওয়ার পর, দুঃখভুলে থাকবার জন্য, রাতে একটু পানীয়ের ব্যবস্থাও আছে। কিছু এতিম ছেলেপেলে আর মসজিদের ইমাম এসেছিলো। মনিবপুত্র খাওয়া শেষে মোনাজাতেও কাঁদলেন, পানীয়ের আসরেও কাঁদলেন। অতিমাত্রায় খাওয়ার কারণে এতক্ষণে লুঙ্গির কাছা খুলে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন নিশ্চিন্তে। সমস্যা নাই, দীর্ঘ আট বছরে কুকুরটা রাতের পাহারায় ছিল অতন্দ্র প্রহরী।
মাঝেমধ্যেই মিষ্টির দোকানের বাইরে ফুটপাতের একটা ছেলেকে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটা রসগোল্লা উচ্চস্বরে বলে উঠলো, আমাকে নিয়ে যা তোর সঙ্গে করে। কিন্তু নাছোড়বান্দা মহাজনের চাই টাকা ওহেন জিনিস ছাড়া নাকি ঐ রসগোল্লাটাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। এই আফসোসে সারাদিন মন খারাপ শেষে বিকেলের দিকে রসগোল্লাটা মাঝখান থেকে ফেটে গেলো। রাতে সারাদিনের খাটুনি শেষে ঐ ছেলেটা যখন বাড়ি ফিরছিল দোকানের পাশে মিষ্টিটা দেখে থমকে দাঁড়াল এবার, মালিক তার তাকিয়ে থাকা দেখে ঐ ভাঙ্গা রসগোল্লাটাকে দিয়ে দিলো। এরপর তারা সুখে শান্তিতে একে অন্যের হয়ে গেলো।
এক অদ্ভুত মমতায় ছড়িয়ে আছে আলোর কণাগুলা। প্রতিটা জিনিসকেই মায়াবি আর সুন্দর লাগতে শুরু করেছে। একটা দখিনা বাতাস বইছে ঝিরঝির করে, সারাদিনের ভ্যাঁপসা গরমটাকে কাটিয়ে উঠবার জন্য এর চাইতে মোক্ষম আবহাওয়া আর কিছু হতে পারে না। নিয়ন আলোর মাঝ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতেই শুনতে পাওয়া যাবে সমুদ্রের গর্জন। ঠিক তাই, ভালো করে কান পেতে শুনলে বুঝতে পারবেন এই গাছগুলাই আসলে সাগর পারে সমুদ্রের গর্জনের সাথে মিশে একটা সামুদ্রিক গুঞ্জন তৈরি করে। আর একটু সামনে এগুতেই ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দে নিজের পায়ের শব্দটুকুন পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছি না। ক্রমেই নিয়নের আলো ম্লান হয়ে যাচ্ছে গাছ আর নির্জনতার ঘনত্ব বাড়বার সাথে সাথে। এই পাশটা উম্মুক্ত, সুনসান। এক ঝাঁক জোছনার দল খেলা করছে এইখানে। রজনীগন্ধার একটা হালকা গন্ধ এসে নাকে লাগতেই জীবনে প্রথমবারের মতন বুঝতে পারলাম নাক থাকার অত্যাবশ্যকতা। বুকের বামপাশটা হঠাৎ কেঁপে উঠলো। বুক পকেটে হাত রাখতেই আরও একবার। মুঠোফোন বের করতেই চোখ ঝলসে গিয়েছিল দু´শব্দের একটা বার্তায়ঃ নীল নেই।
আসিফের সাথে বিয়ে হলো নীলিমার। তাদের ঘরে একটি ফুটফুটে চাঁদ এলো। ফুটফুটে চাঁদটির বয়স যখন ২ বছর। ছেলেটি বাবা বাবা বলে সারাদিন গান গাইতো। এক শীতের রাতে বাবা তার রাতের ডিউটিতে ফ্যাক্টরি যায়। সকালে চাঁদটাকে মা ফ্যাক্টরির পাশের রাস্তায় নিয়ে যায়। ফ্যাক্টরির আগুন তখনও নিভেনি। নীলিমার চোখের পানি মুছে দেয় চাঁদ। বাবা বাবা বলে চিৎকার করে। কিন্তু আগুন যেন সেই ডাক মুছে দিতে আরও দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠে ফ্যাক্টরির ধ্বসে পড়া চালে। নীলিমার বুকের মধ্যেও সেই আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। সেই আগুনের উষ্ণতায় বেঁচে থাকতে চায় আমাদের চাঁদ সোনা।
বাঁধ ভেঙ্গে পানি ঢুকে গেছে। সাথে প্রচণ্ড ঝড় যেন সবকিছু উড়িয়ে নিতে চাচ্ছে। রহমত আলি শুনেছিল কেয়ামতের সময় নাকি সব শেষ হয়ে যাবে কিন্তু মসজিদ অক্ষত থাকবে, কিন্তু মসজিদটাও উড়িয়ে নিয়ে গেলো চোখের সামনে। তবে কি যা ঘটছে তা কেয়ামতের চাইতেও ভয়ঙ্কর কিছু? কোন কিছুই আর চিন্তা করতে পারছে না সে। বাড়ির উঠানে পানি ঢুকে গেছে। বাড়ির চালা উড়ে গেছে উত্তরের বাঁশঝাড়ের কাছে। পোয়াতি বউ আর একমাত্র মেয়াকে নিয়ে দিশেহারা রহমত। উপায় না দেখে আমগাছে উঠিয়ে দিয়েছে মেয়েকে। মেয়ে ভয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। স্ত্রীকে এই অবস্থায় কীভাবে উঠাবে বুঝতে পারছে না। কোলে করে কয়েকবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমগাছটার প্রথম শাখা একটু উঁচু হওয়ায় তাতে কাজ হয়নি। মেয়ের মতন কাঁধে করে উঠানোর চেষ্টাটা বাকি ছিল। এইবার তাই করলো। বহু কষ্টে বউকে ঘাড়ের উপর উঠালো সে। ৮ মাসের এই পেট নিয়ে কুলসুমেরও উঠতে জান বের হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু অন্য কোন উপায় না থাকায় এই ঝুঁকিটা নিতেই হলো শেষমেশ। পানি উঠতে উঠতে আমগাছ ছুঁই ছুঁই করছে। ঘরের চাল বরাবর পানি চলে এসেছে। রহমত বুঝতে পারছে না, এখন কি হবে!
পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে গাছের যে ডালে কুলসুম ধরে আছে তা ছুঁতে আর ২ ফুট লাগবে। রহমত আলি মেয়েকে এতক্ষণ ধরে ছিল। বউয়ের এই অবস্থা দেখে সে মেয়েকে ছেড়ে বউকে উপরের ডালে উঠতে বলে নিজে নিচের ডালে নেমে আসলো। রহমতের অর্ধেক পর্যন্ত ডুবে গেছে। রহমত বউকে উপরের ডালে উঠতে বলল, যেখানে তার মেয়ে ডাল জড়িয়ে আছে। ঝড়ের চাপ কিছুটা মৃদু হয়ে আসলেও পানি বেড়ে চলছে অবিরাম। কুলসুম বলল আমি আর পারছিনা। কুলসুমের গলা পর্যন্ত পানি, রহমত কোন মতে একটা ডাল ধরে ভেসে আছে। উপরের ডালে উঠলে মেয়েসহ ভেঙ্গে পড়তে পারে। রহমত বলল, আল্লাহ্ ভরসা ময়নার ডালটা ধরে ভাসতে থাকো। কুলসুম একবার ভাবে যদি ময়নার ডাল ধরে ভাসতে চায়, মেয়ের ডালটা না জানি আবার ভেঙ্গে পড়ে। রহমত ভেসে ভেসেই বউকে ধরতে চায়, কুলসুম বুঝতে পারে এভাবে ওরা সবাই এক সাথে মারা পড়বে। রহমতের মাথা কাজ করে না; বলে, ময়নার ডালডা ধরো, মরলে সব একসাথে মরমু। কুলসুম হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমার ময়নারে বাঁচাইয়ো। বলতে না বলতেই ডাল ছেড়ে দিয়ে স্রোতের মধ্যে বিলীন হয়ে যায় কুলসুম। রহমত মেয়েকে বলে শক্ত করে ডাইল ধরিস মা। সেও স্রোতের মধ্যে ঝাঁপ দিবে এমন সময় আচমকা মনে পড়ে, তার ময়নাকে কে দেখবে? চোখের সামনে ময়নার ভেসে যাওয়া দেখছে আর চিৎকার করে বাপ বেটি কাঁদছে। কুলসুমের শাড়িটা অনেকক্ষণ পর্যন্ত দেখতে পায় এরপর কোথায় সব হারিয়ে যায়, জানে না। ময়নার কোমর পর্যন্ত পানি, রহমত এখনও ডাল আর মেয়ের হাত শক্ত করে ধরে ভাসছে। ঘন্টাখানেক পর পানি থাম ধরে। সারারাত গাছের উপর থেকে, সকাল থেকে পানি কমা শুরু হলে দুজনেই নেমে আসে নিচে।
সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেছে সিডর। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা প্রশান্তি অনুভব করে রহমত। সাথে সাথেই বুকটা হু হু করে কেঁদে উঠে-কুলসুম আর পেটের বাচ্চাটার জন্য। সারা সপ্তাহ তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে আশেপাশের গ্রামে, নদীতে। কোথাও লাশটা পেলো না। এক মাইল উজানের দিকে একটা উঁচু গাছের মধ্যে শুধু শাড়িটা পেয়েছিল অর্ধেক প্যাঁচানো অবস্থায়। হয়তো গাছটা ধরে বাঁচার শেষ চেষ্টাটা করেছিল। পারে নি। শাড়িটাকে আমগাছের নিচে কবর দিয়ে রাখে রহমত। বউয়ের শেষ নিশানার তো তবু একটা ঠাই হলো- এতোটুকুই বা কম কিসের! রহমতের বেঁচে থাকার আনন্দ মরে গেছে। তবু ময়নার চোখের দিকে তাকালে মনে হয়, আবার বেঁচে উঠতে।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..