এপারে পরীর ডাঙা, ওপারে ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির গাঁ

অয়ন্ত ইমরুল
গল্প
এপারে পরীর ডাঙা, ওপারে ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির গাঁ

দুপুর ঝিম হয়ে আছে। শান্ত পুকুরে ঢিল ছুঁড়ে কেউ তরঙ্গ সৃষ্টি করছে। পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া রাঙা মেঠোয়, ক্যাঁচোর কোঁচ-ক্যাঁচোর কোঁচ শব্দে ছুটে যাচ্ছে গরুর গাড়ি। গাড়িয়ালের কণ্ঠ ভরা গান। একবার,পায়ে হেঁটে পথের শেষটা দেখার আকাঙ্ক্ষা জেগে আবার দমে যায় হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে। অথচ কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। পুকুর পাড়ে একটা ডেউয়া গাছ। গাছে বেনেবৌ- খুব যে ফুরফুরে মেজাজে বোঝা যায় ডেউয়া ফলে তার ঠোকরের ভঙ্গিমা দেখে। হলুদ ডেউয়া ফলের অনেকটা অংশ সে খেয়ে নিয়েছে। ‘পীলোলো’ শব্দে মাঝেমাঝে শিস দিচ্ছে। কিন্ত তার সঙ্গিনীর সাড়া পাচ্ছে না। নেচে নেচে এক ডাল থেকে অন্য ডালে যাচ্ছে। পুনরায় আবার ফলের কাছে ফিরে আসছে। দূরের শালবনে একদল কাঠুরে- গাছ কাটার শেষার্ধে অন্যদের সাবধানে-সাবধানে বলে সতর্ক করে দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে গাছ একদিকে কাৎ হয়ে পড়ে যাচ্ছে। আর কিছু কাক কা–কা ধ্বনি ছড়িয়ে উড়ে যাচ্ছে দূরের নীলিমায়। রাখালিয়া ভাবা হল আর অষ্ট আঙুল বাঁশের বাঁশি। সুর এমন- রসুইঘরে থমকে যায় কেউ; ভাত পোড়া কিংবা তরকারি পোড়া ঘ্রাণে শাশুড়ি চিৎকার করে ডেকে, বর্তমানে ফিরিয়ে আনে নতুন বঁধুকে। জামিরের বনে তখন রাঙাদি ঘুঙুরে ফেরে টিলিক দিয়ে দেখে ধূলিঝড় কত দূর এগুল। নায়রী ভাসানো গঙ্গা শুধু ছলাৎ বুনে যায়। দূরের নায়রে উতলা পায় কারো কলকণ্ঠধ্বনি- আমারে দেখবার যাইয়ো উজানতলির গাঁ; চিকন দশা থাইকা চাঁন যেদিন ভইরা উঠবো, ভরার নদীর জলের শেষে দেখা যাইবো বঁধুয়া তোমার। আমাদের ঢেউটিনের চৌচালায় পায়রা, সমস্বরে ডেকে ডেকে ক্ষুধার জানান দিচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে যায়- এখনো দানাপানি পড়েনি পেটে। মাঠের রোদে দাঁড়িয়ে গাভিন গাইটি হাম্বা-হাম্বা ডাকছে; ঘাস খাচ্ছে না- ঘাস হলুদ হয়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। অপেক্ষা পর নিজের শক্তি ব্যবহার করে গাভিটি, খুঁটি উঠিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঝুড়িনামা বটের তলায় বসে যায়। অসহ্য রোদে তার শরীর পুড়ে যাচ্ছিল হয়তো। বটগাছের ঠিক সোজা উত্তরে ভাঙা মন্দির, পোড়া বাড়ি বা ভূতুড়ে বাড়ি বলে এ তল্লাটে ও তল্লাটে বেশ পরিচিতি আছে তার- ভর দুপুর বেলায়ও ওদিকটায় কেউ যাতায়াত করে না। আমার যাওয়ার ইচ্ছেটা মাঝেমধ্যেই জেগে ওঠে আর কেন জানি, হৃৎস্পন্দন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। গদাই গিয়েছিল একবার। বাজি ধরে। তারপর সাতদিন বিছানায় পড়েছিল। প্রচণ্ড জ্বর হয়েছিল। জ্বরের ঘরে আবোলতাবোল বলাবলি করতো। ভয়ে চোখই খুলতে চাইতো না। চোখ খুললেই কি যেন দেখতে পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠতো। সাথে সাথে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলতো। পরে ওর মুখেই শুনেছি, ওখানে নাকি বাঘের ছাল দেখতে পেয়েছিল। মৃতের কঙ্কাল দেখতে পেয়েছিল। ভাল্লুকের ডাক শুনে একটা দৌড়ই দিয়েছিল- আর সেই দৌড়েই বাড়ির উঠোনে এসে সটান হয়ে পড়ে যায়। তারপর, ওর বাবা-মার হাউমাউ শুনে পড়শিরা দৌড়ে আসে। রাত বাড়ার সাথে সাথে জ্বরও বাড়তে থাকে। এতটা জ্বর যে, কাঁপন থামানোই যাচ্ছিল না। কবিরাজ এলে অনেক রাতে জ্ঞান ফিরলে দেখা যায়, গদাই বাগ-বাগ করে চিৎকার করছে। আবার শিথিল হয়ে যাচ্ছে।

বেলা পড়ে এসেছে। ওপারের ঝাউবন ঝাপসা হয়ে আসছে। ধূপের ধোঁয়ার সাথে তাল মিলিয়ে সন্ধ্যা নামছে। নদী ঘেঁষা শ্মশানে কারো চিতা জ্বলছে দাউদাউ। কারো আর্তনাদে আকাশ ভারি হয়ে যাচ্ছে। যে সন্তান মুখাগ্নি দিচ্ছে, তার বুকের ভেতরটা যদি ঘুরে আসা যেত- বোঝা যেত বিদায়ের বেদনা কেমন করে সয়ে থাকা যায় বা আদৌ সয়ে থাকা যায় কিনা। এক সময় চিতা নিভে যায়। ভষ্মীভুত দেহটি ভাসিয়ে দেয়া হয় পূত ও পবিত্র গঙ্গায়। আপনজনেরা চেয়ে থাকে, যতদূর ছাইগুলো দেখা যায়। তারপর আকাশের দিকে মাথা তুলে প্রার্থনা করে আত্মার শান্তিকামনায়। আকাশে ঈশ্বর থাকে। তারও কি কেঁদে ওঠে, কেঁপে ওঠে বুক নাকি লীলার অনন্য চূড়ায় বসে সে দেখতে থাকে মানব মুক্তির খেলা!

হঠাৎ করেই দমকা হাওয়া শুরু হয়। উজিয়ে চলে কেউ ধূলিঝড়ের ভেতর। অথচ কিছুক্ষণ পূর্বেও আকাশ পরিচ্ছন্ন ছিল। এখনো বৈশাখ তার ক্ষেমটা নাচ শুরু করেনি। কিন্তু বৈশাখী ঝড়ের মতোই তার ব্যবহার। শতাব্দীর বটগাছটা উপড়ে যাবে কি না- একবার তাকিয়ে বুকের ভেতরটায়  দুরুদুরু টের পেলাম। ভাবনার ভেতর দিয়ে কিছু পাখি উড়ে যায় কাঁদতে কাঁদতে। এই বটগাছটা কত পাখিদের আহার যুগিয়েছে, কত মানুষ এসে ছায়ায় শীতল হয়েছে। ওর আরো আয়ু কামনায় চোখের কোণে দুফোটা জল এল কি না টের পেলাম না। একটা আয়নায় নিজের অসহায় মুখটা ধরার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছি।

সন্ধ্যায়, প্রতি অমাবস্যয় মা, তিলের তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন বাড়ির মূল দরজায়। তার একটি নিভে গেছে। মা পুনরায় জ্বালানোর চেষ্টা করছেন। নিভে গেছে বলে মাকে খুব অস্থির দেখাচ্ছে। আজ অমাবস্যার রাত, অমাবস্যায় নাকি অশুভ শক্তির প্রভাব বেড়ে যায়। তাই এই প্রদীপ জ্বালাতে হয়। মা বলতো, এই রাতে কেউ বাইরে বের হইয়ো না। প্রতি অমাবস্যার রাতে ঐ ভূতুড়ে বাড়ি থেকে একদল শেয়াল মিলিত স্বরে ডাকতে থাকে। এই ডাকাডাকি চলতে থাকে ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এই অমাবস্যার রাতেই তাদের ডাক শোনা যায় এবং সারা মাসে তাদের আর সাড়া- শব্দ পাওয়া যায় না। এই ভূতুড়ে বাড়ির আশেপাশে, তেত্রিশ ঘর হিন্দু পরিবার ছিল এক সময়। এখানকার বসতভিটেগুলো কেউ কিনতে চাইতো না। তাই নামমাত্র দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয় তারা। কেউ ভারতে, কেউ অন্য গ্রামে চলে যায় এক সময়। শুধু গণেশ কাকুর দাদু আমাদের বাড়ির পাশেই বাড়ি করেছিল। গণেশ কাকুর মুখে শুনেছিলাম, তারা বন্ধুরা মিলে নাকি এক রাতে এই শেয়ালদের দেখার জন্য, তাবিজ-কবচের সাহায্য নিয়ে এবং একজন তান্ত্রিককে নিয়ে, সন্ধ্যা থেকেই ওৎপেতে ছিল। রাত যখন একটু গভীর হয় তারা পোড়া বাড়ির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রধান গেট, যার চিহ্ন এখন নেই- কিন্তু সবাই বলেই এইখানেই ছিল সদর দরজা- তার কাছাকাছি আসতেই তারা দেখতে পায়, সাদা জুব্বা পরিহিত বেশ কজন লোক- দীর্ঘকায়, প্রাচীর আকারে দাঁড়িয়ে আছে। গণেশ কাকুরা চমকে ওঠে। তান্ত্রিক নরেণ বৈদ্য ফিসফিস করে জানিয়ে দিলেন যে, ভয় পাইয়ো না তোমরা- মন্ত্রটা মনে আছে তো? সবাই উত্তর দিল, হ্যাঁ- আছে। ওটা জপতে থাকো। বলেই নরেণ বৈদ্য মাটিতে বসে কি যেন আঁকতে লাগলো। বারোটা বাজতে এখনো অনেকটা দেরি আছে। বারোটার পর শুরু হয় শেয়ালদের ডাকাডাকি। গণেশ কাকু মনে মনে চাইছিলেন পালিয়ে যেতে। কিন্তু এও ভেবে নিয়েছিলেন যে সকাল হলেই বন্ধুরা ভিতুর ডিম বলে ক্ষ্যাপানোর সুযোগ পাবে। হঠাৎ সামনের ঝোপ থেকে ঝপঝপ শব্দ করে কি যেন পড়লো। গণেশ কাকুর ভাষ্যমতে, নিতাই’মাগো’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। নরেণ বৈদ্য তার হাত ধরে রাখলেন, যাতে ভয় না পায়। নরেণ বৈদ্যর কথায় গণেশ কাকুরা একটু পিছু হটে যায়। দিঘীর পাড়টাতে এসে দাঁড়ায়। তখন মনে পড়ে যায় খেলারাম দাতার কথা- এই খেলারাম নাকি মস্ত বড় ডাকাত ছিলেন। ডাকাতি করে যা যা নিয়ে আসতেন, গরীবদের মাঝে তার অনেকটা বিলিয়ে দিতেন। একবার অনেক সোনাদানা নিয়ে এলেন। তার মাকে এমনভাবে  অলংকরণ করলেন যে, এই দিঘিতে একদিন গোসল করতে নেমে স্বর্ণালংকারের ভারে তাকে ডুবে যেতে হল। তিনি আর উঠতে পারলেন না। এমনকী তার মৃতদেহটিও নাকি কোনদিন ভেসে উঠেনি। কথাগুলো যখন নিতাই বলছিল- সবাই শিউরে উঠছিল। নরেণ বৈদ্য থামিয়ে দিলেন। এর মধ্যে শাঁই করে একটা বাতাস বয়ে গেল। মনে হল বাতাসের সাথে কিছু আছে। নরেণ বৈদ্য বললেন- ভয় পাইয়ো না। আমার হাতে রক্তজবা ফুল আছে। রক্তজবা ফুলের মাহাত্ম্য  কি, তা আমরা কেউ জানি না। হঠাৎ নরেণ বৈদ্য বললেন চলো এখান থেকে,কোনদিকে তাকাবে না। আমার পিছু পিছু হাঁটবে সবাই। আমাদের ভেতরটা ধুকপুক করতে লাগলো। নরেণ বৈদ্যকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও জিজ্ঞেস করতে পারলাম না।

পিছুনে তাকিয়ে দেখি দীঘির মাঝখান থেকে একটা আগুনের ফুলকি উঠে, গোল হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমি আমার সামনের জনকে ঝাপটে ধরি। ওরা খেয়াল করেনি। কিছুক্ষণ পর আবার তাকিয়েই দেখি আলোটা নেই। আমরা আবার ভূতুড়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছি নরেণ বৈদ্যকে সবার সামনে রেখে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাতাস ঘাপটি মেরে আছে। কিন্তু ঝড়বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছিল না। আমরা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে পরিবেশটা বোঝে নেয়ার চেষ্টা করছি। কেমন যেন গোলাপ ফুলের সুবাস পাচ্ছি, সুবাস ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, বাড়ির যেদিকটাতে ফোয়ারা ছিল, ওপাশ থেকেই সুবাসটা আসছে। আমরা বিদ্যুৎ চমকানোর জন্য অপেক্ষা করি, যদিবা তার আলোয় কিছু বোঝা যায়। দাদুর মুখে শুনেছিলাম, ফোয়াটি রাণীর জন্যই বিশেষ করে নির্মাণ করা হয়েছিল। রাণী এখানেই  গোলাপমিশ্রিত জলে স্নান করতেন। শ্বেতশুভ্র মার্বেল ও তার সবুজাভ নকশা কালের বিবর্তনে অনেকটা মলিন হলেও এর জৌলুশ নাকি এখনো রয়ে গেছে। শব্দ হল- দোলদোল দুলানি। তারপর, একসাথে অনেকজনের হাসির শব্দ। হাসির ধরন দেখে মনে হল সবাই নারী। কিছুক্ষণের জন্য আবার চারপাশ স্তব্ধ হয়ে এল। একটা জ্বরাজীর্ণ দোলনার মতো দেখা গেল বিদ্যুতের আলোয়।ফাঁকা দোলনা, একা একাই দুলে যাচ্ছে। আবার সেই একি দৃশ্য- জুব্বা পরিহিত অনেকগুলো লোক, দীর্ঘকায়- আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো প্রাচীর আকারে। নরেণ বৈদ্য সবাইকে মন্ত্র পড়তে বললেন। আমরা নিজেদের অজান্তেই কাঁপতে শুরু করেছি, তারা ধীরে ধীরে আমাদের দিকে আসছে। একজন দূর থেকেই হাত বাড়িয়ে নরেণ বৈদ্যের গলা ধরে, তাকে উপরের দিকে উঠায়। আমরা চিৎকার দেয়ারও শক্তি পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে কেউ আমাদের কণ্ঠ রোধ করে রেখেছে। মনে হচ্ছে বোবা হয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ নরেণ বৈদ্যকে নিয়ে জুব্বা পরিহিত লোকগুলো উধাও হয়ে যায়। আমরা চারপাশে তাকিয়ে দেখি, আমাদের কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে  অনেকগুলো শেয়াল ঘুরাঘুরি করছে। বিদ্যুতের আলোয় যা মনে হল, তাদের বর্ণ ও আকার স্বাভাবিক শেয়ালের মতো ছিল না। একসময় মনে হল, আমরা দৌড়াতে পারবো। যে যার মতো দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলাম। আমাদের মধ্যে একজন শেয়ালের কামড়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল। কাকুর বর্ণনামতে, শেয়ালগুলো যখন ঘুরছিল, তাদের চোখ দিয়ে একপ্রকার নীলচে আভা বের হচ্ছিল।

নরেণ বৈদ্যকে পরদিন সকালে দিঘির পাড়ে পাওয়া গিয়েছিল ঠিকই, তার ঘাড় মটকানো ছিল। তিনি বেঁচেছিলেন যতদিন ঘাড় আর সোজা করতে পারেননি। আমরা কেউ ই বাড়িটার ভেতরে গিয়ে দেখার সাহস পেতাম না। তাছাড়া বাড়িটি এখন এমনভাবে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা যে, তার না কেটে যাওয়াও সম্ভব নয়। মাঝেমধ্যে বন্ধুরা মিলে কৌতূহল মেটাতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু কেউ না কেউ পিছিয়ে যাই। কারন ভর দুপুরেও নাকি ওখানে স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার। গাছপালা, লতাগুল্ম এমনভাবে ছেয়ে আছে যে, কতকাল ওখানে সূর্যের আলো পৌঁছায়নি, তার লেখাজোখা নেই।

পেরিয়ে যাচ্ছি সরুখালের সাঁকো। সামনে বেউড়বন। পথ বেঁকে নদীঅবধি ঠেকেছে।চা-বাগানের মেয়েগুলো বাড়ি ফিরছে। কিছু বখাটেপনা দেখা গেল। যুগল ভ্রুর মাঝে টের পেলাম আমার বিরক্তি। ক্রুদ্ধ কাঠঠোকরার মতো ঠোকর দিতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু ছোট বলে পারিনি। সন্ধ্যার শেষ চিৎকার দিয়ে যাচ্ছে ফেরিওয়াল। গোধূলির রক্তাভা পশ্চিমের আকাশে শেষ ঢেউ দিয়ে যাচ্ছে। প্রায় নির্জন গ্রাম্যপথে ঝড়েরবেগে মোটরবাইক চালিয়ে যাচ্ছে একজন তরুণ। পিছুনে বসা ছেলেটি কেন জানি হৈ হৈ করছে। খেলা শেষে একদল ছেলেপিলে ভীষণ হল্লা করে বাড়ি ফিরছে। পতনের দু:খে গোধূলি কাঁদছে আর ধীরে নামছে নীল রাত চরাচরে। হাতিঘাটা চরে আজকাল ডাকাতের উপদ্রব বেড়ে গেছে, সেই সাথে সাপের উপদ্রপ। কয়েকদিন পূর্বে কাশিমের ছেলেটাকে গোখরোতে কামড়ায়ে মেরে ফেলেছে। হাটুর নিচে কামড় দিয়েছিল,কয়েকটা দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল। পাশেই নদীঘেঁষে চিংড়ি ধরছিল রজ্জব।  চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে, গামছা দিয়ে ঠিকঠাক বেঁধেও ছিল। কিন্তু কয়েক মুহূর্তেই শরীর নীল হয়ে যায়। আজ রাতে পালা করে পাহাড়া দিতে হবে। আমিও সাথে থাকতে চাচ্ছি সাথে কিন্তু খালা নিষেধ করলেন। এই চরেই আমার খালাবাড়ি। দুদিন হল বেড়াতে এসেছি। ইচ্ছে ছিল কিছুদিন থাকবো। কিন্তু ভেতরে সাপের ভয় কাজ করছে। একেক সময় চোখে ভেসে উঠছে সাপের এঁকেবেঁকে চলা, ফণা তুলে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য। চরে প্রচুর ঘাস। চরবাসীদের প্রত্যেকের বাড়িতেই গরু পালন করা হচ্ছে। সামনে ঈদ। মোটা দামে বিক্রির আশায় তারা ষাঁড় গরুর খুব যত্নাদি করছে। কয়েকজনের আবার খামারও আছে। ফইজুদ্দির খামারে ক’দিন আগে ডাকাতি হয়েছে। গভীর রাতে, ট্রলারে করে ডাকাতরা আসে। ঘাট একটু দূরে থাকায় ট্রলারের শব্দ শুনতে পাওয়া যায় না। ফইজুদ্দি তার শেষ সম্ভল দিয়ে চারটি ষাঁড় কিনেছিল। ষাঁড়গুলো তখন খুব ছোট ছিল। ষাঁড়গুলার পিছুনে বেশ টাকাও খরচ হয়েছিল। ক’দিন  আগে এক গরুর দালাল এসে, চারটা ষাঁড় দাম করে গেছে। কিন্তু ফইজুদ্দি বিক্রি করে নাই আর একটু বেশি দাম পাওয়ার আশায়। ফইজুদ্দি কাঁদে আর জনে জনে সেই কথাই বলে। নি:সন্তান ফইজুদ্দি একেবারে নি:স্ব হয়ে গেল। এখন পাগলের মতো এদিক-ওদিক দৌড়ে বেড়ায়। সবাই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, ডাকাতদের একবার ধরতে পারলে তাদের চোখ উপড়ে দেয়া হবে। কয়েক রাত পাহাড়া দেয়ার পরও যখন ডাকাতরা এল না। তখন তারা ক’দিন পাহাড়া বন্ধ করে দেয়। ক’দিন পর আবার শুরু করে। এভাবে বেশ কিছুদিন চলার পরও ডাকাত আসার নামগন্ধ না পেয়ে তারা পাহাড়া বন্ধ করে দেয়। রাত জাগলে শরীর খারাপ হয়। দু চারজন অসুস্থ হয়েও পড়লো। কৃষ্ণপক্ষ শেষ কিন্তু চাঁদ তার চিকন দশা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। রাস্তা দিয়ে একদল লোক মৃতদেহ নিয়ে শ্মশানে চলছে। চারপাশে ধ্বনিত হচ্ছে’বল হরি, হরি বল’। কেউ একজন জিজ্ঞেস করছে- কিরা মইলো রে কাশি?

সুদেব কাহা। লোকটি দৌড়ে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো। তরতাজা পুলাডার হঠাৎ কি অইল!

কাহা, শুনছি ওরে মেছো ভূতে ধরছিল। পরিত্যাক্ত শ্মশানঘাটের পুকুরে অমাবস্যার রাতে সুদেব মাছ ধরতে গিয়েছিল। কি কস!  ওই জঙ্গলের ঘাটে তো কেউ যায় না। হ, কিন্তু ওর মরণ আছিল বইলাই ও গেছে। এই পুকুরে প্রচুর মাছ। কিন্তু কেউ কখনো এই পুকুর থেকে মাছ ধরে না। শুধু এর পানি চিতায় ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এই শ্মশান এখন পরিত্যক্ত হওয়ায় এর জলও আর ব্যবহার করা হয় না। প্রাকৃতিকভাবেই এখানে মাছের বংশবৃদ্ধি ঘটে। শুধু এটুকুই জানি এখানে মাছ ধরা নিষেধ। একটা ঘটনা সবাই জানে, এখানে মাছ ধরে, মাছ নিয়ে কেউ বাড়ি ফিরতে পারে না। সুদেব জেনেও কেন ওখানে মাছ ধরতে গেল। লোকটি ভাবতে বসে। মনে পড়ে, বহু বছর পূর্বে, তারা যখন কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিয়েছে মাত্র- পাঁচ-ছয়জন মিলে একবার মাছ চুরি করতে গিয়েছিল। সেদিন ছিল অমাবস্যার রাত, নিরব, নিস্তব্ধ, থমথমে চারপাশ। গ্রামের শেষপ্রান্তে পুকুরটা।  জনমানব শুন্য এলাকা। জংলা আর বিদঘুটে অন্ধকার।কচুরিপানা সরিয়ে জাল ফেলি, ঝাঁকি জাল। কিন্তু জালে কোন মাছ এলো না। তারা আশ্চর্য হয়ে গেল। আবার জাল ফেলার কিছুক্ষণ পর  জাল উঠিয়ে দেখি, ঠিক হতুম পেঁচার ন্যায় একটা জটাবুড়ি, জটাবুড়ি খিলখিল করে হেসে দিলে, তারা চমকে যাই।থরথর করে কাঁপতে থাকি সবাই। বুড়িটা লাফ দিয়ে অন্যত্র যাওয়ার পর একটা বাচ্চা বিড়ালের আকৃতি পায়। আর মিউমিউ করে ডাকতে থাকে। আমরা দোয়াদরুদ পাঠ করতে থাকি। একসময় বিড়াল উধাও হয়ে গেলে কিছুটা সাহস ফিরে পাই। জালে কিছু আগাছা ছিল, তা ছাড়াতে গিয়ে দেখি, জটাবুড়ি যেদিক দিয়ে বের হয়েছে, সেদিকের কিছু অংশ ছেঁড়া। আমরা আবার জাল ফেলি। জালে উঠে আসে মানুষের হাড়গোড়, কুকুরের মাথার খুলি, পোড়া কাঠ আর ভাঙা কলসি। আমরা মনে মনে খুব ভয় পেতে থাকি, ভয় কুঁকড়ে খায় আমাদের, কিন্তু কেউই প্রকাশ করি না। আমরা দেখি, বড় বড় মাছ একটু দূরেই খলবল করছে। আশ্চর্য হই। একটা মাছও জালে আটকানো যাচ্ছে না। কুকুরের মাথার খুলি থেকে ঘেউঘেউ শব্দ আসছে কিন্তু খুলিটি নড়ছে না। হাড়গোড় আর কাঠ ঝনঝন শব্দ করছে। দূর থেকে ভেসে আসছে মানুষ পোড়ার গন্ধ।

সবাই ভয়ে জড়োসড়ো, কেউ আর থাকতে চাচ্ছে না। কিন্তু মাছ না নিয়ে যাব না বলে আমি অনড়। এবং সবাইকে ভীতুর ডিম বলে বকা দেই। এও বলি যে, তোদের সাথে নিয়ে আর কোথাও মাছ ধরতে যাব না। আমি মাছ নিয়েই বাড়ি ফিরবো- বলেই আবার জাল ফেলি। এবার জালই উঠে ছিঁড়ে গেল। শুধু রশিটুকু ফিরে এল। থতমত করে বশিরকে বলি, যা- পুকুরে নাম। ও কেঁদে ফেলে। সবাই পুকুরে নামতে অস্বীকার করলে, বাধ্য হয়েই আমাকে নামতে হয়। আমিও ভয়ে ভয়ে নামি গভীর পানিতে। যেই ডুব দিলাম অমনি কে যেন আমার পা জড়িয়ে ধরলো। আমি চেষ্টা করলাম ছাড়িয়ে নিতে কিন্তু পারলাম না। এদিকে বড বড় শোল, বোয়াল, আমাকে খাবল মেরে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। আমার চিৎকারে ওরা সবাই নেমে পড়ে পানিতে। সবাই মিলে আমাকে উদ্ধার করে। ওরাও রক্তাক্ত হয়ে যায়। পরদিন সবাই মিলে হাশেম কবিরাজের কাছে গিয়ে তাবিজ এনে হাতে বাঁধি। লোকটি এই বলেই হাতের তাবিজটা খুলে চুমো খেয়ে পুনরায় হাতে বাঁধে।

অয়ন্ত ইমরুল। কবি। জন্ম ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের সাভার। প্রকাশিত বই: 'ছায়া সমুদ্র' (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৬), 'বুদ্ধের ভায়োলিন' (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৮), 'সাদা ধূলির দূরত্বে' (কাব্যগ্রন্থ, ২০২০), 'স্বৈর হাওয়ার হরিণী'  (কাব্যগ্রন্থ, ২০২০) এবং 'কিসমত আলী অথবা শূন্য' (গল্পগ্রন্থ, ২০২০)।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..