প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
অনেক্ষণ ধরে ‘ম্যাবেল ম্যাবেল’ বলে ডাকাডাকি করেও ম্যাবেলের খোঁজ পাওয়া গেল না। হতাশ হয়ে সোফার উপর ধপ করে বসে পড়লেন যোসেফ রুবাদিরি। ম্যাবেলটা বড্ড ফাজিল হয়েছে। হঠাৎ যেন রাজ্যের স্বাধীনতা পেয়ে বসেছে। ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কিছু বলছে না। ফ্রিজ খুলে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেলেন রুবাদিরি। সকালে জগিং থেকে ফিরে আর ম্যাবেলের দেখা পাননি। সেই থেকে কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে বদমাশটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই অবস্থায় কি করে যাওয়া যায়। ম্যাবেলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এই মুহূর্তে এর চেয়ে সাংঘাতিক কোনো বিষয় তার জন্য আর নেই। হঠাৎ ডোরবেলের আওয়াজ শুনে বিরক্ত হলেন রুবাদিরি। কে এলো এই অসময়ে! দরজা খুলে দেখলেন পাশের ফ্ল্যাটের পিচ্চিটা একটা বই হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
‘কি চাই?’ রুবাদিরি বললেন।
‘তোমাকে বইটা দিতে এলাম।’ পিচ্চি বলল।
‘কিসের বই এটা?’
‘এটা রাক্ষস খোক্কসদের বই। বইটা আমার খুব ভালো লেগেছে। তুমি পড়ে দেখো অনেক মজা পাবে।’
পিচ্চিকে ভেতরে নিয়ে এলেন রুবাদিরি। পিচ্চির নাম ওকারা। ক্লাস ফোরে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ লেকচারার ডেভিড সেমাবিয়ার একমাত্র পুত্র। সেমাবিয়া তার পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে। এক সময় তার বিভাগের ছাত্র ছিল। এখন লেকচারার হয়েছে। মেধাবী এই তরুণকে পছন্দ করেন রুবাদিরি। ওকারাকে তাই গ্র্যান্ডসানের মতো আদর করেন তিনি।
ওকারাকে সোফায় বসিয়ে বইটা হাতে নিলেন রুবাদিরি। একটা বাচ্চাদের বই। বাচ্চাদের বই পড়তে তার খারাপ লাগে না। একটা ফ্যান্টাসির জগতে চলে যাওয়া যায়। ওকারা তার প্রিয় বইগুলো রুবাদিরিকে পড়তে দেয়।
‘রাক্ষস খোক্কস কি জিনিস, ওকারা?’ বললেন রুবাদিরি।
‘এরা অনেক আগের প্রাণী। ইন্ডিয়ায় থাকতো।’
‘এখন থাকে না?’
‘নাহ’
‘কেন’
‘কারণ রাক্ষসরা মানুষের মতো রান্না করা খাবার খেতে শিখে গেছে। এখন আর ওরা কাচা মাংস খায় না। তাই রাক্ষস প্রজাতি মানুষ প্রজাতির সাথে মিশে গেছে। আলাদা করা যায় না।’
‘বাহ। দারুণ ইন্টারেস্টিং তো। আমি বইটা পড়বো।’
ওকারার সাথে কথা বলতে বলতে ম্যাবেলের কথা ভুলতে বসেছিলেন রুবাদিরি। ওকারার জন্য বিস্কুট আনতে গিয়ে আবার তার কথা মনে হল। রুবাদিরি ডেকে উঠলেন, ‘ম্যাবেল ম্যাবেল’।
‘ম্যাবেল কোথায় গেছে। ওকে দেখছি না যে!’ ওকারা বলল।
‘সকাল থেকে ম্যাবেলকে খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় যে গেল বুঝতে পারছি না। ঘরের দরজা জানালা তো বন্ধ ছিল। যাবে কোথায়?’
রুবাদিরির কথা শুনে ওকারাও ম্যাবেলকে খুঁজতে শুরু করলো। সে ডাকলো ‘মিঁউ মিঁউ’ বলে। ওমনি আলমারির আড়াল থেকে ‘ম্যাঁও’ শব্দ শোনা গেল। রুবাদিরি দ্রুত আলমারির পেছনে গিয়ে দেখলেন ম্যাবেল আড়মোড়া ভাঙছে। তার মানে সে এতক্ষণ ঘুমিয়েছিল। পোষা বিড়ালকে দেখতে পেয়ে শিশুর মতো খুশি হয়ে উঠলেন বৃদ্ধ রুবাদিরি।
যোসেফ রুবাদিরি কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞানের অধ্যাপক। পড়াশোনা আর গবেষণা নিয়েই তার জীবন। গবেষণায় অতিরিক্ত আত্মমগ্ন হওয়ার কারণে জীবনে বিয়ের ফুরসত পাননি। মানব জাতির উৎপত্তি নিয়ে জীববিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানের কোনো মতবাদই তিনি গ্রহণ করতে পারেননি। তার মনে হয় প্রচলিত থিউরিগুলোর বাইরে এমন কিছু ঘটেছে, যা সম্পর্কে এখনো কোনো একাডেমিক তত্ত্ব উপস্থিত হয়নি। তাই তার বর্তমান গবেষণার বিষয় সেই পুরাতন প্রশ্ন- মানব জাতির উৎপত্তি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে নিজের চেম্বারে ঢুকেই থতমত খেলেন রুবাদিরি। ফ্যান ঘুরছে। ভেতরে কেউ নেই। থাকার কথাও নয়। গতকাল যাওয়ার সময় তালা লাগিয়ে গিয়েছিলেন যা খুলেই তিনি আবার ভেতরে ঢুকেছেন। তার মানে গতকাল ফ্যান বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলেন। কি যে হচ্ছে ইদানীং। বিভিন্ন কাজে ভুল হচ্ছে। তিনি যখন গভীরভাবে কোনোকিছু নিয়ে ভাবতে শুরু করেন তখন এরকম নানা কাজে ভুল করেন। তিনি কাজ করেন, গল্প করেন, হেঁটে বেড়ান ঠিকই, কিন্তু তার মন পড়ে থাকে বিভিন্ন তত্ত্ব আর রেফারেন্স বইয়ে। চেয়ারে বসে বুকশেলফের দিকে তাকালেন তিনি। ডারউইনের ‘অন দ্যা অরিজিন অব স্পেসিস’ হাতে নিয়ে কয়েকটা পৃষ্ঠায় কলমের দাগ কাটলেন। ডারউইনের সাথে এসব জায়গায় তার দ্বিমত রয়েছে।
ডারউইন বলছেন, মানুষ এসেছে প্রাইমেট শ্রেণির একটা সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে। যার আরো শাখা হল ওরাং ওটান, শিম্পাঞ্জি, গরিলা ইত্যাদি। আদি প্রাইমেট পূর্ব পুরুষকে একটা বৃক্ষ কল্পনা করলে এই প্রজাতিগুলো হবে তার শাখা প্রশাখা। এসব শাখার একটি থেকেই মানব জাতির উৎপত্তি। রুবাদিরি মনে করেন ওরাং ওটান, শিম্পাঞ্জিরা যদি মানুষের কাজিন হয় তাহলে তাদের মধ্যেও মানুষের মতো বিবর্তন হওয়া উচিত ছিল। ওরাং ওটান, শিম্পাঞ্জিদের পূর্বপুরুষ এবং মানুষের পূর্বপুরুষ সমবয়সী, অথচ বুদ্ধিমত্তা ও সভ্যতায় এগিয়ে গেল শুধু মানুষরা। এটা যেন মানুষের প্রতি অনেকেটা প্রকৃতির পক্ষপাতিত্ব। রুবাদিরির ধারণা, প্রকৃতি কারো প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে না।
কফি মেকারে কফি বসিয়ে দিয়ে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিল নিশি। আজ সারাদিন বেশ খাটুনি গেছে তার উপর দিয়ে। দীর্ঘসময় ল্যাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করে পা ব্যথা হয়ে গেছে তার।
সোমালিয়ায় পাওয়া যাওয়া নতুন একটা ফসিল নিয়ে গবেষণা করছে তার দল। ধারণা করা হচ্ছে ফসিলটি প্রায় একুশ লক্ষ বছর আগের মানুষের কোনো এক প্রজাতির। নিয়ান্ডারথালদের সমসাময়িক অন্য এক মানব প্রজাতির পূর্বসূরি হিসেবে ধারণা করছেন কোনো কোনো গবেষক।
নিশি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত সাউথ আফ্রিকান মেয়ে। তার পূর্ব পুরুষেরা ব্রিটিশ পিরিয়ডে সাউথ আফ্রিকা গিয়ে আর ফিরে আসেনি। তার দাদা ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর সহচর। এই অঞ্চলে তার পরিবারকে বেশ সম্মানের চোখে দেখা হয়। নিশির বাবা একজন সাংবাদিক। তার বয়স যখন এগারো তখন তার মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। নিশি পড়াশোনা করেছে কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রাণিবিজ্ঞানে পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষ করে পিএইচডি করছে প্রফেসর রুবাদিরির অধীনে। একই সাথে ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছে লেকচারার হিসেবে। হঠাৎ ফোনের রিংটোনে ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এলো নিশি। ফোন করেছে ডেভিড সেমাবিয়া।
‘হ্যালো সেমা, কি খবর?’
‘এইতো। আজ তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওনি?’ সেমাবিয়া বললো।
‘গিয়েছিলাম তো। কিন্তু ডিপার্টমেন্টে যাওয়া হয়নি। সারাদিন ল্যাবেই কাটিয়ে দিয়েছি।’
‘ওহ, আমি ভাবলাম অসুস্থ হয়ে পড়লে কিনা।’
‘নাহ, তেমন কিছু না।’
‘নতুন ফসিলটার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারলে?’
‘সিদ্ধান্তে আর কি করে আসি বলো। স্যার ইদানিং কি সব আবোল তাবোল কথা বলছেন। তার কথা শুনে মনে হচ্ছে বিবর্তনবাদ আবার নতুন করে লিখতে হবে।’
‘মানে কি। কিছুই তো বুঝতে পারছি না!’ সেমাবিয়ার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘তুমি হয়তো জানো স্যার সম্প্রতি কেনিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ তার ধারণা সেখানে গেলে মানব জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে নতুন মতবাদ হাজির করতে পারবেন তিনি।’
‘তিনি মানব জাতির উৎপত্তি নিয়ে ভিন্নধর্মী এক গবেষণা করছেন সেটা জানি। কিন্তু তিনি যে কেনিয়া যাচ্ছেন তা জানা ছিল না। কাল তাহলে সামনাসামনি এ ব্যাপারে বিস্তারিত কথা বলবো।’
‘ঠিক আছে।’
ফোন রেখে কফির মগ হাতে নিয়ে টিভি অন করলো নিশি। গানের চ্যানেলে দিয়ে আরাম করে কফি খেতে লাগলো সে। সারাদিন জটিল সব থিউরি কপচিয়ে নিজেকে মোটেই সময় দেওয়া হয় না তার। এমনকি হিশামকেও সময় দিতে পারছে না। বেচারা সেই দুঃখে দুদিন ধরে ফোনও করছে না তাকে। বলেছে যেদিন তার ব্যস্ততা কমবে সেদিন যেন সে ফোন করে। হিশামের অভিমানী কথা শুনে মুখ টিপে হেসেছে নিশি। হিশাম ওর বাগদত্তা। মরক্কো থেকে মাইগ্রেশান করে আসা একটি পরিবারের ছেলে সে। পেশায় ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনিয়ার। নিশির কাজের ক্ষেত্র যেখানে জীবন, সেখানে হিশামের কাজের ক্ষেত্র মেশিন। প্রকৃতির কি অদ্ভুত খেলা। দুই বিপরীতধর্মী স্বভাবের মানুষের মধ্যে ভালোবাসা তৈরি করে দেয় যে প্রকৃতি, জীবনের সমস্ত রহস্য লুকিয়ে আছে তো সেখানেই। এভাবেই কি বৈচিত্র্যময় প্রাণিকুল সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীতে?
কফির মগ শেষ করে ফোন হাতে নিলো নিশি। হিশামকে এখন ফোন না দিলেই নয়।
প্রফেসর যোসেফ রুবাদিরি আজ বাসায় যাননি। তিনি যখন বইয়ের পাতায় চোখ বুলান তখন তার কাছে সময় স্থির হয়ে যায়। একাধারে দীর্ঘসময় তিনি বই পড়তে পারেন। আজ তিনি মানুষের উৎপত্তি বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা বই পড়েছেন। কিছু ডকুমেন্টারি দেখেছেন। বিজ্ঞান বলছে ক্রিটেশিয়াস যুগের আগে কোটি কোটি বছর পার হয়ে গেলেও মানব প্রজাতির অস্তিত্ব ছিলো না। মানুষ ও প্রাইমেট ছাড়া অনেক প্রাণি ছিল। গাছপালা, মাছ, পাখি, সরীসৃপ এবং মহা শক্তিশালী ডাইনোসর ছিল। কিন্তু তাদের কেউই কোটি কোটি বছরের অস্তিত্ব সত্ত্বেও সভ্যতার জন্ম দিতে পারেনি। ক্রিটেশিয়াস যুগের ধ্বংসলীলায় ডাইনোসরসহ পৃথিবীর ৭৫ ভাগ প্রাণি ধ্বংস হয়ে গেলেও টিকে ছিল ২৫ ভাগ। এই ২৫ ভাগেরও কোনো প্রজাতি মানুষের মতো সভ্যতার জন্ম দিতে পারেনি। কিন্তু মাত্র ১৫-২০ লক্ষ বছর আগে থেকে অস্তিত্বশীল মানুষ জাতি এতো অল্প সময়ের মধ্যে এতোবড় সভ্যতা নির্মাণ করে ফেললো ব্যাপারটা খুবই অবাক করার মতো। রুবাদিরির ধারণা মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের মতামত ভুল। বিজ্ঞান বলছে মানুষের আদি পূর্বপুরুষের মধ্যে একটা হল হোমো ইরেক্টাস। হোমো ইরেক্টাস হল সেই মানব প্রজাতি যারা প্রথম দুই পায়ে হাঁটতে পারতো। এদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা গেছে কেনিয়ার টুরকানা হ্রদ অঞ্চল থেকে। এই অঞ্চলগুলো কুবি ফোরা নামে পরিচিত। যেহেতু মানুষের আদি পুরুষের অস্তিত্ব এই অঞ্চল থেকে শুরু হয়েছে তাই রুবাদিরি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি ওই এলাকায় যাবেন। কারণ সমস্যার যেখানে শুরু সমাধানও সেখানেই পাওয়া যায়।
নিশি এমনিতে ক্রিকেট খেলা পছন্দ করে না। কিন্তু বাংলাদেশের খেলা মাঝেমধ্যে দেখে। বাংলাদেশে কখনো যাওয়া হয়নি তার। কিন্তু দেশটার প্রতি কোথায় যেন একটা টান অনুভব করে সে। তার দাদার বাড়ি ছিল বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুরে। ব্রিটিশ পিরিয়ডে অনেক ভারতীয়র মতো তিনিও ভাগ্যান্বেষনে পাড়ি জমিয়েছিলেন সাউথ আফ্রিকায়। সাউথ আফ্রিকা তখন ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত। সেই থেকেই তার পরিবার এখানে আছে। তারা বাবা মা ভালো বাংলা বলতে পারতো। কিন্তু তার বাংলা সাবলীল না। বিদেশী ভাষার মতো থেমে থেমে বলতে হয়।
আজ কেপটাউনের নিউল্যান্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে বাংলাদেশ বনাম সাউথ আফ্রিকার খেলা হচ্ছে। নিশি হিশামকে নিয়ে এসেছে খেলা দেখতে। হিশাম ক্রিকেট তেমন বোঝে না। খেলাধুলায় তার আগ্রহ ফুটবলে। নিশির ডাকে সে এসেছে তার সঙ্গে। মাঠে তেরো চৌদ্দ জন লোক কি করছে তা নিয়ে তার আগ্রহ নেই। তার সমস্ত মনোযোগ নিশির দিকে। কেমন ইনোসেন্ট একটা মুখ। মুখের এশীয় অবয়ব এখনো মিলিয়ে যায়নি। প্রথম দেখাতে যে কেউ তাকে ইন্ডিয়ান বলেই ভাববে। হাইকিংয়ে গিয়ে তার সাথে পরিচয়। কথায় কথায় জানতে পারে একই এলাকায় থাকে তারা। তারপর একসাথে আড্ডা, ঘোরাফেরা করতে করতে একসময় টের পেলো তার হৃদয়ের জানালায় যে অর্গল লাগানো ছিল তা খুলে ফেলেছে এই এশীয় মেয়েটি। নিশি একমনে খেলা দেখে যাচ্ছে আর মাঝেমধ্যে হিশামের সাথে কথা বলছে।
‘তুমি কখনো মরক্কো গিয়েছো?’ জিজ্ঞেস করলো নিশি।
‘ছোটবেলায় একবার গিয়েছিলাম। কেন?’
‘দেশটা কি খুব সুন্দর?’
‘নিজের দেশ যেমনই হোক, তা সেদেশের সন্তানের কাছে সুন্দরই লাগে।’
‘মরক্কোর সিদি আব্দুর রহমান ও সালে নামে দুটো জায়গায় মানব ফসিলের দুটো খণ্ডাংশ পাওয়া গিয়েছিল।’
‘নিশি, আমরা একটা ভালো সময় কাটাতে এসেছি। এখানো তোমার ফসিল টসিল নিয়ে কথা বলা লাগবে? ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। উফ!’
হিশামের কথা শুনে মৃদু হাসলো নিশি। কপাল থেকে চুল সরিয়ে হিশামের দিকে তাকালো। বেচারা গম্ভীর হয়ে আছে।
‘এতটুকু শুনেই মুখের যে অবস্থা করেছো বাকিটুকু শুনলে না জানি কি হয়।’
‘কেন, আর কি শোনাতে চাও।’
‘আগামী সপ্তাহে আমাকে কেনিয়া যেতে হবে। রুবাদিরি স্যারের সাথে।’
‘বলো কি, কেনো?’ আর্তনাদের মতো শোনালো হিশামের কণ্ঠ।
‘কারণ স্যার কেনিয়ার কুবি ফোরা অঞ্চলে যাচ্ছেন গবেষণার জন্য। পুরো একটা টিম নিয়ে যাবেন তিনি। এর মধ্যে থাকবে নৃবিজ্ঞানী, আর্কিওলজিস্ট, এবং একদল তরুণ গবেষক। আমাকেও যেতে হবে তাদের সঙ্গে।’
নিশির কথা শুনে হতাশ হয়ে পড়লো হিশাম। কোনো কথা বললো না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মাঠের দিকে। যেন সে গভীরভাবে ক্রিকেটের উত্তেজনা অনুভব করছে।
‘আমি জানি তোমার একা থাকতে খারাপ লাগবে। কিন্তু কি করবো বলো। জব ইজ জব। একটা কাজ করলে কেমন হয়। তুমিও চলো আমাদের সঙ্গে।’ নিশি বললো।
‘আমি? কিন্তু আমার কি কাজ সেখানে?’
‘তুমি ইঞ্জিনিয়ার। কতো যন্ত্রপাতির কাজ থাকবে সেখানে। তুমি টেকনিক্যাল কাজে হেল্প করবা।’
‘আমি তো তোমাদের টিমের লোক নই। রুবাদিরি আমাকে নেবে কেনো?’
‘স্যার খুব সরল মানুষ। আমি কিছু একটা বলে তাকে রাজি করাবো।’
‘ঠিক আছে। আমি রাজি। তুমি ব্যবস্থা করতে পারলে আমি যেতে প্রস্তুত।’
কেনিয়ার উত্তর পশ্চিম ও ইথিউপিয়ার দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি হ্রদের নাম টুরকানা। ৬৪০৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার এই হ্রদের পূর্ব উপকূলকে বলা হয় কুবি ফোরা। এখানে পাওয়া গেছে মানুষের পূর্বপুরুষ হোমো ইরেক্টাসের ফসিল। প্রফেসর রুবাদিরি তার দল নিয়ে এই অঞ্চলে এসেছেন গবেষণার কাজে। নিশি যখন তাকে বলেছিল তাদের সাথে একজন ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনিয়ারকে নিতে হবে তখন তিনি অবাক হয়েছিলেন। যখন জানতে পারলেন সেই ইঞ্জিনিয়ার তার বাগদত্তা, তখন আর না করেননি। রুবাদিরির ছেলে মেয়ে নেই। তিনি তার ছাত্র-ছাত্রীদের নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করেন। তাদের আব্দার পূরণ করতে তাই তার খারাপ লাগে না। সেমাবিয়া অবশ্য নিশিকে টিপ্পনী কাটতে ছাড়েনি। ‘আহা কি প্রেম, যেন সুপার গ্লু’ বলে খোচা দিয়েছে সে।
কয়েকদিন ধরে কুবি ফোরার পুরো অঞ্চল চষে বেড়িয়েছেন প্রফেসর রুবাদিরি। কোনো ক্লু পাননি। নৃবিজ্ঞানী ড. স্টিফেন ক্লার্কের মনে হচ্ছে অহেতুক তিনি বুড়ো রুবাদিরির সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এই খাটাখাটির কোনো অর্থ নেই। একদিন বিকেলে কফি খেতে স্টিফেন বলে বসলেন- ‘স্যার, আমার মনে হয় না এখানে কিছু পাওয়া যাবে। আপনার ধারণা তো ভুলও হতে পারে।’
‘আমার ধারণা যে পুরোপুরি ঠিক তা তো বলছি না। বিজ্ঞানের সব আবিষ্কারই আগে ধারণা ছিল। পরে সেটা বাস্তব রূপ লাভ করেছে। ধারণা সঠিক কিনা তা যাচাইয়েত জন্যই তো এই রিসার্চ।’ রুবাদিরি বললেন। টিমের বাকি সবাই শুনতে লাগলো দুই বিজ্ঞানীর কথোপকথন। বিকেলের মিষ্টি রোদে তাবুর পাশে চেয়ারে বসে কফি খাচ্ছে সবাই।
‘আপনি যা বলছেন তাতে তো এতদিন ধরে চলে আসা বিবর্তনবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।’ স্টিফেন বললেন।
‘আমি বিবর্তনকে অস্বীকার করছি না। বিবর্তন তো হয়ই। বিবর্তন না হলে মানুষের মধ্যে এতো বৈচিত্র্য কেনো? কেউ সাদা, কেউ কালো, কেউ ফর্সা। কালো আর সাদাদের শারীরিক গঠনেও রয়েছে বৈচিত্র্য। এটা তো বিবর্তনের ফলেই হয়েছে।’
‘তাহলে আপনার ধারণাটা কি? মানুষ আসলে কোত্থেকে এসেছে?’
‘সেটা তো আমি জানি না। এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যই তো এখানে আসা।’
‘মানুষ যে প্রাইমেট পূর্ব পুরুষ থেকে আসেনি এর পক্ষে আপনার যুক্তি কি?’
‘মানুষ ছাড়া বাকি সব ম্যামাল প্রাইমেট একই পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে এটা মেনে নিতে আমার আপত্তি নেই। বিবর্তনের ক্রম পরিবর্তনের ফলে বানর, শিম্পাঞ্জি,ওরাংওটান, গরিলার উদ্ভব হয়েছে এটা ঠিক আছে। কিন্তু এর মধ্যে মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি নই আমি।’
‘কেন, মানুষের ডিএনএর সাথে তো শিম্পাঞ্জির ডিএনএর ৯৫ শতাংশ মিল আছে। তাহলে এটা মানতে দোষ কোথায়?’
‘দোষ এখানেই। ডিএনএর মিল আছে কিন্তু বুদ্ধিমত্তার মিল নেই। অদ্ভুত না ব্যাপারটা! মানুষ আর শিম্পাঞ্জি একই পূর্বপুরুষ থেকে আসলে মানুষের মতো শিম্পাঞ্জিদেরও একটা সভ্যতা থাকতো। গরিলাদের একটা সভ্যতা থাকতো। প্রকৃতি শুধু মানুষের উপর দয়া দেখিয়েছে এই তত্ত্বে আমি বিশ্বাস করি না।’
রুবাদিরির কথার পর স্টিফেন চুপ হয়ে গেলেন। আর কেউ কোনো প্রশ্ন করলো না। নীরবে কফি শেষ করে সবাই যার যার তাবুতে ফিরে গেলো। শুধু রুবাদিরি বসে রইলেন। সূর্যটা তখন অস্ত গিয়ে আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। ওদিকে তাকিয়ে আকাশটার প্রতি বড় টান অনুভব করলেন রুবাদিরি।
হিশামের হাতে একটা মেটাল ডিটেক্টর। আফ্রিকার প্রখর রোদের মধ্যে সে বালি আর উলুখাগড়ার মধ্য দিয়ে যন্ত্রটা হাতে নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। রুবাদিরি তাকে এটি দিয়েছেন। কোনো ক্লু পেলে সাথে সাথে তাকে ইনফর্ম করার জন্য বলেছেন। প্রাণিবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞানের কাজে মেটাল ডিটেক্টর কি কাজে লাগবে বুঝতে পারছে না নিশি। সেমাবিয়া হিশামের হাতে মেটাল ডিটেক্টর দেখে একচোট হেসেছে। হিশাম অবশ্য খুশি হয়েছে। কারণ একেবারে বসে খাওয়ার চেয়ে কিছু একটা করা ভালো। অন্তত একটা কাজ তো পেয়েছে সে।
হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এসেছে হিশাম। এই অঞ্চলে শুধু বড় বড় পাথর আর বালি। কোনো গাছপালার চিহ্ন নেই। মাঝেমধ্যে ছোট ছোট লতাগুল্ম চোখে পড়ছে। গরমে অস্থির হয়ে পড়েছে সে। আর এগুনো যাবে না। চলে আসতে যাবে এমন সময় তার হাতের যন্ত্রটি বিপ বিপ শব্দ করে উঠলো। কি হল ব্যাপারটা দেখার জন্য মাটিতে বসে পড়লো হিশাম। নাহ, কোনো কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু বালি আর পাথর। ওদিকে যন্ত্রটা বিপবিপ করেই চলেছে। একবার ভাবলো হবে হয়তো কোনো লোহার টুকরা মাটিতে গেড়ে আছে। একে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। আবার ভাবলো যাই হোক, যেহেতু একটা ক্লু পাওয়া গেছে এখন তার দায়িত্ব প্রফেসরকে জানানো। ওয়াকটকিতে রুবাদিরিকে জানিয়ে দিল কথাটা।জায়গাটা মার্ক করে হিশামকে ক্যাম্পে ফিরে আসতে বললেন রুবাদিরি।
পরদিন পুরো টিম নিয়ে জায়গাটায় হাজির হলেন রুবাদিরি। ঘটনা সত্য। মেটাল ডিটেক্টর কিছু একটা ইঙ্গিত করছে। জায়গাটা খনন করার নির্দেশ দিলেন প্রফেসর। শুরু হল খনন কাজ। সাধারণ যন্ত্রপাতি দিয়ে বেশখানিকটা খনন করার পরও যখন কিছু পাওয়া গেলো না, অথচ মেটাল ডিটেক্টরের বিপবিপ চলতে লাগলো তখন বড় মেশিন আনা হল জায়গাটা খনন করার জন্য। সবাই অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো এখানে কি আছে তা দেখার জন্য। তাবু গেড়ে অস্থায়ী ক্যাম্প করা হল জায়গাটায়। টানা তিনঘন্টা খননের পর হঠাৎ একটা ধাতব বস্তু ভেসে উঠলো। জিনিসটা দেখে রুবাদিরি বললেন বাকিটা সাবধানে খনন করতে। পুরো দুদিন লাগিয়ে খনন করা হল জায়গাটা। তারপর যা পাওয়া গেল তা দেখে হতভম্ব হয়ে গেল টিমের প্রতিটা মানুষ। বিরাট একটা জিনিস উঠে এসেছে যা দেখতে অনেকটা মহাকাশ যানের মতো। কিন্তু যানটির মডেল পৃথিবীর কোনো মহাকাশযানের মতো না। যানটি তিরিশ ফুট বালির নিচে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে এমন কিছু যন্ত্রপাতি পাওয়া গেল যা কেউ কখনো দেখেনি। রুবাদিরি তার টিম নিয়ে পুরো যানটির সর্বত্র অনুসন্ধান চালালেন। বেশকিছু অদ্ভুত যন্ত্রপাতি পাওয়া গেল যা সব টাইটেনিয়ামের তৈরি। আর পাওয়া গেল একটা ডায়েরির মতো বস্তু। অনেকটা কাগজের মতো কোনো একটা জিনিসে লেখা। দীর্ঘদিন বালির নিচে চাপা পড়ে থাকলেও কি এক অদ্ভুত কারণে যানটির জিনিসপত্রের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি৷ অনুসন্ধান করে জানা গেল জলোচ্ছ্বাসের কারণে প্রথমে যানটি পানি ডুবে যায়। তারপর তার উপর বালির আস্তরণ পড়তে থাকে। বহুকাল এই জায়গাটা পানির নিচে ছিল। কয়েক দশক আগে এটি আবার স্থলে পরিণত হয়েছে।
রুবাদিরি ডায়েরিটার লেখা পাঠোদ্ধার করার বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। তার টিমের কোনো বিজ্ঞানীই লেখাগুলো বুঝতে পারছে না। যানটিকে দেখে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে এটি মানুষের হাতে তৈরি কোনো যান নয়। ল্যাবে এর নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে এর বয়স প্রায় পঁচিশ লক্ষ বছর। টেস্টের ফলাফল দেখে হয়রান হয়ে গেছে টিমের প্রতিটা প্রাণী। এটা কি করে সম্ভব। এতো আগে এরকম একটা স্পেসশিপ কারা তৈরি করলো। তবে কি এটা এলিয়েনদের তৈরি কোনো মহাকাশযান। মানুষের শেকড় খুঁজতে এসে তারা এলিয়েনের অস্তিত্ব খুঁজে বের করে ফেললো কিনা কে জানে। বিজ্ঞানের অনেক আবিষ্কারই তো হয়েছে ভুল এক্সপেরিমেন্টের ফলে। এটাও কি তেমনই একটা আবিষ্কার হয়ে যাবে?
রুবাদিরি তার আবিষ্কারের কথা বাইরের দুনিয়ার কারো কাছে প্রকাশ করতে নিষেধ করে দিলেন। অহেতুক হৈচৈ হোক তা তিনি চান না। এতে আসল কাজ চাপা পড়ে যায়। রুবাদিরি তার কর্মক্ষেত্রে ফিরে এলেন। তারপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞান একাডেমির কাছে ডায়েরিটার কপি পাঠালেন। কিন্তু কেউ এর পাঠোদ্ধার করতে পারলো না। কোনো ভাষাবিদই এরকম ভাষার সাথে পরিচিত নয়। হতাশ হয়ে রুবাদিরি যখন হাল ছেড়ে দিচ্ছিলেন তখন নিশি তাকে পরামর্শ দিল এমন একটা প্রোগ্রাম তৈরি করতে যা পৃথিবীর সব ভাষা জানে। কারণ মানুষের পক্ষে পৃথিবীর সব ভাষা একবারে আয়ত্ত্ব করা সম্ভব নয়। ফলে মানুষের পক্ষে এই টেক্সটের সিমিলারিটি খুঁজে বের করা অসম্ভব। কিন্তু একটা প্রোগ্রাম অনায়াসে এই কাজটা করতে পারে। নিশির কথাটা ভীষণ পছন্দ হল রুবাদিরির।
প্রোগ্রামটি তৈরি করার দায়িত্ব নিশির উপরই ন্যাস্ত করলেন তিনি। নিশি একদল প্রোগ্রামার নিয়ে প্রোগ্রাম তৈরি করতে লেগে গেল। প্রোগ্রামটিতে যোগ করা হল দশ হাজারেরও বেশি বেশি ভাষা। প্রাচীন সুমেরীয়, গ্রীক, সংস্কৃত, আরবি থেকে শুরু করে মান্দারিন, সুরিয়ানি, হিব্রু বাদ গেল না কোনোটাই। এমনকি সাব সাহারান অঞ্চলের সমস্ত ডায়ালেক্টও অন্তর্ভুক্ত করা হল তাতে। প্রোগ্রামটার কাজ করার পদ্ধতি হল এতে কোনো ইমেজ আপলোড করা হলে তা বলে দেবে এটা কোন ভাষা এবং অর্থ কি। এমনকি ভাষার বিকৃত রূপ থেকেও অর্থ উদঘাটন করার সক্ষমতা রয়েছে এর। হায়ারোগ্লিফিক্স থেকেও ভাষাকে ডিকোড করতে পারে প্রোগ্রামটি। প্রোগ্রামটি তৈরি করা শেষ হলে ডায়েরির কিছু ছবি আপলোড করা হলো। প্রোগ্রাম যখন ডায়েরিটা ডিকোড করতে সক্ষম হল তখন খুশিতে চিৎকার করে উঠলো নিশি ও প্রফেসর রুবাদিরি। পুরো ডায়েরি পাঠ করে বিধ্বস্তের মতো অবস্থা হল নিশি ও রুবাদিরির। নিজের ব্রেইনকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হল না তাদের। পুরো ডাইরিটা ডিকোড করলে যা দাঁড়ায় তা অনেকটা এরকম- ‘আজ আমাদের আরদ থেকে বিদায় নেওয়ার দিন। জানি না আমরা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবো কিনা। কিন্তু আমাদের যে আরদের মায়া ত্যাগ করতেই হবে। এটাই হয়তো প্রকৃতির পরিকল্পনা। এই ডায়েরি কেউ কোনোদিন পড়বে কিনা জানি না। কোয়ান্টাম ডাইনামিক্স অনুসারে হিসেব করলে এর সম্ভাবনা সত্তুর ট্রিলিয়ন বারে একবার। সত্তুর ট্রিলিয়নে একবার সম্ভাবনা থাকলেও আমি ওই একজন পাঠকের উদ্দেশ্যেই ডায়েরিটা লিখছি। মানুষ বেঁচে থাকে আশার অক্সিজেনে। আশা আছে বলেই আজ আমরা পাড়ি জমাচ্ছি অজানা এক গন্তব্যে।
আমার নাম এলি। আর আমাদের গ্রহের নাম আরদ। প্রায় সাড়ে তিন কোটি বছর ধরে আমরা এই গ্রহে বাস করছি। আমরা মানে আমাদের প্রজাতি। আমাদের পূর্বপুরুষেরা শত শত বছর ধরে নির্মাণ করেছে আরদের সভ্যতা। কিন্তু আজ আমাদের এই নাড়ির বন্ধন ছিড়ে চলে যেতে হচ্ছে। প্রকৃতির নিয়মের কাছে আমরা বড় অসহায়।
আমার বাবা আরদের বিজ্ঞান কাউন্সিলের প্রধান। মায়ের মুখটা কল্পনা করতে পারি না। সেই ছোট্টটি থাকতেই তিনি মিলিয়ে গিয়েছিলেন প্রকৃতিতে। আমাকে বড় করেছেন আমার বাবা। তিনি একই সাথে আমার মাও। আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিটাকেও আমার ছেড়ে যেতে হচ্ছে। মেয়ে হিসেবে এর কষ্টের আর কিছু নেই আমার জন্য।
কি লিখতে এসে কি লিখে যাচ্ছি। নিজের ব্যক্তিগত আবেগের কথা বলে ফেললাম। তুমি কিছু মনে করোনা হে ভবিষ্যতের পাঠক। আবেগ হল আমাদের এমন এক অনুভূতি, বিজ্ঞান দিয়ে যার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। এই আবেগ আছে বলেই আমরা যন্ত্রের থেকে আলাদা। ভালোবাসা আছে বলেই আজ বাবা মেয়ের এই বিচ্ছেদ। কী যন্ত্রণার অথচ মমতাময় এই অনুভূতি!
আরদে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এমন এক সভ্যতার সৃষ্টি করেছিলেন যা ছিল ইউনিভার্সের একমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক সভ্যতা। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগে আমার জন্ম। ভালোর বিপরীতে যেমন মন্দ থাকে তেমনি আলোর বিপরীতে থাকে অন্ধকার। আমাদের উন্নতির বিপরীতে সমানুপাতে এগিয়ে আসছিল আরদের বিপর্যয়।
আমাদের গ্যালাক্সির নাম সামাওয়াত। এই গ্যালাক্সিরই একটা বৃহদাকার তারকাকে প্রদক্ষিণ করে আমাদের গ্রহ আরদ। তারকাটি তার শেষ বয়সে চলে এসেছে। শীতল হতে শুরু করেছে এর পৃষ্ঠ। এর প্রভাবে গত দুই শতাব্দী ধরে আরদ পরিণত হয়েছে ঠাণ্ডা গ্রহে। তারকাটিতে এখন যে জীবনীশক্তি আছে তাতে আর দুইশো বছর জীবিত থাকবে সে। তারপর বিরাট এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে নিউট্রন স্টারে পরিণত হবে এটি। কিন্তু আরদের প্রাণিকুল দুইশো বছর টিকে থাকতে পারবে না। তারা সর্বোচ্চ আর পঞ্চাশ বছর টিকে থাকবে। তারপর শক্তির অভাবে তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। আমাদের সূর্যের এই অবস্থা হবে তা আমাদের পূর্বপুরুষগণ বহু আগে থেকেই জানতেন। তাই তারা এমন গ্রহের সন্ধান করছিলেন যেখানে আমাদের প্রজাতি সারভাইভ করতে পারে। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার পর তাদের অনুসন্ধান সফল হয়। এমন এক গ্রহের সন্ধান পাওয়া যায় যেখানে আমরা বেঁচে থাকতে পারি। কিন্তু গ্রহটা আমাদের গ্যালাক্সির নয়। আমাদের গ্যালাক্সি থেকে কয়েক কোটি আলোকবর্ষ দূরের এক গ্যালাক্সিতে এর অবস্থান। সাধারণ স্পেসশিপের মাধ্যমে নয়, শুধুমাত্র ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়েই সেখানে যাওয়া সম্ভব। আমাদের সভ্যতা ততদিনে অনেকগুলো প্রাকৃতিক ওয়ার্মহোলের খোঁজ পেয়ে গিয়েছিল। সেগুলোর মাধ্যমেই আমাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারা ওই গ্রহটার খোঁজ এনে দিয়েছে। গ্রহটার নাম রাখা হয়েছে ‘হায়া’ যার অর্থ জীবন। গ্রহটি আমাদের নবজীবন দান করবে বলেই এই নাম। কিন্তু সমস্যা হল সেই গ্রহ বাস করছে এমন কিছু জীবজন্তু যাদের নির্মূল করা সম্ভব না হলে সেখানে বাস করা অসম্ভব। বিরাট বিরাট জন্তুগুলো দুই পায়ে হেঁটে বেড়ায়। এদের মুখের মধ্যে রয়েছে দুই পাটি ধারালো দাঁত। এরা অত্যন্ত হিংস্র। হায়াকে আমাদের জন্য বাসযোগ্য করতে হলে এদের আগে নির্মূল করতে হবে। কিন্তু ততদিনে আমাদের প্রযুক্তি এতদূর অগ্রসর হয়নি যা দিয়ে ওদের নির্মূল করা যায়। ওদের কিভাবে নির্মূল করা যায় তা নিয়ে গবেষণা করতে করতেই কেটে গেল কয়েকশো বছর। অবশেষে পাওয়া গেল সেই উপায়।
কৃত্রিম ওয়ার্মহোল তৈরির কৌশল আবিষ্কার করে ফেললো আমাদের বিজ্ঞানীরা। তারপর হায়া’র কক্ষপথে গিয়ে আমাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যন্ত্রগুলো একটা কৃত্রিম ওয়ার্মহোল তৈরি করলো। সেখান থেকে বিরাট এক গ্রহাণুকে মহাকর্ষ বল থেকে বিছিন্ন করে ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল হায়া অভিমুখে। গ্রহাণুটি ভীষণ বেগে আঘাত হানলো হায়ার পৃষ্ঠে। এর আঘাত এতোই শক্তিশালী ছিল যে হায়ার প্রায় সব প্রাণিই মারা পড়লো। ধ্বংস হয়ে গেল অধিকাংশ উদ্ভিদ। হায়ার পৃষ্ঠ দুই ভাগ হয়ে মাঝখান দিয়ে সমুদ্র তৈরি হয়ে গেল। আর সেই বিকট দর্শন প্রাণীর অস্তিত্বই রইলো না। হায়ার পৃষ্ঠ আর বায়ুমণ্ডল এতোই দুষিত হয়ে পড়লো যে কয়েক শতাব্দীর মধ্যে সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করতে হল। এদিকে আমাদের সূর্যের ক্রমশ শীতল হয়ে যাচ্ছে। গণহারে মারা যাচ্ছে প্রাণিকুল। কিন্তু কোনো উপায় নেই। কখনো কখনো প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা পাষাণ হৃদয়ে মেনে নিতে হয়। কিছু করার থাকে না।
অবশেষে আজ সেইদিন উপস্থিত হয়েছে যখন আমরা হায়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো। আমাদের শক্তি একেবারে শেষের দিকে। খুব অল্প কিছু প্রাণীই বেঁচে আছে। আমাদের যে ক্ষমতা বাকি আছে তাতে সর্বোচ্চ চল্লিশজন মানুষ হায়ায় যেতে পারবে। হাইপার ডাইভ ও ওয়ার্মহোলের ধাক্কা সহ্য করার মতো মহাকাশযান তৈরি করতেও কয়েক বছর লেগে যায়। আর এরকম যান বেশি বানানোর মতো সক্ষমতাও আমাদের অবশিষ্ট নেই। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে বিশজন যুবক আর বিশজন যুবতী এই সফরে যাত্রা করবে। সবচেয়ে বুদ্ধিমান আর উন্নত মেধার চল্লিশজন নারীপুরুষ বাছাই করা হল। তার মধ্যে আমিও অন্তর্ভুক্ত হলাম। আমার সঙ্গী হিসেবে যাকে নির্বাচন করা হল তার নাম এন। এন খুবই বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ এক যুবক। প্রাণিবিদ্যায় তার অসামান্য দখল রয়েছে।
আমরা সবাই যার যার আপনজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। আমার বাবাও আমার মতোই বরাবর একজন আবেগপ্রবণ মানুষ। কিন্তু আজ তার আবেগের বহিঃপ্রকাশ ভিন্ন। আমি কেঁদে বুক ভাসালেও বাবাকে দেখলাম খুবই উৎফুল্ল। যেন তার মধ্যে এক ধরনের চাপা আনন্দ কাজ করছে। এটা কি একজন বাবার তার মেয়ে নবজীবন লাভ করতে যাচ্ছে দেখে আনন্দ নাকি একজন বিজ্ঞানীর সারাজীবনের সাধনা সফল হতে যাচ্ছে দেখে খুশি বুঝতে পারলাম না। তবে আমার সিক্সথ সেন্স বললো প্রথম ধারণাটাই সঠিক।
যথাসময়ে আমাদের মহাকাশযান যাত্রা করলো। মহাকাশযান চালানোর জন্য কোনো মানুষের প্রয়োজন নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মধ্যে আরদ থেকে হায়া পর্যন্ত যাওয়ার সকল তথ্য প্রোগ্রাম করে দেওয়া হয়েছে। অনন্ত নক্ষত্রমণ্ডলী ভেদ করে ছুটে চললো আমাদের মহাকাশযান।
আমাদের যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখলাম আমরা এক সমুদ্রের তীরে মহাকাশযানের মধ্যে শুয়ে আছি। হায়ায় পৌঁছে গেছি আমরা৷ খুশিতে চিৎকার করে উঠলো সবাই। সবাই খুশি হলেও এনকে দেখলাম চিন্তিত। তার কপালে চিকন দুটো চিন্তার ভাঁজ। আমি বললাম, সবাই আনন্দ করছে আর তুমি এতো চিন্তিত কেনো? এন বললো, চিন্তার শুরু এখনই। আমরা এমন এক জায়গায় পৌঁছেছি যেখানকার জলবায়ু ও আবহাওয়া পুরোপুরি আরদের মতো নয়। আমাদের এখানে টিকে থাকতে অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হবে। এখানকার কোন জিনিস আমরা খেতে পারবো আর কোনটা খেতে পারবো না তাও আমরা জানি না। আরদের অভিকর্ষ বল ছিল এখানকার অভিকর্ষের চেয়ে অনেক কম। তাই এখানে অভিকর্ষের টানে আমরা ধীরে ধীরে কুঁজো হয়ে যেতে পারি। এখানকার পানিও লবণাক্ত। সুপেয় পানির সন্ধান করতে হবে। সহজ কথায় আমাদের কয়েক প্রজন্ম কেটে যাবে শুধু সারভাইভ করতে করতে।
এন যে কথাগুলো বললো তা যে আমি জানতাম না তা নয়। কিন্তু প্রাথমিক সাফল্যের আনন্দে এসব কথা মাথায় ছিল না। এনের কথা শুনে আমার আনন্দ দূর হয়ে গেল। মহাকাশযান থেকে বের হয়ে সবাই জায়গাটি দেখতে লাগলো। হায়ার সৌন্দর্য আরদের চেয়ে কম নয়। একপাশে সাগর আরেক পাশে পাহাড়। পাহাড়ের মাঝে সবুজ বৃক্ষরাজি। সত্যিই অপূর্ব সুন্দর একটা গ্রহ এই হায়া৷ আমাদের নতুন বাসস্থান। আমরা যে খাবার এনেছিলাম আরদ থেকে তা কিছুদিনের মধ্যেই ফুরিয়ে গেল। এবার শুরু হল আমাদের খাবার সংগ্রহের পালা। প্রথম প্রথম দলবদ্ধভাবে আমরা খাবার সংগ্রহে বের হতাম। কিন্তু এতে যে খাবার জুটতো তা সবার জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। তাই এরপর থেকে প্রত্যেকে তার সঙ্গীকে নিয়ে খাবার খোঁজায় বের হতে শুরু করলো। প্রথম কিছুদিন দিনশেষে সবাই মহাকশযানে ফিরে আসতো। তবে কিছুদিন পর দেখা গেল অমুক দম্পতি ফিরে আসেনি। তারপর আরেক দম্পতি নিখোঁজ। এরা ফিরে আসতো না কারণ তারা এমন জায়গায় খাবারের সন্ধান পেতো যেখান থেকে মহাকাশযানে ফিরে আসা অনেক কষ্ট। দেখতে দেখতে মহাকাশযানে থেকে যাওয়া দম্পতির সংখ্যা দাঁড়ালো চার। একদিন অনুভব করলাম আমাদেরও আর এখানে অবস্থান করা সম্ভব নয়। আমরা বুঝতে পারছিলাম এই গ্রহে টিকে থাকতে হলে এখানকার প্রকৃতির সাথে আমাদের মিশে যেতে হবে। এই প্রকৃতিকে আত্মীকরণ করেই বেঁচে থাকতে হবে। তাই আমরা এখানকার অন্যন্য প্রাণীর মতোই উন্মুক্ত প্রকৃতিতে বসবার শুরু করলাম। শুন্য থেকে আমাদের মাধ্যমে এই গ্রহে আবার সভ্যতার বিকাশ ঘটবে। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে লক্ষ লক্ষ বছর। কারণ আমাদের ছেলেমেয়েদের সভ্যতার কোনো জ্ঞান থাকবে না। তাদের কাছে এর গল্প মনে হবে রূপকথার মতো। ধীরে ধীরে পুরো হায়ায় ছড়িয়ে পড়বে আমাদের প্রজাতি। বন্য জীবন থেকে তারা সামাজিক হতে শিখবে। তারপর আবার তাদের মধ্যে জ্ঞানের চর্চা হবে। তবে আরদে সভ্যতার বিকাশ ঘটাতে যেখানে কয়েক কোটি বছর লেগেছিল এখানে অতো সময় লাগবে না। কারণ আমাদের সন্তানদের ডিএনএতে জ্ঞান বিজ্ঞান ও সভ্যতার একটা প্রতিচ্ছবি থেকেই যাবে। তাই এখানকার সভ্যতার বিকাশ হবে খুব দ্রুত।
আজ আমরা মহাকাশযান ছেড়ে যাচ্ছি। এই ডায়েরি পরবর্তী সভ্য কোনো মানুষের হাতে পড়বে কিনা জানি না। যদি পড়ে তাহলে জেনে নিও এই ডাইরির পাতায় আছে আমার হাতের স্পর্শ। তোমার হাত যখন এই পাতাগুলো স্পর্শ করবে তখন এই গ্রহের আদি মানুষের সাথে তোমার করমর্দন হবে। তোমাদের জন্য ভালোবাসা।’ ৷
ইতি
এলি
এলির দীর্ঘ ডায়েরি শেষ করে গম্ভীর হয়ে বসে রইলো নিশি ও রুবাদিরি। ডায়েরিটাকে বড্ড আপন মনে হল নিশির। এলিকে মনে হল তার মা। মনে হল ডায়েরিটার পাতায় পাতায় তার মায়ের ছোয়া লেগে আছে। রুবাদিরি ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আকাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে রক্তকরবীর মতো গুচ্ছ গুচ্ছ লাল আভা। আকাশটাকে অনেকদিনের চেনা মনে হল তার।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..