এসো নৈঃশব্দ্য, এসো আলম্ব সরণী

চিরঞ্জীব হালদার
মুক্তগদ্য
Bengali
এসো নৈঃশব্দ্য, এসো আলম্ব সরণী

এসো নৈঃশব্দ্য, এসো আলম্ব সরণী

বিড়ালের সাথে বিড়ালের সম্পর্ক সমান নৈঃশব্দ্য। একটা ছিচকাঁদুনে বিড়াল আর শব্দ না করে অন্ধকারে এক’শ আশি ডিগ্রী অবস্থানে ভেসে থাকা শয়তান বিল্লির চোখ দুটো নৈঃশব্দ্য আর নৈঃশব্দ্য। সাদা বিছানা জুড়ে অজস্র টগরফুল ফুটে আছে। কে যে মজা করে এক শিশি ফলিডল ছুঁড়ে দিল ঘোসপুকুরে,  সকাল বেলা উঠে দেখি পুকুরে জল কই, মাছেদের মড়কের ভেতর ওরা যেন উৎসব শুরু করেছে।

খেসারি ক্ষেতে সাদা থান পরে পরমাসুন্দরী পদ্মপিসি মিলিয়ে গেলে তাকে কি নৈঃশব্দ্য বলবো। যেদিন আমার সাইকেল চুরি হল, যেদিন দেরীতে পৌঁছলো বিধবা মায়ের হাতে আমার যন্ত্রণাদগ্ধ বাসি অভিজ্ঞাপত্র, যেদিন আমি মার্কেজ কিনতে পারিনি, ভুন্টি ভুন্টি করতে করতে একরত্তি মেয়েটাও আমাকে ছেড়ে গেল, পেয়ারা বাগানে ডাঁসা ফলের পাশে একটা লাল টুকটুকে ওড়না একা একা হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছে, তাকে কী নামে ডাকবো।  নৈঃশব্দ্য প্রকৃত বান্ধবীর মত। ভার্চুয়াল নয়। যারা নিরুদ্দেশ হয়, যার রেলপাতের ওপর রক্তাক্ত পড়ে থাকে , যারা দরজায় দরজায় ঘুরে ঘুরে শোণিত বিক্রি করে, যারা শৃগালের মুখ থেকে পচনশীল মাংসের কাছে গোল হয়ে বসে নৈঃশব্দ্য পান করে তকে কী নামে ডাকবো।

মার্কেজ কাকে উৎসর্গ করেছিলেন ‘এক’শ বছরের নিঃসঙ্গতা’। দু’টো শব্দের মধ্যে একটা হাইফেনের থেকে নিঃসঙ্গ কী আর হতে পারে। এরা সারাবছর নিরুদ্দেশ। আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই যুগলও কি ভয়ানক কোন দ্বীপে গা ঢাকা দিয়েছে। কোন যৌন তাড়নায় না আরক্ত জন্মের সাধনায়। কে বলবে? পাঠক? সেও তো বড় হেঁয়ালি। আর যদি পাওয়া যেতো তাহলে কী সুবর্তুল যুবতীর স্তন থেকে, পচনশীল জন্মের থেকে বিস্ফারিত নৈঃশব্দ্য তারদের ডেকে ডেকে বলতো- এস আজ আমার ঘরে আমার গৃহপ্রবেশ। সেই আমগাছটা, সেই পারিজাত ফুল, সেই জামরুল গাছে ঝুলিয়ে রাখা মৃত্যুঞ্জয় দাদুর কাতান মাঝে মাঝে এলিয়টের উন্মাদিনী প্রেমিকার কাছে বসে গুলতানি করে। একঘর বইয়ের মধ্যে একটা বিড়াল, যেন ঠেকা নিয়ে বসে আছে একটা অক্ষরও যেন পালিয়ে যেতে না পারে নৈঃশব্দ্যের তীব্র সাদা থেকে। চন্দ্রগ্রহণের সময় কেন যে ঘুম কেটে গেল। যে পুকুর চিরকাল বাঁজা, একটা ল্যাঠা মাছের জন্ম দিতে অক্ষম, কিছু বেহিসেবী আলোর গুলতানি দেখি ভরে থাকে সারা সবুজ আগাছায়। চারপাসে এত কলকাকলি, বেলুন ওয়ালার চিৎকার সব ফিরিয়ে দেয় বাঁজা পুকুরটা।

পঞ্চিস্যাকরা কোনও নারীকে গর্ভবতী করতে পারেনি, অথচ তার দোকানের চারপাশে থরে থরে গর্ভফুলের ছড়াছড়ি। নাম না জানা ডাগর মেয়েটাও দেখি কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে এক গ্লাস জল চাইলো। আমি তাকে দেখতে পাইনি। মাইরি বলছি পাঠক, শুধু তার ছায়া দেখে মাঝে মাঝে আঁতকে উঠি। যেন নৈঃশব্দ্য উগরাতে উগরাতে একটা হেলিকপ্টার দুপুর শাসন করতে করতে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল নাতালিয়াদের মত। যারা আর ফিরে আসেনি মার্কেজের কাছে।

যে আমার আজও বন্ধু, চার কেলাস পাস করার পর স্কুলের গণ্ডি আর মাড়ায়নি, উমাচরণ কর্মকারকে সে চিনতে চেয়েও চূড়ান্ত অসফল। একদিন খরদ্বিপ্রহরে কসবার মাঠপুকুরে বাসের অপেক্ষায় দাঁডিয়ে আছি। এক লাজুক মধ্যবয়সী মহিলাকে দেখি হাতে টিফিন কৌট নিয়ে ছায়া ঘেঁসে আমারই অতি কাছে দাঁড়িয়ে। টেরও পাইনি। ইনি কী সেই প্রাচ্যের অশিক্ষিত নাতালিয়া। একটা অটো এসে দাঁড়ালো, উঠতে গিয়েও উঠলাম না। এও কী তার কারসাজি। অসহিষ্ণু আটো চালক। ছেড়ে যাওয়া যাত্রীর প্রতি ঝাঁঝালো স্বর নিক্ষেপ করতে করতে অন্য যাত্রীর তোয়াক্কা নয়া করে চলে গেলো। এই যে দাঁড়িয়ে রইলুম আর এই ফাঁকে আমার বহুদিনের স্মৃতি নামোছা পাঠশালের শ্যামবর্ন সহপাঠী উদিত হলো এক অস্থির নৈঃশব্দ্যের বুক চিরে। যেন বিসর্গের দুটো বিন্দুর মত। একটা সে আরেকটা তার সহধর্মিনী। যে মধ্যবয়সী এক নিরাপদ দুরত্ব জুড়ে এতক্ষণ সুনসান স্তব্ধতার মায়া নির্মাণ করছিল না জেনে আমি টের পাইনি। সময়ের কী নিদারুণ ব্যাপ্তি। কী রসালাপ। কী ভঙ্গীমা। তার ডাক নাম বুড়ো। ভালো নাম আসিত। হয় তো সে প্রকৃতার্থে অসিত। ভগ্ন রাত ও মনে হয় তার পোষা বেড়াল। আমাকে হিপ্নোটাইজ করে। জাদুতাড়িত দেহমাত্র আমি। সে আমাকে নন্তে বালির বাগান থেকে পাকা টুকটুকে তেলাকচু কত এনে দিয়েছে। তুলসি দাদুর বাগানে ডাঁশা বাংলা আমড়া এনে দিয়েছে। হ্যান্ডেল ভাঙা সাইকেলে বসিয়ে দয়ারামপুরের মোড়ে শ্যামাপূজোর তুবড়ি প্রতিযোগিতায় নিয়ে গেছে। সে আমার প্রেমিকার উৎকৃষ্ট পত্রবাহক হতে পারতো, হয়নি সেও কী নৈঃশব্দ্যের চক্রান্ত। যার তার সাথে আমার জন্য ঝগড়া করতো। মার খেয়ে নাক দিয়ে লাল নিঃশব্দ্য গড়াতো। সেই ঝগড়া করনেওয়ালারা আজ আর একজনও বেঁচে নেই। এই ষাট ছুঁই ছুঁই দেহে সে এখনও শক্তপোক্ত গতর মজুরা নাগরিক মাটির কাছে।

খুব জানতে ইচ্ছে করে যে সব রবীন্দ্ররচনাবলীর পাতায় কোন মেদুর চোখের চোঁয়া লাগেনি, বইগুলো আজও অপেক্ষায় আছে কোন উৎসাহী পাঠকের অপেক্ষায়। ঝকঝকে পূজোবাড়ির থান, যেখানে ঠাকুর বাসানো হয়। তার চারপাশ হালদার মোড়ল সিমেন্ট ছাইতে দেয়নি, সিঁদুরখেলার সময় পাড়ার এয়োতিরা খালিপায়ে আলতা মুগ্ধপায়ে এই মাটিতে অনৈঃশব্দ্য বেঁটে দিয়ে যায় সারাবছরের জন্য। আরতির সময় থেবড়ে বসা গৃহিনীদের স্ফীত মধ্যদেশে এই মাটি থেকে উঠে আসা ডাগর মৌনতাগুলো শারদীয়ার মূহুর্তগুলোকে স্বর্ণমণ্ডিত করে। এদের নাতি দূরে স্বামী খোয়ানো, স্বজন খোয়ানো গৃহীরা এক অলিখিত নিয়মে নির্বাক জড়ো হয়। আরতির মুগ্ধ আলোকরেখাগুলো এক মহাজাগতিক মহানৈঃশব্দ্য ছাড়িয়ে দিচ্ছে চুড়ান্ত ঘণ্টা বাদনের মধ্যে।

অর্জুন গাছের ছায়া তখনও গাঢ় হয়নি। পুকুরের জল সারাবছর কোমর সমান। ছায়া গাঢ় হলে নৈঃশব্দ্য যেন চোদ্দগুষ্টিকে নিয়ে পুকুরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। ওরা তুতো ভাই-ভাগ্নেদের নিয়ে আধা ঘোলাটে পুকুরের ওপর জমিয়ে আড্ডা মারতো। এসব অনুভব করতে করতে মা অর্জুন গাছে হেলান দিয়ে একের পর এক লকলকে ছিপে তুলে আনতো সরপুটি-খয়রা- ট্যাংরা। ঠিক যেন নৈঃশব্দ্য এর পিতামহীর সাথে অনর্গল বৈকালিক আড্ডা দিতে দিতে ফাতনার উপর সতর্ক নজর রাখতো। তখন তাকে অতি জাগতিক এক কায়া মনে হতো। অর্জুন গাছও যেন তার যুতসই দোসর। তার কাছে যেতেও গা ছম ছম করতো। হায় কালের নিয়মে সেই অনাবিল অশৈল শব্দ শহুরে সংস্করণে প্রত্যেকের ভেতর তাঁবু খাটিয়ে বসেছে। সংসার স্ফীত হোক বা রাজনৈতিক অচারুময়তা আমাদের চারপাশে দমবন্ধ একাকিত্ব আর তার বিশ্বস্ত অনুচর নৈঃশব্দ্য। মার্কেজের মত তুমিও কী আমাদের মহান করবেনা।

চিরঞ্জীব হালদার। কবি। মূলত ক্ষুদ্র পত্র -পত্রিকার লেখক। জন্ম- ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৬১, গাববেড়িয়া; দক্ষিণ ২৪ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। পড়ালেখা করেছেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা। লেখালেখির শুরু গত শতাব্দীর আশির দশক। শুধু কবিতা আর ভালো কবিতাই তাঁর আরাধ্য। এপর্যন্ত নির্মিত কাব্যগ্রন্থ ষোলটি। প্রকাশিত সাতটি। যৌথ সংকলন একটি। সম্পাদিত কবিতা...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ