এ এক নিভৃত স্বৈরাচারী অসুখের নাম

তুলি রায়
কবিতা, প্রবন্ধ
Bengali
এ এক নিভৃত স্বৈরাচারী অসুখের নাম

কবিতা একটি অসুখ, যাচ্ছেতাই বিশ্রীরকম। সারেনা, সারলেও যায় না। কবিতা একটি অশান্তি নামক মরীচিকার নাম।  রক্তের ভিতর ছুটিয়ে মারে কেবল।

ভ্যাগাবন্ডদের খাতায় নাম লেখায়। মিছিলে হাঁটে মাইলের পর মাইল যে মানুষেরা, পায়ের তলায় তাদের ক্ষয়ে যাওয়া মাংসের গর্ত। আমি দেখেছি তার রং  আগুনের মতো। ওই আগুনের নাম কবিতা। বঞ্চিত মানুষের কথা স্লোগানে বলেছিল যে মেয়েটি!  শাসক দল তাকে পুরস্কার দিয়েছিল!  ছিঁড়ে খুবলে খেয়েছিল ওর শরীরটা, মনটা শেষ করে দিতে চেয়েছিল।  ওর বিবস্ত্র দেহটা পড়েছিল খালের ধারে। সারা শরীরে ক্ষত’র চিহ্ন নিয়ে, মুখ দিয়ে বেয়ে পড়া কষ্, থেতলে যাওয়া একটা চোখ খোলা, পড়ে আছে নিথর দেহটা। ওর হাতের মুঠি’টা সোচ্চারে বলছে ধিক্কার! আমি দেখেছিলাম কবিতা মেয়েটির লাশ, ওর চোখে  দেখেছিলাম দিন বদলের স্বপ্নের আগুন।

আমি দেখেছিলাম ওর স্বপ্নের খুন!

যে শিশুটি চকলেটের লোভে ওর দাদুর কাছে শৈশব খুইয়ে আসে যন্ত্রণার আদর গায়ে মেখে। সঁপে দিয়ে আসে নিরপত্তা নামক ঠুলি, তার নামও কবিতা ছিল বোধহয়।

শূন্য বুকে নকল বক্ষবন্ধনীর প্রজাপতি এঁকেছিল যে মেয়েটি। লুকিয়ে লিখে রাখতো পাতার পর পাতা। রাজপুত্তুরের স্বপ্নে সারা শরীরে মাখতো জোছনাআদর। শিহরণ’কে ভুল করে ভালোবাসা ভেবেছিল, ফিরেছিল জরায়ু’তে বিষাক্ত বীজ নিয়ে। সেদিন ওর লিখে রাখা পাতারা আয়না দেখিয়েছিল ওকে। তারপর আর কোনদিন লেখা আসেনি ওর।গা গুলিয়ে উঠতো যখন-তখন! রাজপুত্তুরটি নকল বুকে বাসা বাঁধতে পারেনি পছন্দ হয়নি বলে। কবিতা তাকে বশ করতে পারেনি। মেয়েটি ফিরেছিল, সিলিং ফ্যানের ঝুলন্ত দড়িতে।

গরীবের কৃতি সন্তান, ঠাঁই মিলেছিল অভিজাত একটি মেডিকেল কলেজে। সবার আগে তাক লাগিয়ে দেওয়া উত্তর, অনেকে নিতে পারেনি।  রিগিং নামক খেলায় হার মেনেছিল শেষে। ধনীর তকমাআঁটা কুশীলবরা তাকে শাস্তি দিয়েছিল। ও অনেকিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু বলতে পারেনি। ওর কলমে অনেক শব্দ ছিল খরচের মতো। শুধু একটি লাইন লিখে গেছিল চলে যাবার আগে!

ডিপ্রেশনে হাতের শিরা কেটে মুক্ত করেছিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের টপার। ক্যাম্পাসিং’এ জুটে গিয়েছিল টপমোস্ট এমএনসি’তে চাকরী। তারপর ফ্ল্যাট, বান্ধবী, বৈভব, সুখ। কিন্তু তারপর?

শিশুটি ছবি আঁকে খুব মন দিয়ে। সদ্য বাবা হারিয়েছে।  ওর কষ্টের কথা কাউকে বুঝতে দেয় না। ইদানীং কেমন যেন গুম মেরে থাকে। জানালা দিয়ে আকাশ দ্যাখে। হয়তো খোঁজে কিছু, নালিশ জানায় তারপর কিছু লিখে রাখে। খুব স্বযত্নে লুকিয়ে রাখে। মুছে ফ্যালে চোখের জল। মন দিয়ে পড়াশোনা করে, তবু কেন যে মনে থাকেনা আজকাল! একা একা ক্রাফ্ট করে তারপর সেসব গুছিয়ে রাখে, এলোমেলো করে দেয় শেষে, আবার গুছিয়ে রাখে। ভাবে একদিন সব গোছানো শেষ হয়ে যাবে একেবারে আর কোনদিনও ঘাঁটবে না। ক্লাসে সবাই ওকে জিজ্ঞেস করে ওর বাবার জন্য কষ্ট হয় কিনা। ও উত্তর দিতে পারেনা।  ও কেবল নিজের দোষ খোঁজে মনে মনে আর গুটিয়ে যায়!

এমন নাজানি কত কথা কবিতা হতে হতেও হয়ে ওঠেনি। হয়তো হারিয়েছে কালের গর্ভে। কখনও সে গেঁথেছে নিজেকে শব্দরূপে বা কখনও ছবি এঁকেছে।  কবিতা জন্মকাল কখন, কীভাবে, কেন – এভাবে হিসেব হয়না বোধহয়। কবিতা কেন লিখিত হয় কেনই বা পাঠক পড়ে এর উত্তর আমার জানা নেই। তবে এ এক নিভৃত স্বৈরাচারী অসুখের নাম যা আমি লালন করি চেতনে অবচেতনে একথা সত্য। শুধু প্রেম নয়, যাবতীয় বিরহ, দ্রোহ, অপ্রাপ্তি, যন্ত্রনা, বিচ্ছেদ এসব ভীড় জমায় মনের কোণে। গলে যায় গ্লেসিয়ার। এ এক অন্বষেণ। কেবলই খনণ, থেমে থাকা নেই  ঈশ্বরপ্রাপ্তির খোঁজে।  হতে চাওয়া আর না হওয়া এসবের মাঝের সেতুটুকু গড়ে নিভৃত অন্ধকারে টুপ করে ঝরে যাবার নাম হয়তো কবিতা/জীবন!

তোমাতে মুক্তি
হাহাকার তোমাতেই
নিভৃত অসুখে
বেদন পুষেছি
একতারা সুরে আউল হবো বলে
খুঁজেছি, খুঁজে চলেছি
বিলীণতার পথে …

তুলি রায়। কবি। জন্ম ও বাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের কলকাতায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..