এ মৌসুমী পরদেশে

মাসকাওয়াথ আহসান
ছোটগল্প, মুক্তগদ্য, রম্য রচনা
Bengali
এ মৌসুমী পরদেশে

জোছনা করেছে আড়ি
আসে না আমার বাড়ি
গলি দিয়ে চলে যায়,
গলি দিয়ে চলে যায়
জোছনা করেছে আড়ি,
আসে না আমার বাড়ি।

সে রাতে জোছনা ছিলো পদ্মার ঢালে; পুঁঠিয়া রাজবাড়ির শ্বেত পাথরের মিহরাবে নিপুণ কারুকাজ জুড়ে; উঁচু খিলানের কড়িকাঠে বাড়ি খেয়ে কিন্নর কন্ঠী শেহেরজাদ বানুর রাগের আলোড়ন মাতোয়ারা করে চারপাশ। সবুজাভ বেনারসি শাড়ির মাঝে জোতস্নার মতো মুখখানা তার; কপালে সোনালি মিনারের মতো টিকলিতে ঝাড়বাতির আলো ঠিকরে পড়ে।

চেয়ে চেয়ে পথ তারি,
চেয়ে চেয়ে পথ তারি
হিয়া মোর হয় ভারী
রূপের মধুর মোহ,
রূপের মধুর মোহ
বলো না কি করে ছাড়ি
জোছনা করেছে আড়ি

জীবন সরকার নামে এক ঊনিশ- বিশ বছর বয়েসী যুবক একগাছা রজনীগন্ধা এনে রাখেন শেহেরজাদের পাশে; চোখে চোখ রাখতে পারেন না; খানিকটা আড়ষ্ঠ-খানিক লাজুক। শেহেরজাদ মুচকি হাসেন। ইশারায় তাকে কান পাততে বলেন। নাকছাবিতে মৃদু কাঁপন; ঠোঁটের ওপর একটি লাল তিল; আর চোখ তার সমুদ্রের অতল নীলাভ আহবান হয়ে ফুটে থাকে; “রূপের মধুরও মহুয়া; বলোনা কী করে ছাড়ি!” প্রবীণ অতিথিরা একটু অবাক হন তরুণের কাণ্ড দেখে; প্রশ্রয়ের হাসিতে তারা খানিক উপভোগও করেন।

নৈশভোজের কালে আরেকটু সাহস করে জীবন সরকার পাশে এসে বসেন। দরাজ জানালার বাইরের রুপা ঝরা নারকেল পাতার দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, আজ প্রমত্তা পদ্মার বুক জুড়ে জোছনার মাতামাতি। বজরা দাঁড়িয়ে ঘাটে। কেউ যদি চান; সে আজ রুপালি বৃষ্টিতে চোখ ভেজাতে পারেন।
শেহেরজাদ আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বলেন , চলুন জীবনজি; দেখে আসি কোথায় এতো রুপালি বৃষ্টি!

টেগোর টেরেসে বসে কফিতে চুমুক দিয়ে রিয়াজ হোয়াটস এপ মেসেজ পড়ছিলো। ম্যানেজার ভদ্রলোক এসে জিজ্ঞেস করেন, সব কিছু ঠিকঠাক ছিলো তো স্যার; আর কিছু কী চাই!
-দারুণ আপনাদের আয়োজন; পরিবেশটাও ছিমছাম; আরেকটু কী বসতে পারি!
-আপনার যতক্ষণ খুশি বসুন স্যার।
“আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।”

রিয়াজ হেসে বলে, জীবনানন্দ দাশ তাই না! খুব কবিতা পড়া হয় নাকি!
-যারা কবিতা পড়ে তারাই টেগোর টেরেসের যত্ন নেয় স্যার!
দুজনে খানিকক্ষণ হাসে। ম্যানেজার চলে যেতেই একজন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, রিয়াজ তাই না! ছবি বানাতে এসেছেন দেশে; তাই তো! ভাবলাম একটা স্ক্রিনটেস্ট দিয়ে আসি; যদি ছোটখাট একটা রোল জুটে যায়!
-দেখুন ইউরোপের অনুদান পেলে গরিবি দেখাতে হয়। আপনি কী গ্ল্যামার ছাড়তে রাজি হবেন!
রিনরিনে হাসি আছড়ে পড়ে চারপাশে। দূরের টেবিল থেকে একজন এটিকেট আন্টি বিরক্ত হয়ে তাকান; সামনের জনকে বলেন, আজকাল কারা কারা যে এসে পড়ে এখানে; এতো লাউড!
রিয়াজ জিজ্ঞেস করে, কী কফি খাবেন তো!
-চা খাবো! আমি চারুলতা; আমি কফি খাই না। বলেই হাসতে শুরু করে মেয়েটি। তার হাসির ব্যামোতে ভ্রু কুঁচকে এটিকেট আন্টি ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল দিয়ে বলেন, হুশশ।
চারুলতা জিজ্ঞেস করে, ওয়াটার বাসে চড়বেন নাকি! এখানে তো সব ‘রামগরুড়ের ছানা; হাসতে তাদের মানা’।
রিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, চলুন।
মেঘলা দিন; স্বচ্ছতোয়া জল; হঠাতই কী করে যেন চারপাশটা অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। অথচ সকালবেলা মনে হচ্ছিলো এটা বুঝি কর্কশ একটা দিন।
চারুলতা জিজ্ঞেস করে, কী ছবি বানাচ্ছেন!
-অনুদানের ফর্মুলা মুভি। একটু ইরনি ছবির নীলাভ রঙ, একটু নিওরিয়ালিজমের স্ট্রাগল, একটু বাঙালি আবেগ, একটু ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল ধরানোর মতো পশ্চিমের চোখে পূর্ব। কঠিন কিছু না; খুব স্পেশাল কিছুও না!
-তাহলে আর ছবি বানানো কেন! দেশেই বালিশ-পর্দা সাপ্লাইয়ের কাজ নিতে পারেন। অনুদানে আর কয় টাকা পান! এখানে আজকাল ধুলোমুঠিও সোনামুঠি হচ্ছে।
দুজন মিলে আবার খানিকক্ষণ হাসে। চারুলতা হাসি থামিয়ে বলে, অনেক তো অলৌকিক জলযানে ঘোরা হলো। এখন চলুন লিটনের ফ্ল্যাটে যাই!
রিয়াজ একটু ঘাবড়ে গিয়ে সেটাকে সামলে নিয়ে তাকায়; চারুলতা আবারও যে জোরে হাসে; তা পানিতে তুমুল অভিঘাত ছড়ালো যেন!
ওয়াটার বাস থেকে নামতে নামতে সে বলে, ইস দিনের বেলায় জার্নি বাই বোট ঠিক জমলো না। জোৎস্না থাকলে রুপালি বৃষ্টিতে ভেজা যেতো। আজ আসি তবে!
-সেকি ফোন নম্বর-টম্বর কিছু দিবেন তো নাকি! সুটিং-এ ডাকতে হবে যে অভিনেত্রীকে!
-নাহ আপনার ফর্মুলা মুভিতে আমার পোষাবে না! যাই দেখি খ্রিস্টোফার নোলানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। আপনি সোজা রুপপুরে চলে যান, বালিশ ও পর্দা সরবরাহের কাজটা নেন; সেই ভালো।


পদ্মা নদীতে সে রুপালি বৃষ্টি ঝরা রাতে বজরায় বসে শেহেরজাদ বানু গেয়েছিলেন,
এ মৌসুমী পরদেশে তোমায় যেতে দেবো না।
না শোনো শুনোনা কথা না বোঝো বুঝোনা ব্যথা
অশ্রুমালাই দিও শেষে, ফুলমালায় নেবো না
যেতে তোমায় দেবো না।
জীবন সরকার বলেছিলেন, আমার জীবন জুড়ে গান আর কবিতা; আমাদের পরিবারে সম্পদের মোহ কেটেছে অনেক আগেই; কিন্তু কেউ যদি চায়; থেকে যেতে পারে স্বচ্ছন্দে। আমার মা নূরবাহার বেগম দার্জিলিং-এ বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে গ্রামোফোন এনেছেন সঙ্গে করে। হেদায়েতি ঘরের মেয়ে বেদায়েতি স্বামীর সংসারে এসে মানিয়ে নিয়েছেন বেশ। আমার বাবা-মা’র মাঝে গভীর প্রেম ছিলো! বাবা মারা গেলেও; মা তাঁর স্মৃতি আঁকড়ে রেখেছেন।
শেহেরজাদ জিজ্ঞেস করেন, গ্রামোফোনে গান শুনলে সমাজ কিছু বলে না!
-চেষ্টা করেছিলো। আমার বাবার কাছে এসে অভিযোগ করেছিলো, সরকার বাড়ির বৌ আমাদের ঘরের বউগুলোর গ্রামোফোনের গান শোনার নেশা করেছেন। তারা রোজ দুপুরে গান শুনতে আসে! কিছু করুন সরকার! সরকার কী উত্তর দেবেন ঠিক করে ওঠার আগেই পর্দার ওপাশ থেকে মা বলেন, পুকুর ঘাটে গোসল করতে গেলে যদি মেয়েদের জাত না যায়; গান শুনলে জাত যাবে কেন!
শেহেরজাদ এতোক্ষণে প্রাণ খুলে হাসেন, আম্মাজিকে আমার সালাম দেবেন। গানই আমার জীবন। সেই জীবন ফেলে নতুন জীবন আমার ঠিক হবে না! আমি জানি নতুন জীবন অনেক আনন্দের হতে পারতো। কিন্তু আমি যে ঘর বেঁধেছি গানের সঙ্গে।
জীবন সরকার খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, অনেক না পাওয়ার মধ্যেই পাওয়া লুকিয়ে থাকে।
-আপনি তো ঘন ঘন কলকাতা যাতায়াত করেন; সুতরাং না পাওয়া মানেই তো দেখা না হওয়া নয় জীবনজি!

কলাকেন্দ্রে ইনস্টলেশন প্রদর্শনীতে ঘুরতে ঘুরতে রিয়াজের চোখে পড়ে একটা মজার কাজ। শিল্পী তার নিজের ইনস্টলেশনে; ঊনবিংশ শতকের এক গায়িকার সবুজ রং-এর বেনারসি শাড়ীর কাঠ বোর্ডের মডেলের মুখের জায়গাটাতে টিকলি পরা ঠোঁটের ওপর লাল তিল আঁকা আর নীলাভ সমুদ্রের মতো চোখ মেলে দাঁড়িয়ে আছে। ইন্সটলেশনের ক্যাপশনঃ শেহেরজাদ বানু।

নামটা খুব পরিচিত লাগে রিয়াজের। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারে না কোথায় শুনেছে সে। শেহেরজাদ বানুর ইনস্টলেশন দেখে ফিরে যাবার আগেই জীবন্ত নারী মুখটি শব্দ করে হেসে ওঠে। রিয়াজ জিজ্ঞেস করে,
-চারুলতা আপনি!
-চারুলতা কে! আমি তো শেহেরজাদ! শেহেরজাদ বানু।
-তা কতক্ষণ চলবে আপনার ইন্সটলেশন বিজনেস!
-অপেক্ষা করেন; যান বাইরে আঁতেলদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আর্টফর্ম নিয়ে গল্প করে কাটান। আমি এটা শেষ করে আসছি। চলে যাবেন না যেনো।

রিয়াজ স্টুডিওর বাইরে এসে মন দিয়ে এক চিত্রকরের মুখে কিউবিজমের গল্প শোনে। জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের আলাপটা উঠতেই কে একজন উদাহরণ হিসেবে শেহেরজাদ বানুর ইন্সটলেশন আর্টের কথা বলে। ভালোই লাগছিলো মোহরের শহরে সুন্দর নিয়ে বেঁচে থাকা কজন শিল্পীর গল্প শুনতে।

হঠাত পেছন থেকে ডাক আসে, কই চলেন; আজ আপনাকে শ্যামলী নদীর ধারে পাঁচমুড়া পাহাড় দেখাতে নিয়ে যাবো; যেখানে লালরাস্তা ধরে সেই অমলের দইওয়ালা হেঁটে হেঁটে বলে, ‘দই নেবে গো দই!’
ড্রাইভিং সিটে বসে শেহেরজাদ বলে, সিট বেল্টটা বাঁধুন মশাই। এখন রেস শুরু হবে।
সাঁঝ নামছে। সাঁই সাঁই করে বাতাস কেটে গাড়িটা বেরিয়ে যেতে থাকে ঢাকা থেকে। ট্রাফিক পুলিশ নেহাত নারী ড্রাইভার দেখে হয়তো কিছু বলে না।
রিয়াজ মনে করিয়ে দেয়, ষাট কিলোমিটারের নীচে রাখতে হবে কিন্তু স্পিড!
-নিয়ম ভাঙার নিয়ম থাকে কিছু। শহরের মধ্যে স্পিড সিক্সটিই ছিলো। কিন্তু শহর থেকে বের হলেই তো বেহেশত এ দেশে। সেটা সেলিব্রেট করতে দেন। চুপ করে বসে থাকেন।

রিয়াজ মনে করার চেষ্টা করে শেহেরজাদ নামটা কোথায় শুনেছে সে। হঠাতই মনের মধ্যে হুঁই দিয়ে যায়। এই নামটা মায়ের মুখে শোনা। মা ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় নানার আলমিরাতে কিছু চিঠি পেয়েছিলেন; আর ছিলো দুটি সাদাকালো ছবি। রিয়াজ সেই ছবির টিকলি-ঠোঁটের ওপর তিল-আর ধূসর চোখের বর্ণনা শুনেছিলো। মিলিয়ে দেখতে থাকে।

-কী দেখছেন মশাই! এমন স্টকারদের মতো তাকাচ্ছেন কেন!
-মিলিয়ে দেখছি এই শেহেরজাদ সেই শেহেরজাদ কিনা!
আবার শুরু হয় সেই হাসি। সে ফোনের ব্লুটুথ চালু করলে সেই গানটা বাজতে থাকে।
এ মৌসুমী পরদেশে তোমায় যেতে দেবো না।
না শোনো শুনো না কথা না বোঝো বুঝো না ব্যথা
অশ্রুমালাই দিও শেষে, ফুলমালায় নেবো না
যেতে তোমায় দেবো না।


এয়ারপোর্টে বোর্ডিং পাস নিয়ে; নানারকম তল্লাশি করিয়ে ভেতরে ঢুকে বোর্ডিং গেটের সামনে বসে অপেক্ষা করছিলো রিয়াজ। ফিল্ম প্রজেক্টের জন্য রেকি করে ফিরে যাচ্ছে সে। শীতকালে আবার আসবে সুটিং করতে। কী কী করার ছিলো; কী কী করা হলো সেই চেক লিস্ট মেলাতে মেলাতে একবার ঝোড়ো হাওয়ার মতো শেহেরজাদের চিন্তাটা মাথায় আসে।

বংশী নদীতে জোতস্নারাতে নৌকা করে ঘুরে; ফেরার পথে গাড়িতে জোছনা করেছে আড়ি গান শুনিয়ে; তারপর হোটেল লা মেরিডিয়েনের পোর্টিকোতে নামিয়ে দিয়ে গেছে সে। নিজে থেকে দেয়নি বলে রিয়াজও আর ফোন নম্বর জানতে চায়নি। একবার ভেবেছিলো কলাকেন্দ্রে ফোন করে খোঁজ নেবে; পরে ভেবেছে, কিছু কিছু রহস্যভেদ না করাই হয়তো ভালো। থাকুক না কিছু স্মৃতি কিছু অজানা গল্পের ইতিউতি।

অন্যমনস্ক হয়ে প্লেনের ওড়াওড়ি দেখতে দেখতে হঠাতই কানে আসে প্লেনে ওঠার ডাক পড়েছে। তড়িঘড়ি করে ল্যাপটপটা হ্যান্ড ক্যারিয়ারে ঢোকানোর সময় পাশের সিটে চোখে পড়ে একটা খাম, ওপরে লেখা রিয়াজ। সেটা পকেটে ঢুকিয়ে প্লেনে উঠে সিটে বসে ধাতস্থ হয়। খাম খুলে একটা ছোট্ট চিরকুট পায়। তাতে লেখা, ‘অনেক না পাওয়ার মধ্যেই পাওয়া লুকিয়ে থাকে। সুতরাং না পাওয়া মানেই তো দেখা না হওয়া নয় জীবনজি!’

মাসকাওয়াথ আহসান। লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক। 'শিল্পের জন্য শিল্প নয়, সমাজ-রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য শিল্প' এই ভাবনাটিই মাসকাওয়াথ আহসানের লেখালেখির প্রণোদনা। নাগরিক বিচ্ছিন্নতার বিচূর্ণীভাবনার গদ্য ‘বিষণ্ণতার শহর’-এর মাঝ দিয়েই লেখকের প্রকাশনার অভিষেক ঘটে। একটি পাঠক সমাজ তৈরি হয় যারা নাগরিক জীবনের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ