কচুপাতার জল

ওয়াহেদ সবুজ
গল্প
Bengali
কচুপাতার জল

মুনা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আত্মহত্যা করবে৷

গলায় দড়িতে অত্যধিক যন্ত্রণা, বিষপানে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা, উঁচু ভবন থেকে লাফ দেয়ার ক্ষেত্রে তার উচ্চতাভীতি— সকল উপায় বিবেচনার পর আপাতত পরিকল্পনা রেইলওয়ে লাইনের উপর গলা রেখে ট্রেনের চাকার নিচে জীবন দিয়ে দেয়া৷ অনেক ভাবনাচিন্তা করে এ উপায়টি সে নির্বাচন করেছে৷ অথচ, কেন সে এ রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, সেটা একটা ধোঁয়াশার মতো ব্যাপার; এমন কি মুনা নিজেও এ ব্যাপারে চিন্তিত যে, যে কারণটি দেখিয়ে সে আত্মাহুতি দিতে যাচ্ছে সেটা খুব বেশি silly বা হাস্যকর হয়ে যাচ্ছে কি না৷

যাই হোক, আত্মহত্যার কাজটি সে আজকেই সুসম্পন্ন করতে চায়; তা না হলে তার ক্ষীণ আশঙ্কা— যে কোনো সময় তার মত বদলে যেতে পারে৷ কিন্তু যেহেতু সে সারাজীবনে কখনোই আর কোনো বিষয়েই কোনো সিদ্ধান্ত বদল করেনি, এবারও সেটা সে হতে দিতে চায় না৷ বাড়ি থেকে বের হয়েই একটি রিকশা পাওয়া গেল-

“যাবেন?”

“কই যাইবেন?”

“জাহান্নামে যাবো, যাবা?”

“নাহ, যামু না! এত শিগগির আমার মরার কোনো ইচ্চা নাই৷”

রিকশাটা চলে যাবার সাথে সাথেই নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হলো; রাগ কমাতে নিজের গালে ঠাস করে গোটা দুই থাপ্পড় লাগিয়ে দিল৷ মনে মনে বললো, সবকিছুতেই নিজেকে এত হিউমারাস প্রমাণ করার কিছু নেই৷

আরেকটা রিকশা পাওয়া গেছে৷ এবারে আর কোনো উল্টাপাল্টা না বলে চুপচাপ রিকশায় চড়ে বসলো, বললো, “কমলাপুর রেলস্টেশান চলেন৷” যদিও রিকশায় যেতে সময় বেশি লাগবে, তারপরও আজ ও রিকশাতেই চড়বে; জীবনে শেষবারের মতো রিকশায় ঘোরা৷ এখনই যদি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে আসতো, বড্ড ভালো হতো; শেষবারের মতো বৃষ্টিতে গা ভেজানো যেত৷

মুনা বৃষ্টি খুব পছন্দ করে; প্রথম যেবার সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিল, ঘরদোর বন্ধ করে দিয়ে দড়ির ভেতরে কেবলই মাথা গলিয়ে দিয়েছে, ঠিক সেই মুহূর্তে বৃষ্টি৷ সে কী বৃষ্টি, নুহ নবির প্লাবনের মতো দশা! বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মুনা ভাবলো, শেষবারের মতো একটু বৃষ্টিতে ভেজা যাক৷ দড়ি-টড়ি ফেলে ছুটে চলে গেল ছাদে, তার আগে কম্পিউটারে গান ছেড়ে দিল “আজি ঝরঝর মুখর বাদলদিনে….!” বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মনে হলো— আহ্, এই বৃষ্টি এই আকাশ ফেলে রেখে সে চলে যাবে?! ওপারে কি এমন আকাশ-বৃষ্টি থাকবে? বৃষ্টিজলে ডুব দেয়ার সুখ পাবার ব্যবস্থা থাকবে? যদি না থাকে? সিদ্ধান্ত বদলে ফেললো— নাহ্, এই বৃষ্টির জল ফেলে রেখে কোনো আগুনে সে জ্বলতে রাজি নয়, এই বৃষ্টিস্নেহ অবহেলে কোনো ফাগুনেই গলতে সে রাজি নয়৷

আজ অবশ্য বৃষ্টি হবার কোনোই সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না; ঝকঝকে আকাশে সূর্যের হলুদ সোডিয়াম আলো; পরিষ্কার আকাশে ঐ তো উড়ে চলা কাকের চোখের মণিটাও যেন সে দেখতে পেল৷ ‘কাকের ডাক অশুভ’ মনে আসতেই, মুনার মনের মধ্যে উচ্ছ্বাস জেগে উঠলো; তার মানে আজকে কোনো বাধা নেই, আজকে সব ঠিকঠাক মতোই হবে৷ কাক সম্পর্কে মুনার কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে৷ সে প্রায়ই ভাবে— চড়ুই-শালিক-টিয়া নিয়ে মানুষের এত্ত মাতামাতি, কোকিলের কণ্ঠ নিয়ে এত এত উপমা, অথচ যে কাক ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে পরিবেশ বিশুদ্ধ রাখে, তাকে নীচু করে দেখা হয়, তার ডাককে ‘অশুভ’ বলা হয়; কেন? আচ্ছা, মানুষের ক্ষেত্রেও কি এটা প্রযোজ্য? যে মানুষ যত দূরে অবস্থান করে, সে মানুষটি ততই আকাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে; অথচ যে মানুষটি সকল কঠিন সময়ে পাশে থেকে সমস্যা মোকাবিলায় শক্তি যোগায়, প্রাপ্য মর্যাদা ও ভালোবাসা থেকে চিরদিন সে বঞ্চিত হয়! এমন কেন?

মুনার মন খারাপ হয়ে গেল৷ মানুষ সম্পর্কে, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কগুলো নিয়ে ভাবতে গেলেই ওর মন খারাপ হয়ে যায়, হিসাব মেলাতে পারে না; ওর প্রায়শই মনে হয়, মানুষে মানুষে সম্পর্কগুলোই পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল অঙ্ক৷ না, আজ মন খারাপ করে থাকা চলবে না; আজ তাকে হাসিমুখ থাকতে হবে৷ সে চিরদিন ভেবে এসেছে, মৃত্যুর সময় তার হাসি হাসি মুখ থাকবে, লোকে দেখে বলবে— “বড্ড সুখী ছিল মেয়েটা!”

মুনা মুখে হাসি আনতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে— এই পথ, এই আকাশ, এই ফুল-পাখি শেষবারের মতো প্রাণ ভরে দেখে নিতে হবে! হঠাৎ তার চোখ গিয়ে পড়লো একটি বাড়ির গেটের ভেতরে; সেখানে বিশাল আকৃতির সব রক্তজবা ফুটে আছে, ফুলগুলো এমনভাবে ঝুঁকে আছে যেন তারা আর দেয়ালের ওপাশে থাকতে চায় না, বৃক্ষের বন্ধন ছিন্ন করে হলেও দেয়াল টপকে বাইরে বেরোতে চায়৷ এ দৃশ্যটি দেখার প্রায় সাথে সাথেই মুনার এক কলেজফ্রেন্ডকে মনে পড়ে গেল— জবা!

প্রথম যখন নামটা শুনলো, সে খুব চমৎকৃত হয়েছিলো— কী দারুণ স্নিগ্ধ একটি নাম, জবা; নামটা শুনতেই নাকের কাছে বাতাস এসে রক্তজবার সুগন্ধ জানিয়ে যায়৷ জবার মধ্যে একটি চরম রহস্য ছিল; সেটা হলো, তার গা থেকে সব সময় জবা ফুলের সুগন্ধ পাওয়া যেত৷ মুনার মাথায় নানান ধরনের চিন্তা ঘোরপাক খাচ্ছে; তার কলেজফ্রেন্ড জবার ঘটনাটা মাথায় আসতেই মনে হলো, এই রক্তজবা কত সৌভাগ্যবান যে বৃক্ষের বন্ধন ছিন্ন করার ক্ষমতা তার নেই; ফুল তো জানে না, বন্ধন ছিন্ন করলে দুর্ঘটনার ইতিহাস রচিত হয়; প্রকৃতি বন্ধন ছিন্ন করা পছন্দ করেন না! কিন্তু মুনা নিজে আজ কী করতে যাচ্ছে? নিশ্চয়ই বন্ধন ছিন্ন করতেই যাচ্ছে!

জবার কথা ভেবে মুনার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে উঠলো; এ কী, ঐ তো রক্তজবার গহ্বরে জবার চোখ; কিন্তু সে তো অনেক আগেই….!

দুই. 

জবার প্রসঙ্গ আপাতত থাক; পরে যথাসময়ে তাকে সামনে আনা যাবে৷ এই মুহূর্তে আমাদের সকল দুশ্চিন্তা মুনাকে ঘিরে; একটি অত্যন্ত সাহসী, স্পষ্টভাষী, শুদ্ধাচারী মেয়ে আত্মহত্যা কেন করবে?

সে যে অত্যন্ত সাহসী, তার একটা উদাহরণ দেয়া যাক৷ মুনা যখন স্কুলে পড়ে, নবম কি দশম শ্রেণিতে, স্কুল ছুটি হবার পর প্রায়ই দেখে একটি ছেলে তার রিকশা ফলো করে; মুনা যেহেতু গার্লস স্কুলে পড়ে এবং যেহেতু একদল ছোকরা চিরকালই পৃথিবীর অতি স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী সকল কাজকর্ম ফেলে নারীরূপে অবগাহন করার উদ্দেশ্যে গার্লস স্কুল ছুটির সময় স্কুলগেটের অপর পাশে দাঁড়িয়ে হা করে মেয়েদের দিয়ে তাকিয়ে থাকে, সুতরাং এ রকম হাজারো ছেলেছোকরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেও সে খুব একটা বিব্রত হতো না৷ সমস্যা তখন হয়ে যায়, যখন কেউ প্রতিনিয়ত রিকশার পেছনে ধাওয়া করে৷

একটি প্রশান্ত বিকেল৷ মুনা কোচিং ক্লাসে গিয়ে ছেলেটিকে দেখামাত্রই চরম উত্তেজনায় অশান্ত হয়ে গেল— ফলো করতে করতে শেষমেষ কোচিং পর্যন্ত! এত বড় সাহস! কোনো রকমে ক্লাস শেষ হতেই ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গেটের সামনে ছেলেটির কলার চেপে ধরলো; আশপাশের সবাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডান হাত মুঠ করে জোরসে বসিয়ে দিল দু-চার ঘুসি৷ পরিস্থিতি বেগতিক দেখে গণপিটুনির শিকার হওয়ার আগেই ছেলেটি তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়লো, অতিদ্রুত মুনাকে বোন পাতিয়ে কোনো রকমে ছুটে পালিয়ে গেল৷

এ ঘটনার পর থেকে পুরো গার্লস স্কুল তো বটেই, অতি স্বাভাবিক কারণেই বয়েজ স্কুলেও মুনা দারুণ ফেমাস হয়ে গেল, রাতারাতি! ফেমাস মানে বোন হিসেবে ফেমাস; স্কুলপড়ুয়া সমবয়সী কোনো মেয়ের এহেন আচরণের কথা জানতে পেরে ছেলেগুলো একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়লো৷ এমন এক বিপ্লব ঘটে গেল যে সেই ঘটনার পর থেকে মুনার স্কুলের সামনে ছেলেদের আনাগোণাটা বিস্ময়করভাবে কমে গেল৷ এতে অবশ্য ওর কতিপয় বান্ধবী বড্ড নাখোশ হলো; ওদের একমাত্র দুশ্চিন্তা এই যে এখন কার জন্য ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাবে আর কার জন্যই বা চুল ঝাঁকিয়ে বাতাস দোলাবে?

আপনার মনে হতে পারে, যে মেয়ে স্পষ্টভাষী, সে মেয়ের এত গোপন কষ্ট কিসের যে এমন চুপেচাপে রীতিমতো আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেবে? স্পষ্ট কথা বলার মতো মানসিক শক্তি যাদের নেই, তারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গোপন কষ্টে নিপতিত হয়!

আপনার চিন্তাটা সঙ্গত, কিন্তু মুনা যে প্রচণ্ড স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড এতেও সন্দেহের কোনোই অবকাশ নেই৷ একটা ঘটনাতেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে; ‘ঘটনা’ না বলে বরং ‘ইতিহাস’ বললেই ঠিক বলা হবে৷ মুনা তখন কলেজে, ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে৷ স্বভাবগত সহজাত আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে খুব সহজেই দ্রুততর সময়ের মধ্যেই সে আশপাশের সকলের নজরে চলে আসে; কেউ তার কথায়, কেউ হাসিতে বা কেউ বিমুগ্ধ হয় তার রূপসৌন্দর্যে৷ একবার যেটা হলো, মুনা হিসাববিজ্ঞানে কিছুটা কাঁচা হওয়ায় তার জন্য একজন টিউটর ঠিক করা হলো; ছেলেটি সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েছে, নাম সাজিদ৷ চেহারায় টিউটর যতটা, তারচেয়ে বেশি যেন বলিউডি সিনেমার হিরো বলে ভুল হয়৷ সাজিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী ছিলো; বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পার্টটাইম টিচিং দিয়ে ইতোমধ্যেই টিচিং-এর ক্ষেত্রেও মেধার পরিচয় দিয়েছে৷ সঙ্গত কারণেই ছাত্রছাত্রীদের কাছে, বিশেষত তার কলেজপড়ুয়া ছাত্রীদের কাছে সে মোটামুটি দারুণ এক আকাঙ্ক্ষিত পুরুষ৷ কিন্তু অত্যন্ত বিস্ময়করভাবে, মুনাকে দেখার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সে কুপোকাত হয়ে গেছে৷ যেহেতু সে মেধাবী একজন মানুষ, তাই দারুণ সন্তর্পণে ব্যাপারটি চেপে গেছে; এর পরবর্তী মাসখানেকেও মুনা ব্যাপারটা কিছুমাত্রও আঁচ করতে পারেনি৷

বিপত্তিটা ঘটলো হঠাৎ করেই৷ মুনার সামনে নিজেকে লুকোতে পারলেও তার বান্ধবীদের ক্রূর দৃষ্টিকে এড়াতে সাজিদ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে৷ মুখের ভাষা লুকোনো গেলেও চোখের ভাষাকে যে কোনোভাবেই লুকিয়ে রাখা যায় না তা কে না জানে! মুনা তার এক বান্ধবী মারফত জানতে পেরেছে, সাজিদ ভাইয়া তাকে খুব পছন্দ করে৷ শুনেই সে রীতিমতো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো— সে তো সাজিদ ভাইয়াকে ‘স্যার’ হিসেবে মানে, আর তিনি কি না…. ছিহ্! সেদিন সাজিদের কাছে পড়তে বসেই মুনা একটি চরম হঠকারি কাজ করে বসলো; কোনো রাখঢাক না রেখে সরাসরি সাজিদের চোখে চোখ রেখে বলে দিল, “ভাইয়া, আপনার কাছ থেকে আমি এগুলো আশা করিনি৷ আপনি আমার স্যার, এবং আমি আপনাকে সেভাবেই ভেবেছি৷” সাজিদ কিছু একটা বলতে গেল; তাকে থামিয়ে দিয়ে মুনা বলতে থাকলো, “আমি জানি, আমি কেন, সবাই জানে আপনি দেখতে সিনেমার নায়কদের মতো, আইনস্টাইনের কাছাকাছি আপনার মেধা, শয়ে শয়ে মেয়েরা আপনার প্রেমে খাবি খায়; কিন্তু তাতে আমার কিছুই এসে যায় না৷ আপনি আমার স্যার, স্যার মানে স্যার; দ্যাট্স ইট!” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল মুনা৷ সব শুনে সাজিদ এক্কেবারে স্তম্ভিত— এ মেয়ে বলে কি, যা ইচ্ছে তাই!

প্রচণ্ড রকম হতাশ দৃষ্টি ফেলে সাজিদ বললো, “সেই মানুষটাকে আমার হৃদয়নিঙ্ড়ানো ভালোবাসা জানাবে যে তোমাকে এগুলো বলেছে; কারণ আমি নিজে কখনোই তোমাকে জানাতে পারতাম না৷ অতটা মানসিক সক্ষমতা আমার নেই মুনা!”

কী বুঝলেন? স্পষ্টভাষী হলে তার সাথে সাথে আরো একটা ব্যাপার নিজের মধ্যে ধারণ করতে হয়— ঠাণ্ডা মস্তিষ্ক৷ হুটহাট কিছু একটা করে ফেলার প্রবণতা আমাদের মুনার মধ্যে এত পরিমাণে যে জীবনে বিভিন্ন সময়ে তাকে নানাভাবে এর মূল্য দিতে হয়েছে৷ সবচেয়ে বড় যে মূল্যটা তাকে দিতে হয়েছে সেটা হচ্ছে, সে সাজিদকে হারিয়েছে৷ সাজিদ চলে যাবার বছর দুয়েক পর সে উপলব্ধি করতে পেরেছে সে এক মহামূল্যবান সম্পদ হারিয়ে বসে আছে শুধু তার হঠকারিতার জন্য৷ সে উপলব্ধি করেছে— জীবনে প্রায়শই এমন ঘটে যে নিজের যোগ্যতার অধিক কিছু অতি সহজেই পেয়ে গেলে মানুষ সে ধাক্কাটা সামাল দিতে পারে না৷ সে উপলব্ধি করেছে— সূর্যের আলো চোখের উপর এসে পড়লে চোখ সেটা ধারণ করতে পারে না, আলোর বদলে চোখের সামনে তখন অন্ধকার খেলা করে৷

রক্তজবাটির ওপর থেকে দৃষ্টি না ফিরিয়েই মুনা রিকশাওয়ালাকে থামতে বললো৷ সে রক্তজবার ভেতর থেকে জবা ফুলের সুগন্ধ আসছে, এত দূর থেকেও সে সুগন্ধ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে৷ কিন্তু অবাক ব্যাপার, এটা তো ওই ফুলের সুগন্ধ নয়; জবার গা থেকে যে রকম সুগন্ধ বেরোতো, সে রকম৷ রিকশা থেকে চট করে নেমে এক রকম দৌড়ে ফুলগাছটির দিকে এগিয়ে গেল মুনা, ফুলটাকে তার চাই৷ ফুলটা ছেঁড়ার জন্য স্পর্শ করতেই তার সারা শরীর হিম হয়ে গেল— রক্তজবার অভ্যন্তরে জবার মুখ৷

তিন. 

কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা, দু-হাত পেছনে ঘুরিয়ে দড়িবাঁধা অবস্থায় দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে জবা৷ গত তিন দিন এই একইভাবে দুঃস্বপ্নের সময় কাটছে; আদৌ কি কাটছে? একেকটা মুহূর্ত মনে হচ্ছে যেন একেকটা শতাব্দী; যে কোনো মূল্যে এই পৃথিবীর অবসান প্রয়োজন, যে কোনো মূল্যে বাতাসের প্রবহমানতা স্তব্ধ করে দেয়া প্রয়োজন৷ যে মুহূর্তে তার চোখ কালো কাপড়ে ঢেকে দেয়া হলো, তার ঠিক আগমুহূর্তে সে একটি রেইলওয়ে লাইন ও একটি রক্তজবা দেখতে পেয়েছে; গত তিন দিনে তার পৃথিবীতে দুটো মাত্র উপাদান উপস্থিত— রেইলওয়ে লাইন ও রক্তজবার লাল, এর বাইরে আর যা আছে তার সবই অন্ধকারে ঢাকা৷

ছোটবেলার একটি ঘটনা জবার আজ খুব করে মনে পড়ছে৷ স্কুল শেষে বান্ধবীদের চাপাচাপিতে দশ-বারোজন মিলে এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গেছে৷ বাসায় ঢুকে ওর চক্ষু চড়কগাছ— কী বিশাল ড্রইং রুম, পুরো ঘরটার তিন পাশের দেয়াল ঘেঁষে দামি দামি সোফা; পূর্বদিকের দেয়ালে বিরাট একটা টেলিভিশন, এত বড় টিভি সে জীবনে চোখে দেখেনি; ছাদ থেকে প্রায় মাথার কাছাকাছি নেমে এসেছে রাজকীয় ঝাড়বাতি, চার দিকের দেয়ালে বড় বড় কয়েকটি পেইন্টিং, তার মধ্যে একটি পেইন্টিং-এ দৃষ্টি আটকে গেল— একটি সাদা পাখি, তার রক্তাক্ত শরীরে বিঁধে আছে তিনটি তীর৷ এত এত সুন্দর পেইন্টিং-এর মধ্যে এই একটা বিষণ্ন ছবি, কেমন যেন মন খারাপ করে দেয়৷ নিরবচ্ছিন্ন সৌন্দর্য বলে কিছু থাকতে পারে না? সকল সুন্দরের গা ঘেঁষেই থাকবে অপ্রিয় বাস্তবতা?

সে যাক, তীরবিদ্ধ পাখির রক্তাক্ত শরীর ছাপিয়ে জবার মনে হলো, ওদের যদি এত সুন্দর একটা বাড়ি থাকতো, তাহলে সে বাড়ি থেকে কখনো বেরই হতো না!

দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করে যখন বাসায় ফিরলো, তখন ঘড়িতে দুটো চুয়াল্লিশ৷ পুরো বাড়িতে সুনশান নীরবতা, দেয়ালঘড়ির কাঁটা যে ঘুরছে সে আওয়াজও কানে আসছে৷ কোনো একটা ঝড় প্রায় আসন্ন, তা বুঝতে আর বাকি থাকলো না; বড় কোনো ঝড়ঝাপটা আসার আগে প্রকৃতি কিছু সময়ের জন্য বড্ড প্রশান্ত হয়ে যায়, তারপরেই তো অশান্ত আক্রমণে লণ্ডভণ্ড করে দেয় সব৷ ড্রইং রুমে বাবা বসে; জবাকে দেখামাত্রই কোনো কথা না বলে মেয়ের হাত ধরে সোজা নিয়ে গিয়ে বাথরুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন৷ দুপুর গড়িয়ে পুরো বিকেল পার হয়ে গেল, দরজা খোলা হলো না৷ সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত কোনো রকমে সময় কেটে গেলেও অন্ধকার হতেই জবার কাঁপুনি আরম্ভ হয়ে গেল; প্রবল প্রচণ্ড অন্ধকার চিড়ে কিচ্ছুটি চোখে পড়ছে না, গভীর অন্ধকারে দরজা-বন্ধ বাথরুমে বুকের মধ্যে দ্রুতগামী দুরুদুরু, নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে বারবার; চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু কিছুতেই গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না; হৃদস্পন্দন ক্রমেই বাড়ছে, দ্রুতগতিতে; মনে হচ্ছে বুকটা এখনই ফেটে যাবে, হৃদপিণ্ড বের হয়ে আসবে বুকের দেয়াল ভেদ করে৷ ভয়ে-আতঙ্কে শরীরের সব শক্তি এক করে চিৎকার করে উঠতে চাচ্ছে, চিৎকার-চেষ্টায় গলার শিরা-উপশিরাগুলো ফুলে উঠেছে অস্বাভাবিকভাবে৷

শিরা-উপশিরাগুলো ছিঁড়ে বের হয়ে আসবে, এমন সময় সে কী ভীষণ চিৎকারে কেঁপে উঠলো অন্ধকার ঘর; কান্নার স্বরে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো ধরের মেঝে-দেয়াল-ছাদ, বাতাসে ছড়িয়ে গেল চোখের আর্দ্রতা৷ তিন দিন ধরে এই অন্ধকার ঘরে দুর্বিষহ সময়, পালাক্রমে দৈনিক তিন বার খুবলে খাওয়া হয় তাকে; নগ্ন শরীরে এক টুকরো কাপড় তার সম্ভ্রম— নিজ চোখে জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতাটা তাকে দেখতে হচ্ছে না! তার চোখে লেগে আছে এক টুকরো রেইলওয়ে লাইন আর একটা রক্তজবা, চেতনাজুড়ে শুধু রাত্রিসম অন্ধকার৷

জ্ঞান ফেরামাত্রই মুনা আকাশ-পাতাল এক করে কান্না জুড়ে দিল; সে কান্নায়-চিৎকারে মুহূর্তেই ভারি হয়ে উঠলো বাতাস, হাসপাতালের একেবারে অপর শেষ প্রান্তেও সে চিৎকার শোনা গেল৷ সে কান্নার সাথে প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো একটি মাত্র অর্থবোধক শব্দ— জবা! বারবার জবার নাম বলতে দেখে মুনার বাবা-মা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন দু-তিনবার— জবা? জবা কে?

মিনিট দশেকের অস্থির সময় শেষে মুনা প্রবল আর্তনাদে বলতে লাগলো, “ওরা ওকে রেইললাইনের উপর শুইয়ে দিয়েছিল বাবা; জবার শরীরজুড়ে নখের আঁচড় ছিলো বাবা৷ ওরা জবাকে আটকে রেখেছিল শূন্য অন্ধকার ঘরে, খুব ভয় পেয়েছিল জবা, খুব!” ধীরে ধীরে মুনার আওয়াজ ক্ষীণতর হতে থাকে, “ছেলেটাকে জবা ‘ভাই’ ডাকতো, জবার চোখ বাঁধা, জবা খুব ভয়, জবাকে ওরা, রেইললাইন, ভয়, জবা, ওরা, ওরা জবাকে!” বলতে বলতেই সে অচেতন হয়ে গেল!

মুনার সমস্ত শরীর বার দুয়েক কেঁপে কেঁপে উঠলো; সাথে সাথে রোদ-ঝলমল আকাশ বেয়ে নেমে এল বৃষ্টি৷ রক্তজবার শরীরে জবার অস্পষ্ট মুখ দেখে অস্থির হয়ে উঠলো সে; জবার মুখটা কোনোভাবেই মনে করতে পারছে না! অস্পষ্ট; কী অস্পষ্ট ছায়া জবার মুখটা৷ অথচ কত কত সময় একসাথে কাটিয়েছে ওরা, এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়িয়েছে কত; কত মধুর স্মৃতি, কত শত ছবি!

ছবি? নিশ্চয়ই একসাথে তোলা ছবি পাওয়া যাবে এ্যালবামে; এখনই খুঁজে দেখতে হবে, এখনই! জবার চেহারাটা মনে নেই কেন? কেন মনে নেই?

চার. 

রিকশা ছেড়ে সিএনজি করে মুনা বাসায় ফিরে এলো৷ দৌড়ের ভঙ্গিতে ছুটে গেল নিজের ঘরে৷ আলমারি খুলে অস্থিরভাবে এ্যালবামগুলো খুঁজতে লাগলো; বাদামি রঙের এ্যালবামটা কোথায়? ওখানেই কলেজলাইফের সকল প্রোগ্রাম ও ট্যুরের ছবিগুলো ছিলো; উত্তেজনায় তার সমস্ত শরীর কাঁপছে৷
এই তো, এই তো সেই এ্যালবাম; বাদামি রঙের কাভার, উপরে লেখা ‘My Life’! এ্যালবামের কাভারটা উঠিয়ে মুনা কলেজজীবনের স্মৃতিঘরে ঢুকে পড়লো; প্রথম ছবিটায় মুনা একা, মাথায় হ্যাট পরা হাস্যোচ্ছল ছবি, তার নিচেই দিগন্তবিস্তৃত একটি নীল আকাশ৷ মুনা পৃষ্ঠা ওল্টাতে থাকে; স্টাডি ট্যুর, ক্লাস পার্টি, আড্ডা, বর্ষবরণ— সবগুলো প্রোগ্রামের ছবি একে একে দেখতে থাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে৷ এখন পর্যন্ত কোনো গ্রুপছবিতে জবাকে পাওয়া গেল না; সে না যাক, জবার সাথে ডুয়েট ছবি ছিলো বেশকিছু, সেগুলো কোথায়! না, নেই; মুনা অস্থির হয়ে ওঠে খুব, এ্যালবামের পৃষ্ঠাগুলোর ওপর এক দারুণ ঝড় বয়ে যাচ্ছে— কোথায়, জবার ছবি কোথায়? দুজন একসাথে আইসক্রিম খাচ্ছে, এমন একটা ছবি ছিলো— মুনার স্পষ্ট মনে আছে; সেটা কোথায়? এই তো, এই তো আইসক্রিম হাতে ছবি; কিন্তু জবা কোথায়? এ তো মুনার একক ছবি!

মাথার মধ্যে বনবন করে ঘুরতে আরম্ভ করলো; কয়েকটি দৃশ্য শুধু একের পর এক আসছে-যাচ্ছে— রেইলওয়ে লাইন, রক্তজবা ফুল, অন্ধকার ঘর! হঠাৎ মুনার মনে হলো কেউ তার হাত দুটো টেনে ধরছে, দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিচ্ছে; মনে হলো, কেউ একজন কালো কাপড়ে বেঁধে দিতে চাচ্ছে তার চোখ; নিমিষেই অন্ধকার নেমে এলো চোখের সামনে, অন্ধকার ভেঙে এক ঝলক দেখা গেল একটি পরিচিত মুখ! কে? কে এটা? মাথা ঘুরে সে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো৷

ঘুমের মধ্যে মুনার চোখের পাতা কাঁপছে, চোখের পাতার নিচে চোখমণিটা ডান-বাম করছে দ্রুতগতিতে৷ নিশ্চয়ই সে কোনো স্বপ্ন দেখছে; স্বপ্নের মধ্যে পরিচিত কোনো দৃশ্য, খুব পরিচিত কোনো দৃশ্য৷ রেইললাইনের মাঝখানে একটি বিশাল গেইট, চারপাশে অসংখ্য পুতুল— লাল, নীল, সাদা; পরিচিত একটা মানুষ— একটা ছেলে, মুনা তার দিকে সজোরে ছুড়ে দিল একটি রক্তজবা; কিন্তু এ কি, রক্ত এলো কোত্থেকে? মুনার সারা শরীর নিমিষেই রক্তে ভিজে যেতে থাকে; ভয়ে-আতঙ্কে ছেলেটা মুনার পায়ে লুটিয়ে পড়েই তার সালোয়ার ধরে সজোরে একটা টান দিলো৷ সাথে সাথেই একটা চিৎকার দিয়ে মুনা উঠে বসলো! বিছানায় তার পাশেই বাবা বসে ছিলেন, তাঁকে জড়িয়ে ধরে সে কাঁদতে লাগলো; কী ভীষণ কান্না— সে কান্নায় অন্তরীক্ষে যেন কারো হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে গেল— অন্ধকার আকাশের দেহ ছিঁড়ে বৃষ্টিফোঁটায় ভেসে গেল নগরের ধূলিময় ইতিহাস৷

মুনা আজ সকালে খুব ভোরে ঘুম ভেঙে উঠে পড়েছে৷ হাতমুখ ধুয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জবাকে নতুনভাবে দেখে নিল সে; জবার চুল আঁচড়ে দিল, কপালে পরিয়ে দিল ছোট্ট কালো টিপ৷ জবাকে সে-ই জন্ম দিয়েছে; এক ভয়ানক মানসিক বিপর্যস্ততার মধ্যে সে নিজেই জবাকে সৃষ্টি করেছে৷ দুঃসহ কিছু স্মৃতির শেকল থেকে মুক্তি দিতে প্রকৃতি জবাকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন মুনার মস্তিষ্কে; যে জবা কখনো কোনোদিন ছিলোই না, কোনো রক্তপাত না ঘটিয়ে সেই জবাকে হত্যাও করা গেছে সহজেই— মুনার মস্তিষ্কে৷ কিন্তু হায়, প্রকৃতি কোনো মিথ্যাকে চিরদিন প্রশ্রয় দেন না, সত্য প্রকাশিত হয়ে পড়ে৷

মুনার কাছে আজ সবকিছুই দিবালোকের মতো পরিষ্কার— রিকশায় বসে অত দূর থেকেও সে রক্তজবার সুগন্ধ পেয়েছে; অথচ কী আশ্চর্য, জবা ফুল নিগন্ধি, এর কোনো সুগন্ধ হয় না! সে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে, জবার শরীর হতে ভেসে আসা রক্তজবার সুবাস আসলে তার নিজের শরীরেরই সুগন্ধ!

খুব পরিপাটি সেজে মুনা বাড়ি থেকে বের হলো; সন্দেহাতীতভাবে তার গন্তব্য সেই একই— কমলাপুর রেইলওয়ে স্টেশান, কারণটি শুধু ভিন্ন! গেইটের সামনে থেকে একটি সিএনজিতে উঠে পড়লো সে৷

রেইলওয়ে প্ল্যাটফরমে শূন্য দৃষ্টিতে মুনা দাঁড়িয়ে আছে, ট্রেনের অপেক্ষা! হঠাৎ কেমন যেন একটা হাওয়া খেলে গেল চোখের পাতায়; ডান দিকে মাথা ঘুরিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল— সাজিদ! গতকাল ঠিক এই মানুষটার অভাবেই সে আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল; কিন্তু প্রকৃতি সেটা হতে দেননি৷ কেন? সাজিদের সাথে দেখা হবে বলে? মুনার অপ্রস্তুত চোখে সাজিদের কোলে একটি নবাগত শিশু, পাশে মমতামাখা একটি হাসিমুখ; সাজিদের স্ত্রী?

মুনার মনে হলো, পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্যটি তার দেখা হয়ে গেছে৷ জীবন কত সুন্দর! কত সুন্দর!

হাস্যোজ্জ্বল মুখে পরিতৃপ্ত চোখে মুনা সুদূরে দৃষ্টি ফেরালো; ট্রেন আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে! দ্বিধান্বিত মন নিয়ে সে পুনর্বার পেছন ফিরে দেখে নিলো— আহ্, জীবন কী সুন্দর!

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..