কদমতলায় কে

সৌরভ মিত্র
প্রবন্ধ
কদমতলায় কে

চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে কদমতলায় কে? হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে সোনামণির বে।

এই বহুল প্রচলিত ছড়াটির অর্থ নিয়ে একটু তলিয়ে ভাবা যাক। -পদ্ম, সন্ধ্যামালতি, রজনীগন্ধা, গ্ল্যাডিওলাস, মুনফ্লাওয়ার জাতীয় কিছু প্রজাতির ফুল রাতে ফুটলেও তার সাথে ‘চাঁদ ওঠা’র বা শুক্লপক্ষের বা কৃষ্ণপক্ষের কোনও সরাসরি সম্পর্ক নেই। আবার হাতি বা ঘোড়ার একমাত্র সার্কাসের মঞ্চ ছাড়া নাচিয়ে হিসেবে তেমন নামডাক নেই। হঠাৎ তারা কদমতলাতেই বা যাবে কেন!… মোটকথা, এই পথে ভেবে বিশেষ সুবিধে হয় না।

বিদ্বজ্জনেরা বলেন, ‘প্রচলিত ছড়াগুলি থেকে আমরা প্রধানত যেমন পাই দৈনন্দিন আচার-আচরণ-ব্যবহার, রীতি-নীতি, সুখ-দুঃখ, আশা-বেদনার লৌকিক সংবাদ – তেমনি কতকগুলি সংক্ষিপ্ত সামাজিক ইতিহাসও।’[i] –এই নজরে ছড়াটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বিদ্বজ্জনেরা আরও বলেন যে, আপাত-আজগুবি লালকমল-নীলকমল, সাত ভাই চম্পা, ডালিমকুমার বা শিয়াল পণ্ডিত জাতীয় রূপকথাগুলিও যেখানে আজগুবি নয়, বরং সেগুলির মাধ্যমে ধরা রয়েছে শাসক-প্রজা, নারী-পুরুষ, ইত্যাদি সম্পর্ক, লৌকিক ইতিহাস ও তৎকালীন সামাজিক মূল্যবোধের মনগ্রাহী ছবি।[ii] অতএব এই ‘চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে’ –গোছের একটি অর্থহীন ছড়া শুধু লঘু হাস্যরসের কারণে এতদিন টিকে আছে, -মানতে কষ্ট হয়।

তাহলে কী? -যদি বলা হয়, এই আপাতভাবে ছেলেভোলানো ছড়া আদতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিশা পরিবর্তনের ইতিহাস, তাহলে সে’কথা মার্জিত ভাষায় মনে হয় কষ্টকল্পিত আর স্পষ্ট ভাষায় মনে হয় গাঁজাখুরি।  কিন্তু, সত্যিই কি তাই? পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ইতিহাসকে ছড়ার মধ্যমে প্রকাশ করার রীতি দেখা যায়। যেমন, ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের (১৬৪২-৪৯) সময় কোলচেস্টার শহরের দূর্গ-প্রাচীরে হাম্পটি ও ডাম্পটি নামক দুই বিশালাকার কামান স্থাপন ও ১৬৪৮ সালে সেই দূর্গ-প্রাচীর ধ্বংস হলে কামানদুটির গড়িয়ে পড়া, -এই ঘটনা থেকে ‘হাম্পটি-ডাম্পটি’ ছড়াটির সৃষ্টি। ‘জ্যাক্ অ্যান্ড জিল’ ছড়াটি সৃষ্টি হয়েছিল ফ্রান্সের রাজা ষোড়ষ লুই ও রাণী মারীর কাহিনী থেকে। মোৎসার্টের এক বিরহগীতি থেকে সৃষ্টি হয় ‘টুইংকল্ টুইংকল্’ ছড়া। ১৬৬৫-৬৬ সালের ভয়াবহ প্লেগে লন্ডনে কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। এই প্লেগে আক্রান্তদের শরীরে গোলাকার ফুসকুড়ি উঠত। এক বিশেষ ধরণের ফুল ব্যবহার করা হত এর প্রাথমিক চিকিৎসায়। -এই কাহিনী থেকেই ‘রিংগা রিংগা রোজেস্’ ছড়াটি।…

‘চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে’ ছড়াটির প্রধান বিশেষ্য পদগুলির তৎসম রূপ হল চন্দ্র (চাঁদ), পুষ্প (ফুল), কদম্ব (কদম), হস্তী (হাতি), অশ্ব (ঘোড়া), স্বর্ণ-মাণিক্য (সোনামণি) ও বিবাহ (বে)। এই শব্দগুলির ক্রিয়ার মধ্যে লুকিয়ে ছড়াটির প্রকৃত অর্থ। কিন্তু, তাদের moon, flower, elephant, horse… বুঝলেই গণ্ডগোল। (যা হয় বলেই সমস্যা!) যাই হোক, ইতিহাসের কথা যখন উঠল, সে’পথেই হেঁটে দেখা যাক।…

বিদেশী পণ্ডিত ও (বিদেশী শিক্ষায় শিক্ষিত) কিছু ভারতীয় পণ্ডিতের সৌজন্যে প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস  আজও এক গোলকধাঁধা। সিন্ধু সভ্যতা আর বৈদিক বা আর্য্য (‘আর্য’ নয়) সভ্যতার ইতিহাসকেই দেখা যাক। বলা হল, সিন্ধু সভ্যতা অনেক উন্নত ছিল, সেই তুলনায় ‘বহিরাগত’ আর্য্যরা নাকি ছিল অনুন্নত। প্রথমটি নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা, আর আর্য্যরা নগর বিরোধী। বলা হল, আর্য্যদের ঝটিকা আক্রমণে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস হয়। আর এই সম্পূর্ণ বিভাজনের অন্যতম প্রধান যুক্তি হিসেবে ইতিহাসবিদদের মনে রইল -ঘোড়ার ব্যাবহার জানা আর না জানা।

দুঃখজনকভাবে গোটা বিশ্লেষণটিই পরস্পরবিরোধিতায় পূর্ণ। ভেবে দেখুন না, দারুণ উন্নত সিন্ধুসভ্যতার নিদর্শন হিসেবে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, স্নানাগার, ইত্যাদি পাওয়া গেল অথচ কিছু দুর্বোধ্য লিপি ছাড়া একটিও সাহিত্যকীর্তি পাওয়া গেল না! আর বেদ, পুরাণ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত যাদের রচনা, -সেই আর্য্যরা নাকি ‘অনুন্নত’! তারা নাকি নগর বিরোধী ছিল, অথচ তাদের রচনায় অযোধ্যা, হস্তিনাপুর, ইন্দ্রপ্রস্থ, মথুরা, দ্বারকা, ইত্যাদি নগরের (কাল্পনিক ধরলেও) বর্ণনা বেশ স্বতঃস্ফূর্ত। এমনকি বেদেও নগর-মহত্বের উদাহরণ নেহাৎ কম নয়। সেখানে কখনও বলা হচ্ছে -‘হে অগ্নি! তুমি মনুষ্যগণের স্তুতিভাজন, কারণ তুমি অতিথির ন্যায় আমাদিগের প্রিয়, নগরীস্থিত হিতোপদেষ্টা বৃদ্ধের ন্যায় আশ্রয়যোগ্য এবং পুত্রবৎ পালনীয়’ বা ‘হে অগ্নি, তুমিও সেরূপ অমিত তেজবলে অপরিমিত অয়োনির্মিত (নিরাপত্তা দানকারী অংশ দ্বারা নির্মিত) নগরী দ্বারা আমাদের রক্ষা করো’, কখনও বলা হচ্ছে -‘নগরের ন্যায় সমুজ্জল মহাপর্বতের চারিদিকে প্রবাহিত বারিরাশি আমাদের বাক্যে কর্ণপাত করুন’[iii], ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপরেও আর্য্যদের তথাকথিত নগর-বিরোধীতার প্রসঙ্গ উঠলে মোল্লা নাসিরুদ্দিনের ঢঙে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, -এটা যদি বেড়াল হয়, তাহলে মাংস কোথায়? আর এটা যদি মাংস হয়, তাহলে বেড়াল কোথায়!?

আসলে সিন্ধু সভ্যতা আর বৈদিক সভ্যতাকে গোড়াতেই আলাদা ধরে নেওয়ার পর যখন বৈদিক সভ্যতার কোনও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেল না, তখন জবরদস্তি তাকে গ্রামীণ বলে দাগিয়ে দেওয়া হল। নইলে যে জাতিকে পৃথিবীর প্রায় সবকটি উন্নত সভ্যতার জনক বলা হয়, তারা কখনও নগর বিরোধী হতে পারে?

‘ঘোড়ার নাচ’ থেকে আলোচনার শুরু যখন, ঘোড়ায় চড়ার গল্প না শুনলে নটেগাছ-টি মুড়োবে না।…

বাবু নতুন ঘোড়া কিনে নিজের হাতে তাকে সাজ পরাতে গেলেন। সমস্ত সাজ কোনওমতে ঘোড়ার গায়ে এঁটে দেওয়ার পর, এক চাকর বলে উঠল -‘বাবু, সাজ উলটো হলো যে!’ বাবুরও সন্দেহ হচ্ছিল, কিন্তু তাই ব’লে সামান্য চাকর ভুল ধরবে! -তিনি চটে গিয়ে বললেন -‘উল্টো হবে কেন রে ছোটলোক?’ চাকর বলল -‘আঁজ্ঞে, এ দিকটা থাকবে আপনার মুখের দিকে, ও-দিকটা থাকবে পিঠের দিকে।’ বাবু ধমকে বললেন -‘ব্যাটা মূর্খ। তুই কী করে জানলি, আমি কোন দিকে মুখ ক’রে বসব?’…

ভৃত্যের জ্ঞান, ইতিহাস বা ঐতিহ্য প্রভুর থেকে মহানতর হলে প্রভু তা কোনওদিনই মেনে নেয় না। এদেশের একদা প্রভুরা এদেশের ইতিহাস লেখার সময় তার যথেষ্টই পরিচয় রেখেছেন। বস্তুতঃ, আর্য্য আগমন তত্ত্বের বিপক্ষে সহস্রাধিক প্রমাণ ও শতাধিক গ্রন্থ আছে। পারস্যের সম্রাট দারায়ুসের সমাধি আবিষ্কার হলে দেখা যায় সেখানে তার পরিচয় হিসেবে লেখা আছে ‘একজন পারসীক, একজন পারসীকের পুত্র, একজন আর্য্য, আর্য্যবংশোদ্ভূত’। -আর্য্য আগমন তত্ত্বে এ ছিল একটি বড়ো ধাক্কা। হাল আমলের গবেষকরাও এই তত্ত্বকে নাকচ করেছেন। যদিও মেক্‌ল সাহেবের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার গুণে বহু ভারতীয় আজও সত্যটি মানতে চান না।

‘আর্য্য’ শব্দটি জাতিবাচক নয়, গুণবাচক।[iv] ঋগ্বেদ (১.৫১.৮) অনুসারে এর অর্থ ‘বিদ্বান্, অনুষ্ঠাতা’। অমরকোষ টিকা অনুসারে এর অর্থ ‘উপজীব্যতা হেতু উপগম্য’। সহজ করে বললে, জীবিকার জোরে সমাজের উপরিভাগে উঠে আসা মানুষজন। (আজকের সমাজের সাপেক্ষে অফিসের মেজবাবু ছোটবাবুর থেকে বেশি আর্য্য, আবার বড়বাবু মেজবাবুর থেকে বেশি আর্য্য।) এই ‘আর্য্য’ থেকে ‘আয্যি’, আর ‘আয্যি’ থেকেই সন্মানীয় ব্যক্তিদের নাম বা সম্বোধনের শেষে ‘জী’ যুক্ত করার রীতি।[v]

সাম্প্রতিক কালে সরস্বতী নদীর প্রাচীন গতিপথ আবিষ্কৃত হওয়ার পর দেখা গেছে তথাকথিত ‘সিন্ধু সভ্যতা’র অধিকাংশ পুরাতাত্ত্বিক স্থান সিন্ধু নয়, সরস্বতী নদীখাত বরাবর অবস্থিত। ঋগ্বেদ জুড়ে নদী সরস্বতীর বন্দনাকে বিবেচনা করলে বোঝা যায় -দুটি সভ্যতা আসলে একই। (এই তত্ত্বের আরও অসংখ্য যুক্তি আছে। নিবন্ধটিকে প্রসঙ্গে বাঁধার উদ্দেশ্যে সেই আলোচনা সংযত করা হল।)

এরপর, ‘আর্য্য আক্রমণে সিন্ধু সভ্যতার পতনে’র কথা। মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত তেত্রিশ বা সাইত্রিশটি কঙ্কাল বিশ্লেষণ করে ইতিহাসকার হুইলার সাহেব সর্বপ্রথম এই গুজবটি রটিয়েছিলেন। মহেঞ্জোদারোর আয়তন প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ বর্গ ফুট, সেখানে বাড়ির সংখ্যা প্রায় সাড়ে দশ হাজার। এর জনসংখ্যা ছিল তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজারের মধ্যে।[vi]  সেখানে মাত্র গোটা তিরিশেক কঙ্কাল কোন যুক্তিতে ‘large scale destruction and abolition of Indus Valley Civilisation’-এর প্রমাণ হয়ে ওঠে, -তা সত্যিই বিস্ময়কর। (‘জামা কিনিতে গেলাম, পাইলাম একপাটি মোজা; এখন ভাবিতেছি, ঐটেকেই কাটিয়া ছাঁটিয়া কোনোমতে জামা করিয়া পরিব।’ -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।)

রইল পড়ে ঘোড়ার ব্যবহার জানা আর না জানা। যেহেতু বৈদিক সাহিত্যে অশ্বের উল্লেখ আছে, আর সিন্ধু সভ্যতায় ঘোড়ার কঙ্কাল পাওয়া যায় নি, তাই ‘ঘোড়ার ব্যবহার’কে দুই সভ্যতার বিভাজন রেখা ধরে বসা হল। কিন্তু, বৈদিক সাহিত্যে তো দেবতা, অসুর, দৈত্য, দানব, হস্তপদবিশিষ্ট নাগ, গরুড় পক্ষী, ছাগমুণ্ড দক্ষ, যক্ষ, রাক্ষস, কিন্নর, গন্ধর্ব, পারিজাত পুষ্প –এদেরও উল্লেখ আছে এবং তাদের কারুর-ই জীবাশ্ম পাওয়া যায় নি (পাওয়ার কথাও নয়)! এদিকে গুজরাতের সুরকোডাটায় সিন্ধু সভ্যতার পুরাতাত্ত্বিক সাইটে ঘোড়ার কঙ্কাল পাওয়া যাওয়ায় ‘অশ্বের ব্যবহার’-তত্ত্বেও দুলুনি লেগেছে বইকি। তাহলেও, যাবতীয় বোঝা ঘোড়ার-ই পিঠে চাপল কেন? –উত্তরের খোঁজে বরং ‘লাগাম হাতে’ বৈদিক সাহিত্যে ঢুকি।

বৈদিক রচনায় ‘ঘোড়া’ বা ‘ঘোটক’ নেই, আছে ‘অশ্ব’। বেদের বুৎপত্তি গ্রন্থ নিরুক্ত। সেই নিরুক্ত বলে, -‘ব্যাপ্ত্যর্থক অশ্ ধাতুর উত্তর ক্কন্ প্রত্যয়ে অশ্ব শব্দের নিষ্পত্তি।[vii] অশ্ব নাম কোথা থেকে হল? অশ্ব পথ ব্যাপ্ত করে। অশ্ব মহাভোজন হয়। অশ্ব চলনপটু হয়। অশ্ব পথের কুটিল প্রদেশসমূহে অনায়াসে যাতায়াত করে। অশ্ব নিজের আকৃতির দ্বারা পরের ভীতি উৎপাদন করে। অশ্ব চালকের প্রজ্ঞা বর্ধিত করে।’ –এখানে একবারের জন্যও ঘোটক বা কোনও ইতর জীবের ইঙ্গিত নেই, আছে কিছু গুণ বা বৈশিষ্ট্যের সংকলন। বাংলায় ‘অশ্ব’ শব্দের আরেকটি অর্থ পাওয়া যায়, -‘চার জাতি পুরুষের চতুর্থজাতি’[viii]! –অশ্ব তাহলে পুরুষ! কিন্তু, এ কেমন ‘পুরুষ’?

অশ্ব = অশ্ + ব। অর্থাৎ ‘অশ্’ বা প্রাপ্তি, উপভোগ, লাভ, ব্যাপ্তি, রাশীকরণ (রাশ করা, পুঞ্জীকরণ)[ix] ইত্যাদির ক্রিয়ার ‘বহনকারী’ (ব)। সহজ করে বললে, ‘অশ্ব’ বিশেষজ্ঞ ও উঁচু পদের কূটনীতিকগণ, -যারা বুদ্ধিবলে কুটিল প্রদেশসমূহে অনায়াসে যাতায়াত করে। সে তার কৃতকর্মের আকার (আকৃতি) দ্বারা পরের ভীতি উৎপাদন করে। পরামর্শের মাধ্যমে চালকের (রাজার) প্রজ্ঞা বর্ধিত করে। সংঘাত বা কূটনীতির মাধ্যমে পররাজ্য গ্রাস করে, স্বরাজ্যের রাজকোষে ধনসম্পদ পুঞ্জীভূত করে, রাজ্যের সীমা ব্যাপ্ত করে…। –এই প্রক্রিয়াকেই ‘অশ্বমেধ[x] যজ্ঞ’ বলে। (আর যেহেতু ঘোড়ার মধ্যেও আতিভোজন, চলনপটুতা, ইত্যাদি গুণ দেখা যায়, তাই সেই প্রাণীকেও ‘অশ্ব’ নাম দেওয়া হয়।)

এবার হাতির খোঁজ।… কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছিলেন, ‘দিগগজ তোমার কিঙ্কর স্নানে’। আবার এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির মৃত্যুর পর জনৈক উত্তর-ভারতীয়কে বলতে শুনেছি ‘শর্মাজী বহৎ বড়ে হস্তী থে’। কে বা কারা এই গজ আর হস্তী? – দিক থেকে দিগগজ। পুরাণ অনুসারে অষ্টদিগগজ হল অষ্টদিক রক্ষাকারী হস্তীগণ। পূর্ব্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈশান, বায়ু, নৈঋত ও অগ্নি –এই আটদিক রক্ষাকারী হস্তীরা হলেন ঐরাবত, পুণ্ডরীক, বামন, কুমুদ, অঞ্জন, পুষ্পদন্ত, সার্ব্বভৌম ও সুপ্রতীক। -এদের পরিচয় খুঁজে দেখা যাক।[xi]

দিকনাম তাৎপর্য হস্তীনাম হস্তীনামসমূহের অর্থ ও ক্রিয়াভিত্তিক ব্যাখ্যা
পূর্ব্ব যে স্থান/ কাল/ পাত্র থেকে বর্তমান স্থান/ কাল/ পাত্র উদ্ভূত হয়েছে।

(স্মর্তব্য: পূর্বদিক, পূর্বকাল, পূর্বপুরুষ)

ঐরাবত ‘ইরাবৎ’ হইতে জাত / উদ্ভূত। (ইরাবৎ থেকে ইরাবতী। ইরাবতী = জনধারা, জলধারা, পণ্যধারা।) ‘গণ-পতি’ বা ‘গণ-ইশে’র দেহে এর মস্তক বিদ্যমান। সর্দ্দার, মজুরদের দলপতি।
পশ্চিম যা পশ্চাতে বা পরে উদ্ভূত হয়েছে। অঞ্জন কাজল। সমুচিত বিদ্যাবুদ্ধির জনন (অঞ্জ) চলমান (অন) যাহাতে। দক্ষজ্ঞানী।
উত্তর উচ্চভাবের (উত্) তাড়ন (ত) রহে (র) যাহাতে। জবাব, শ্রেষ্ঠত্ব। সার্ব্বভৌম সর্ব্ব বা সর্ব ভূমি হইতে জাত। সর্ব্বভূমির অধিপতি। সম্পদ সৃজন ও বিতরণ করেন যিনি।
দক্ষিণ (জ্ঞান নয়,) ‘দক্ষ’তা সক্রিয় (ই) ভাবে ‘অন’ থাকে যেদিকে। সূর্য্য বা রাষ্ট্র-পুঁজির ‘মুখাপেক্ষি’ হলে যেদিকে অধিক মজুরী বা দক্ষিণা জোটে। বামন খর্বাকৃতি। প্রচলিত প্রথার বিপরীতে (বাম) যারা চলমান (অন)। নষ্ট বা অধঃপতিত ব্রাহ্মণ।
ঈশান উত্তর ও পূর্ব্বের তাৎপর্যদুটির সংযোগ স্থান/ কাল/ পাত্র। নিয়ন্তা। ঐশ্বর্যশীল। প্রভুত্বশীল। ঈশ্বর।

(ঈশ্বর = জ্ঞানী, স্বকার্যকরণক্ষম।)

সুপ্রতীক উত্তম / সাধু (সু) প্রতীক যাহার।

(প্রতীক = ‘প্রতি’ / সৃষ্টি / পদার্থকে সক্রিয়কারী। যে শব্দ, চিহ্ন, চিত্র, ইত্যাদি দ্বারা সৃষ্টজগৎকে মনোজগতে সক্রিয়/ চিহ্নিত করা হয়।)

বায়ু উত্তর ও পশ্চিমের তাৎপর্যদুটির সংযোগ স্থান/ কাল/ পাত্র। যে প্রবাহীত সত্তা প্রবাহপথের সংবাদ বহন করে। সংবাদমাধ্যম।

(‘বাতাস’ অর্থে বায়ু সংবাদ বহন করে গন্ধ, তাপ, গতি… -এর মাধ্যমে।)

পুষ্পদন্ত পুষ্পের ন্যায় দন্ত যার। বিদ্যাধর বিশেষ। জৈনধর্মের নবম তীর্থঙ্কর। তিনি ‘সুবিধিনাথ’ নামেও পরিচিত। একজন সিদ্ধ ও অরিহন্ত।

(দন্ত = দমনক্রিয়া তাড়িত যাতে। পুষ্প-শব্দটি পরে ব্যাখ্যা করা হবে।)

নৈঋত দক্ষিণ ও পশ্চিমের তাৎপর্যদুটির সংযোগ স্থান/ কাল/ পাত্র। ন্যায়সম্মত বা প্রচলিত রীতি রহে যেদিকে। কুমুদ পদ্ম। কু-তে (পৃথিবীতে) ‘মুদ’ যিনি। সীমালঙ্ঘনের মাধ্যমে নতুনের উদ্ভব করেন যিনি।
অগ্নি দক্ষিণ ও পূর্ব্বের তাৎপর্যদুটির সংযোগ স্থান/ কাল/ পাত্র। কর্মযজ্ঞে সর্বপ্রথমে যাকে প্রয়োজন। শক্তি। শ্রম। পুণ্ডরীক শ্বেতপদ্ম। নাগবিশেষ। √পুণ্ড্ + ঈক। ভোগ্যদ্রব্য প্রস্তুতকারীর (পুণ্ড্র)-এর অধিপতি।

হাতি তো দূরে থাক, তার লেজ-ও আর চোখে পড়ে না। বরং দেখা যাচ্ছে, এই ‘বড়ে হস্তী’-রা রীতিমত ‘মহা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’! আমাদের ছড়াটিতে তাহলে এই গণ্যমান্যরা রাষ্ট্রের কূটনৈতিকদের সাথে ‘নাচ’ করছিল! (যদিও এদের ওজন বুঝে ‘নাচ’ শব্দটি ব্যবহার করতে সঙ্কোচ হচ্ছে।)

কিন্তু, কেন? আর দক্ষিণদিকের রক্ষাকারী হস্তী যদি বামন হয়, তাহলে ‘বামন হয়ে চাঁদে হাত’ স্পর্ধার বিষয়-ই বা কেন? – জটিল প্রশ্ন। তার জন্য আগে ‘চাঁদ’কে জানা দরকার। তারও আগে, উত্তর-দক্ষিণের সংঘাতটা বোঝা যাক। অগত্যা, ‘পশুপতি’র স্মরণ ভিন্ন গতি নেই।

বঙ্গীয় শব্দকোষে ‘পশু’ শব্দের অর্থ হিসেবে সবার প্রথমে যা আছে তা ‘জীব-জন্তু’ নয়, ‘যে অবিশেষে দেখে’! ‘পশু’ সম্বোধন যে মোটেই তুচ্ছার্থে নয়, অশ্ব আর হস্তীর পরিচয়ে তা ইতিমধ্যে টের পাওয়া গিয়েছে। পশুদের আচার বা ‘পশ্বাচার’-এর অর্থ জানলে পশু-পরিচয় পাওয়া যায়। আচারভেদতন্ত্র অনুসারে বৈদিক আচারকেই পশ্বাচার বলে।[xii] মহানিৰ্ব্বাণতন্ত্র অনুসারে, -‘…ত্রিসন্ধ্যা জপ ও পূজা, নিৰ্ম্মল বস্ত্রপরিধান, বেদশাস্ত্রে দৃঢ় জ্ঞান, গুরু ও দেবতাতে ভক্তি, মন্ত্রে দৃঢ় বিশ্বাস, পিতৃ ও দেবপূজা, শুদ্ধি ও নিত্যকাৰ্য্য, ইত্যাদি আচার-কে পশ্বাচার বলে।’ -এগুলি আর যাই হোক, হাতি-ঘোড়া বা গরু-ছাগলের কম্ম নয়।

‘পশু’র সেই ‘অবিশেষে দেখা’-কে এবার বোঝার চেষ্টা করা যাক। -ঘরভর্তি ছাত্রের মধ্যে শুধু প্রথম স্থানাধিকারীকে বেছে নেওয়া হল ‘বিশেষ ভাবে দেখা’। আর প্রথম-দ্বিতীয়-অকৃতকার্যের মধ্যে ভেদ না রেখে, সকলকেই ছাত্র হিসেবে দেখা হল অবিশেষে দেখা। -এককথায়, সকলকে সমান দেখা। এই ‘সাম্যপন্থী’দের অধিপতি (পশু-পতি) ছিলেন জ্ঞানের শিখা (শি) বহনকারী (ব) বা জ্ঞানবাদী ‘শিব’-শ্রেণীর মানুষজন। শুরুতে এই দর্শন-ই ছিল সমাজের নিয়ম। তখন দক্ষতাপন্থীরা ছিল জ্ঞানপন্থীদের অনুগামী। কোনও ব্রাহ্মণের পক্ষে (উৎকৃষ্ট) জ্ঞান ছেড়ে (নিকৃষ্ট) দক্ষতার চর্চা করে মজুরী বা দক্ষিণা গ্রহণ ছিল ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিপরীত আচরণ। তাই তাকে বামন বলা হত। কিন্তু, একসময় (পুরাণ বর্ণিত দক্ষযজ্ঞের সময়) সামাজিক নিয়মগুলি পাল্টে গেল। এবার শিবতা-এর দিশার পরিবর্তে ‘দক্ষতা ও দক্ষিণা-নির্ভর’ দিশা কে ‘সঠিক’ বা ‘right’ (দক্ষিণ / ডান) বলা হল। পুরোনো দিশাটি হল ‘পরিত্যক্ত’ বা ‘left’ (বাম)। ‘জ্ঞানবাদী সাম্যতার পন্থা’ এক সময় পরিত্যক্ত হয়েছিল বলে তার নাম হয় ‘বামপন্থা’। আজও যে’কারণে (প্রতীক হিসেবে, হয়তো না বুঝেই) সমাজ বা সংসারের মধ্যে (মূলস্রোতে) থাকা মানুষ ‘দক্ষিণাকালী’র পুজো করে, ‘বামাকালী’র পুজো হয় সমাজের বাইরে।[xiii]

এই হস্তি বা গজগণের উত্থানপথ কি সম্পূর্ণ মসৃণ ছিল? –না। পুরাণ বা মহাভারত অনুসারে দীর্ঘদিন ধরে ‘গজ-কচ্ছপের দ্বন্দ্ব’ চলেছিল। এরা ছিল একই গোত্রের মুনি। এদের বিরোধের সূত্র হিসেবে কাশীদাসী মহাভারত বলে, ‘ধনের কারণে দোঁহে হইল বিচ্ছেদ’। গজ-এর পরিচয় আমরা পেয়েছি। কে এই কচ্হপ? –‘কচ্ছ’ কে পালনকারী (প)। কচ্ছ-এর অর্থ ‘সত্ত্বাকে (সাদৃশ্যে, কাছিম) বা সৃষ্টিশীল সত্ত্বাকে (সাদৃশ্যে, লিঙ্গ-যোনি) রক্ষাকারী। এককথায় সৃষ্টিকে বা সৃষ্টিশীলতাকে রক্ষাকারী জ্ঞান। বিদ্যাদেবী-স্বরূপা সরস্বতী নদীর মোহনা হল ‘কচ্ছ’। আবার কচ্ছপ শব্দের একটি অর্থ সরস্বতীর বীণা (‘সরস্বত্যাস্ত কচ্ছপী’ –বৈজয়ন্তী)। সে’যুগে জ্ঞান মানে বেদ, -যা জীবন ও সমাজকে চতুর্বেদ, চতুরাশ্রম, চতুর্বর্গ, চতুর্বর্ণ, ইত্যাদি ‘চতুর্পদে’ (পদ = পালন দানকারী) পর্যায়ভুক্ত করেছিল। এই ‘চতুর্পদ বিশিষ্ট রক্ষাকারী জ্ঞান’ (কচ্ছপ বা কূর্ম্ম) –কে ভিত্তি করে আদিতে ‘সমুদ্রমন্থন’ বা সামাজিক পুনর্গঠন/ পুনর্বিন্যাস করা হয়। (স্মর্তব্য: জনসমুদ্র, গণসমুদ্র ইত্যাদি শব্দে ‘সমুদ্রে’র ব্যবহার)।…

যাই হোক, ‘গজ-কচ্ছপের দ্বন্দ্ব’ বা সমাজের গণ্যমান্যদের সাথে বেদজ্ঞানীদের দ্বন্দ্ব অমিমাংসিত অবস্থাতেই তাদের ‘আইন রক্ষার গুরুভার বহনকারী সত্ত্বা’ বা ‘গরুড়’ গ্রাস করে নেয়। (গরুড়: গুরুং ভারং সমাসাদ্য উড্ডীনঃ।… কথিত আছে, ধর্মের বা আইনের অধঃপতন তথা অধর্মের বা অন্যায়ের অভ্যুত্থান হলে আইনব্যবস্থার বা ধর্মের পুনঃস্থাপন করতে ‘আইনব্যবস্থার ধ্বজাধারী’র বা ‘গরুড়ধ্বজে’র আবির্ভাব হয়।[xiv])

জ্ঞানচর্চা হ্রাস পেলে নিত্যনতুন আবিষ্কারের গতি রুদ্ধ হয় ঠিক, কিন্তু ক্রমাগত দক্ষতার চর্চার ফলে সমাজে উৎপাদনের পরিমাণ ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। আর প্রয়োজনের বাড়তি বা উৎবৃত্ত উৎপাদন পরিণত হয় পণ্যে। পণ্য হল ‘পুষ্প’। -নিরুক্তে যাকে বলা হয়েছে ‘যাজ্ঞ’ বা ‘যজ্ঞ (কর্মযজ্ঞ) হইতে জাত/ বিকশিত’। ফুল ফুটলে বা ‘পুষ্পের বিকাশ’ হলে বাতাস বা বায়ু গন্ধের মাধ্যমে তার সংবাদ এনে দেয় (‘অষ্টদিক ও অষ্টদিগগজ’ তালিকা-টি দেখুন), ঠিক যেমন আজও নতুন পণ্য এলেই সংবাদমাধ্যম তার খবর আনে। যে পুষ্প বা পণ্য সীমান্ত ‘পেরিয়ে’ যাওয়ার জন্য জন্মেছে (জাত) সেই ‘রপ্তানিযোগ্য পণ্যে’র নাম ‘পারিজাত’। উৎকৃষ্ট পণ্য বা পুষ্প মানুষের মনে পণ্যটির প্রতি ‘কামনার উদয়’ ঘটায়, তাই সে ‘কাম-উদিতি’ (যা বহু মুখ ঘুরে ইংরেজীতে ‘commodity’ হিসেবে থিতু হয়েছে।) পুষ্পের সাথে ‘কামনা’র সম্পর্ক আছে বলেই কামদেবের ধনুর নাম ‘পুষ্পধনু’। প্রাণীগর্ভে (উৎপন্ন) সন্তান যার মধ্যে থাকে সেই ‘placenta’ বা গর্ভপরিস্রবকে আজও গ্রামাঞ্চলে ‘ফুল’ বলা হয়। আর উদ্ভিদের নিজস্ব ‘কর্মযজ্ঞ থেকে জাত’ হয় তার ‘পুষ্প’।

যে কোনও পণ্য আবার জন্মসূত্রেই অন্য কোনও পণ্যের সঙ্গে শুধু তার আত্মারই নয়, শরীরেরও বিনিময় করতে প্রস্তুত, -তা সে অপর পণ্যটি উত্তম বা অধম, যা-ই হো’ক না কেন। পণ্যের এই বাস্তববোধের অভাব, পণ্যের মালিক তা পূরণ করে পণ্যের ‘মূল্য’ নির্ধারণের মাধ্যমে। পণ্যের (পুষ্পের) বিক্রয়মূল্য দ্বারা সম্পদ অর্জিত হয়। তাই সম্পদের দেবতা কুবের-এর রথের নাম ‘পুষ্পক’। ‘সোনামণির বে’ আসলে সোনা-মানিক ও নানাবিধ মূল্যবান বস্তুর বিণিময়ে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ ও বিক্রয়ের ‘বিবাহ’, মানে ‘সামাজিক চুক্তি রচনা’।

তাহলে বোঝা গেল, পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় শুরু হলে সমাজের গণ্যমান্যরা ও রাষ্ট্রের কূটনৈতিকগণ ‘তালবাদ্য অনুসারে (প্রয়োজনমত, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে) গাত্রনিক্ষেপ’ বা নৃত্য করছিল। এই কর্মের স্থান কদমতলা বা ‘কদম্ববৃক্ষে’র তল। প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে, ‘পদক্ষেপ’ অর্থে ‘কদম’ শব্দের বুৎপত্তি অন্য। এই নিবন্ধের ক্ষেত্রে তা অপ্রাঙ্গিক। ‘কদম্ববৃক্ষে’র কদম্ব-শব্দটিকে ভাঙলে পাওয়া যায় ‘√কদি + অম্ব (অম্বচ)’। ‘কদি’, অর্থাৎ ‘কদ’-এর সক্রিয়তা (ই)। ‘কু’ এর সাথে ‘অ’ যোগ করলে ‘কদ’ হয় (উদাহরণ: কু + অন্ন = কদন্ন)। ‘কদ্’ গুণের ধারক/ বাহক সত্তা তার দর্শকের কাছে হয় খুব ভাল অথবা খুব খারাপ, -দর্শকের গ্রহণযোগ্যতার সীমার বাইরে।

কিন্তু, ‘খুব’ কোনও আকার বা আকৃতি বাচক শব্দ নয়। অঙ্কের ভাষায়, তার বিস্তার ভাল-এর দিকে ধনাত্মক অনন্তরাশি বা খারাপের দিকে ঋণাত্বক অনন্তরাশি অবধি। (অনন্তরাশিকে হিন্দুগণিত দর্শনে ‘খহর’ বা ‘শূন্য হর’ বলে। খ = মহাশূন্য, আকাশ) এক কথায়, সে ভাল বা খারাপ -কোনও একটি দিকে অসীম। -এ আবার কেমন কথা! কোনও বাস্তব সত্তার তো এমন অসীমতা থাকতে পারে না। বিষয়টিকে রেখাচিত্রের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করা যাক,-

(চিত্র: ০১)

এবার ‘অম্ব’-এর পালা। অসীম আকাশের যতটুকু অংশ আমাদের চোখে বা বোধে ধরা পরে, তাকে ‘অম্ব-র’ বলে। এর অর্থ, অস্তিত্বন (অ) –এর সীমায়ন (ম্) কে বহন (ব) করে যে/ যা। তার মানে, ‘কদ’-তে অসীমতার আভাস থাকলেও ‘অম্বে’র কারণে সেই সেই দশা ঘুচল। গ্রহণযোগ্যতার সীমার বাইরে হলেও ‘কদম্ব’ একটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকার। উদ্ভিদ কদমগাছ বা কদম্ববৃক্ষের ফুল (পুষ্প!) পুজোয় লাগে না বা ‘গ্রহণযোগ্যতার বাইরে’। আর সামাজিক কদমগাছ এমন একটি ব্যবস্থা, যার উৎপাদন সেই সমাজের গ্রহণযোগ্যতার বাইরে। আজকের ভাষায়, যে ব্যবস্থার উৎপাদন সে’ দেশের মানুষের জন্য নয়, রপ্তানির জন্য।[xv] (স্মর্তব্য: কাহিনী অনুযায়ী, সমসাময়িক সমাজে অগ্রহণীয়, অকাম্য ও নিন্দিত রাধা-কৃষ্ণের ‘রাসলীলা’র জন্য কদমতলাকে বেছে নিতে হয়েছিল।) অনুমান করা যায়, একসময় সমাজের বিত্তবানরা রপ্তানিমানের মহার্ঘ পণ্য বা ‘কদম্ববৃক্ষের পুষ্প’ ক্রয় ও প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজেদের প্রাচুর্য বা আভিজাত্য জাহির করত। -সম্ভবতঃ, এই প্রথা থেকে, পুজোয় না লাগলেও, মণ্ডপসজ্জায় বা ক্ষেত্রবিশেষে অঙ্গসজ্জায় ‘কদমফুল’ ব্যবহারের রীতির সূত্রপাত।

কিছু আগে দর্শনকে ‘অংকের ভাষা’য় বা ‘রেখাচিত্রের মাধ্যমে’ প্রকাশ করার যে চেষ্টা করা হয়েছে, -একনজরে তা অদ্ভুত ঠেকতেই পারে। কিন্তু, mathematics–এর ছাত্র মাত্রে জানে -বিষয়টি আদ্যোপান্ত philosophy বা দর্শন।[xvi] mathematics–এর গণনা-সংক্রান্ত অংশের নাম ‘গণিত’ ও তার দর্শন বা philosophy হল ‘অংক’। ‘অং’ থেকে অংক। সেই ‘অং’ থেকেই ‘অংরূপীনি’ অর্থাৎ, ‘যে রূপ অতিসূক্ষ্ম ও রহস্যময়’।  ‘অ’-এর ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ ‘অস্তিত্বন্’ ও ‘ং’-এর ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ ‘রহস্যময়তা’। ‘ং’-কে দেবনগরী হরফে লেখা হয় ‘বিন্দু’র মাধ্যমে (উদাহরণ: অহংকার → अहंकार)। এই ‘বিন্দু’ অংকের ভাষায়, ‘দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতাহীন রহস্যময় অস্তিত্ব’। স্মর্তব্য: ‘অংরূপীনি’-র আরেক নাম ‘বিন্দুবাসিনী’।

‘ং’ ছাড়াও ঙ, ঞ, ণ, ন ও ম –কে (বর্ণগুলির সংশ্লিষ্ট বর্গের অন্য কোনও বর্ণের সাথে যুক্ত হলে) দেবনগরী লিপিতে ‘বিন্দু’র মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। উদাহরণ: সঙ্ঘ → संघ, রঞ্জন → रंजन, অণ্ড → अंड, সন্ত → संत, সম্ভব → संभव, ইত্যাদি। ঙ, ঞ, ণ, ন ও ম ধ্বনিগুলিরও ক্রিয়াভিত্তিক অর্থে রহস্যময়তা বিদ্যমান। ঙ = কারীরহস্য, ঞ = চয়নরহস্য, ণ = টঙ্কাররহস্য, ন = নাকরণ-অনাকরণ রহস্য ও ম = সীমায়ন রহস্য। তাই ‘অংক’ শব্দের যে বিকল্প বানানবিধি ‘অঙ্ক’, -সেখানেও তার রহস্যময়তা বা দর্শন উবে যায় না। – এ তো গেল অংকের দর্শন। আর দর্শনের অংক? -সেই কারণেই দর্শনের চিরাচরিত আধার, -কাব্য, নাট্য, উপন্যাস, ইত্যদি হামেশাই প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়… ‘অংকে’ ‘বিভক্ত’ বা ‘বিভাজিত’ হয়।

প্রসঙ্গে ফিরে আসি, রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় শুরু হলে সমাজের গণ্যমান্যরা এবং রাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ ও কূটনৈতিকগণ এই প্রক্রিয়ার তাল তাল মেলাচ্ছিল। কিন্তু, তার সাথে ‘চাঁদ ওঠা’র কী সম্পর্ক? -এই চাঁদ খুঁজতে আকাশে নয়, ‘মহাকাব্যিক’ ইতিহাসে যেতে হবে।…

শুরুতে গোষ্ঠীবদ্ধ জীব মানুষের যাবতীয় উৎপাদন ছিল সামাজিক সম্পত্তি। দক্ষতা বৃদ্ধির সাথেসাথে উৎপাদন বাড়তে থাকে। পাশাপাশি, বিনিময় প্রক্রিয়ার পরিবর্তে কেনা-বেচা চালু হয়। এর ফলে সৃষ্টি হয় উদ্বৃত্ত ধনসম্পদ। আদি মুদ্রা ছিল গরু, তাই তাকে বলা হত গো-ধন। পরে মুদ্রা হিসেবে সোনা, রূপা, তামা, কড়ি, প্রভৃতি ব্যবহার হতে থাকে। ধনসম্পদ যে’ রূপেই থাকুক না কেন, তার মালিক ছিল সমাজ, কোনও ব্যক্তি নয়। সকলের তাতে সমান অধিকার। ততদিনে রাষ্ট্র-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ায় সামাজিক ধনসম্পদ পরিণত হল রাষ্ট্রীয় ধনসম্পদে। বর্ণাশ্রম প্রথা চালু হল, -গোড়াতে তা ছিল কাজ-ভিত্তিক, জন্ম-ভিত্তিক নয়। তখন মানুষ তার কাজ অনুসারে সেই ধনসম্পদের অধিকার পেত, (মালিকানা নয়)। তখন ব্যক্তি-মালিকানা বিষয়টি লুকিয়ে চুরিয়ে লালিত হতে শুরু করলেও সমাজ তাকে ‘দুর্গন্ধ’ হিসেবে দেখত। কিন্তু ধীরে ধীরে তা ‘সুগন্ধে’র মর্যাদা পেতে শুরু করে।[xvii]

পুলস্ত গোত্রের মানুষদের দায়িত্ব ছিল সামাজিক ধনসম্পদ রক্ষা ও সমৃদ্ধ করার। ‘রক্ষামঃ ইতি যরুক্তম রাক্ষসাস্তে ভবন্তু বঃ। যক্ষামঃ ইতি যরুক্তম যক্ষা এব ভবন্তুবঃ।।’ (বাল্মীকি রামায়ণ, উত্তরকাণ্ড, চতুর্থ সর্গ।) কিন্তু, সমৃদ্ধকারী বা যক্ষরা (যক্ষরাজ = কুবের) সম্পদের সামাজিক কল্যাণকারীতা ভুলে শুধু ব্যক্তিগত ভোগের জন্য সম্পদ বাড়িয়ে চলে। (‘যখের ধন’ কথাটির উৎপত্তি সেখান থেকে।) এদিকে রক্ষাকারীরা (রক্ষরাজ = রাবণ) রক্ষিত ধন নিজেই খেয়ে ফেললে, অর্থাৎ ‘রক্ষক-ই ভক্ষক হয়ে’ পড়লে, তাকে ‘নি-ধন’ করার প্রয়োজন হয়।

রামায়ণের আদি নাম ‘পৌলস্ত্য-বধ কাব্য’। এই মহাকাব্যে ‘লাঙ্গলের ফলায় যার জন্ম’[xviii] –সেই ‘কৃষি-উৎপাদন’কে হরণ করে ‘রাবণ’ নামের সত্তা। যাকে বধ করার পর ‘রাম’ নামক সত্তা বলছেন, -‘তোমাকে উদ্ধারের কারণ ও উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। তোমাতে আমার আর কোনও আসক্তি নেই। যেখানে ইচ্ছা যাও। চাইলে লক্ষ্মণ বা ভরত –যাকে পেলে তোমার সুখ, তাকে বরণ কোরো।’[xix] এই উক্তি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, রাবণবধের উদ্দেশ্য পত্নিপ্রেম –এই ধারণাটি প্রতীকী।

রক্ষরাজের প্রসঙ্গ যখন এল-ই, তখন বলে রাখা ভাল ‘রাক্ষস’ আর ‘অসুর’ কিন্তু এক নয়। তাই বলে সাম্যপন্থী ‘অসুর’কে আবার ‘দৈত্য-দানব’ বুঝে বসলে, ‘লৌকিক ইতিহাস’ পরিণত হয় ‘অলৌকিক কাহিনী’তে।… ‘অসুর’ শব্দের অর্থের সন্ধানে ‘নিরুক্ত’ সহ বিভিন্ন শাস্ত্র খুঁড়ে যা পাওয়া যায়, তা হল –‘যার মধ্যে প্রাণশক্তির প্রাচুর্য’, ‘যে সুর মানে না’, ‘যে ইন্দ্রবিরোধী’, ‘যে সর্বদা অস্থির’, ‘ইন্দ্রের দ্বারা বিতাড়িত’, ইত্যাদি। এরা সেই আদি সাম্যবাদী, যারা অবশ্যই প্রাণশক্তিতে ভরপুর, কেনাবেচা-নির্ভর সমাজের ‘সুর’ মানে না, মালিকানার (প্রভুত্বের) বিরোধী। কোনও তরল যেমন তার ‘সাম্যপন্থা’ (সমোচ্চশীলতা) রক্ষার জন্য সবসময় গতিশীল, এরাও সামাজিক সাম্য বজায় রাখতে সদা অস্থির। স্বাভাবিক ভাবেই তারা ‘মালিকানায় বিশ্বাসী প্রভু’ বা ‘ইন্দ্রে’র দ্বারা বিতাড়িত। তারা বারবার প্রভুত্বের ‘স্বর্গে’ আঘাত হানতে যায়। মজার কথা হল, ঋগ্বেদের দ্বিতীয় থেকে সপ্তম মণ্ডলে প্রায় ত্রিশ বার অগ্নি, রুদ্র, মিত্র-বরুণ, বায়ু, প্রমুখকে অসুর বলা হয়েছে! অসুরদের শ্রদ্ধা-ও প্রদর্শন করা হচ্ছে।[xx] ষষ্ঠ অধ্যায় থেকে শুরু হয়েছে ইন্দ্র-অসুর বিরোধের কথা। প্রভুত্ববাদীদের সাথে এই লড়াই-এ অসুরগণ হেরে যায়। ফলে যুদ্ধজয়ীর কাছে যেমন পরাজিত মাত্রেই ‘বর্বর’, তেমনই তারা ‘বর্বর, নৃশংস, ভয়ঙ্কর’ –জাতীয় ইতিহাসকারের ‘blasphemy’-এর শিকার। সম্ভবতঃ, গুপ্তযুগে রচিত ‘অমরকোষ’-টিকায় ‘অসুরে’র অর্থ হিসেবে সর্বপ্রথম দেব-বিরোধী[xxi], দৈত্য, দানব, দনুজ, দৈতেয় -শব্দগুলি লিপিবদ্ধ হয়। প্রশ্ন হল, ‘অসুর’গণ ‘অ-সুর’ কেন?

‘সুর’ বলতেই মাথায় আসে ‘সপ্তসুরে’র কথা। সেই সপ্তসুরকে ‘সা-গা-মা-পা-ধা-নি’র মাধ্যমেই কেন প্রকাশ করা হয়, ‘ঘা-টে-চ-লে-ধো-পা-নী’ বা ‘বো-মা-ফে-লে-জা-পা-নী’ বা অন্য কোনও ধাঁচে নয় কেন? –এই সপ্তসুরের স্বরূপ নীচে দেওয়া হল।–

(চিত্র: ০২)

আরও কিছুটা গভীরে যাওয়া যাক[xxii];-

সূত্র প্রচলিত অর্থ সংশ্লিষ্ট সত্তা সত্তা-নামের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ / সত্তা-নামের তাৎপর্য সামাজিক অর্থ (সত্তার গুণধারী মানুষ)
ষড়জ ময়ূরের ডাক ময়ূর সর্প-দের {‘সর’ বা ধনসম্পদ (‘cream’ of society) পালন/ পান (প)-কারীদের} শত্রু। দেবসেনাপতির বাহন। সুসজ্জিত সেনাবাহিনী।
ঋষভ ষাঁড়ের ডাক বৃষ/ ষণ্ড বৃষ = বীজ বা সৃজনশীলতা বর্ষণকারী। ষণ্ড = সৃজনশীলতা থাকলেও যে অলস। (বলদের মতো খাটতে চায় না।) আবিষ্কারক, উদ্ভাবক, সৃষ্টিশীল সত্তা।
গান্ধার ছাগলের ডাক অজ যে সত্তার সৃজনশীলতা বা ‘জনন’ নেই, শুধু পুনরুৎপাদনের দক্ষতা আছে। দক্ষ। অধঃপতিত শিব বা শংকর। পণ্য উৎপাদনকারী দক্ষগণ (experts)।
মধ্যম বকের ডাক ক্রৌঞ্চ যে সত্তা কর্মফল চয়ন করে। ধনলোভী জ্ঞানবাদী/ ব্রাহ্মণ।
পঞ্চম কোকিলের ডাক পিক যে সৃষ্টি করলেও (ডিম দিলেও) পূর্ণতা দান করে না। (পূর্ণপাচিত নয়, অর্ধপাচিত পানের রস।) কাঁচামাল প্রস্তুতকারী।
ধৈবত ঘোড়ার ডাক অশ্ব ‘অশ’ (প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জ্ঞানসার) বহনকারী। নানাবিধ বিশেষজ্ঞ ও কূটনৈতিকগণ।
নিষাদ হাতির ডাক হস্তী যারা তাদের বিশাল ও নিপুণ ‘হস্ত’ দিয়ে সমাজের বিভিন্ন দিক রক্ষা করে। নানাবিধ গণ্যমান্যগণ।

কল্কিপুরাণ অনুযায়ী ধর্মের রথের সাতটি অশ্বের নাম ষড়জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ। এখানে ধর্ম শব্দটি ‘রিলিজিয়ন’ অর্থে নয়, সামাজিক নিয়ম বা আইন-শৃঙ্খলা অর্থে। স্মর্তব্য: আজও বিচারককে ‘ধর্মাবতার’ সম্বোধন করা হয়। ‘আইন’-এর ফারসি প্রতিশব্দ ‘কানুন’। মজার কথা, ‘কানুন’ শব্দের আরেকটি অর্থ বীণা-জাতীয় একপ্রকার সুরযন্ত্র![xxiii] ‘সা’ থেকে ‘নি’ স্বর ক্রমশঃ চড়ার দিকে যায়। অর্থাৎ, ‘সুর’ হল এমন এক ‘আইন ব্যবস্থা’, -যেখানে সেনাবাহিনীর ‘গলার জোর’ সবচেয়ে কম। আবিষ্কারক বা উদ্ভাবকদের চেয়ে দক্ষদের স্বর বেশি ‘চড়া’। তার চেয়েও চড়া স্বর ধনলোভী জ্ঞানবাদী আর কাঁচামাল প্রস্তুতকারীদের। আর সবচেয়ে চড়া স্বর বিশেষজ্ঞ-কূটনৈতিক ও নানাবিধ গণ্যমান্যদের।

–এ যেন এক পণ্যবাদী সমাজের আদর্শ চিত্র! এই সমাজ ছিল ‘দেবতা’দের অনুকূল। তবে, বৈদিক দেবতা ও পৌরাণিক দেবতা কিন্তু এক নয়। বেদের প্রধান দেবতারা হলেন ইন্দ্র, বরুন, অগ্নি, সূর্য্য, রুদ্র, মিত্র-বরুণ, বায়ু, ইত্যাদি। ‘সোম’ নামক এক দেবতার উল্লেখ পাওয়া গেলেও সে চন্দ্রদেবতা নয়। চন্দ্র পৌরাণিক দেবতা।… বেশ, তাহলে ‘অ-সুর’ কারা? তারা থাকতই বা কোথায়? -উত্তর খোঁজার পথে ভারতবর্ষের সামাজিক ক্রমবিকাশের অধ্যায়গুলি বোঝা দরকার;-

(চিত্র: ০৩)

এবার স্মরণ করা যাক, -পারস্যের সম্রাট দারায়ুসের সমাধির কথাগুলি, ‘একজন পারসীক, একজন পারসীকের পুত্র, একজন আর্য্য, আর্য্যবংশোদ্ভূত’। এই দারায়ুস তথা আদি পারসীকদের ধর্মের নাম ‘মাজদা য়াস্ন/ য়স্ন’, -যে ধর্মের প্রচারক ছিলেন জরাথুষ্ট্র। জরাথুষ্ট্রের গোত্রের নাম ‘স্পিতামা’। আবার অথর্ববেদের ভার্গব সংহিতা অনুসারে অসুর-গুরু শুক্রাচার্যের গোত্র-ও স্পিতামা!

ঋগ্বেদের বিভিন্ন সূত্রে ‘প্রভুত্বকারী’ বা ‘ইন্দ্র’ নামক সত্তার সাথে ‘পার্শব’ নামক এক জনগোষ্ঠীর মতবিরোধ, যুদ্ধ, ইত্যাদির উল্লেখ আছে। সম্ভবতঃ, বৈদিক যুগের শেষদিকে এই পার্শবরা একসময় নিজের মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়। এই পার্শবগণই আদি পারসীক। তাদের ধর্মগ্রন্থের নাম ‘আবেস্তা’ বা ‘আর্য্যদের স্থান’। আবেস্তা অনুযায়ী তাদের জন্মস্থানের নাম ‘হপ্তহিন্দু’ (সপ্তসিন্ধু বা উত্তর ভারত)[xxiv]। ইন্দ্রকে তারা শয়তান বলে (আবেস্তা, ১০/৯)। আবেস্তায় সমস্ত কর্মের দুটি চালিকা শক্তির নির্দেশ পাওয়া যায়, -‘আহুর মাজদা’ (শুভ শক্তি) ও ‘অঙ্গর মইন্যু’ (অশুভ শক্তি)। আবেস্তা ও বেদ, দুটি পৃথক ভাষায় রচিত হলেও এই ভাষাদুটির উৎস এক। যে’কারণে এই দুটি ভাষার অজস্র শব্দে ধ্বনিগত বা ‘ফোনেটিক’ সাদৃশ্য দেখা যায়। আবেস্তার ‘আহুর’ ও ‘অঙ্গর মইন্যু’ -ঋগ্বেদের ‘অসুর’ ও ‘অঙ্গিরা মুনি’। অঙ্গিরা মুনি নামক সত্তা ছিলেন দেবপূজারীদের গুরু, স্বভাবতই তার/ তাদের আদর্শ পার্শবদের কাছে ছিল অগ্রহণীয়।

সুতরাং, শুভ-অশুভের বিচারে আবেস্তা ও ঋগ্বেদের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। এই বৈপরীত্যের কারণ কী? –কথিত আছে, ইন্দ্র ও তার অনুগামীরা ছিলেন ‘সমাজভূমির উর্বরতা বৃদ্ধির’ জন্য পশুবলি বা পশুমেধ-এর পক্ষে, পার্শব বা আদি পারসীকরা ছিলেন এই প্রথার বিপক্ষে। কিন্তু এই সামান্য কারণে এত বিশাল এক জনগোষ্ঠী নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করতে পারে? –এই নিবন্ধে আলোচিত ‘অশ্ব’, ‘হস্তী’, ‘অজ’, ‘বৃষ’… ও ‘মেধ’ শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থগুলি বিবেচনা করলেই বোঝা যায় এই বিরোধের মূল কারণ পশুহত্যা নয়, সমাজের সামগ্রিক রীতিনীতি।

পরশুপুরী (পেশোয়ার), মাদ্র (মিডিয়া), পৃথু (পার্থিয়া), কুরুশ্রাভন (খোরাসান), বল্হীক (বল্‌খ), পারস্য (ইরান) ইত্যদি স্থানে পার্শবেরা ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু শুধু পার্শবগণ একমাত্র ‘অ-সুর’? -পুরাণ অনুসারে অসুররাজ বলির পাঁচ পুত্রের নাম অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুহ্ম। তাদের নামেই তাদের দেশের নামকরণ হয়। অঙ্গ মানে পূর্ব বিহার, বঙ্গ মানে দক্ষিণ বাংলা, কলিঙ্গ মানে উড়িষ্যা, পুণ্ড্র মানে উত্তর বাংলা ও সুহ্ম হল দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা। ইন্দ্র-বিরোধীদের একদল চলে গিয়েছিল আর্য্যাবর্ত্তের পশ্চিমে আর আরেকদল গিয়েছিল পূর্বে। একদিকে জরাথুস্ট্রীয় ধর্মের উত্থান হলে অন্যদিক তন্ত্রসাধনার পীঠস্থান হয়ে ওঠে।

দেবতা মানেই ‘শুভ’ আর অসুর মানেই ‘অশুভ’ –এই পূর্বকল্পিত ধারণা ছেড়ে প্রাচীন ভারতীয় রচনাগুলিতে উঁকি দিলে দেখা যায় যে, শুভ-অশুভের সমীকরণ মোটেই একরৈখিক নয়। যেমন, গুরুপত্নীর সাথে লিপ্ত হওয়া ‘গুরুতল্প’ পাপ। -কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এর শাস্তি সর্বাধিক। মোটামুটি দ্বিতীয় নিকৃষ্টতম পাপ ‘ব্রহ্মহত্যা’। -কাহিনী অনুসারে ইন্দ্র এই দুই পাপেই দুষ্ট। -অহল্যার আখ্যান ও ধ্যানমগ্ন বিশ্বরূপের (বিশ্বকর্মার পুত্র) হত্যার কাহিনী স্মরণীয়। অন্যের তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য স্বর্গবেশ্যাদের নিয়োগ করার উদাহরণ-ও ইন্দ্রের কম নয়। অন্যদিকে প্রহ্লাদ, বলি, প্রমুখ অসুরের ধর্মপরায়ণতা বিখ্যাত। তারকাসুরের তিন পুত্র বা মহিষাসুরের তপস্যাও স্মরণীয়।…

ঋগ্বেদে কয়েকশো (হাজার-ও হতে পারে) বার প্রভুত্বকারী বা ইন্দ্র-সত্তার সোমরস-প্রেমের কথা বা তাকে সোমরস উৎসর্গ করার নির্দেশ পাওয়া যায়। (‘সোম’ শব্দের একটি অর্থ ‘চন্দ্র’) সোমরস মাদকতা আনে। প্রভুত্বকারীর মাদকতা কিসে হয়? –প্রভুত্বে বা ব্যক্তিমালিকানায়। (জরাথুস্ট্রীয়রা ‘হাওমা’ বা সোম-পানের বিরোধী।) বেদে ‘সোম’ সোমরস। কিন্তু, বাণিজ্যতন্ত্রের যুগে ব্যক্তিমালিকানা ও ব্যক্তিপুঁজির বিকাশের সাথে সাথে এই সোম ‘চন্দ্রদেবতা’ হিসেবে উল্লেখিত হতে থাকেন। চন্দ্রের ষোলটি কলা। দেখা যাক কী কী[xxv];-

কলা কলা-নামের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ / তাৎপর্য
অমৃতা অমরত্ব দানকারী ‘অমৃতে’র ‘আধার’ (আ)। যজ্ঞশেষের পুরোডাশাদি (মনুসংহিতা), ধন, ঘৃত, অন্ন, বিষমাত্র, সুরা, অতিবিষ, ইত্যাদি। (বণিকের নাম ‘অমরত্ব’ পায় তার পণ্য, সম্পদ ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।)
মানদা মান দান করে যা/ যে। কৌলীন্য, পরিমাপ, গোঁসা/ গুমোর, ইত্যাদি দান করে যা/ যে।
পূষা ‘পূষ’-এর (প্রদানকারীর দিশাগ্রস্ত শক্তির) আধার (আ)। (‘পূষ’ থেকে আধুনিক ‘পোষা’) ধনসম্পদ বা জ্ঞানসম্পদের কেন্দ্র।
তুষ্টি সন্তোষ বা প্রীতির সক্রিয়তা (ই) যা’তে।
পুষ্টি সম্পূর্ণতা, সন্তুষ্টি, পূর্ণতা, ইত্যাদির সক্রিয়তা (ই) যা’তে।
রতি রত + ই (সক্রিয়ন)। কর্মে নিযুক্ত/ লিপ্ত/ অর্পিত (invested) বা ‘রত’ হওয়া। (স্মর্তব্য: আরতি, বিরতি, অবিরত, কর্মরত, ইত্যাদি শব্দগুলি।)
ধৃতি সুখ, আশ্রয়, শরণ, ব্যভিচারভাব বিশেষ। মানসিকতার বন্দিত্বের (ধৃত) সক্রিয়তা (ই) যা’তে।
শশিনী ‘শশ-গুণ’ বা দ্রুত/ আকস্মিক/ (লাফিয়ে লাফিয়ে) আকার বৃদ্ধির/ হ্রাসের গুণ সক্রিয় যা’তে। (‘শশক বা খরগোসের চিহ্ন বুকে ধারণ করে বলে চাঁদের আরেক নাম শশধর’, -এই জোর করে মিলিয়ে দেওয়া ব্যাখ্যাটি আধুনিক যুগের সংযোজন। চাঁদের পিঠে আলো-ছায়ার খেলাকে শুধু খরগোস কেন, আরও অনেক কিছুর-ই আবয়ব হিসেবে কল্পনা করা যায়। আশৈশব ‘চাঁদের বুড়ি’র গল্প শোনানোর পর, একমাত্র এই ‘শশধর’ শব্দটির ন্যায্যতা ‘প্রমাণ’ করার সময় সেই বুড়ি হঠাৎ খরগোসে পরিণত হয়!)
চন্দ্রিকা আনন্দদায়িনী, বিশদব্যাখ্যা, ইত্যাদি।
কান্তি ‘কান্ত’ (কাম তাড়িত হয় যা’তে বা যা’কে সবাই কামনা করে) –এর সক্রিয়তা (ই) যা’তে।
জ্যোৎস্না জ্যোতির্যুক্ত কাল। নিজস্ব নয়, ‘-জনিত’ বা প্রতিফলিত আলো।
শ্রী অভ্যুদয়, বৃদ্ধি, উদয়, ঐশ্বর্য্য, প্রভুভাব, অধিকার, ইত্যাদির প্রকাশ।
প্রীতি তৃপ্তি, আমোদ, প্রেমভাব, ইত্যাদির প্রকাশ।
অক্ষদা ‘অক্ষ’ দান করে যা/ যে। অক্ষ = যা ব্যাপ্ত করে।
পূর্ণা ‘পূর্ণ’ (আরক্তি, সামগ্রিকতা, আকর্ষণ, ইত্যাদি) -এর আধার (আ)।
পূর্ণামৃতা পূর্ণ + অমৃতা, বা ‘অমৃতা’-কলার পূর্ণ রূপ/ ভাব।

একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, চন্দ্রের ষোলটি কলা ব্যক্তি-পুঁজির বিভিন্ন গুণ বা বৈশিষ্ট-বাচক। উৎসব-অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে মধ্যবিত্তের আতঙ্ক উদ্রেককারী শব্দ ‘চাঁদা’-র দিকে খেয়াল করলেই ব্যক্তি-পুঁজির সাথে ‘চাঁদে’র সম্পর্ক হাড়ে-হাড়ে টের পাওয়া যায়! বহুক্ষেত্রেই এই অনুষ্ঠানগুলি সম্পন্ন করা হয় ‘চন্দ্রাতপ’ বা ‘চাঁদোয়া’র তলায়। পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদের আতপ বা রৌদ্র থাকে না। এই প্রথার তাৎপর্য হল –ব্যক্তি পুঁজির ছত্রছায়ায় অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা। যাই হোক, আদিতে এই ব্যক্তি-পুঁজির কারবারীরা নিজের নামে ‘চাঁদ’ বা ‘চন্দ্র’ শব্দগুলি প্রয়োগ করত।[xxvi] (স্মর্তব্য: ‘চাঁদ সদাগর’ নামটি।) ‘প্রচলিত প্রথার বিপরীতে চললে’ বা ‘বামন’ হলে ব্যক্তি-পুঁজির বা বণিক-পুঁজির নাগাল পাওয়া যায় না।

কিন্তু প্রশ্ন হল, ব্যক্তি পুঁজিকেই বণিক পুঁজি বলা হচ্ছে কেন? –পুঁজির উৎসের কারণে। বিক্রয়যোগ্য বিষয়টি ‘পণ্য’ই হোক কি ‘শ্রম’ অথবা ‘মেধা’, পুঁজি উপার্জনের সময় কোনও না কোনও রূপে যে কর্মটি সম্পাদন হচ্ছে তা হল বাণিজ্য। এমনকি আজও যার শ্রম আছে -সে শ্রম বিক্রি করে, যার মেধা আছে -সে বিক্রি করে মেধা আর বাকিরা বিক্রি করে এই দুই পক্ষের শ্রম ও মেধার প্রয়োগে উৎপাদিত পণ্য।

চন্দ্র যেমন ব্যক্তি-পুঁজির প্রতীক, তেমনই সূর্য্য রাষ্ট্রীয় পুঁজির প্রতীক। পতাকায়, মুদ্রায় বা বিভিন্ন প্রাসাদে রাষ্ট্রের প্রতীক হিসেবে ‘সূর্য্যে’র ব্যবহার অতীতে তো বটেই, আজও দেখা যায়। পুরাণ ও মহাকাব্যদ্বয় অনুসারে প্রথমে সূর্য্যবংশের (ইক্ষ্বাকু) রাজত্ব ছিল, পরে চন্দ্রবংশের (যাদব ও কুরুবংশ)। অর্থাৎ, আদি ভারতবর্ষে প্রথমে ‘পরিকল্পিত-অর্থনীতি’ (Planned Economy) –জাতীয় কোনও ব্যবস্থা চালু ছিল, কিন্ত, পরবর্তিকালে ‘বাজার-অর্থনীতি’ (Market Economy) –জাতীয় ব্যবস্থা চালু হয়।

মহাভারত অনুসারে রামচন্দ্রের (সূর্য্যবংশ) ঊনত্রিশতম পুরুষ বৃহদ্বল কৌরবপক্ষে যোগ দেয় এবং যুদ্ধে তাকে ‘নি-ধন’ করা হয়। -এর তাৎপর্য হল, রাষ্ট্রের পুঁজি একসময় বাজার-অর্থনীতিতে প্রবেশ করলে তা ‘নি-ধন’ বা ধনহীন হয়ে পড়ে। এদেশের প্রাচীন অর্থনীতিতে ব্যক্তি/ বণিক-পুঁজির রমরমা ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। বৌদ্ধযুগে শ্রেষ্ঠী-শ্রেণীর উত্থানের মাধ্যমে তা চরমে ওঠে। বৌদ্ধযুগের পতনের পর পুরোহিততন্ত্রের কালে হিন্দুযুগের প্রতিষ্ঠার সময় সেই রমরমা কমে যায়। বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রা বা ‘কালাপানি’ ধর্মীয় ভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, মধ্যযুগে শুরু হওয়া বৈষ্ণব আন্দোলনকে গোঁড়া হিন্দুরা মোটেই ভাল চোখে নেয় নি। ঘটনাচক্রে, সংখ্যাগুরু বৈষ্ণবদের জীবিকা ছিল বাণিজ্য।

আমাদের ছড়াটি তাহলে বণিক বা ব্যক্তি পুঁজির ছত্রছায়ায়, বিশেষজ্ঞ-কূটনৈতিক ও নানাবিধ গণ্যমান্যদের পৌরহিত্যে রপ্তানি বা বৈদেশিক বাণিজ্যের ‘গৌরবগাথা’।  কিন্তু, এই ছড়াটির আরও দুটি পাঠান্তর পাওয়া যায়। -যেখানে ‘সোনামণির বে’ শব্দবন্ধটির পরিবর্তে একটি ক্ষেত্রে ‘খেঁকশিয়ালের বিয়ে’, ও আরেক ক্ষেত্রে ‘ঘোমটা তুলে দে’ শব্দবন্ধগুলি দেখা যায়। -কেন?

শেয়াল/ শিয়াল/ শৃগাল অপরের শিকার বা পরিশ্রম লব্ধ ফল চুরি করতে অভ্যস্ত। স্বভাববশতঃ, সে ‘চাঁদ উঠলে’ (ব্যক্তি/ বণিক পুঁজির উদয় হলে) হাঁকডাক শুরু করে। এছাড়া ‘শৃগাল’ শব্দটি চিরকাল-ই ধূর্ততার সাথে সম্পর্কিত। লৌকিক ছড়া লৌকিক ইতিহাসের গাথা, লোকমুখেই তার সৃষ্টি, লোকমুখেই তার প্রচার। লোকজীবনের কোনও রকম উত্থান-পতন, ধারা বদল লোকচক্ষুর অম্তরালে থাকে না। বেদবিরোধী বাণিজ্যিক সমাজতন্ত্রে বাণিজ্যকর্মে ধূর্ততার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। ফলে বাণিজ্যের চিত্র ও চরিত্র, দুই-ই বদলাতে শুরু করে। -এই পালাবদলের ছায়া দেখতে পাওয়া যায় ছড়াটির এই বয়ানে।

আর ‘ঘোমটা তুলে দেওয়া’, অর্থাৎ ‘সব আড়াল চুকে যাওয়া’ বা ‘দৈহিক/ মানসিক ভাবে উলঙ্গ হয়ে যাওয়া’ যে পণ্যবাদের বাড়বাড়ন্তের অবশ্যম্ভাবী ফল, -আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে তা আর নতুন করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হয় না। শিল্পবিপ্লবের পর থেকে আধুনিক পৃথিবীতে পণ্যবাদের প্রতাপ ক্রমশঃ বেড়েছে। মানসিকভাবে উলঙ্গ হওয়া না হয় তর্কাধীন বিষয়, কিন্তু প্রতি দশকে (প্রতি বছরে না হলেও) দেহকে নিরাবরণ করার প্রবণতা ও সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা যে ক্রমশঃ বেড়েছে -সে বিষয় সমর্থনযোগ্য নাকি নিন্দনীয়, সেই তর্কে না গেলেও, ‘ঘোমটা তোলা’র বাস্তবতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

মানবসমাজের হাবভাব অনেকটা রসায়নের স্বয়ংক্রিয় অনুমাপন (Titration) প্রক্রিয়ার মতো। -অম্লের গাঢ়ত্ব যত বাড়ে, প্রশমনের জন্য তত কড়া ক্ষার যেন আপনা থেকেই জন্ম নেয়! যে কোনও ক্ষেত্রেই হোক না কেন, সমাজের এক দলের আবরণ যত উন্মুক্ত হয়, আরেক দল হয়ে ওঠে ততটাই কট্টরপন্থি। -তার চেহারা ধার্মিক বা রাজনৈতিক যা-ই হো’ক না কেন, তারা দাঁত-নখ বার করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুঃখজনক হলেও এটিই হয়তো স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ বা সাম্প্রতিকতম সংবাদপত্র, সর্বত্র এই আঁচড়-কামড়ের দাগ। এই দুই দলের কোনও এক দলের পক্ষপাত কি নিরপেক্ষতা বা উদাসীন থাকাও –একেবারেই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কারণ, (রবীন্দ্রনাথের কথায়) ‘নিজের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটানো থেকে নিজের সর্বনাশ করা পর্যন্ত পুরোটাই ব্যক্তিস্বাধীনতার এলাকার মধ্যে পড়ে।’ তার পরিণতি?… লোভ-কে আকাঙ্খা আর ভোগ-কে প্রাপ্তি ভাবার ভুল। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘শরীর বলতে তো হাঁ-করা মুন্ডু আর আজানুলম্বিত একটি পেট’! সমাজে আগুন লাগলে গায়ে আঁচ লাগবেই।–তাই নিরপেক্ষতা বা উদাসীনতা খুব একটা কার্যকর দৃষ্টিকোণ নয়।

সামাজিক ক্রমবিকাশ ও মানুষের ‘ভাগ্য’ পরিবর্তন ঘটেছে একই ধারায়। সনাতন যুগের আগে মানুষ যাবতীয় সামাজিক উৎপাদন নিজেদের মধ্যে সমান ভাগে ‘ভাগ’ করে নিত। এই ‘ভাগে’ পওয়া সম্পদ ছিল তার ‘ভাগ্য’{ভাগ্ + য (যাওয়ন/ যোগ্যতা/ যুজ্ ধাতু)}। সনাতন যুগের জ্ঞানী-কর্মীর যৌথসমাজে মানুষ নিজের কাজের (কর্মের) বিণিময়ে ও কাজের পরিমাণ অনুযায়ী ভাগ পেত। তখন ‘ভাগ্য’ হল ‘কর্মফল’।

বৈদিক যুগে সম্পদের অধিকার ছিল বর্ণাশ্রম অনুযায়ী। চতুর্বর্ণ, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্র যথাক্রমে শাদা, লাল, হলুদ ও কালো বর্ণের তিলক ধারণ করত। নিজ-নিজ গোষ্ঠী বা গোত্র অনুসারে সেই তিলকের নকশা পরিবর্তন হত। -আজও বৈষ্ণবদের মধ্যে যে প্রথা দেখা যায়। তিলক আঁকা হয় কপালে বা ললাটে। সে’যুগে তিলক দেখে মানুষের সামাজিক অবস্থান ও সেই সাথে সামাজিক সম্পদের কতটুকু ‘ভাগ’ তার অধিকারে যাবে –তার নির্ণয় হত। তাই এই সময় থেকে ‘ভাগ্য’–কে ‘ললাটলিখন’ বা ‘কপালের রেখা’ হিসেবে উল্লেখ করা শুরু হল।

বাণিজ্যতন্ত্রের যুগে শুরু হল ‘ভাগ্য’-এ বিভিন্ন ‘গ্রহ-নক্ষত্রে’র প্রভাব। এই ‘গ্রহ-নক্ষত্র’রা হলেন সূর্য্য (রাষ্ট্রীয় পুঁজি), চন্দ্র (বণিক পুঁজি), বুধ (চন্দ্রবংশ বা বণিকপুঁজির পৃষ্ঠপোষকদের প্রতিষ্ঠাতা), মঙ্গল (চিরপ্রচলিত আচার, যা কল্যাণকারী), বৃহস্পতি (‘সুর’ বা বাণিজ্যের উপযোগী আইন-ব্যবস্থার অথবা ‘দানের মাধ্যমে তুষ্টকারী’ ‘দেবতা’দের গুরুগণ), শুক্র (শুক্রাচার্য্য বা ‘সুর’ বিরোধী বিকল্প ব্যবস্থার গুরুগণ), রাহু (রাষ্ট্রীয় পুঁজি ও বণিক পুঁজি –উভয়কেই যে ‘গ্রাস’ করতে চায়। সামাজিক বিশৃঙ্খলা), শনি (যার দৃষ্টি পড়লে কিছু না কিছু মূল্য চোকাতেই হয়, -জরিমানা, রাজস্ব/ শুল্ক সংগ্রাহক), ইত্যাদি।[xxvii]

শিকড়ছিন্ন হয়ে গাছ বাঁচে না। ইতিহাস-বিচ্যুত হলে সুস্থ ভাবে বাঁচতে পারে না সমাজও। তবে ‘ইতিহাস’ হিসেবে সাধারণত আমরা যা মুখস্থ করি সেই সব তথ্যসমৃদ্ধ ব্যক্তিনাম ও সাল-তারিখের ভারে, এই ছড়াটি বা তার গর্ভস্থ অর্থ কোনোভাবেই ন্যুব্জ নয়। কিন্তু, সে কি অবহেলার বিষয়? অতীতকে প্রায়শঃ-ই আমরা সুবিধাজনক রেফারেন্স ফ্রেমে দেখতেই অভ্যস্ত। কিন্তু, এই দেখার সীমাবদ্ধতা আছে। -‘২৬০ খ্রীষ্ট পূর্বে সম্রাট অশোক কলিঙ্গ আক্রমণ করেছিলেন’ –বক্তব্যটি যে মুহূর্তে মূলতঃ ‘মুখস্থযোগ্য’ তথ্যে রূপান্তরিত হয়, সেই মুহূর্ত থেকে বোধহয় একটি অবচেতন ধারণা-ও জন্মায় যে -কলিঙ্গ আক্রমণ অতীতে হয়েছিল, বর্তমানে তার বিশেষ কিছু গুরুত্ব নেই। সম্রাট/ বাদশাহ্/ রাজা/ নবাব-কেন্দ্রিক কাহিনীতে বা স্থান-কাল-পাত্রের মাত্রায় ইতিহাস সীমাবদ্ধ রয়ে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নিছক ‘তথ্যে’ পরিণত হয়, গভীরের ‘তত্ত্ব’ রয়ে যায় আড়ালেই। ফলে ‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি’র কথা জানলেও হয়তো তার অর্থ ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।

‘কালক্রমে সব অলঙ্কার-ই ধ্বংস হয়, চিরকাল রয়ে যায় কেবল বাগ্-অলঙ্কারই।’[xxviii]… বাণিজ্যতন্ত্রের নির্ধারিত ভাগ্য মোটামুটি আজও আমাদের নিয়ন্ত্রক। -ফলাফলও বোধহয় অজানা বা অচেনা নয়। আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের উপলব্ধি বিভিন্ন রূপে লিপিবদ্ধ বা বাক্যবদ্ধ করে রেখছেন। গতানুগতের বাইরের সেই ইতিহাস বা জ্ঞানভাণ্ডারকে এখন পুনরূদ্ধার বা হৃদয়ঙ্গম করব কিনা, –সে সিদ্ধান্ত আমাদেরই।।

 

 

টীকা ও সূত্র:

[i] সূত্র: ‘বাংলা ছড়ায় সমাজ-ভাবনা’ – দেবাশিষ বসু।

[ii] বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য পঠিতব্য: ‘গোপাল রাখাল দ্বন্দ্ব সমাস: উপনিবেশবাদ ও বাংলা শিশুসাহিত্য’ – অধ্যাপক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়।

[iii] অধা হি বিক্ষ্বীড্যোহসি প্রিয়ো নো অতিথিঃ। রণ্বঃ পুরীব জূর্যঃ সূনুর্ণ ত্রয়য়ায্যঃ।। – ঋগ্বেদ, ৬.২.৭।… যথা বঃ স্বাহাগ্নয়ে দাশেম পরীলাভিঘৃর্তবদ্ভিশ্চ হব্যৈঃ। তের্ভিনো অগ্নে অমিতৈর্মহোভিঃ শতং পূর্ভিরায়সীভির্নি পাহি।। – ঋগ্বেদ, ৭.৩.৭। …শৃন্বন্ত্বাপঃ পুরো ন শভ্রাঃ পরি স্রুচো ববৃহাণস্যাদ্রেঃ। – ঋগ্বেদ, ৫.৪১.১২।

[iv] আর্য্য-অনার্য্য বিভাজনের স্থুল মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়েছিল মানুষের দেহের আকার ও চামড়ার রং। এ হল নিও-ডারউইনিজমের সাহায্যে ঔপনিবেশিক বর্ণবিদ্বেষকে প্রতিষ্ঠা করার অসভ্য প্রবণতা। (যার সবচেয়ে কুখ্যাত পরিণাম বোধ হয় নাৎসি জার্মানি।) অবশ্য এই ভাবধারাকে আকড় করে এদেশের মাটিতে পুরোহিততন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পরে হিন্দু মৌলবাদের জনক গোলওয়ালকর ও ইসলামি মৌলবাদের প্রবক্তা সৈয়দ আলা মাওদুদি, দু’জনেই নিজের নিজের ধর্মের মূলে না ফিরে মুখে বিশুদ্ধ হিন্দুত্ব কিংবা বিশুদ্ধ ইসলামে ফেরার ডাক দিয়েছিল। গোলওয়ালকরের মূলধন ছিল অ্যাডল্ফ হিটলারের জাতিবিদ্বেষ, মাওদুদির মূলধন ছিল অ্যালেক্সিস ক্যারলের ইউজেনিক্স (বিশুদ্ধজন্ম-বাদ)। ভারতীয় উপমহাদেশে তার কুফল সম্বন্ধে নতুন করে কিছু বলার নেই।… ভাষাগত ভাবে আর্য্য-অনার্য্য বিভাজনের কিছু তত্ত্ব চালু আছে। পৃথিবীর ভাষাগত বিভেদগুলি বাস্তব হলেও তার থেকে ‘বহিরাগত’-তত্ত্বের সিদ্ধান্তে আগাগোড়া ত্রুটিপূর্ণ। আকাডেমিক মহলেও তার পাল্টা যুক্তির পরিমাণ অপ্রতুল নয়। (‘ওরে কবি তোর নাম দিলাম ‘চোর’। সুতরাং প্রমাণিত হল কবিমাত্রেই চোর!’ –হাস্যকর শোনালেও সিদ্ধান্তটি খানিকটা এমনই।) এই বিষয়ে অন্য নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

[v] সূত্র: ‘Indigenous Indians: Agastya to Ambedkar’ by Koenraad Elst.

[vi] তথ্যসূত্র: Department of Archaeology and Museums, Pakistan, Oxford University ও National Geographic.

[vii] ‘অশ্বঃ কস্মাদশ্নুতেহধ্বানং মহাশনো ভবতীতি বা।।’ –নিরুক্ত।

[viii] ‘…চারি জাতি নায়িকার শুনহ নায়ক। শশ মৃগ বৃষ অশ্ব সন্তোষদায়ক।।…’ – রায় গুণাকর ভরতচন্দ্র (রসমঞ্জরী, ‘পুরুষ জাতি কথন’)। কবি ভরতচন্দ্র সংস্কৃত ও পারসীক ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। তার পঠের বিষয় ছিল ব্যাকরণ ও অভিধান।

[ix] ‘অশ্’ শব্দের বিভিন্ন অর্থের জন্য দ্রষ্টব্য: বঙ্গীয় শব্দকোষ – হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়।

[x] ‘মেধ’ মানেই কিন্তু নিছক ‘মাথা কেটে নেওয়া’ নয়। ঘটনাচক্রে, ‘উৎসর্গ করা’ মানেও শুধু ‘বলি দেওয়া’ নয়। ‘মেধ্’-এর একটি অর্থ ‘সঙ্গম’। (প্রজায়ৈ গৃহমেধিনাম –রঘুবংশ) সঙ্গম ভাবগত ভাবে একটি সৃষ্টিশীল ক্রিয়া। তাই মানুষের সৃষ্টিশীলতা(মেধ্) এর আধার(আ)-কে ‘মেধা’ বলা হয়।

[xi] সূত্র: নিরুক্ত, অমরকোষ, পৌরাণিক অভিধান – সুধীরচন্দ্র সরকার, বঙ্গীয় শব্দকোষ – হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ – কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী, ছাত্রবোধ অভিধান, সংসদ বাংলা অভিধান, সংস্কৃত বাংলা অভিধান – অশোক কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।

[xii] বেদোক্তন যাজদেবীং কামসংকল্পপূৰ্ব্বকৰ্ম্ম। স এব বৈদিকাচারঃ পশ্বাচারঃ স উচ্যতে॥ – আচারভেদতন্ত্র।

[xiii] পৃথিবীর প্রায় সমস্ত প্রান্তে এই সামাজিক দিশা পরিবর্তন আগে-পরে ঘটেছিল। যে’কারণে দেশগুলি আলাদা হলেও তাদের মহাকাব্য, ধর্মগ্রন্থ বা প্রচীন লৌকিক কাহিনীগুলিতে অদ্ভূত সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ফরাসী বিপ্লবের সময় সম্ভবতঃ সে’দেশের সেই আদি ইতিহাসের পরম্পরায় রাজতন্ত্রের ও পুঁজিবাদের সমর্থকরা আইনসভার ডানদিকে, আর সামাজিক সমতার সমর্থকরা ও পুঁজিবাদের বিরোধীরা আইনসভার বামদিকে বসতে শুরু করে। সেই থেকে রাজনৈতিক মেরুদুটির নামও ‘rightist’ (দক্ষিণপন্থী) ও ‘leftist’ (বামপন্থী) হয়ে যায়। বামদিক বলতে উত্তরদিক-ও বোঝায়। উত্তর শব্দের আরেকটি অর্থ শ্রেষ্ঠত্ব। যে ধারা বা পন্থা পরিত্যক্ত হযেছে, তাকে শ্রেষ্ঠ বলা যুক্তিযুক্ত নয়। তাই ‘বামদিক’ বলতে ‘উত্তরদিক’ বোঝালেও ‘উত্তরপন্থা’ বা ‘উত্তরপন্থী’ শব্দগুলি ব্যবহৃত হয় না।

[xiv] ‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।। পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্। ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।’ –শ্রীমদ্ভগবদগীতা। (বিষ্ণুর অপর নাম গরুড়ধ্বজ।)

[xv] সূত্র: বঙ্গীয় শব্দকোষ ও বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ।

[xvi] সন্দেহের অবকাশ না হলে পঠিতব্য G. H. Hardy-এর ‘A Mathematician’s Apology’, Edwin A. Abbott-এর ‘Flatland: A Romance of Many Dimensions’, Imre Lakatos-এর ‘Proofs and Refutations’, ইত্যাদি।

[xvii] ব্যক্তি-মালিকানার দুর্গন্ধ ও সুগন্ধ কী?… ‘ছিঃ, লোকটা দিনরাত শুধু টাকা-টাকা করে‌!’ –এ হল ব্যক্তিমালিকানার দুর্গন্ধবোধ। আর ‘বাহ্, লোকটা তো অনেক টাকা কামিয়েছে!’ -এ হল ব্যক্তিমালিকানার সুগন্ধবোধ। ব্যক্তিমালিকানার প্রতি মনোভাবের এই পরিবর্তন মহাভারতে বর্ণিত হয়েছে ‘মৎসগন্ধা’ থেকে ‘পদ্মগন্ধা’য় পরিণত হওয়ার কাহিনীতে।

[xviii] সীতার নামকরণে কৃষিকথার নির্দেশ দেখা যায়। সীতা বসুন্ধরা-কন্যা, সে হলরেখ (হল/ লাঙ্গলের রেখা।) হল বা লাঙ্গলের রেখা পড়ে জমিতে। সেই জমির মাটি ছুঁয়ে যে ফল হয়, -সেই ‘কুমড়ো’র আরেক নাম ‘সীতাফল’। সীতাপুত্রের নাম লব ও কুশ। ‘লব’ শব্দের একটি অর্থ ‘শস্যচ্ছেদন’ আর ‘কুশ’ শব্দের অন্যান্য অর্থগুলি হল ‘নবজাত ধান’, ‘বিশেষ প্রকার তৃণ’, ইত্যাদি (বঙ্গীয় শব্দকোষ)। ঋগ্বেদে সীতা নামটির উল্লেখ আছে। সীতা সেখানেও হলরেখ; মূর্তিমতী কৃষিশ্ৰী। অথর্ববেদের কৌশিক সূত্র (১৪.৭) অনুযায়ী সীতা ‘পর্জন্য পত্নী’ বা মেঘ-পত্নী। পারস্কর গুহ্যসূত্র অনুযায়ী সীতা ‘ইন্দ্ৰপত্নী’। ‘ইন্দ্র = যিনি প্রভুত্ব করেন’ (বঙ্গীয় শব্দকোষ)। কথিত আছে, শত অশ্বমেধ যজ্ঞ করলে ইন্দ্রত্ব লাভ হয়। অর্থাৎ, একশতবার পররাজ্য গ্রাস, নিজের রাজকোষে ধনসম্পদ পুঞ্জীকরণ, রাজ্যের সীমা ব্যাপ্তকরণ, (নিবন্ধে ‘অশ্ব’ শব্দের অর্থ দেখুন) ইত্যাদির মাধ্যমে প্রভুত্ব লাভ হয়। কৃষিভিত্তিক সমাজে ইন্দ্রত্ব বা প্রভুত্ব লাভের উপায় কৃষি-প্রক্রিয়ার ‘স্বামী’/ মালিক হওয়া। সীতার ‘কৃষিশ্ৰী’-রূপকে কেন্দ্র করে রামায়ণ রচিত হয়েছে।

[xix] ‘যদর্থং নির্জিতা মে ত্বং সোহয়মাসাদিতং ময়া। নাস্তি মে ত্বয্যভিষ্বঙ্গো যথেষ্টং গম্যতামিতি।। তদস্য ব্যাহৃতং ভদ্রে ময়েতৎ কৃতবুদ্ধিনা। লক্ষণে বাথ ভরতে কুরু বুদ্ধিং যথাসুখম্।।’ – রামায়ণ ৬/১১৫/২১-২২।… বা ‘সূর্য্যবংশে জন্ম, দশরথের নন্দন। তোমা হেন নারীতে নাহিক প্রয়োজন।। তোমারে লইতে পুনঃ শঙ্কা হয় মনে। যথা তথা যাও তুমি থাক অন্য স্থানে।। এই দেখ সুগ্রীব বানর-অধিপতি। ইহার নিকটে থাক যদি লয় মতি।। লঙ্কার ভূপতি এই বীর বিভীষণ। ইহার নিকটে থাক যদি লয় মন।। ভরত শত্রুঘ্ন মম দেশে দুই ভাই। ইচ্ছা হয় থাক গিয়া তাহাদের ঠাঁই।।’ – কৃত্তিবাসী রামায়ণ।

[xx] ‘ঘৃতপ্রসত্তো অসুরঃ সুশেবো রায়ো ধর্তা ধরুণো বস্বও অগ্নিঃ’ –ঋগ্বেদ, ৫.১৫.১।

[xxi] দেবতা = ‘যার দানে আমরা তুষ্ট হই’ বা নিরুক্ত মতে ‘যে ঐশ্বর্য এবং ঈপ্সিত বস্তুগুলি দান করেন’। স্মর্তব্য: পিতৃদেব, মাতৃদেবী, পতিদেবতা, গণদেবতা, ইত্যাদি শব্দগুলি। লেখক কলমের দানে, পাঠক বই-এর দানে, গায়ক বা নর্তক মঞ্চের দানে, ক্রীড়াবিদ মাঠের দানে… তুষ্ট হয় বলে কলমকে, বইকে, মঞ্চকে, মাঠকে… ‘দেবতাজ্ঞানে প্রণাম’ করার রীতি।

[xxii] সূত্র: বঙ্গীয় শব্দকোষ, বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ।

[xxiii] সূত্র: ‘বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি ফারসি উর্দু শব্দের অভিধান’ –মোহাম্মদ হারুন রশিদ।

[xxiv] পূর্ববঙ্গীয় সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষ্যে ‘শ’, ‘ষ’ বা ‘স’ কে ‘হ’ উচ্চারণের প্রবণতা দেখা যায়। যেমন ‘সকল’ থেকে ‘হগ্‌গল’, ‘সকাল’ থেকে ‘হকাল’, ‘সনে’ (সঙ্গে) থেকে ‘হনে’ ‘সড়ক’ থেকে ‘হড়ক্’, ‘সেই দিকে’ থেকে ‘হদিকে’… (দ্রষ্টব্য: ‘বাংলা একাডেমী বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’।) বেশ কিছু ক্ষেত্রে নতুন শব্দগুলি আভিধানিক স্বীকৃতিও পায়। -যেমন ‘সপ্তাহ’ থেকে ‘হপ্তা’।

[xxv] সূত্র: পৌরাণিক অভিধান, বঙ্গীয় শব্দকোষ, বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ।

[xxvi] জীবিকা অনুসারে পদবীপ্রাপ্তির আরও উদাহরণ: দুই/ তিন/ চারটি বেদ অধ্যয়নকারীদের পদবী হয় দ্বিবেদী/ ত্রিবেদী/ চতুর্বেদী। কাব্য/ ব্যাকরণ/ তর্কশাস্ত্র/ ন্যায়শাস্ত্রে পণ্ডিতের পদবী হয় কাব্যতীর্থ/ ব্যাকরণতীর্থ/ তর্কালঙ্কার/ ন্যায়তীর্থ। একই ভাবে সেন, সামন্ত, বসু, গোস্বামী, কবিরাজ, চক্রবর্তী, বিশ্বাস, সরকার, মন্ডল, হালদার, মজুমদার, চৌধুরী, পুরকায়স্থ, বণিক, সদাগর, গোপ, সাঁপুই, গায়েন, গোপালন, মোদক… বা পার্সিদের দারুওয়ালা, স্ক্রুওয়ালা, বাটলিওয়ালা, ইত্যাদি পদবীর সৃষ্টি। এমনকি, ইঞ্জিনীয়র-এর মতো শব্দও পদবীতে পরিণত হয়েছে, যথা, -ফারুখ্ ইঞ্জিনীয়র। (সূত্র: ‘আমাদের পদবীর ইতিহাস’ –লোকেশ্বর বসু।)

[xxvii] সূত্র: বঙ্গীয় শব্দকোষ, বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ।

[xxviii] ‘… বাণ্যেকা সমলঙ্করোতি পুরুষং যা সংস্কৃতা ধার্যতে ক্ষীয়ন্তে খলু ভূষণানি সততং বাগ্ভূষণং ভূষণম্ ।।’  -ভর্তৃহরি’র নীতিশতক (১৯)।

সৌরভ মিত্র। লেখক ও বাঙলা ভাষার গবেষক। জন্ম কলকাতা, ভারত। তাঁর লেখার বিষয় বাংলা ভাষা ও ভাষাতত্ত্ব, ছোটগল্প, উপন্যাস ও রম্যরচনা। প্রকাশিত বইপত্র: 'আয় বৃষ্টি' (ভাষালিপি প্রকাশনী, ২০১০), 'আদরের মরাগাঙ' (প্রতিভাস প্রকাশনী, ২০১১), 'টিপিক্যাল মিডিলক্লাস' (একুশশতক প্রকাশনী, ২০১৩), 'হুক' (সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী, ২০১৮)...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..