প্রেম এবং অপ্রেমের কাব্য
এ-এক প্রেমের শহর, এ-এক প্রেমের শহর, এখানকার বাতাস প্রেমের সৌরভ বয়ে আনে। হাজারো প্রেমের কলি…..
কবিতায় ধরেছিল কিশোরবেলায়। অথচ বাসায় কোন পত্রপত্রিকা, বই কিছুই আসত না। দু’ একটা পুজোবার্ষিকীর বাইরে কিছু কেনার উপায়ও ছিল না। কাছাকাছি কোন লাইব্রেরী ছিল না। বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব এতখানি ছিল যে হেঁটে হেঁটে ফিরে এসে আর বাবার নির্দেশিত গৃহপ্রবেশের সময় সামলে সম্ভব ছিল না দূরের লাইব্রেরীতে যাওয়া।যে পাড়ায় থাকতাম সেখানে একফোঁটা সবুজও ছিল না। শুধু সরু সরু ইটে গড়া কিছু পুরোনো বাড়ি এবং পরবর্তী কালের কিছু। শুধু পিচ এসফল্ট আর লালমাটির পথ। ব্যাস। একটা ব্যাপার ছিল অবশ্য। আমার প্রয়াত দাদা শিশুকাল থেকেই অসম্ভব ভাল আবৃত্তি করত। পুরষ্কার পেত প্রচুর, সবই রবিঠাকুরের বই, এছাড়া কাজী নজরুলের সঞ্চিতা। খুবই কি পড়তাম সেগুলো? উত্তরটা না-এর দিকে। তবু কেন কবিতায় ধরেছিল জানি না। সেই সময়টায় অবশ্য প্রচুর আবৃত্তি আর গানের প্রতিযোগিতার কাল। কিন্তু আফ্রিকা, আমারই চেতনার রঙে আর বীরপুরুষ শুনতে শুনতে কান পচে যেত। কখনও সখনও জন্মদিন বা হঠাৎ দেখা। আর বিদ্রোহী। দাদা অবশ্য কোথা থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্র এমনকি মাণিক বন্দোপাধ্যায়ের কবিতাও যোগাড় করে আবৃত্তি করত, জানি না। তবু আমার খাতা ভরে গেল টুকলিতে আর স্মরণে। হে রবীন্দ্রনাথ থেকে হে রামকৃষ্ণ হয়ে লালবাহাদুর পর্যন্ত ছড়িয়ে যেত এলাকা। চতুর্দিকে এত হে যে ছোট ছোট হাতে কুলোতোও না সব। তা বাদে আরও বেশ কিছু লেখা। যা পড়ে গুরুজনস্থানীয় এক শিশুসাহিত্যিক বলেছিলেন, এই যে সব পাকা পাকা কথা লিখেছিস, এর এক বর্ণও বুঝিস! উত্তরটা, না। কিন্তু স্বীকার করে কে! ফলে মিটিমিটি শয়তানের হাসি। ফলে, আগে ভাল করে পড় জান বোঝ তারপর লেখ। সে জ্ঞান অবশ্য বিশেষ কম্মে লাগে নি। কিন্তু ধীরে ধীরে, কি করে জানি না, বয়সের তুলনায় ততোধিক একটি পাকামি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল যে, যা লিখব নিজের মতো লিখব, কারও মতো নয়। বাংলা হিন্দী অজস্র গান শুনতাম আর গলায় তুলে ফেলতাম এবং সোৎসাহে চ্যাঁচাতাম। বহু গানের বাণী মাথা থেকে নামতেই চাইত না। সব থেকে বিরক্তিকর লাগত রবীন্দ্রসংগীত। বাড়িতে একটি রেডিও। খবরই বেশি চলত। তবে গান নাটক ছাড়াও শম্ভু মিত্র কাজি সব্যসাচী প্রদীপ ঘোষ এসবও অবরে সবরে। তারপর একদিন কোথা থেকে বন্ধুরা জড়ো হল লেখার খাতা আঁকার তূলি হাতে নিয়ে। বাসা থেকে কুড়ি মিনিট হাঁটাপথের শেষে, ছোট নদী পেরিয়ে, ছোট্ট একটেরে গ্রামে মাটির দাওয়া মুড়ি-বাতাসার আপ্যায়ন থেকে ফিরে আসার দুদিন পর এক বন্ধু তার আঁকা ছবির পোস্টকার্ড উপহার দিল। দেখলাম। টের পেলাম, এত সব সুন্দরের কিছুই দেখিনি ঠিক করে। এমন কি রোদে শোয়ানো গরুর গাড়ির চাকায় লেগে থাকা কাদামাটি-বালি-গোবরের প্যাচটিও যে আসলে এক খুবই সুন্দরের প্রতিলিপি তা টের পেয়ে ভিতরে কিরকম গোলমাল হয়ে গেল। দেখার বাইরে দেখা আর তার উচ্চারণ টানতে লাগল। নিজের পথ এই ভাবনাটি সাবালক হয়ে উঠতে চাইল বস্তুতই পথটি কোনরকম টের না পেয়েই। হাতে এল কৃত্তিবাস গঙ্গোত্রী কৌরব। আমার বিষ্ণুপুরের এলিট কাগজ টেরাকোটা তাতে শক্তি সন্দীপন অসীম রায়। গজিয়ে উঠল নিজের কাগজ, মুহুর্ত। তা পড়ে ভালোবাসলেন, টেরাকোটা সম্পাদক বিখ্যাত হাংরি সুবো আচার্য। দিন যায়। তারপর আরও দিন গেল ভীষণ সব দুঃখে, নানা আনন্দে, নতুন পথে ওবন্ধুত্বে, বারেবারে হারিয়ে যাওয়া ও ভেসে ওঠায়, পাহাড়ে জঙ্গলে সমুদ্রে, অপারেশন থিয়েটারের বাইরে উৎকণ্ঠিত ভীড়ে, ওয়ার্ডের বাইরে রাতজাগায়, জন্মকাতার আর মৃত্যুমিছিলে, কবিতার নতুনে, সুবর্ণরেখায়। পুরোটাই পঠনপ্রক্রিয়া বস্তুত। চলতে চলতে পড়া। রবিঠাকুরের গান যে একদা আমার মানসিক আশ্রয় হয়ে উঠল সেও ওই পঠনপথ ধরেই। এখানে স্বীকার্য যে আমার অক্ষরে অক্ষরে পঠনের পরিমাণ বস্তুতই ফক্কা। চোখের পড়াই সম্বল। আর তা নিজের মতো করে বলতে চাওয়া কলম দিয়ে। শুনতে পাওয়া অনন্তবিশ্বের চলমান ধ্বনিতরঙ্গ ছন্দলহর এবং লিরিক। যে কোন কিছুই কবিতার উৎস হয়ে ওঠা। সেই তরঙ্গ খুঁজে পাই মল্লভূমের অনুপম শিল্পনজিরগুলিতেও, পড়ি নিজের মত করে। মনে পড়ছে, ভিলাই যাওয়ার মাঝপথে সবুজ আলোর অপেক্ষায় ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়েছে বণ্ডামুণ্ডা নামের ছোট্ট স্টেশনে। চারপাশের পাহাড়ে জঙ্গলে রাত লেগে আছে। হু হু করে কুড়ি বয়সের ভিতরটা। চোখে জল। মনে হয় নেমে পড়ি। মনে মনে লিখতে থাকি—- একটি মৃত্যু কোন সুদূরের বীণ, একটি মৃত্যু নির্মম উদাসীন, আঙুলবিহীন দুটি হাত সরে গেলে, একটি মৃত্যু প্রাকৃতিক রাতদিন। সহযাত্রী বয়স্কা মহিলা পিঠে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, বাড়িতে বলে এসেছো নাকি পালিয়ে ! এই বিস্ময়, ভিজে যাওয়া, খোঁজ আর পালাই পালাই আমার পঠনপ্রক্রিয়া এবং লিখনপ্রক্রিয়ারও ভাল এবং মন্দ। তারপর একদা মহানগর। নানা দশক, গুরুজন, সমসাময়িক এবং অনুজনদের লেখা অসংখ্য কবিতা যা পড়তে পড়তে আমার কলমও চলতে শুরু করে। তারপর নতুন পথের বন্ধুরা দাদারা, ঋকবৈদিক কৌরব কবিতা ক্যাম্পাস বারীনদা এবং নতুন কবিতা। ততদিনে নিশ্চিত হয়ে গেছে যা পড়ব যা লিখব তা অন্য কবিতা, অন্য জগত অনুভব ও উচ্চারণ। সমস্ত মুগ্ধতা থেকে পালানোর একলা পথ। পিঠের ব্যাগটিকে দেখি চলে যাচ্ছে দূরে কোথায় দূরে দূরে অথচ নিজের হাত পা শক্ত শিকলে বাধা। ব্যাগটি ফিরে এলে তার কাছে বসেকবিতা শুনি, গদ্য, এবং ভুলে যাই। আবার কখনও ব্যাগটি এবং কলমটি মনে করিয়ে দেয় মাঠাবুরুর বৃদ্ধ গহন সিং-এর একক ঝুমুর নাচ, সুবর্ণরেখার পারে মকর পরব, রাবং লা-র নেশাতুর রাত। শরীরের ভিতরে শ্লেট ভরে যায় লেখায় লেখায়। তারপর সব মুছে দিই, ভুলে যাই। নাহলে আমার কলম ধরা হয় না। শূণ্য পড়ে থাকে ঝর্ণাপথ। তারপর কোন একদিন হঠাৎ আনন্দে লিখে ফেলি, আলো ঢালবার শব্দ গ্লাসে গ্লাসে। একপেশে এবং একমুখী দেখাদেখি ও উচ্চারণের নন্দিত বন্দিত বৈপ্লবিত দিগর ছাড়িয়ে কবে যেন টেনেছিল, “দুঃখী মানুষেরা ঠিক তত দুঃখী নয়/ তাদেরও নৈশ রেডিওতে আছে কিশোরকুমার”– সেই কথা মনে পড়ে। কিছু পাওয়ার জন্য লেখার কথা ভাবতেও পারি না। এক চাকরির জায়গায়, হাঃ হাঃ, রীতিমতো বস হয়েও মজদুর ইউনিয়নের মাটির ঘরে তাদেরই সংগে বসে ফ্যানাভাত আর আলুসেদ্ধর আনন্দপাঠকে কোন বিপ্লব ভাবতেও ঘেন্না হয়। বাইরে তখন অজস্র ট্রাকের একটানা শব্দঢেউ অভিন্ন হয়ে যাচ্ছে সমুদ্রলহরের সাথে। প্রাণভরে পড়তে থাকি সেই ধ্বনিসঙ্কলন। কলম হাতে তুলে টের পাই, কেন লেখা হয়েছিল— “বেঁচে থাকার রহস্যে আর তোমাকে ছাড়ছি না”।
সন্তানবয়সী কবিভাই আশুতোষ সরকার বড় চমৎকার বলেছেন,
কেন কবিতা পড়ি
আনন্দ পাই বলে,
কেন কবিতা লিখি
আনন্দ পাই বলে।
আসলে এটুকুই তো কথা। এইটুকুই। বাকি সবই ওই, যা করলাম এতক্ষণ, কথাসাহিত্য।
এ-এক প্রেমের শহর, এ-এক প্রেমের শহর, এখানকার বাতাস প্রেমের সৌরভ বয়ে আনে। হাজারো প্রেমের কলি…..
পতাকায় মিশে যায় ফেলানির নাম উড়তে থাকে কাঁটাতারে; মানুষের মনে জমে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ বিকল্প মেঘের…..
প্রেমিক হয়তোবা তাকে আমি গড়তে পারতাম তার বুকের ভিতর এপাশ থেকে ওপাশে উল্টে নতুন একটা…..
চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..