প্রেম এবং অপ্রেমের কাব্য
এ-এক প্রেমের শহর, এ-এক প্রেমের শহর, এখানকার বাতাস প্রেমের সৌরভ বয়ে আনে। হাজারো প্রেমের কলি…..
কেন লিখি? পুরাতন প্রশ্ন। প্রশ্নেরপিঠে এসেছে উত্তর। বিচিত্র সব কারণ। কারো কাছেলেখা বেদনাময় কর্তব্য। কারো কাছে হতাশা থেকে বেরিয়ে আসার পথ। কেউ লিখেছেন দম্ভ প্রকাশের জন্য। বন্ধুদের আরও বেশী ভালোবাসা পেতে লিখেছেন মার্কেজ। যে কারনে বাঘ হরিণ শিকার করে, সেকারণে লিখেছেন হেমিংওয়ে। লেখার মাধ্যমে দেববীর্যে বলীয়ান মানুষ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন গ্যোয়েটে। অক্ষরেরপরঅক্ষর সাজিয়ে বিকল্প জীবন তৈরীর চেষ্টা করেছেন লেখকেরা। হেঁটেছেন মানুষের সমষ্টিগত দুঃখ, হতাশাবোধ নিজের ভেতর ধারন করার কঠিন সাধনার পথে।
আমার কাছে লেখা মানে নিজের কাছে ফেরা। বাবা একা একা কথা বলতেন। ঠিক যেন নিজের সঙ্গে কথা বলা। প্রথমে বুঝতে পারিনি কী বলছেন! কাকে বলছেন? কিছুটা বড় হয়ে বুঝেছি। বাবার কোনও বন্ধু ছিল না। অফিসের সহকর্মী, আত্মীয়, পরিজন সবার সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক। হয়তো কেউ বাবাকে পড়তে পারেন নি। বা তিনি কাউকে। সবকিছু ছাপিয়ে নিজের মতো থেকেছেন। আমিও নিজের সঙ্গে কথা বলি। উত্তরাধিকারসূত্রে আমারও একই স্বভাব। স্বভাবের বর্ধিত সংযোজন লেখা।
লেখা এক থেরাপি। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া। জীবন থেকে পালানোর উপায়। লিখি প্রশ্নের উত্তর পেতে। যে উত্তর কারো কাছে নেই। কোনও এক বোধ আমাকে নিজের মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেয়। আমি যা এড়াতে পারি না। জীবনানন্দ দাশের মতোই বলতে পারি,
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে
সে আমার হাত রাখে হাতে,
সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময় শূন্য মনে হয়, শূন্য মনে হয়।
একই পরিবেশে বড় হলেও ভাইরোনদের তাড়া করেনি এই বোধ। বা ‘চৌদ্দগুষ্টি’র কাউকে। বংশে কোনও লেখক নেই। বোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ভাই ব্যবসায়ী। আমার বোনও সাহিত্যের ছাত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়েছে। তার মাথায় নেই লেখালেখির ভুত। আমার বিশ বছর গেছে সাংবাদিকতায়। লেখায় বিনিয়োগ করতে হয় গোটা জীবন। সবটুকু সময়। সেটা হয়ে উঠেনি। শিল্পের সঙ্গে বেধেছে জীবনের সংঘর্ষ। লেখার বোধ তাড়া করার আগেই একলা হতে শিখেছি। কৈশোরে। খেলাধুলা, ছুটোছুটির বয়সেই হাতে নিয়েছি বই। স্কুলপাঠ্যের বাইরের বই। স্কুলে বা স্কুলের বাইরে খুব একটা মেলাতে পারিনি নিজেকে। এখনও আছি এই বিচ্ছিন্নতায়। ছোটবেলায় থেকেছি ভৈরব। জুট মিলের কোয়ার্টারে। বাবা মিলের হিসেব কর্মকর্তা। কোয়ার্টারে অনেক পরিবার। সমবয়সী অনেক শিশু। তাদের কেউ বন্ধু হয়নি। অথবা আমিই বন্ধু হতে পারিনি কারো। এই বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আসে প্রকৃতির কাছাকাছি। বাসার বাইরে পুকুর। একটু দূরে নদী। চারপাশে নির্জনতা। অবারিত প্রকৃতি। নারকেল বাগান। সবুজ মাঠ। নদীতে পালতোলা নৌকা। ট্রলার। পুকুর পাড়ে সুপারি বাবলা গাছের সারি। জলে ভাসমান মাছ। রাজহাঁস। এই রাজহাঁসের পালকে, লাল টাকি মাছের ঝাঁকে ফেলে এসছি শৈশব। আমার নাড়ি পোতা জন্মস্থান, শান্ত মফস্বল, ভৈরবের মাটিতেই ফেলে এসেছি লেখালেখির শেকড়।
প্রকৃতির সান্নিধ্য নির্জনতাপ্রিয় স্বভাবে যোগ করে অধিক পাঠের সংযোগ। বড় হয়ে পরিবর্তিত জীবনের সঙ্গে মেলেনি যেই সংযোগের সুত্র। ছোটবেলার প্রকৃতিকে কিছুটা হলেও ফিরে পাই রোকেয়া হলে। শতবর্ষী গাছ, চলার পথে ঝরা বকুল। ভোরের শিউলি। পথের পাথে বেগুনী জারুল। কমলা রঙন ফুল। রেইনট্রির পাশে সবুজ ঘাসের মাঠ। জুট মিলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠের কাছাকাছি। এখানে ঘাসগুলো আরও সবুজ, ঘন। মিলে বেশক’টি বাগান ছিল। একটা বাবার অফিসের সামনে। লম্বা একতলা দালানের অফিস। আই শেপের। সামনের পুরোটাই বাগান। গেটের পাশে মাধবীলতা। বাগানে গোলাপ, বেলী, দোলনচাঁপা, ডালিয়াসহ নানা মৌসুমী ফুল। মালিরা দেখাশোনা করতো বাগান। আরকেটি বাগান ছিল বাসার কাছাকাছি। সেখানেও অনেক ফুল। হলুদ সূর্যমূখী। সাদা গন্ধরাজ। আরকেটি বাগান ছিল ম্যানেজার চাচার বাংলোতে। সেই বাগানের চারপাশে জলপাই, লিচু আমলকিসহ নানা ফলের গাছ। আমাদের ঘরের সামনেও ফুলের গাছ। দরজার পাশেই দোলন্চাঁপা। লিলি। গোলাপ কামিনী ফুলের গাছ। হাসনাহেনার ডাল জানালা দিয়ে চলে আসত ঘরে। এই প্রকৃতিকে পাই রোকেয়া হলেও। আমার রুমের পেছনেই উপাচার্যের বাংলোর সীমানা দেয়াল। সকাল সন্ধ্যায় হাজারো পাখির কিচির মিচির। যেমনটা ছিল ভৈরবে, বাসার পাশে। শত শত গাছ! পাখ পাখালির ছুটোছুটি। এভাবে ছোটবেলা থেকে কর্মজীবনে প্রবেশের আগ পর্যন্ত প্রকৃতি আর সাহিত্যই ছিল জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। সেই সূত্র ভুল না শুদ্ধ সেই হিসেবে না গিয়েই বলছি, প্রকৃতির রহস্য আর নির্জনতাই আমাকে ভাবিয়েছে, ভেতরে বুনে দিয়েছে লেখকসত্ত্বার বীজ।
এরপরের বাস্তবতা আলাদা। ভিড় কোলাহলের নাগরিক জীবন। অফিস, সংসার, সামাজিকতা। সময়খেকো পেশায় অধিকাংশ কর্মঘণ্টা খরচ। যে আমি শুধু লিখে বাঁচার কথা ভেবেছি; সেই আমিই লেখা ছাড়া আর সব কিছুই করছি। কী তুমুল বৈপরীত্য জীবনের! না মেলা হিসেব নিয়ে মুখোমুখি হই নিজের। আমার কী এখানেই কথা ছিল আসার? জীবনের ম্যারাথনে শুধুই ছুটে চলা! সাদাপৃষ্ঠা আয়না হয়ে ওঠে। দেখি নিজের প্রতিচ্ছবি। এক ব্যর্থ মানুষের মুখ। উত্তর না পাওয়া প্রশ্ন টুকে রাখি মগজে। প্রতিদিন এই যে এত ব্যস্ততা। রিপোর্টিং, ছুটোছুটি। নষ্ট রাজনীতির তত্ত্বতালাশে হারিয়ে ফেলা ঘণ্টা, দিন, মাস। বছরেরপরবছর। এর মাঝে কী থাকে নিজের? এই যে এত রিপোর্ট, লাইভ, সমাজ, রাষ্ট্রের ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণ। তুলে ধরা সমাজের নানা অসঙ্গতি। কী এসে যায় এসবে! সবই সময়ের শ্রাদ্ধ। দিন-মাস-বছর শেষে কী থাকে অবশিষ্ট? কার মুখোমুখি দাঁড়াই? যাদের জন্য সবচেয়ে কম সময় বরাদ্দ, দিনশেষে তারাই দাঁড়িয়ে থাকে পাশে। এলিয়ট, জিবরান; রিলকে। একসময় কিছুটা সময় দিয়েছিলাম যাদের। আর সবাই ছেড়ে গেলেও তারা কখনও ছেড়ে যায় নি। আর আমার স্কুল। স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি। আমার কবিতা। আমার আয়না। দীর্ঘশ্বাস, বেদনার বীজতলা। এভাবে আর কার সঙ্গে বলা যায়, নিসঙ্কোচে? সবকিছুর সাক্ষী আমার কলম। জীবনের সেরা বন্ধু।
লিখেই কাটিয়ে দেব জীবন, ভেবেছিলাম। কী স্পর্ধা! সাহিত্যের ছাত্রীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে বাংলা বিভাগে ক্লাস নিয়েছেন দেশসেরা বুদ্ধিজীবীরা। ডঃ হুমায়ুন আজাদ, আনিসু্জ্জামান, সনজিদা খাতুনসহ অনেকে। চর্যাপদ থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের রথি মহারথিদের পড়ার সময় জীবন ছিল সাহিত্যময়। আমার সঙ্গী সেরা সব কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, উপন্যাস। ক্লাসপাঠ্য, বিভাগের সেমিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরিতে পড়া বইয়ের বাস্তবতাই সত্য। জীবনের মূল সত্যটা তখনও অনাবিস্কৃত। মাস্টার্সের ভাইভাতে শিক্ষকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছি লেখক হতে চাই। এই উত্তর তাদের বিস্মিত করেছিল। তৃতীয় বিশ্বের দেশে শুধু লিখে বাঁচা যায়? উত্তর পাওয়ার পর বদলে যায় জীবনের রুটিন। পেশার গতিপথ। পত্রিকা ছেড়ে চলে আসি টেলিভিশন সাংবাদিকতায়। বিসর্জিত হয় লেখালেখির অবসর। এভাবেই কেটেছে কুড়িবছর। এই দীর্ঘ ভ্রমণে কিছুটা হলেও চেষ্টা করেছি। লেখা ও পেশার সমন্বয়ের। যেদিন ব্যস্ততা বেশি, লেখা বা পড়া হয়ে ওঠে না, যে সপ্তাহ নিস্ফলা, যে মাস খরায় কাটে। লেখা দূরে থাক, কিছু পড়াও হয়ে ওঠে না। সবকিছুর পরও শূন্য মনে হয় সব। মনে হয় আমি কেউ নই। কী বিপুল অপচয় জীবনের! লেখা এই অপচয়ের খেসরাত। শূন্যতা পূরণের চেষ্টা। সাদা খাতায় দাগ কাটি। পরিচয় নির্মাণের জন্য নয়। আয়নায় নিজের ব্যর্থ চেহারা দেখতে। এই ব্যর্থতাই মৌলিক। ব্যর্থতায় আমার বিশ্বস্ত বন্ধু আমার কলম। আমার অর্ন্তনিহিত চিন্তার বয়ানে শব্দরাই সেরা সঙ্গী। হয়তো এভাবেই সংযোগ স্থাপন করা যায় জীবনের রহস্যের সঙ্গে।
এ-এক প্রেমের শহর, এ-এক প্রেমের শহর, এখানকার বাতাস প্রেমের সৌরভ বয়ে আনে। হাজারো প্রেমের কলি…..
পতাকায় মিশে যায় ফেলানির নাম উড়তে থাকে কাঁটাতারে; মানুষের মনে জমে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ বিকল্প মেঘের…..
প্রেমিক হয়তোবা তাকে আমি গড়তে পারতাম তার বুকের ভিতর এপাশ থেকে ওপাশে উল্টে নতুন একটা…..
চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..