কবিতা যখন যোজনগন্ধা

অন্তরা দাঁ
মুক্তগদ্য
Bengali
কবিতা যখন যোজনগন্ধা

কবিতা লিখতে গেলে নরম দুটো হাত পিছন থেকে আমার গলা জড়িয়ে ধরে, সেই হাতে যেন কতকাল আগে সেই শৈশবের জনসন বেবি পাউডারের গন্ধ মাখা থাকে… কত গন্ধে সাজানো আমাদের ছোটবেলা…ল্যাক্টোজেনের গন্ধ,সদ্য চান করে ওঠা মায়ের গায়ের বসন্তমালতীর গন্ধ, সবুজ রঙ প্যাকেটের প্যাশন ধূপের গন্ধ সব ছাপিয়ে ওঠে… কবিতার গন্ধ। কবিতার একটি নিজস্ব গন্ধ আছে আমি পাই, প্রায়। সারাদিন ধ্বস্ত, ঘামেভেজা একটা গরমের বিকালে কাজফেরত হঠাৎই ভীড়ে ঠাসা টাউনসারভিস বাসে, শহরের সানবাঁধানো রাস্তায় দুপুরের একপশলা বৃষ্টির পর রোদ পড়লে, বসন্তবিকালের মাতাল হাওয়ায় আর্ট গ্যালারির সামনে মর্গের রাস্তাটায় আমি প্রায়ই সে গন্ধ পাই। নিজের সাথে ফিসফিস করে কথা বলি তখন। আমাদের জেলাগ্রন্থাগারের দোতলায় একটি পড়ার ঘর আছে,সেই জানলা দিয়ে একটা মজা পুকুর দেখা যায়, তার ঘন সবুজ জল, মরা দাম, দু একটা পানকৌড়ির ডুবসাঁতার এসব দেখে যখন সন্ধেবেলায় দুখানা বই হাতে করে,সবুজ ঘাসের মাঠটা আড়াআড়ি পেরোই, সামনে সদর থানায় মোটাগোঁফ চৌকিদার তার ছদ্ম গাম্ভীর্য্যর আড়ালে একটু হাসে… আমি সেই গন্ধটা আবার পাই।

আমি ইচ্ছে করে কবিতা লিখিনা, আমার কবিতা পায়। সন্ধের আলোআঁধারিতে কাঁ টাপুকুরের পাশের ছাতিমগাছটার নিচে দুদন্ড দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করি…

“কেমন আছ? “

পথচারী মানুষজন আড়চোখে তাকায়, কেউ কেউ মুখ টিপে হাসে, আমি তাড়াতাড়ি মুদির দোকানে গিয়ে বলি “এক প্যাকেট মুড়ি দাও তো ভাই “…”

ডিম কত করে? “

তারপর পায়ে পায়ে বাড়ি ফিরে আসি, পথে মেঘ করে, বিদ্যুৎ চমকায়, একটি দুটি বৃষ্টিফোঁটা টপটপ করে গালে, কপালে…

আমি গন্ধটা পাই।

লোডশেডিংয়ের আনচান করা রাতে ছাদে এসে দাঁড়ালে হু হু ঠান্ডা হাওয়ায় বাতাবীলেবু ফুলের গন্ধ ভেসে আসে, কোথাও একটি বালিকা তখনও গলা সাধছে… “যখন প্রথম ধরেছে কলি আমার… ” মায়ের কথা মনে পড়ে, ছোটবেলার সেই প্রাইমারী স্কুলের কথা, মেয়েবেলার ঘ্রাণ,সোনালী বিকালে খেলার মাঠে ধুলোর গন্ধ, বাসি বিয়ের সানাই, সব ছাপিয়ে মস্তিষ্কের কোষে কোষে সেই গন্ধটা…

কত্বদিন পর আজ খবর পেলাম পলাশ ফুটেছে, থোকায় থোকায় শিমুল সেজেছে দিগন্তকে এক অদ্ভুত উদ্ভাসে অপরূপ রঙে রাঙিয়ে দিয়ে,ঠিক যেন কবিতার মত চাঁদের আলোর ফেনায় মাতাল হাওয়ায় লুকোচুরি ছোঁয়া,বুকের ভিতর কে যেন পাখির পালক বুলিয়ে দেয় এসময়,এমন ফাগুন বেলায় অকাতরে তাকে বলা যায় ‘ভালোবাসি’ বলা যায়… ‘ চলো ভালোবাসি’। ধানজমিতে যে আদিবাসী মেয়েটা যোনির দার ব্লেডে হাঁ করে চিরে পরেছিল রক্তাক্ত, জরায়ু বেরিয়ে এসেছিল… চোখ রাখতে পারিনি ওর শরীরে, মোমবাতিমিছিলে হাঁটা লোকজন পেয়েছিল কিনা জানিনা, কিন্তু দুব্বোঘাসের ওপর শুকিয়ে আসা রক্তের গন্ধটা ঠিক আমার নাকে এসে লেগেছিল… খুব অদ্ভুত একটা গন্ধ,আমি ঠিক পাই…
প্রত্যেকবার কবিতা লিখতে গেলে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ