আমি জানতাম না চব্বিশের জুলাইটা এত দীর্ঘ হবে
আমি জানতাম না চব্বিশের জুলাইটা এত দীর্ঘ হবে, আমি জানতাম না, অগাস্টকেও রাহুর মত গ্রাস…..
কবিতা কেন লিখি?
কবিতা লিখি হামানদিস্তায় রোজ ছেঁচে না ফেলে,একবার এক কোপে শেষ করে ফেলবার সাধনায়। এরও নিজস্ব রাজনীতি চলেছে, কখনো বোমা বারুদের কারসাজি। চাপান উতোরে হার না মানা। কবিতা লিখি এই প্রতিশোধ নিতে। যে আমি আমার তফাতে আছি, যে আমি কিছুটা জুগুপ্সা চাই, কবিতায় সে অনেকটা আমার সঙ্গে পায়ে হেঁটে আসে। তখন চেনা চেনা মনে হয়, কিরকম বুঝি ঐ আওয়ালসিদ্ধি চৌমাথাই হল গন্তব্য, ওখানে পেয়দল বা রিক্সা পৌঁছতে হবে আমাকে। নিজের এই গন্তব্যে যাওয়া আসলে কিন্তু একটা ছুতো, কোথাও দূর ভবিষ্যতে যেতে হবে এই ভরসা বাঁচিয়ে রাখবার একটা ছল মাত্র। এমন একটা বোবা সাজার খেলা, যেখানে সব সত্যি নয় যা কবিতায় সত্যির মতো লাগে। বরং সত্যিটাও মীরজাফরের মতো। সে সম্রাটের আত্মীয় বলেই তার নাড়ীনক্ষত্র সব জেনে তাকে খতম করবে। কবিতার বিশ্বাসঘাতকতা চূড়ান্ত সত্যের মতো, কবিতা কাছের মানুষটার কুলুঙ্গি চুরি করে, লেখকের প্রধান বাটপাড়, সে তারই প্রযুক্ত শব্দ, স্বর, শব্দার্থের মধ্যে তুফান বইয়ে দেয় – লেখার মুহূর্তে কবিও জানেন না এরা কী উপায়ে সম্পর্ক বিস্তার করবে বা এদের যৌথ যোগাযোগের পরিণাম কেমন হতে পারে। কবি তার মনের উচাটন বসিয়ে দিয়েছেন সৃষ্ট চরিত্রের ওপরে, গুঁজে দিয়েছেন নিজের অনাহার, নিজের কান্না, নিজের ভ্রান্তি, এমনকী নিজের অভিশাপও। নায়ক নায়িকা দুজনের মধ্যে কোনো একজনকে বা দুজনকেই কবি নিজের ভেতর থেকে গঠন করেন। কখনও একজন অন্যজনের বিপরীত বাসনার প্রতিভূ, কখনো এককভাবে কবির অন্তরের রূপায়ক। লেখকের স্বতন্ত্র আত্মপ্রকাশের ভাষ্যে প্রতিটা যতিচিহ্ন তাঁর অন্তর্দাহ বহন করে, প্রতিটা ছত্র হয়ে যায় নিজেকে মজ্জা পর্যন্ত বার করে আনার স্বাক্ষর। লেখার কালিতল যখন বেরিয়ে আসে টুকরো করা গর্দান, ঘিলু,রক্ত- তখনও নিরীক্ষার শেষ হয় না। পরবর্তী লেখায় আবার লাশ ফেলে তার দেহ শনাক্ত করতে করতে তার চেতনার নীরব স্তরে সেঁধিয়ে থাকতে হয়। কবি তাই একবার ফরেনসিক একবার লফঙ্গা একবার আইজেনস্টাইনের দ্য ব্যাটলশিপ্ পটেমকিন্ ছবির সেই অসহায় মা, যে দেখতে পেল মৃত্যুর আগে তার কোল থেকে সন্তানটির কী মর্মান্তিক হত্যা, অর্থাৎ কবিতায় কবি সেই মুহূর্ত হয়ে যান, যা তিনি লিখতে চান না, যা তিনি দেখতে চান না। কিন্তু ডিকস্ট্রাকশন তাঁকে তাও করিয়ে ছাড়ে, রেহাই নেই এমনতর নৃশংসতা থেকে। কারণ?
কারণ উপনিষদ বলেন, কবি হলেন সেই মনীষী, যাঁর মনের বিস্তার সর্বদিকে, তিনি সৃষ্টিকর্তার মতো জ্ঞানী ও পরিজ্ঞাতা। তিনি নিজেকে জানেন ও অপরকে জানান। আমাদের এই প্রাকৃত জীবনের অন্নকোষ প্রাণকোষ থেকে রসদ নেওয়া শুরু হয়, রামপ্রসাদ কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম মানেন নি। বরং মূর্তিপূজার বিরোধিতা করে জগজ্জননীকে সেই তহবিলের দায় চেয়েছেন, যা আত্মার মাধ্যমে দুনিয়ার নানা স্তরে নিজেকে বিচ্ছুরিত করে। ঈশ্বর বা আরাধ্য ঈশকে কবি নিজের অন্তরে তথা সমস্ত মানুষের অন্তরের মধ্যে প্রকাশের ভাষা পেয়েছেন। সে ভাষায় কোনো শর্ত ছাড়া অশ্বমেধ নিয়ে কবিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হয়। সভ্যতার বদলের শক্তি সেই রশির মধ্যে। কোনো দেশের সুপারপাওয়ার তাকে মুছে দিতে পারে না। লেখার শক্তির জন্য লেখক বহিষ্কৃত হন, দেশ ছেড়ে বন্ধু স্বজন সকলকে বিদায় জানিয়ে অন্য দেশে গিয়েও কলম থামে না। কবিতা এই না-লেখা মানুষের নিরাশ্রয় একার কথা বলে। যা বললে কারাবাস হয়, যা বললে মেরেও ফেলতে পারে, কবিতা তারই কথা বলে। সেই দিনলিপি, সেই দলিল দেশ ও কালের দ্বারা বদ্ধ নয়।
কবিতা কেন পড়ি?
আমি যা পারিনি, পারি না – আর কেউ তাকে লিখতে পেরেছেন কিনা সেটা দেখবার দায় আছে। নিজের পৃথিবীর বাইরে আরো অন্য পৃথিবীর কথা জানার জন্য কবিতা খুঁজি, লেখার খবর নিই। যে পথ আর একজনের পায়ের তলার ক্ষতে লাল হয়ে গেছে, সে পথটা হেঁটে দেখতে সাধ হয়, এখানে ভয় তো কম। কারণ এই বিপজ্জনক রাস্তা একজনের পায়ে ফোটা পাথরে রক্তাক্ত। তাই রিস্ক্ নেই আমার। বরং অন্যের অনুভবে নিজেকে কল্পনার পৃথক মজা আছে, সে অক্সিটোসিনটুকু আমি চুমুক দিয়ে পান করি, নীরবে গোগ্রাসে খাই। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যতত্ত্বে বলা হয়েছে, সাহিত্যে যখন আমরা আমাদের স্বজনমৃত্যুর কথা পাই, সাহিত্যের মা যখন কাঁদে, সে কান্না আমাদের কোথাও গভীরে এক উপলব্ধির জ্ঞানে পৌঁছে দেয়। সেইই হল জননান্তর সৌহৃদানি।
পরস্য ন পরস্যেতি
মমেতি ন মমেতি চ –
সাহিত্য কেবল লেখকের, আবার লেখকের কেবল নয়। তা আমার অথচ আমার শুধু নয়। তাই তো কবিতা পড়া, তা যুগে যুগে আছে ও থাকবে।
আমি জানতাম না চব্বিশের জুলাইটা এত দীর্ঘ হবে, আমি জানতাম না, অগাস্টকেও রাহুর মত গ্রাস…..
অভিশাপ মেঘের ভেলায় নিঃশ্বাসে ক্লান্তির ছাপ সবুজের নীড়ে আপন ঠিকানার খোঁজ এক ফালি সুখের নেশায়…..
পাখি দম্পতি পাখি গিয়েছিল কতদূর বনে তা কারো নেই জানা। ঠোঁটে ধরা লাল টুকটুকে ফল…..
তারা যেমন বলে, চোখে ধুলো দিলে থেমে যাবে আমার কাব্যময়তা অথচ আমি প্রামান্য দলিলের নই…..