কভার ড্রাইভ

অপূর্ব সাহা
গল্প
Bengali
কভার ড্রাইভ

বাড়িতে থাকলে বিকেলের দিকটায় একটু লাইব্রেরিতে যায় অরণ্য। অরণ্য এমনিতে কলকাতাতেই থাকে,ওখানেই থেকে পড়াশুনো করে।শুধু শুক্রবার করে বাড়ি ফেরে। আর এমনি টুকটাক ছোটখাটো ছুটি পেলে তো কথাই নেই। মেসে রোগীর পথ্যের হাত থেকে সাময়িক রক্ষা পেতে সোজা বাড়িতে চলে আসার এই প্রচেষ্টা খুব একটা নিন্দনীয় নয়।

লাইব্রেরিটা শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে। সামনে বড় রাস্তা সোজা এসে ডানদিকে বেঁকে ব্রিজের দিকে চলে গেছে।পাশেই নদী যে।লাইব্রেরির সামনে একটা বড় মাঠ। আর আশেপাশে দু’চারটে বিল্ডিং।  একটু এগিয়ে গেলে শহরের একমাত্র অডিটোরিয়ামটাও দৃষ্টি এড়াতে পারে না।

অরণ্যের বাড়ি থেকে লাইব্রেরি অব্দি হেটে লাগে পাঁচ-সাত মিনিট বড়জোর। তারমানে এককথায় কাছেই। অরণ্য বইপ্রেমী হলেও সাধারণত খবরের কাগজ পড়তেই লাইব্রেরিতে যায়। লাইব্রেরিতে আরো অনেক লোক আসে। খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে থাকতে থাকতে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে হঠাৎ কারো কারো সাথে বিতর্ক ও শুরু হয়ে যায়। কেন্দ্র সরকার-রাজ্য সরকার দ্বন্দ্ব, ধোনির অবসর বা কোহলি-শাস্ত্রী জুটির ভূমিকা,এমনকী সিনেমার গল্প কিছুই বাদ যায় না সেই মজলিশে। সবাই সবার মতপ্রকাশে বদ্ধপরিকর। মাঝে মাঝে অরণ্যও যোগ দেয় তাতে। কখনো বা দুজনের ঝগড়া সে নীরব দর্শক হয়ে উপভোগ করে ও মিটিমিটি হাসে। সবমিলিয়ে বাড়িতে থাকলে বিকেলটা বেশ মজার মধ্যেই কাটে অরণ্যের।

অন্যদিনের মতো সেই সপ্তাহেও বাড়ি ফিরছে অরণ্য। গতকাল মা বাবার কাছে ফোন করে জানতে পেরেছিল শহরতলির অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। রাজনৈতিক কারণে বচসার জেরে নাকি শহরতলির বিভিন্ন জায়গায় গণ্ডগোল, বোমাবাজি, ভাঙচুর ও হয়েছিল কাল। সংবাদ মাধ্যমে আরো একটু রং চড়িয়ে ফলাও করে দেখাচ্ছিল সেসব।

মা বারবার করে বলেছিল অরণ্যকে এই সপ্তাহে বাড়িতে না আসতে। কোথায় না কোথায় কী ঝামেলা হবে কোনো ঠিক নেই। কিন্ত অরণ্যও নাছোড়বান্দা। বাড়িতে সে আসবেই; মেসের ওই খাবার সহ্য করা যায় না। অগত্যা মাও রাজি হলেন।

ট্রেনে আসতে আসতে কালকের ঘটনা নিয়ে দু’একবার গুঞ্জন কানে গেছিলো অরণ্যের। হেডফোনটা এককান থেকে খুলে একটু শোনার চেষ্টাও করেছিল ও। কিন্তু ট্রেনের ঝাকুনিতে ঝিম চলে আসায় নিরস্ত হতে হলো ওকে।

অরণ্য ভাবলো, এখন শুনে কাজ নেই। বিকেলে লাইব্রেরি যে গিয়ে কাগজ তো পড়বে ও। তখন এমনিতেই জানতে পারবে সব।

দুপুরের দিকে বাড়িতে ফেরে অরণ্য। তারপর নাওয়া খাওয়া করে একটা জম্পেশ ঘুম দেয়।বিকেলে ঘুম থেকে উঠে ট্রাউজার আর গায়ে হালকা টিশার্ট চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ে অরণ্য।গন্তব্যস্থল-‘লাইব্রেরি’।

আমাদের এই বয়সটা একটু যেন অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। প্রকৃতির প্রতিটা ক্রিয়াতে এ যেন স্পন্দন প্রদর্শন করে প্রতিনিয়ত। কোনো কোনো সময় দরকার না পড়লেও এই স্পন্দন প্রদর্শনে আমরা পিছপা হইনা। আর হয়তো সেই কারণেই আমাদের এই বয়সটা পার্বত্য নদীর ন্যায় চঞ্চল, শক্তিতে পূর্ণ। অশিক্ষা, যুক্তিহীনতার জগদ্দল পাললিককে এই বয়স যেন মোটেই প্রশ্রয় দেয়না। ধারালো যুক্তির স্রোতে তাকে কেটে বেরিয়ে আপন গতিপথ প্রস্তুত করে এগিয়ে চলে। এই যৌবন সমতলের নদীর মতো শান্ত নয়, এ চঞ্চল, কোনোকিছুই যেন মানতে চায় না।

স্বাভাবিকভাবে বয়সের নিয়মে অরণ্যের মন ও শান্ত নয়। সবসময়ই যেন এক জটিল রসায়ন খেলা করছে সেখানে। মনের গবেষণাগারে চলছে নানা বিচিত্র বিক্রিয়া। কোনোসময় সেই বিক্রিয়া দেশের রাজনীতি, কোনো সময় বা খেলা, কোনো সময় তা ধর্ম বনাম নাস্তিকতা, কোনো সময় বা সে কোনো নারীঘটিত কোনো জটিল বিক্রিয়া। চঞ্চল এই মনে সমীকরণের x খুঁজে পাওয়া সত্যিই খুব দুরূহ কাজ।

“দাদা বলটা দাও না।“, -নরম গলার একটা আওয়াজে অন্যমনস্কতা কাটে অরণ্যর। তাকিয়ে দেখে একটা স্ট্যাম্পার বল ওর পায়ের কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। আর সেটার দিকে তাকিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সামনের আন্দাজ বছর পনেরোর ছেলেটা। সে হাত তুলে আবার বললো, ”দাদা…”।

অরণ্য আর একবার তাকাতেই সে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বললো,  ”বলটা…বলটা…”।

অরণ্য বলটা তুলে নিয়ে একটু হেসে ছুড়ে দিলো ছেলেটার দিকে। ছেলেটাও হাত তুলে একটু হেসে ইশারায় ধন্যবাদ জানিয়ে আবার খেলতে চলে গেল বন্ধুদের সাথে।

লাইব্রেরির মাঠে খেলা শুরু হলো আবার। দেখে মনে হচ্ছে all fielding এ খেলা। মাঠের ওই ঘাসওঠা জায়গাটা হয়তো চারের সীমানা। কেননা, যে ছেলেটা বল করছে সে ছেলেগুলোকে সব ঐদিকেই ঠেললো আর বলল, ”সীমানার দিকে যা…সীমানার দিকে”। ব্যাটিং টিমের কোনো একজন সদস্য বোধ হয় আম্পায়ার। কেননা বোলার ছেলেটা ওকে কী একটা বলে বল করতে গেল। যেই না বল করা অমনি আম্পায়ার মহাশয়ের চেঁচিয়ে ওঠা, ”নো বল”। আর অমনি বোলিং টিমের ছেলেপেলের খেপে দৌড়ে আসা। তারা কৈফিয়ত চায় কেন এটা নো বল ডাকা হলো? আম্পায়ার ও সাফ জানিয়ে দিল বল জোরে হয়েছে তাই। বোলিং টিমের ওদের অপেক্ষাকৃত বড় একটা ছেলেও উল্টে আম্পায়ারকে গরম দেখিয়ে জানিয়ে গেলো যে তারাও দেখে নেবে। আর বোলারকে বলল ভালো বল করতে। কিন্তু বল কই? ইতোমধ্যে ব্যাটসম্যান-এর দুর্দান্ত কভার ড্রাইভে যে বলটির নর্মদা নয়, নর্দমাপ্রাপ্তি ঘটেছে সেটা বোধহয় উইকেটের পিছনের শুটকো ছেলেটা বাদে কেউই খেয়াল করেনি। অতএব, ওর কথাতেই শুরু হলো ওদের বলের উদ্ধারকার্য।

অরণ্য লাইব্রেরির নিচের সিঁড়িতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো আবার যখন ওদের খেলা শুরু হবে। আজ কেন যেন আর লাইব্রেরিতে গিয়ে খবরের কাগজ পড়তে ইচ্ছে করছেনা। আর পড়েই বা কী হবে? সেই তো একই মারামারি কাটাকাটির গল্প। এ পার্টির লোক ওকে মারলো, এ ওকে দোষারোপ করলো। অন্য পার্টি কড়া নিন্দা করলো… এইসব ছাইপাশ একঘেয়ে খবর।

নদীর পার্বত্যপ্রবাহে মন্থকুপ আসলে নদীর খরস্রোত বাধাপ্রাপ্ত হয়। মন্ধকূপে পড়ে নদীর জল equilateral spiral এর আকার নেয়, তরঙ্গের অভিমুখ একটু পিছনের দিকে যাত্রা করে। জুসি হাফ ভলিটা অরণ্যের ব্যাট এ ধাক্কা খেয়ে হঠাৎ যেন শৈশবের প্যাভিলিয়ন এ গিয়ে পড়ে।

স্কুলে যখন পড়তো অরণ্যরা তখন ওরা শব্দার্থদের বাড়ি খেলতে যেত। শব্দার্থরা একটা সাবেকি আমলের বাড়িতে ভাড়া থাকতো। বাড়িটার সামনে মোটামুটি একটা বড় মাঠ ছিল আর তার চারপাশে শব্দার্থদের ঘর ছাড়াও ছিল আরো তিন চারটে ঘর, যেখানে অন্য ভাড়াটেরা থাকতো। বাড়ির সামনেই ছিল একটা বড় গেট আর গেটের ওপাশে স্কুল রোড পেরিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট বাংলো। ম্যাজিস্ট্রেট বাংলোর পাচিলের শেষের সাথে সাথে শুরু হতো অরণ্যদের স্কুল কম্পাউন্ড। স্কুলের খুব কাছেই বন্ধুর বাড়ি তার ওপর একটু খোলা মাঠ এ লোভ কোনো স্কুলপড়ুয়ার এর ক্ষেত্রেই সামলানো সম্ভব নয়। ফলে স্বাভাভিকভাবেই স্কুলছুটির পর আধঘন্টা ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং চলতো সেখানে। শব্দার্থদের বাড়িতে ব্যাট, বল, উইকেট সবকিছুরই ব্যবস্থা থাকতো।

মাঠের দক্ষিণ দিকে যে ভাড়াটেরা থাকতো তাদের একটা টিনের দরজা ছিল মাঠের দিকে মুখ করা। আর দুর্ভাগ্যবশত সেটা ছিল অরণ্যদের ছোট্ট স্টেডিয়ামের কভার অঞ্চল এ। আর বেশিরভাগ ব্যাটসম্যান তখন সচিনের অন্ধভক্ত হওয়ায় বল সোজা চলে যেত কভার অঞ্চলে। আর অমনি বলটা টিনের দরজায় গিয়ে আঘাত করে কনফার্মশন দিত যে চার হয়েছে।

দুপুরের দিকে খাবার পর যেকোনো বাঙালি গৃহস্থ বাড়িই একটা জম্পেশ ঘুম দিতে পছন্দ করে। সুতরাং ওই বাড়ির সদস্যরাও তখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন। আচমকা টিনের আওয়াজে তাদের ঘুম ভেঙে যাওয়াতে তারা নিঃসন্দেহে এই ছেলেগুলোকে man of the match award  দিত। বলা বাহুল্য যে, যার অর্থমূল্ল্প ছিল বকুনি ও অভিযোগ।

এই বাড়িটার একটা মজাদার ব্যাপার হঠাৎ মনে পড়ায় অরণ্যের হঠাৎ খুব হাসি পেলো। ব্যাপারটা এরকম- ওই বাড়ির কর্তার নাম ছিল শিব। ওনার ছিল ৩ মেয়ে, ২ছেলে। ছেলে দুটোর নাম ছিল কার্তিক, গণেশ আর ২টা মেয়ের নাম ছিল লক্ষী, সরস্বতী। মায়ের নাম দুর্গা আর ওপর মেয়ের অন্য কোনো নাম হওয়া এক্ষেত্রে দরকার ছিল না। কারণ এই পাঁচটি নামই ওদের খিল্লি করার জন্য যথেষ্ট ছিল। স্বভাবতই ওই পরিবারটি অচিরেই এই ছেলেগুলোর দ্বারা “দুর্গা পরিবার” উপাধিতে ভূষিত হলো।

অরণ্য এসব ভেবে আপন মনে হাসছিল। ইতিমধ্যে দেখলো ছেলেগুলো বল উদ্ধার করে আবার খেলা শুরু করেছে। কিন্তু তিন বল হতে না হতেই আবার বিপত্তি। ব্যাটসম্যান ছেলেটা বেশ হাট্টাগোট্টা ছিল। ফলে এত জোরে বল হাকিয়েছে যে সোজা লাইব্রেরির কাঁচের জানলায় গিয়ে সেটা আঘাত করেছে। আর কি হবে, কাঁচ শতটুকরো।

এই ঘটনা দেখে আরেকটা কথা মনে পড়ে গেলো অরণ্যর।

সেবার ডিসেম্বর মাস। পরীক্ষা শেষ তখন। শব্দার্থদের বাড়িতে যেন তখন ওয়ার্ল্ডকাপ বসে গেছে। সকাল থেকে খেলা শুরু হয়ে দুপুর অব্দি চলতো। আবার দুপুরে নাওয়া খাওয়ার পর শুরু হতো উৎপাত। ছেলেদের উৎপাতে স্বভাবতই অস্থির ছিল দুর্গা পরিবার। সারাদিন তাদের টিনের দরজা সমৃদ্ধ হতো সচিন, সৌরভ, দ্রাবিরদের কভার ড্রাইভে। শুধু তারা কেন, ছেলেগুলোর তাণ্ডবে বাকি ভাড়াটেরাও রীতিমতো অস্থির হয়ে উঠেছিল।

স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেটের পরিবারও অরণ্যদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। ওদের ‘maximum’ এর প্রকোপ ক্রমাগত এসে পড়তো মাজিস্ট্রেটের সাধের বাগানে। ওরা বল আনতে গেলে খেত বকা ম্যাজিস্ট্রেটের স্ত্রীর কাছে। ম্যাজিস্ট্রেটের স্ত্রী একটু মোটাসোটা ছিল বলে অরণ্যরা ওনার নাম দিয়েছিল “মুটকি”।

একবার হলো কি, অরণ্য বল করছিল। আর উল্টো দিকে ব্যাট করছিল সপ্তক। সপ্তকের গায়ে বয়স আন্দাজে জোর ছিল বেশি। ফলে সহজেই অরণ্যের একটা জুসি হাফ ভলিতে প্রহার করে সেটাকে পাঠিয়ে দেয় ম্যাজিস্ট্রেট এর সীমানায়। কিন্তু সেটা maximum এর থেকেও হয়তো বেশি কিছু ছিল। কেননা বলতে সোজা গিয়ে আছড়ে পড়ে ম্যাজিস্ট্রেট এর VIP বক্স এর কাঁচের জানলায়। আর কি, ”মুটকি”র গগনভেদী আওয়াজ রাস্তার ওপাশ থেকে ভেসে আসে। অরণ্যরা ভয়ে উইকেট, ব্যাট রেখে পালায়। তারপর…

লাইব্রেরিয়ান মনোহরবাবুর চিৎকারে চমক ভাঙল অরণ্যের। বল হাতে চেঁচাতে চেঁচাতে বেরিয়ে এসেছেন। দুরন্ত ছেলেগুলোকে দেখে নেবেন তিনি।

কিন্তু ছেলেগুলো ততক্ষণে কই? ওরা তো ততক্ষণে অরণ্যকে আউট করে ওকে স্মৃতির প্যাভিলিয়ন এ পাঠিয়ে নিজেরা পশ্চিম প্রান্তরে শেষবেলার ধুলো উড়িয়ে মিলিয়ে গেছে শহরতলির কানাগলিতে।

অপূর্ব সাহা। জন্ম: ২২ শে অক্টোবর ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগনার সীমান্ত শহর বনগাঁ'য়। কলকাতার আশুতোষ কলেজে গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী। ছোটবেলা থেকেই লেখালিখি, বিতর্ক, নাটক, কুইজ প্রভৃতির প্রতি আকর্ষণ।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..