ফিরে এসো
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
বাড়িতে ঢুকে বারান্দার এককোণে কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রাখল পল্লবী। টং করে একটা আওয়াজ আসলো ব্যাগের মধ্যে থেকে। আওয়াজটা টিফিনবাক্সের। এখন খালি। সকালে তাড়াহুড়ো করে মা তিনটে পরোটা আর আলুর দম বানিয়ে দিয়েছিল। পিছনে ফিরে বারান্দার লোহার কলাপসিভিল গেটটা বন্ধ করে হাতঘড়ি ও মোবাইলদু’টো খুলে রাখল সে ব্যাগের উপর। হাত থেকে ঘড়িটা খোলার আগে একবার দেখে নিলো সময়টা। ৮টা ১o বাজে। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো বাথরুমের দিকে। উল্টোদিকে রান্নাঘর থেকে মা হাঁক মারলো, “তোয়ালে আর তোর জামাকাপড় বাথরুমের ভেতর রেখে দিয়েছি”। নিঃশব্দে বাথরুমের মধ্যে ঢুকে ছিটকিনিটা ভেতর থেকে তুলে দিলো। একবার আড়চোখে দেখে নিলো বাথরুমের ভেতর টাঙানো দড়িটার দিকে। বেশ পরিপাটি করে তার রাতের জামাকাপড়গুলো আগে থেকেই গুছিয়ে রেখে গেছে মা।
প্লাসটিকের কলটা ছেড়ে দিলো। ছড়ছড় শব্দ করে গামলাটা ভর্তি হচ্ছে। বাথরুমের মধ্যে থাকা ছোট আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর ধীরে ধীরে সব পোশাক খুলতে থাকলো সে। শেষে অন্তর্বাসগুলোকেও মুক্তি দিলো। জড়ো করে রাখলো বাথরুমের এক কোণে। ছোট্ট আয়নায় শুধু বুকটুকু দেখতে পাচ্ছে। পাশে গামলাটা অর্ধেক ভর্তি হয়ে গেছে।
হঠাৎ-ই বুকের মধ্যে একটা সাপের নড়াচড়া দেখতে পেল সে। লকলকে চেরা জিভ দিয়ে বেরিয়ে আসছে একটা, দু’টো, তিনটে… অনেকগুলো টিকটিকি। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে টিকটিকিগুলো। পিঠে, কোমরে, দুই উরুতে ও তারপর উরুদ্বয়ের সংযোগস্থলে। মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে ফেললো। পাঁচ সেকেন্ড পরে আবার চাইলো সে নিজের শরীরের দিকে, আয়নার মধ্যে দিয়ে। টিকটিকিগুলি এখনো ঘোরাফেরা করছে তার নগ্ন শরীরে।
একটা টিকটিকি হঠাৎ-ই উঠে এলো তরতর করে। বুক বেয়ে, গলা বেয়ে, থুতনি বেয়ে সোজা ঠোঁটে একটা কামড় বসিয়ে দিলো। তারপর ডেকে উঠলো ‘টিকটিক টিকটিক’। আতঙ্কে আবার চোখ বুজলো চেয়ে। টিকটিকিটা এবার তার বাঁ কান কামড়ে ধরেছে। ডান হাত দিয়ে টিকটিকিটাকে ধরতে যেতেই হুবহু মানুষের গলায় টিকটিকিটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠলো।
“তুমি খুব সুন্দর পল্লবী”, কথা বলে উঠলো টিকটিকিটা। গলার স্বর হুবহু মিঃ দাশগুপ্ত’র মতো। অবাক চোখে লক্ষ্য করলো পল্লবী টিকটিকিটার ত্রিকোণ মুখটা ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে অফিসের বস দাশগুপ্ত’র মতো।
“তোর হলো? আর কত দেরী করবি”? মার গলা কানে এলো। টিকটিকিগুলোও কোথায় যেন ঝপ করে ঢুকে গেলো। তাড়াতাড়ি স্নান ছেড়ে ঘরের জামাকাপড় চড়িয়ে নিলো গায়ে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে তোয়ালেটা বারান্দার দড়িতে মেলে দিলো। তারপর, বারান্দার কোণায় রাখা ব্যাগ, মোবাইল আর ঘড়িটা নিয়ে ঢুকে গেলো নিজের ঘরে। পাশাপাশি দু’টো ঘর। একটা তার। একটা মা-বাবার। বাবা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করে তিলতিল করে টাকা জমিয়ে চাকরির শেষের দিকে বেহালায় গড়াগাছাতে দু’টো ঘরের এই একতলা বাড়িটা করেছেন। এখন রিটায়ার্ড। পেনশন পান। পল্লবী এক মেয়ে। এম.বি.এ করে গতমাসেই একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি পেয়েছে। কোম্পানীটা চেতলা ব্রিজের পাশেই। মাইনে ১০ হাজার।
ডিনারে বসে দু’চার গ্রাস খাওয়া হয়েছে কি হয়নি, টিকটিকিগুলো বেরিয়ে জ্বালাতন শুরু করে দিলো। দাশগুপ্ত’র গলা নকল করে যে টিকটিকিটা কথা বলছিল, সেটা বোধহয় কানের ভেতরেই ঢুকে বসেছিল। ফিসফিস করে বলতে লাগলো, “ভেবে দেখো ! এক ধাক্কায় মাইনে পাঁচ হাজার টাকা বেড়ে যাবে। এমন প্রোমোশন ক’টা মেয়ের ভাগ্যে জোটে? শুধু একবার ! সব খরচ আমার। ফাইভ স্টার হোটেলে ঘর বুক করা থাকবে কাল। অফিসের পর দু’ঘন্টা মাত্র…”। বাকি টিকটিকিগুলো বুকে ও দুই উরুতে আঁচড়াতে শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে।
মেঝেতে বসে খাচ্ছিল তিনজন। উঠে পড়লো সে খাওয়া ছেড়ে। হাঁ হাঁ করে উঠলো ওর মা। “কিরে, কী হলো? এইটুকু খেয়ে উঠে পড়লি কেন”?
“ভালো লাগছে না মা…”, দাঁড়িয়ে পড়েছে সে ততক্ষণে।
“পনীরের ডালনাটা একটু খেতে পারতিস তো…”, আক্ষেপের সুরেই বললেন কমলিকাদেবী।
“থাক, থাক… জোর করো না”। পল্লবীর বাবা তন্ময়বাবু। “জেলুসিল আছে, নিবি”? দ্বিতীয় কথাটা অবশ্য মেয়ে পল্লবীর উদ্দেশ্যে বললেন।
“আমার কাছে ওষুধ আছে বাবা। তোমরা খাও। চিন্তা করো না” ! বেসিনে হাত ধুয়ে তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে বললো পল্লবী।
বাথরুম থেকে ঘুরে এসে ঘরের আলোটা নিভিয়ে দেবার আগে চেঁচিয়ে বললো, “মা, আমি শুয়ে পড়লাম। কাল সকালে উঠতে হবে”। সিদ্ধান্তটা সে নিয়েই ফেলেছে।
দুই.
ঘড়িতে সন্ধ্যে ছ’টা। চেয়ার থেকে উঠবে উঠবে করছে পল্লবী। এমন সময় অফিসের পিয়ন ভোলা দাস এসে বললো, “স্যার আপনাকে একটু বসতে বললেন “।
“আচ্ছা ” ! বলে ব্যাগটা গুছিয়ে পাশে রাখলো পল্লবী। তারপর জুলুজুলু চোখে দেখতে লাগলো আশেপাশে। অফিস বেশ কিছুটা ফাঁকা হয়ে গেছে এর মধ্যেই। পাঁচ-ছ’জন এ’দিক ও’দিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে শেষবেলার কাজ সারতে ব্যস্ত। হঠাৎ আবার টিকটিকিগুলো উৎপাত শুরু করে দিলো। সেই একই জায়গাগুলোতে থাবা মারছে ওরা। কী করবে বুঝতে না পেরে মোবাইলটা তুলে নিলো সে হাতে। কয়েকদিন হলো নতুন মাইনের টাকায় কিনেছে সে মোবাইলটা। ফ্রন্ট ক্যামেরায় পরপর কয়েকটা সেলফি তুললো আর ডিলিট করলো। কোনটাই মনমতো হচ্ছে না। এমন সময় ভোলাদা এসে বললো, “স্যার আপনাকে ডাকছেন ম্যাডাম”। ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে মোবাইলটা নিয়ে উঠে পড়লো সে। টিকটিকিগুলো তখনো সমানে উৎপাত করে যাচ্ছে।
মিঃ দাশগুপ্ত একগাল হেসে উঠলেন পল্লবীকে দেখে। “জানতাম তুমি রাজী হবে। বুদ্ধিমান মেয়ে। অবশ্য আমার কথায় অরাজী এখনো পর্যন্ত কেউ হয় নি”।
মুচকি হেসে একটা কটাক্ষ হানলো পল্লবী। মুখ হাঁ করে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসলো দাশগুপ্ত। দাশগুপ্ত’র মুখটা এখন অনেকটা একটা ধেড়ে টিকটিকির মতো লাগছে পল্লবীর। জিভটা বার করে যেন ঠোঁটগুলো চাটছে সরীসৃপটা। ধীরেধীরে বসের চেয়ারের কাছে এগিয়ে গেলো সে। দাশগুপ্ত ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। মুখটা দাশগুপ্ত’র কানের কাছে নিয়ে গিয়ে বললো, “স্যার, আজকের সন্ধ্যাটা আপনি চিরজীবন মনে রাখবেন…”।
“হ্যাঁ, তা… একদম…”। ততক্ষণে ক্ষীপ্রহাতে দাশগুপ্ত’র প্যান্টের বেল্টটা খুলে ফেলেছে পল্লবী।
“এই…না না, অফিসে না…” ! দাশগুপ্তের মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো। কয়েকটন ওজনের একটা লাথি এসে পড়লো দাশগুপ্ত’র তলপেটে। পরক্ষণেই একটানে দাশগুপ্ত’র প্যান্টটা নিচে নামিয়ে দিলো আপাতনিরীহ মেয়েটি। যন্ত্রণায় বাধা দেবার ন্যূনতম ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেলেছে দাশগুপ্ত। দ্রুতহাতে পরপর কয়েকটা ছবি তুললো সে তার নতুন কেনা মোবাইলে। তারপর অর্ধনগ্ন ছবিগুলো দাশগুপ্ত’র সামনে নিয়ে গিয়ে দেখালো মোবাইল নাচাতে নাচাতে। ” কাল সবকটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবিগুলো ছেড়ে দেব। সেইসঙ্গে অফিসের সবার মোবাইলে পাঠাব। তুই যেমন বুনো ওল, আমি তেমন বাঘা তেঁতুল”। দাশগুপ্ত’র ঘর থেকে বেরিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে সবক’টা টিকটিকিকে ঝেড়ে ফেললো সে।
বাড়ি ফিরে অভ্যাসবশতঃ ব্যাগ, ঘড়ি আর মোবাইলটা বারান্দার এককোণে রেখে বাথরুমে ঢুকলো পল্লবী। বরাবরের মতোই ঘরে পরার জামাকাপড়গুলো ঝুলছে বাথরুমের দড়িতে। গামলাটা ভরতে দিয়ে আবার আয়নার সামনে দাঁড়াল সে। নিজের দেহটিকে শাল-পিয়ালের অরণ্য লাগছে আজকে। টিকটিকিগুলোর পরিবর্তে সেই অরণ্য থেকে ভেসে আসছে আদিবাসীদের ঢাকের মাদল ডাক।
বাথরুম থেকে বেরোতেই কমলিকাদেবী বললেন, “অনেকক্ষণ ধরে তোর মোবাইল বাজছে। কে একজন দাশগুপ্ত বারবার ফোন করছেন তোকে। কে রে? তোর অফিসের কেউ “?
“বুনো ওল…”, বলে হি হি করে হাসতে হাসতে মায়ের গায়ে ঢলে পড়লো পল্লবী।
“কি বললি”?
“ও কিছু নয়। কিছু একটা খেতে দাও। বড্ডো খিদে পেয়েছে”। বলে মোবাইল, ঘড়ি আর ব্যাগটা তুলে নিলো সে বারান্দা থেকে।
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
ভার্সিটির বাস ধরতে হয় আমাকে খুব সকালে। বাড়ি থেকে একটু হেঁটেই রিকসা। তারপর বাস। হাঁটা…..
আজকের সন্ধ্যাটা থমকে যাওয়া মেঘেদের। ঝিরিঝির বৃষ্টি ছিল দিনভর। ঢাকা শহরের পথঘাট জল কাদায় মাখামাখি।…..
জোছনা করেছে আড়ি আসে না আমার বাড়ি গলি দিয়ে চলে যায়, গলি দিয়ে চলে যায়…..