একজনের নিজস্ব ঘর: ভার্জিনিয়া উলফ স্মরণকথা।
তিনি বললেন, ভাষা হল ওষ্ঠের উপর সুধার মতো। আর বললেন, কবিতা যথেষ্ট স্বাদু, কিন্তু…..
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা দেখে বোঝা যায় বিদেশী বণিকের বসবাস এখানে ছিলো। দূর-দূরান্ত থেকে আসা যাযাবর ও বাউন্ডুলে নাবিকের একদা কোলাহলে মুখরিত প্রাচীন সরাইখানার প্রশস্ত হলঘরে প্রবেশ করলে আজো যেন প্রত্ন মানুষের আড্ডা আর সঙ্গীতের ক্ষীণশব্দ শোনা যায়। ঠিক তার পাশে বাংলাদেশের উপকূলের মানুষ অভিবাসী রশিদ গড়ে তুলেছেন তার ফিশ ফুডের রেস্তোরা। প্রত্ন সরাইখানাটি আবার যেন হেসে উঠেছে; শুধু পাকিস্তান নয়; পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে আসা পর্যটকদের হাসি-আড্ডার কলরোলে।
বৃটিশেরা রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর করলে; ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের নজর পড়ে করাচি বন্দরের দিকে। ১৮৩৯ সালের আগে পর্যন্ত এই বন্দরনগরীর দখল নিতে পারেনি বৃটিশেরা। রাজধানী দিল্লির জন্য উপযোগী ছিলো করাচি বন্দরটি। ফলে সমুদ্রযোগে করাচি হয়ে পড়ে ভারতের প্রবেশপথ।
কবি আমির খসরু যেমন দিল্লি সালতানাতের সেনাদলে যোগ দিয়ে কবি সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন; ১২৭৯ সালে বাংলার লখনৌতিতে কিছুকাল থেকে লিখেছিলেন তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ; একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পাই; কবি কাজি নজরুল ইসলাম যখন বৃটিশ সেনাদলে যোগ দিয়ে; করাচিতে কিছুকাল থেকে রচনা করেন বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী (১৯১৯ সালে প্রকাশিত) আর উপন্যাস বাঁধনহারা। ১৯১৭ সালে মাত্র ১৮ বছরের তরুণ নজরুলের ডাক পড়ে করাচি ক্যান্টনমেন্টে; বৃটিশ প্রশাসন যখন বাংলার ৪৯ রেজিমেন্টকে মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধে মোতায়েন করে। নজরুল ইসলাম একজন কবি হিসেবে আমির খসরুর মতোই আদৃত হন সেনাদলে।
সিন্ধু প্রদেশ বাংলাদেশের মতোই কবিতা ও গানের ভূমি। যেখানে কবি শাহ আবদুল লতিফ ভিটাইয়ের মানবিক গীতিকবিতা উচ্চারিত লোকের মুখে মুখে; সেখানে কবি নজরুল খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ভক্ত পেয়ে যান। নজরুল তখন ফারসি শেখায় ব্রতী হন; কারণ ওমর খৈয়ামের কাব্য অনুবাদের আগ্রহ তাকে পেয়ে বসে। পারসিক নাবিক, ব্যবসায়ীদের বিচরণ তখন ছিলো এ সুরম্য নগরীতে। নজরুল কবিতা লিখলে তা অন্যদের সাহায্য নিয়ে উর্দুতে অনুবাদ করে দিলে; মুখে মুখে সে গজল ছড়িয়ে পড়ে। এসময় তিনি রুশ বিপ্লব সম্পর্কে সবিস্তারে জানতে পারেন। ফলে তার গদ্যে বিপ্লব আর যুদ্ধের বর্ণনা আসতে থাকে। বাংলা সাহিত্যে যুদ্ধের এমন জীবন্ত ইতিউতি তুলে আনার ঘটনা সেটাই প্রথম।
নজরুল করাচি থেকে সুদূর বাংলাদেশে তার বন্ধু ও স্বজনদের কাছে চিঠি লিখতেন। যাপিত জীবনের যতকথা; সবই লিখে পাঠাতেন। ফলে বাউন্ডুলের আত্মকথা হয়ে ওঠে সেসব লেখা। করাচি বন্দরে অনেক বাউন্ডুলে জীবনের গল্প আছে; দূর দূরান্ত থেকে যারা এসে এখানে থেকেছেন; স্বদেশের স্বজনের জন্য কষ্ট পেয়েছেন; আবার আগন্তকের সঙ্গে বন্ধুত্বের উষ্ণতায় স্বজন বিরহ ভুলেছেন তারা।
নজরুল ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দুতে লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন; করাচি থেকে ফিরে কুমিল্লার মুরাদনগরে গিয়ে নার্গিসের জন্য যে গীতিকবিতা লেখেন, “আলগা করো গো খোপার বাঁধন, দিল ওহি মেরা ফাস গ্যায়া;” তা করাচিতে নজরুলের যে যোগাযোগের ভাষা ছিলো; তারই শিল্পিত রুপ। কবি আমির খসরু যেমন ফারসির সঙ্গে হিন্দি মিশিয়ে গীতিকবিতা লিখেছেন; নজরুল ঠিক তেমনি বাংলার সঙ্গে উর্দু-ফারসি মিশিয়ে গীতিকবিতা রচনা করেছেন। কবির স্বপ্নই বুঝি ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের সম্মিলন ঘটানো।
করাচি বন্দরে নাবিকদের সরাইখানায় গ্রিক, পারসিক, আরবীয়, মিশরীয় নর্তকীদের মৃদু নৃত্যের আয়োজন ছিলো প্রতি সাঁঝে। “মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে নেচে যায়” যেন সেই রহস্যময় সাঁঝে আরবসাগরের পাশে শ্বেত পাথরের আনন্দগৃহে পরদেশী কল্প- বঁধুয়ার নৃত্যের চিত্রকল্প। “আসিলে এতোদিনে পথচিনে।”
ড আখতার হোসেন রায়পুরী অনুদিত “পায়াম-ই-সাহাব” ও খালিক ইব্রাহিম খালিকের “মঞ্জিলেঁ গার্দ কি মানেন্দ” গ্রন্থদ্বয়ে করাচিতে কাজি নজরুল ইসলামের বসবাসের স্মৃতি চিত্রিত হয়েছে পরম মমতায়। এ ছাড়া সেসময়ের বৃটিশ পর্যটক ও ভ্রমণপিয়াসুদের ট্র্যাভেলগেও “করাচিতে নজরুল”; এ বন্দরনগরীতে কবির প্রাণবন্ত অবস্থানের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়।
কবি তার বাঁধনহারা উপন্যাসটি করাচিতে লিখতে শুরু করেন; কলকাতায় গিয়ে শেষ হয় সে লেখা। নজরুল যে চিরন্তন মুক্তির অনুসন্ধান করেছেন সারাজীবন; তার আকুতিই হয়তো বাঁধন হারা। এ হয়তোবা জগতের তাবত বেদনার মূলে যে মায়া; সে মায়ার শেকল ছিন্ন করে প্রেম ও দ্রোহের গন্তব্য খুঁজে নেবার আকাংক্ষা অথবা নির্বাণের প্রতীক্ষা।
নজরুল সেনানিবাসের “প্যানোপটিক” ওয়াচটাওয়ারের মাঝে বসে প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করেছেন। ধর্ম-গোত্র-অঞ্চলের সীমা ছেড়ে মানবতার অসীমের অনুসন্ধান করেছেন। সহ সৈনিকেরা সাঁঝ হলে নজরুলের গানের আসরের অপেক্ষা করতো। কলকাতার পত্রিকায় পাঠানো “গল্প” প্রকাশের চিঠি খুলে পড়তেন তিনি; সবাই আনন্দে মিষ্টান্ন বিতরণ করতো। সেনানিবাসটির প্রাচীন বৃক্ষ; প্রত্ন দালান আজো দাঁড়িয়ে আছে; যেখানে নজরুল লিখতেন; আর বন্ধুরা অপেক্ষা করতো সে লেখার পাঠ শোনার জন্য। শিল্পের শক্তি অনায়াসে ভেঙ্গে দিতে পারে ভিন্নভাষা যোগাযোগের বাধা। তাইতো নজরুলের গজলের অনুবাদ ” আশিক তুমহারি আঁখো মে হ্যায়, দামান মে হ্যায় ফুল” আজো মুখে মুখে ফেরে।
নজরুলের তার মুক্তি কবিতাটি করাচিতে লিখেছেন।
‘রাণীগঞ্জের অর্জুনপট্টির বাঁকে
রাজার বাঁধে জল নিয়ে যায় শহুরে বৌ কলস কাঁখে-
সেই সে বাঁকের শেষে
তিন দিক হতে তিনটে রাস্তা এসে
ত্রিবেণীর ত্রিধারার মত গেছে একেই মিশে।’
করাচি শহরের ত্রিবেণীতে দাঁড়িয়ে সৈনিক নজরুলকে আজো যেন দেখি সাঁঝের আলো-আঁধারীর রহস্যে; যে নজরুল প্রেম, দ্রোহ আর মানবতার তিনটি চোখ মেলে তাকিয়ে সভ্যতার তিনটি ধারার সম্মিলনের আকাংক্ষায় আকুল।
তিনি বললেন, ভাষা হল ওষ্ঠের উপর সুধার মতো। আর বললেন, কবিতা যথেষ্ট স্বাদু, কিন্তু…..
রূপকথা পড়েছেন ছোট বেলায় অনেকে একথা আর বলা সন্দেহমুলক, প্রযুক্তির ব্যবহার জন্মের পর থেকে এখন …..
একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..
কেতুগ্রামে যেখানে চন্ডীদাস বাস করতেন সেইস্থানটি চন্ডীভিটে নামে লোকমুখে প্রচারিত। চোদ্দপুরুষের ভিটে বাঙালির মনে…..